অসুরবধে ঘরে ঘরে দুর্গা চাই

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 8 Oct 2016, 03:04 AM
Updated : 8 Oct 2016, 03:04 AM

শরৎ বড় নির্মল ঋতু। তার আগমন আকাশে-বাতাসেই টের পাওয়া যায়। বাংলাদেশের শরৎকাল দুনিয়ার কোথাও মেলে না। যদিও এখন তা স্মৃতি। আজকাল গরমের তোড়ে এই ঋতু টের পাওয়া যায় না। অথচ এই সেদিনও শরৎ মানে ছিল– "নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা।" রাত হতে না হতেই ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা, জানালা খুলে দিলে পাশের বাড়ির কিশোরীর হারমোনিয়াম শেখার প্রথম পাঠে "আয় তবে সহচরী হাতে হাতে ধরি ধরি" ভেসে আসা।

এই হাতে হাত ধরেই বড় হয়েছি আমরা। আমাদের দেশে এর আগে এমন খণ্ডিত চিন্তা বা সাম্প্রদায়িকতা দেখা যায়নি। আমাদের কৈশোরে-যৌবনে শারদ উৎসবের ভাবনা ছিল মূলত এলাকাকেন্দ্রিক। পূজা আসার আগেই শুরু হত পাড়ায়-মহল্লায়-গলির মোড়ে ব্যানার ঝোলানোর প্রতিযোগিতা। অমুক পাড়ার তমুক ক্লাবের শারদীয় দুর্গাপূজার ব্যানার মানেই উৎসবের হাতছানি।

এখনও ব্যানার ঝোলে। তবে এর গায়ে লেগেছে 'আওয়ামী' আঁচড়! আওয়ামী লীগের এই এক 'খাই খাই' ভাব। তারা সবকিছু খেতে চায়! পূজার বিমল আনন্দও খাচ্ছে তারা! সেবার দেশে গিয়ে দেখি ব্যানার এমনকি পূজার প্যান্ডেলের বাইরে ফটকে "অমুক ভাইয়ের সালাম নিন", "তমুক নেতার শুভেচ্ছা তোরণ।" সে তোরণের মাথার ওপর নৌকা। কেন? নৌকা আর পূজা কি এক? কবে থেকে মা দুর্গা এত অসহায় হলেন যে তাঁকে নেতাদের ব্যানারের তলায় নিরাপদ করতে হবে?

এই অশুভ প্রতিযোগিতা তাদের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার প্রতীক। সঙ্গে এটাও বলি, হাড়-মজ্জা পচে যাওয়া সমাজে কেউ বা কোনো সম্প্রদায়ও আজ আর নির্মল নেই! সবার ভেতরে ঢুকে আছে লোভ-লালসা আর জাহির করার প্রবণতা। হিন্দু নেতারা ধোয়া তুলসিপাতা নন। তাদের বেশির ভাগই 'আওয়ামী প্রসাদ' পেতে মরিয়া। এগুলো তারই নির্লজ্জ উদাহরণ। আরেক দল দৌড়ে যায় বিএনপির কাছে। দেখবেন, পূজার আগে-পরে আওয়ামী ও বিএনপি শিবিরে ধর্না দেন তারা। উভয় দলের বিশিষ্ট নেতারা তাদের অভয়বাণী শোনান। যেন এদের হাতেই নির্ভর করছে দুর্গার ভবিষ্যৎ!

গয়েশ্বর রায়ের মতো নেতা তো খালেদা জিয়ার ভেতর 'দুর্গা' দেখেন বলেও ঘোষণা দিয়েছিলেন।

আমি সংশয়বাদী মানুষ। উৎসবের আনন্দ, খাবার, বাজনা, পোশাক, আড্ডা আমাকে যতটা টানে 'আচার-রীতি' ততটা টানেনি কোনোদিন। কিন্তু যারা ধার্মিক যারা উপাসনা-পূজাকে ধ্যান মনে করেন তারাও দেখি এসব মেনে নেন। তখন দুর্গাও ভাগ হয়ে যায় আওয়ামী আর বিএনপিতে। এই রাজনীতি এমন কঠিন আমাদের পরম উৎসবের এই পূজাকেও একসময় প্রতিমাহীন ঘটে এনে ছেড়ে দিয়েছিল! সারা দেশে প্রতীকী পূজার সময় যারা দেশশাসনে ছিলেন তারা তা মানেননি। মানলে ভারত ও বিশ্বের কাছে মাথা হেঁট হয়। তাই নিজেদের ইমেজ ঠিক রাখতে পুলিশি পূজাও দেখেছি আমরা।

প্যান্ডেলে যত পুণ্যার্থী তার অধিক পুলিশ। এদিকে মন্ত্রী-মিনিস্টার ঘুরে-বেড়িয়ে দেখিয়েছিলেন সেবার নাকি সেরা উৎসব হয়েছিল দেশে; সৌজন্যে সরকারি টিভি। অথচ তার কয়েক দিন আগেই দেশের নানা প্রান্তে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে আহত মূর্তি, ডানা-ভাঙা দেবী, মুখ থুবড়ে পড়া প্রতিমা দেখেছে জাতি।

এ ব্যাপারে রাজনীতির উৎসাহ চরম! প্রায় প্রতিবার কোথাও না কোথাও এমন ঘটনা ঘটবেই। এটা এখন একটা সংকেতের মতো। আমার কাছে সাইরেন, মানে– "সাবধান হও, বেশি বাড় বেড় না। আমাদের ঢিল-পাটকেল, চাপাতি তৈরি।" দু-একজন সাধারণ মানুষের চোখের জল আর হিন্দুদের মনোবেদনা বোঝার জন্য গাড়িতে বাসে ট্রেনে চেপে যাওয়া মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজান সাহেবকে দেখতাম নিজের বকলেস আঁটা পাতলুন সামলাতে ব্যস্ত। এখন দেখব নতুন কাউকে।

শারদীয় দুর্গাপূজাও আজ রাজনীতির বাইরে না। এই যে আমরা আওয়ামী লীগকে 'হিন্দুবান্ধব' মনে করি বা তার দুশমনরা তাদের এই অজুহাতে ভোটবঞ্চিত করে; তারা আজ কি দেখল? পুলিশ কমিশনার বলেছেন, আজান ও নামাজের সময় ঢাকঢোল বাজানো যাবে না। জন্ম থেকে বড় হওয়া অবধি আমি কোনোদিন আজান বা নামাজের সময় ঢাকঢোল বাজতে দেখিনি।

মনে আছে, ট্রাকে করে কাসর ঘণ্টা বাজিয়ে প্রতিমা বিসর্জন দিতে যেতাম আমরা। চট্টগ্রাম শহর থেকে ভাটিয়ারীর সমুদ্রসৈকত বেশ অনেকটা পথ। পথে পথে অনেক মসজিদ। কাছে আসলেই বাজনা বন্ধ করে দিতাম আমরা। কেউ বলেনি। তারপরও নিজেদের দায়িত্ববোধে তা-ই করা হত।

এখন সেটা এভাবে ফলাও করে বলার পেছনে কি কারণ? হিন্দুরা পূজার সময় তা-ই করে? যার ভেতর দিয়ে উগ্র উত্তেজনাপ্রবণ মানুষ বা সাম্প্রদায়িকদের জানিয়ে দেওয়া যে এই কারণ দেখিয়ে তোমরা চাইলেও কিছু একটা করতে পার! এ জন্য আমি আওয়ামী লীগের ভেতর 'আওয়ামী ওলামা লীগ'কে বেশি ভালোবাসি। তারা সেক্যুলার রাজনীতির ঝাণ্ডা বহন করে না। তারা মূল দলের নেতাদের মতো মুখ ও মনে দুই রকম না; তারা যা বিশ্বাস করে তা-ই বলে। এই যেমন তারা তিনদিন ছুটি চাওয়ার কারণেই মানববন্ধন করে ফেলেছে। ছুটি এক দিন বাড়লে কী হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। খালি মুসলমানদের দোষ?

এখন তো হিন্দুদেরও বলতে হবে পাকিস্তানি আমলে ভালো ছিলাম! তিন দিনের ছুটি পেতাম।

তারপরও পূজা এসেছে। শারদ উৎসবের মেজাজ, আমেজ আর ঘটাই আলাদা। রঙিন পোশাক, আলোকসজ্জা, বাহারি সব গাননাচ, আজকালকার ডিজে স্টাইলের আরতি ও ক্লাবের মতো পরিবেশে সমাজ যাবে বদলে। এই কদিন কেউ বুঝবেই না আসলে কোথায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা। এই দুর্গা এখন ভারতীয় বাংলা চ্যানেলে প্রায়ই তরুণী-যুবতীদের ওপর ভর করে। নাটক-সিরিয়ালে এই 'দুর্গা' নামের মেয়েটি মোড়ল, চেয়ারম্যান বা অসুরের মতো শ্বশুরকে শায়েস্তা করে নিজেকে সত্যিকার দুর্গা বানিবে ফেলে! ব্যাকগ্রাউন্ডের মিউজিকে চলে মন্ত্রপাঠ।

এদিকে আমাদের বাংলাদেশে একের পর এক নারী আজ দুর্যোগের শিকার। মাথায় হিজাব পরেও রেহাই নেই তাদের। তনু, রিশা, মিতুসহ কদিন ধরে মিডিয়া তোলপাড় করা খাদিজা সবাই কোনো না কোনো অসুরের হাতে নিগৃহীত; কারো জান গেছে, কারো জান-মান দুটোই গেছে।

দেবতাকূলের ইন্দ্র আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিছু ঘটলেই দেবরাজের মতো স্বর্গ থেকে পালিয়ে যান! সব ঠাণ্ডা হলে টিভিতে এসে কড়া ধমক দিয়ে বলেন, "কাউকে ছাড়া হবে না।" আসলে হচ্ছেও তা-ই; বাচ্চা মেয়ে থকে বয়স্কা কাউকেই ছাড়া হচ্ছে না!

সময় এসেছে অসুরনিধনের। আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ডাক দিয়েছিলেন, যার যা আছে তা-ই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে। অসুরবধে এর কোনো বিকল্প নেই এখন। আমাদের ধর্মে দেবী দুর্গার এই অকালবোধন হয়েছিল কিন্তু রাবণবধের জন্য। আর রাবণ তো দেশপ্রেমিক রাজা হওয়ার পরও প্রাণ দিলেন নারী অপহরণের দায়ে।

এর মানে, এই দুর্গাপূজার মূল কারণ নারীর অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া।

আজ বাংলাদেশে একদিকে উন্নয়নের জোয়ার, আরেক দিকে রাবণ ও অসুরদের হাতে নারী নির্যাতনের হিড়িক। আমি জানি, এই উৎসব নির্বিঘ্নেই সমাধা হবে। যে বা যারা ক্রেডিট নিক না কেন মূলত মানুষই তা করবে। কারণ, তারা জানে– সম্প্রীতি ও সহাবস্থানই হচ্ছে এ দেশের ভিত্তি।

শারদীয় শুভেচ্ছার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর কথা ধার করে বলি, "ঘরে ঘরে 'দুর্গা' গড়ে তোলার" সময় এখন। ঘরে ঘরে মা-বোন-কন্যারা দুর্গা হয়ে উঠলেই এ দেশের সব অসুর সব রাবণ লেজ গুটিয়ে পালাবে।