পারিবারিক নির্যাতনের সংখ্যাতত্ত্ব ও ভয়ানক কিছু চিত্র

Published : 5 Oct 2011, 12:43 PM
Updated : 5 Oct 2016, 02:27 PM

মহাকবি শেকসপিয়ার যখন বলেন 'ফ্রেইলটি দাই নেইম ই্জ উওম্যান', তখন 'ক্রুয়েলটি দাই নেইম ইজ ম্যান' লিখতে কেন ভুলে যান তা বুঝি না। অন্তত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে গেলে এ কথা তিনি নিশ্চয়ই বলতেন। সেখানে হাত-পা ভাঙ্গা, পাঁজর-ফাটা, মারের চোটে চোখ নষ্ট, ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার, আগুনে ও অ্যাসিডে পোড়া, হাতে-পায়ে-শরীরে ধারালো অস্ত্রের পোঁচ দেওয়া এবং আরও অনেকভাবে আহত নারীদের দেখতে পেতেন। আর মর্গে গেলেও দেখা মিলত প্রভূত নির্যাতনের শিকার হয়ে অবশেষে মৃতদেহে পরিণত হওয়া নারীশরীর। আহত ও নিহত এই মেয়েদের বেশিরভাগই স্বামী ও শ্বশুরপক্ষীয় আত্মীয়দের সীমাহীন নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছেন। সোজা ভাষায়, এরা পারিবারিক নির্যাতনের শিকার।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) অতিসম্প্রতি এক জরিপের ফল প্রকাশ করেছে। 'ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইম্যান সার্ভে ২০১৫' শীর্ষক এই জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের বিবাহিত নারীদের ৮০ দশমিক ২ শতাংশ স্বামী ও শ্বশুরপক্ষীয়দের দ্বারা কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার। সে নির্যাতন শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক বা যৌন হতে পারে। শহর এলাকায় এই হার ৫৪.৪ শতাংশ এবং গ্রাম এলাকায় ৭৪.৮ শতাংশ। ৪১ শতাংশ নারী স্বামীর শারীরিক ও যৌননির্যাতনের শিকার।

গত এক দশকের বেশি সময় ধরে 'আমরাই পারি' ক্যাম্পেইনের ব্যানারে পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের সদস্য হিসেবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, গ্রামীণ ও নিম্নবিত্ত সমাজ থেকে পারিবারিক নির্যাতন দূর করার চেয়ে শহরের উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজ থেকে নির্যাতন দূর করা বেশি কঠিন। কারণ এই সমাজের নারীরা শত নির্যাতনের শিকার হলেও মানসম্মানের ভয়ে কিছুতেই মুখ খোলেন না।

আমার প্রতিবেশিনীদের মধ্যে একজন চিকিৎসক আছেন। তিনি যথেষ্ট ভালো চাকরি করেন। স্বামীর তুলনায় তাঁর উপার্জন বেশি। যে ফ্ল্যাটে তাঁরা থাকেন সেটির ভাড়া ভদ্রমহিলা নিজে দেন। দুটি ফুটফুটে মেয়ের মা তিনি। আপাতদৃষ্টিতে সুখী একজন মানুষ। কিন্তু সেটা আপাতদৃষ্টিতেই। প্রায় প্রতি রাতে তাঁর ফ্ল্যাট থেকে কলহের আওয়াজ পাই। স্ত্রীর উদ্দেশে অকথ্য গালাগাল বর্ষণ করেন স্বামীপ্রবর। কখনও কখনও প্রহারের আওয়াজও পাওয়া যায়। তাদের ব্যক্তিগত বিষয় মনে করে কিছুদিন চুপ করে ছিলাম। পরে নিজের নৈতিক কর্তব্যবোধের তাগিদে এই নির্যাতন প্রতিরোধে উদ্যোগী হলাম। প্রতিবেশিনীকে সহায়তা করার উদ্দেশে একদিন তাঁর কাছে এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করলাম। কিন্তু আমাকে বিস্মিত করে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করলেন– তাঁর স্বামী নাকি খুবই ভালো, তাঁরা খুব সুখে আছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।

হ্যাঁ, এমনিভাবে শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে ঢাকতেই শিক্ষিত সমাজের অনেক নারীর পরিণতি হয় রুমানা মঞ্জুর, জয়ন্তী রেজা কিংবা আখতার জাহান জলির মতো। নাজনীন আক্তার তন্বীর মতো নামকরা সাংবাদিকও স্বামীর নির্যাতন দিনের পর দিন সহ্য করে অবশেষে মুখ খুলতে বাধ্য হন।

শুধু আমাদের দেশ নয়, বিশ্বজুড়ে পারিবারিক নির্যাতন একটি বড় সমস্যা। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এর ভয়াবহ রূপ রয়েছে। মেয়ে-ভ্রুণ হত্যা, যৌতুক, বাল্যবিবাহ ও স্বামী-স্ত্রীর বয়সের বিশাল ব্যবধান, অনার কিলিং, বাট্টা-সাট্টা, নারী-খতনা ইত্যাদি বিভিন্ন রূপে নারীর উপর পারিবারিক নির্যাতন চলে।

শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি মানসিক নির্যাতনও কম ভয়াবহ নয়। শারীরিক গঠন, গায়ের রং, চেহারা, বাবার বাড়ির আত্মীয়দের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, কটাক্ষ, গালাগাল, অন্য কারও সঙ্গে অপমানকর তুলনা ইত্যাদি বহু রকম মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় বিবাহিত জীবনে। লেখাপড়া করতে না-দেওয়া, চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা, চলাচলের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া, অনাবশ্যক জবাবদিহিতাও মানসিক নির্যাতনের বিভিন্ন রূপ। এ ধরনের নির্যাতনের শিকার মানুষ অনেক সময় আত্মহত্যা করে, বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়, তার প্রতিভার বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যায়, মানসিক ভারসাম্য হারায় এবং আরও নানা রকম মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়।

অর্থনৈতিক নির্যাতনও বাংলাদেশের নারীদের উপর বেশ ভালোভাবেই চালানো হয়। যৌতুকের জন্য চাপ তো রয়েছেই। এছাড়া অনেক কর্মজীবী নারী তার উপার্জিত অর্থ স্বামী বা শ্বশুরপক্ষের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অনেক নারীর জন্যই সোনার হরিণ। নিজের রোজগারের অর্থ নিজের খুশিমতো খরচ করা বা বাবার পরিবারে সাহায্য করা অনেক পরিবারে গুরুতর অপরাধ বলে গণ্য হয়।

যৌননির্যাতন বিষয়ে মুখ খোলার ক্ষেত্রে সমাজে এখনও অনেক ট্যাবু রয়ে গেছে। 'স্বামী দ্বারা ধর্ষণ' বিষয়টি বুঝতে এখনও সমাজের সিংহভাগ মানুষ অক্ষম। আমি নিশ্চিত, লেখার এই অংশটি পড়ে অনেক পাঠক বিরূপ মন্তব্য করার জন্য মুখিয়ে উঠবেন। স্বামী হোক বা যে-ই হোক, কোনো মানুষের অসম্মতিতে তার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করাই যে ধর্ষণ, এ কথা বোঝার মতো মানসিক বিকাশ তাদের হয়নি বলে এ বিপত্তি। যৌন সম্পর্কের বেলায় 'না' কে 'না' অর্থেই নিতে হবে। একে জোর করে 'হ্যাঁ' বানানো মানে ধর্ষণ এ কথা বুঝতে সমাজের আরও অনেক দিন লাগবে বলে আশংকা হয়।

গর্ভধারণে অথবা গর্ভপাতে নারীকে বাধ্য করাও যৌননির্যাতন। জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি ব্যবহারের বেলায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বামীর মতামত সাধারণত প্রধান। স্বামীকে সুরক্ষা নিতে বলার ক্ষমতা বাংলাদেশের অনেক গৃহবধূর নেই। স্বামীর বিকৃত যৌনাচারের প্রতিবাদ করার ক্ষমতাও নেই অনেক নারীর। প্রতিকার তো দূরের কথা নিতান্ত মরিয়া না হলে এ বিষয়ে মুখ খোলেন না শিক্ষিত অশিক্ষিত কোনো নারী। যারা মুখ খুলতে বাধ্য হন তাদের খেতাব জোটে 'বেহায়া'।

তবে পরিসংখ্যান ব্যুরোকে সাধুবাদ জানাতে হয় এ ধরনের বিষয়গুলোও জরিপের ফলাফলে তারা তুলে ধরেছেন বলে। পারিবারিক নির্যাতনের নেপথ্য কারণ হিসেবে তারা পুরুষের নিয়ন্ত্রণকামিতার ওপর দায় চাপাচ্ছেন।

পারিবারিক নির্যাতনের প্রসঙ্গ উঠলেই ঘরে বাইরে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত একদল পুরুষ হইহই করে ওঠেন। তারা বলেন, 'পুরুষরাও পারিবারিক নির্যাতনের শিকার', 'স্বামী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইন করতে হবে', 'মেয়েরাই মেয়েদের বেশি নির্যাতন করে', ইত্যাদি ইত্যাদি।

এসব বলে বিষয়টি তারা লঘু করে ফেলতে চান। কিন্তু বিষয়টি যে কত গুরুতর তা জীবন-হারানো, অঙ্গ-হারানো, মানসিক ভারসাম্য হারানো নারীদের দেখেও কি তারা বুঝতে পারেন না? স্ত্রীর নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশের কত জন পুরুষ মর্গে লাশ হয়ে, কত জন হাসপাতালে আর মানসিক ওয়ার্ডের বেডে দিন যাপন করছেন তা জানতে ইচ্ছা করে।

নির্যাতন পুরুষই করুক আর পুরুষতান্ত্রিক ভাবধারার নারী করুক এ কথা তো ঠিক যে, ভিকটিমের মধ্যে নারীর সংখ্যা অনেক গুণ বেশি। সামাজিক বৈষম্য, পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী, নিয়ন্ত্রণকামিতা, নারীর প্রান্তিক ও দুর্বল অবস্থান ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে নারী পুরুষের চেয়ে নিম্নতর অবস্থানে আছেন বলে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আর যে পুরুষরা স্ত্রীর দ্বারা শারীরিক, মানসিক, যৌন ও অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তারাও অবশ্যই সুবিচার পাবার দাবি রাখেন এবং তাদের আর্তিও কোনোভাবেই অবহেলার বা হাসির বা লঘুভাবে দেখার নয়।

মোট কথা, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার যে-ই হোন না কেন, তারই রয়েছে সুবিচার পাবার পূর্ণ অধিকার। বাংলাদেশে এ জন্য আইন রয়েছে। কিন্তু এ সম্পর্কে অনেক নারী জানেন না। তাছাড়া আইনের দ্বারস্থ হওযার পর তারা যে নিশ্চিতভাবে স্বামীগৃহ থেকে বিতাড়িত হবেন সেটা জানেন বলে বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদে। নির্যাতনকারী স্বামীকে তালাক দিলে সন্তানদের নিয়ে বাবার বাড়িতে বোঝা হযে দাঁড়াতে হবে এ জন্যও নির্যাতন সহ্য করেন অনেকে। আবার অনেক নারীর দাঁড়াবার মতো জায়গা নেই, নেই ন্যূনতম অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন। সে কারণে নিতান্ত ভাত-কাপড়ের জন্যও স্বামীর উপর নির্ভর করতে হয়। ফলে প্রতিবাদের পথ অধরা রয়ে যায়।

নারীর শিক্ষা, সচেতনতা, অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া পারিবারিক নির্যাতন বন্ধ হবে না। আইন করে সব কিছু হবেও না। এ জন্য সমাজের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন চাই, চাই নারীর প্রতি আচরণগত পরিবর্তন। নারীকে যেমন মুখ খুলতে হবে তেমনি তার পাশে অন্যদের দাঁড়াতেও হবে। পারিবারিক নির্যাতন 'অন্য লোকের ব্যক্তিগত বিষয়' বলে পাশ কাটিয়ে যাবার উপায় নেই।

নির্যাতনের ধরনগুলো চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার দায়িত্ব গণমাধ্যমের। নিজের পরিবারে হোক কিংবা অন্যের পরিবারে, নির্যাতনের বিষয়ে সকলকে সচেতন ও প্রতিবাদী হতে হবে। ভিকটিমের পাশে দাঁড়ানো এবং নির্যাতনকারীর প্রতি প্রকাশ্যে ঘৃণা প্রদর্শন সমাজের চিত্র বদলে দিতে পারে। আচরণগত পরিবর্তন, নারীর আত্মমর্যাদাবোধ, নির্যাতনের বিষয়ে সচেতনতা, এ বিষয়ে কথা বলা বা নিরবতার সংস্কৃতি ভাঙা, আইনের যথাযথ প্রয়োগ, পুলিশ প্রশাসনের সচেতনতা ও দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ, নারীর শিক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন– সব মিলে প্রতিরোধ করতে পারে পারিবারিক নির্যাতন।

কারও অধিকার নেই অন্যের উপর শারীরিক, মানসিক, যৌন ও অর্থনৈতিক নির্যাতন চালানোর, কাউকে দমন করার বা হাতের মুঠোয় পুরে রাখার।

পারিবারিক নির্যাতন বিষয়টি গৌণ বা দ্বিতীয় গুরুত্বের চোখে দেখার ফলেই কিন্তু নির্যাতনের মাত্রা এত বেশি। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এটি দেখতে হবে। বুঝতে হবে এর ভয়াবহতা। সমাজ থেকে ব্যাধিটি চিরতরে নির্মূল করতে হবে। পরিবার সমাজের প্রথম একক। পরিবার নির্যাতনমুক্ত না করতে পারলে নির্যাতনমুক্ত সমাজ গড়ার স্বপ্ন যে চিরদিন অধরা রযে যাবে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।