তবু আদিবাসী কোটায় চাকরি হল না মুণ্ডা মেয়েটির

শেষ পর্যন্ত ৪ অক্টোবর রাত ৮টায় জানা গেল, চাকরিটা পায়নি বিথীকা

রাজীব নূররাজীব নূর
Published : 5 Oct 2016, 04:52 AM
Updated : 5 Oct 2016, 04:52 AM

গোপাল মুণ্ডার ফোনে ঘুম ভাঙল। তখন বেশ সকাল। আসলে গোপাল দা'র কোনো দোষ নেই। সাতক্ষীরার শ্যামগর উপজেলার একেবারে সুন্দরবনসংলগ্ন কালিঞ্চী গ্রামে গোপালের বাড়িতে গত মার্চ মাসের শেষদিকে যখন চারদিন কাটিয়েছিলাম, তখন তিনি দেখেছেন, আমি সকাল সকাল জাগি। জেগেই নদীর তীরে গিয়ে অপলক তাকিয়ে থাকি বনের দিকে, যদি বাঘ-হরিণ কারোর দেখা মেলে! কখনও গোপাল নিজে আসতেন সঙ্গে। কখনও আবার তার ছেলে বাপ্পি ও মেয়ে অপর্ণাও আসত আমার পেছন পেছন। ছেলেমেয়ে দুটি বাঘ তো দূরের কথা, হরিণের দেখা পাওয়ার চেষ্টাও যে বৃথা তা জানিয়ে দিতে কসুর করেনি। অবশ্য ওরা যখন অনেক ছোট তখন নাকি অনেক হরিণ আসত মরা নদীর ওই তীরে। এখনও মাঝেমধ্যে দলছুট শুকর আসে বলেও জানাল।

যাই হোক, আমাকে 'আরলি রাইজার' মনে করেই হয়তো সকাল সকালই ফোন দিয়ে দিলেন গোপাল মুণ্ডা। এটা ২ অক্টোবর সকালের কথা। মুঠোফোনের ওপাড় থেকে সদ্য ঘুমভাঙা আমার কণ্ঠস্বরের জড়তা বুঝতে পেরে গোপাল মুণ্ডা পরে ফোন করবেন কি না জানতে চাইলেন। ‌"অসুবিধা নেই", বলার পরও তড়িঘড়ি প্রসঙ্গে চলে আসেন। গোপাল মুণ্ডা জানান, কালিঞ্চীর পাশের গ্রাম ভেটখালির মুণ্ডা মেয়ে বিথীকা মুণ্ডা পুলিশের কনস্টেবল হওয়ার জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলেন। মহিলা কনস্টেবলের জন্য পুলিশের চাওয়া উচ্চতার থেকে ওর উচ্চতা এক ইঞ্চি বেশি। নারী প্রার্থীদের জন্য কোটা নির্বিশেষে উচ্চতা পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি হতে হবে। বিথীকার শিক্ষাগতযোগ্যতাও একটু বেশিই।

পুলিশের কনস্টেবল হওয়ার জন্য এসএসসি বা সমমান পাস প্রার্থীরা আবেদন করতে পারেন। প্রার্থীদের ন্যূনতম জিপিএ থাকতে হয় দুই দশমিক পাঁচ অথবা সমমান। বিথীকার আছে তিন দশমিক ১৩। বর্তমানে মেয়েটি শ্যামনগরের একটি কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ছেন।

বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজখবর নেব– গোপাল মুণ্ডাকে এমন আশ্বাস দিয়ে ফোন রেখেই যোগাযোগ করি আমার সহকর্মী 'সমকাল'এর সাতক্ষীরা জেলা প্রতিনিধি ও সেখানকার প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামানের সঙ্গে। তাকে পুলিশ সুপারের (এসপি) সঙ্গে কথা বলতে বলি। কিছুক্ষণ পর কামরুজ্জামান নিজেই ফোন করে জানালেন, এসপি সাহেবকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। সরাসরি এসপির কাছে যেতে তার সংকোচ হচ্ছে। কারণ হিসেবে জামান বললেন, "আপনি তো জানেন, এই সব চাকরির বিনিময়মূল্য কত? অফিসিয়ালি এখনও ফলাফল ঘোষণা করা হয়নি, ফল প্রকাশ করা হবে ৪ অক্টোবর, আমি যদি আগেই এসপির কাছে যাই, এসপি সাহেব ভাবতে পারেন তদবিরে এসেছি, বিনিময়ে আমি কোনো সুবিধা নিয়েছি বলেও সন্দেহ করতে পারেন।"

ফলাফলের আগেই কেমন করে দীপিকা বুঝল তার চাকরি হচ্ছে না। জানার জন্য আবারও ফোন দিই গোপাল মুণ্ডাকে। তার কাছ থেকে সংগ্রহ করি বিথীকার মুঠোফোন নম্বর। বিথীকা জানালেন, পুলিশ কনস্টেবলের চাকরি পাওয়ার জন্য উচ্চতা, ওজন নেওয়ার পর তিনি শারীরিক কসরতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পান ২৮ সেপ্টেম্বর। সবকিছুতে টেকার পর পরদিন ২৯ সেপ্টেম্বর দেন লিখিত পরীক্ষা। প্রশ্ন মোটামুটি সহজ ছিল এবং উত্তরও ভালোভাবে দিয়েছেন। তবু ১ অক্টোবর হয়ে যাওয়া মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাক পাননি তিনি। তাই সাতক্ষীরা জেলার একমাত্র আদিবাসী প্রার্থী হওয়ার পরও সরকারঘোষিত 'উপজাতি কোটায়'ও যে তার চাকরি হচ্ছে না– এটা তিনি বুঝে গেছেন।

বিষয়টি আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য যোগাযোগ করি বন্ধু দীপায়ন খীসার সঙ্গে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জনসংহতি সমিতির নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র দীপায়ন স্পষ্টই বললেন, বাংলাদেশের সরকারি কর্মকমিশনের রীতি অনুযায়ী উচ্চতা, ওজন এবং শারীরিক কসরতে টিকে গেলেই দীপিকার চাকরি পাওয়ার কথা। কর্মকমিশনের রীতি অনুযায়ী ১০০ জনে আদিবাসীদের কোটা পাঁচ। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আদিবাসীদের ন্যূনতম যোগ্যতা থাকলেই চলে। প্রার্থী বেশি হয়ে গেলে আসে প্রতিযোগিতার প্রশ্ন। বিথীকার তো কোনো আদিবাসী প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। পুলিশ কনস্টেবলের ন্যূনতম যোগ্যতা তো আবেদনের সক্ষমতা বোঝানো এবং সেটা বিথীকার আছে।

এরপর সারা দিন বিষয়টা ভুলেই গিয়েছিলাম। সন্ধ্যায় আবার ফোন দিলেন গোপাল মুণ্ডা। সবকিছু বুঝিয়ে বলার পরও এবার তাঁর দাবি, "আপনি কিছু করেন দাদা। আমি আপনাকে দেব বলে এসপি সাহেবের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে রেখেছি।"

আমি বললাম, "আগে ফল বের হোক। তখন না হয় রিপোর্ট লিখব।"

গোপাল মুণ্ডার সরল যুক্তি, "তখন রিপোর্ট লিখে কী হবে, চাকরিটাই যদি না হয়।"

তাই তো? এবার আমার বিব্রত হওয়ার পালা। তাই বলে তো গোপাল দাকে উপেক্ষা করতে পারি না। আমি যে চারটা দিন কাটিয়েছিলাম তার বাড়িতে। তার ছেলেমেয়েরা দ্বিতীয় দিন থেকেই আমাকে 'কাকা' বলতে শুরু করেছিল। বৌদি সুন্দরবনের দুর্লভ কাইন মাছ সংগ্রহ করে খাইয়েছিলেন। কথা ছিল, ফেরার আগে থাকা-খাওয়ার খরচ পরিশোধ করে দেব। ফেরার সময় হিসাবটা চাইতে গেলে গোপাল মুণ্ডা আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে বললেন, "আপনি তো আমার ভাই হয়ে গেছেন। আমার বাচ্চা দুইটা আপনাকে কাকা-কাকা করে ডাকছে। ভাইয়ের বাড়িতে ভাই থাকলে কি টাকা নেওয়া যায়?"

আমার সেই ভাইয়ের দাবি, "বিথীকার জন্য কিছু করেন" উপেক্ষা করি কেমন করে? আমি তো নিজের চোখে দেখে এসেছি, গোপালদা নিজের তিন ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছেন। গোপাল মুণ্ডার অন্য মেয়েটি তখন বাড়িতে ছিল না বলে আমার সঙ্গে ওর দেখা হয়নি। নিজের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে অন্যদেরও গোপাল উৎসাহ দিচ্ছেন যেন পড়াশোনাটা চালিয়ে যায়। শ্যামনগরের পশ্চাৎপদ আদিবাসী মুণ্ডাদের এগিয়ে নেওয়ার জন্য এই মানুষটা যারপরনাই চেষ্টা করছেন।

গোপালদা পুলিশে নিয়োগের জন্য 'ইত্তেফাক' পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপন পড়ে শোনালেন, "জাতীয় বেতনক্রম ২০১৫ অনুযায়ী নিয়োগপ্রাপ্তদের বেতন দেওয়া হবে সর্বসাকুল্যে নয় হাজার থেকে ২১ হাজার ৮০০ টাকা। এছাড়া ভাতা এবং অন্যান্য সুবিধাও রয়েছে।"

তারপর জানতে চাইলেন, "ভাবেন তো দাদা এই মেয়েটা চাকরি পেলে একটা মুণ্ডা পরিবার কতটা এগিয়ে যাবে। না পেলে আপনার ভাতিজা বাপ্পি, ভাইজি অপর্ণার মতো অনেকেই পড়াশোনা করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। ওরা ভাববে পড়ে কী হবে, যদি কোনো কাজেই লাগতে না পারি।"

খুবই যৌক্তিক কথা বললেন গোপাল মুণ্ডা।

কিন্তু আমার কথা শুনবেটা কে? তবু ফোন দিই সাতক্ষীরার এসপি সাহেবকে। তিনি ধরলেন না। আলাপ করি সাবেক সহকর্মী 'প্রথম আলো'র নিজস্ব প্রতিবেদক (সাতক্ষীরা) কল্যাণ ব্যানার্জি ও দীপায়ন খীসার সঙ্গে। তারা আদিবাসী নেতাদের সঙ্গে আলাপ করার পরামর্শ দেন। দীপায়ন অবশ্য আশ্বস্ত করে বললেন, "আমি সাতক্ষীরার এমপি মুস্তফা লুৎফুল্লাহকে বিষয়টা জানাচ্ছি।"

সাংসদ লুৎফুল্লাহকে আমিও চিনি। ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা, সাতক্ষীরা-১ আসনের এই সাংসদের আদিবাসীবান্ধব বলে পরিচয় রয়েছে। মনে পড়ে, কথা প্রসঙ্গে একবার যশোরের সাংবাদিক বন্ধু সাজেদ রহমান বলেছিলেন, সাতক্ষীরা-৪ আসনের সাংসদ জগলুল হায়দারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। তাই সাজেদকে অনুরোধ করি, বিথীকার বিষয়টি নিয়ে জগলুলের সঙ্গে কথা বলতে। কারণ, শ্যামনগর তো জগলুলের নির্বাচনী এলাকা। সহকর্মী নাহিদ তন্ময় তখন পাশেই ছিলেন। নাহিদ বললেন, তার সঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি (সংস্থাপন) হাবিবুর রহমানের পরিচয় আছে, তিনি তাঁকে বলবেন।

এরই মধ্যে গোপাল মুণ্ডা যোগাযোগ করেছিলেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেনের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ সরেন আমাকেও জানালেন, তিনি নিজেই এসপি সাহেবের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। তবে জানিয়েছেন আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের শীর্ষনেতা সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশাকে। বাদশা ভাই পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।

আমাকে এবং আমার বন্ধুদের সবাইকে বিষয়টি নিয়ে আশ্বস্ত করলেও শেষ পর্যন্ত ৪ অক্টোবর রাত ৮টায় জানা গেল, চাকরিটা পায়নি বিথীকা মুণ্ডা।

অবশ্য ফল প্রকাশের আগেই ৪ অক্টোবর দুপুরে আমার সহকর্মী কামরুজ্জামান কথা বলতে পেরেছিলেন সাতক্ষীরার এসপি মো. আলতাব হোসেনের সঙ্গে। কামরুজ্জামান আমাকে জানান, এসপি সাহেব তাকে বলেছেন উপজাতীয় কোটা থাকলেই অযোগ্য কাউকে চাকরি দিতে হবে, এমন নয়। তবে এসপির কাছে সুনির্দিষ্টভাবে বিথীকা মুণ্ডার কথা জানতে চাওয়া হলে বলেন, কেন মেয়েটি বাদ পড়েছে তা তার জানা নেই। পরে যোগাযোগ করলে জানাতে পারবেন, বলেন এসপি সাহেব।

উল্লেখ্য, গত ৬ সেপ্টেম্বর 'ইত্তেফাক' পত্রিকায় পুলিশের এআইজি (রিক্রুটমেন্ট অ্যান্ড ক্যারিয়ার প্ল্যানিং) মনিরুল ইসলামের নামে প্রচারিত বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায়, এবার পুলিশ কনস্টেবল পদে যে ১০ হাজার নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, এর মধ্যে সাতক্ষীরার রয়েছে ১৪৭ জন।