জন্মদিনে কয়েক ছত্র প্রাণের পত্র

আবুল হাসনাৎ মিল্টন
Published : 28 Sept 2016, 04:13 AM
Updated : 28 Sept 2016, 04:13 AM

২০০১ সালের মার্চ মাসে ক্যানবেরাস্থ অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে এক মাসের জন্য একটা কোর্স করতে এসেছিলাম। একদিন বিকেলে চা-চক্রে দেখা হল অস্ট্রেলিয়ান সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাবপ্রাপ্ত, অধ্যাপক বব ডগলাসের সঙ্গে। শুরুতেই তাঁর চোখে-মুখে উচ্ছ্বাস। "আমি তোমাদের প্রধানমন্ত্রীকে চিনি। শি ইজ আ গ্রেট লিডার। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাঁকে সন্মানসূচক ডক্টর অব ল ডিগ্রি দেওয়া হয়েছিল।"

শুনে হলভর্তি মানুষের ভেতরেও আমার বুকটা গর্বে ভরে ওঠে। তাঁকে বলি, "আমিও তাকে চিনি, তিনি আমার নেত্রী।"

পরবর্তীতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সময়ও আরও অনেক শিক্ষকের মুখে শেখ হাসিনার কথা শুনেছি। উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালের ২০ অক্টোবর পৃথিবীর অন্যতম সেরা এই বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধুকন্যাকে সন্মানসূচক এই ডিগ্রি দিয়েছিল। সেটা ছিল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রথমবার নির্বাচিত হওয়ার কাল। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সমগ্র বিশ্বকে চমকে দেন। সন্ত্রাস ও অস্ত্রের নিত্য ঝনঝনানির পার্বত্য জনপদে তিনি বইয়ে দিয়েছিলেন শান্তির সুবাতাস। শান্তির স্বপক্ষে এমন ঐতিহাসিক অর্জনের জন্য তাঁর শান্তিতে নোবেল পাওয়া উচিত ছিল। যদিও জন্মান্ধ নোবেল শান্তি কমিটির তা চোখ এড়িয়ে গেছে।

এরপর একের পর এক তাঁর দক্ষ নেতৃত্বের জন্য সারা বিশ্বে তিনি স্বীকৃতি পেতে থাকেন। বিশেষ করে বিশ্বের অনেক শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সন্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। এই স্বীকৃতিগুলো কেবল ব্যক্তি শেখ হাসিনারই প্রাপ্তি ছিল না, বরং তাঁর এসব অর্জনের মধ্য দিয়ে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের মানচিত্র ক্রমশ উজ্জ্বল হয়েছে। সে সময়কালেই তাঁর প্রাপ্তির তালিকায় আরও যুক্ত হয়েছিল 'মাদার তেরেসা পদক', 'এম কে গান্ধী পুরস্কার'এর মতো আন্তর্জাতিক আরও অনেক পুরস্কার।

প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি দীর্ঘকালের সামরিক শাসনে জর্জরিত বাংলাদেশকে ভিন্ন এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হলেও, ২০০১ সালের অক্টোবর মাসের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অপ্রত্যাশিতভাবে পরাজিত হয়।

তারপরের ইতিহাস বড় নির্মম। গণতন্ত্রের আদলে বাংলাদেশে শুরু হয় ঘৃণ্য, কালো এক অধ্যায়। দুর্নীতি, সন্ত্রাসে নিমজ্জিত জামায়াত-বিএনপি জোটের ওই সরকারের আমলেই, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে গ্রেনেড-হামলা চালানো হয়। এই হামলায় আওয়ামী লীগ-নেত্রী আইভী রহমানসহ অনেকে হতাহত হলেও শেখ হাসিনার বেঁচে যাওয়াটা ছিল অলৌকিক এক ব্যাপার।

বঙ্গবন্ধুকন্যাকে হত্যার উদ্দেশে হামলা অবশ্য এটাই প্রথম নয়। কমপক্ষে ১৯ বার তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। সৃষ্টিকর্তার অসীম করুণায় প্রতিবারই বেঁচে গেছেন। সৃষ্টিকর্তা হয়তো দেশের বৃহত্তর কল্যাণের জন্যই তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, এমনটা মনে হওয়া তাই অসঙ্গত হবে না।

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পটপরিবর্তনের ফলে রাজনীতির মঞ্চে আবির্ভূত হয় ইয়াজউদ্দিন-ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের সরকার। নতুন করে এক চরম অনিশ্চয়তায় পড়ে বাংলাদেশ, চারদিকে ছায়া সামরিক শাসন। আকাশে-বাতাসে মাইনাস ওয়ান-টু ইত্যাকার নানা ষড়যন্ত্র। এ রকম সময়েই বিদেশ থেকে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন প্রতিহত করার চেষ্টা ব্যর্থ হলে, ১৬ জুলাই তাঁকে একটি সাজানো মামলায় গ্রেফতার করা হয়। ফলে এগার মাস নির্জন কারাবাসে কাটান তিনি।

তবে সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে কারাগার থেকে যিনি বেরিয়ে আসেন, তিনি কিন্তু আগের চেয়ে অনেক পরিণত, ঋদ্ধ এক মানুষ। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবার তাঁর দেশ পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্তির পর সে প্রমাণ পেয়েছি বারবার। এবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়বার সংগ্রামের পাশাপাশি তিনি ধীরে ধীরে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে বিশ্বমঞ্চে আবির্ভূত হন।

জলবায়ু সংকট কিংবা অভিবাসী সংকট মোকাবেলায় তিনি ধীরে ধীরে পরিণত হন অনিবার্য এক কণ্ঠস্বরে। গত বছরের ডিসেম্বরে আমেরিকার বিখ্যাত সাময়িকী 'ফরেন পলিসি'র 'নীতি নির্ধারক' ক্যাটাগরিতে বিশ্বের একশ চিন্তাবিদের তালিকায় তাঁর নামটি ছিল ১৩তম স্থানে। ইতোপূর্বে মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, ইরানের রাষ্ট্রপতি হাসান রোহানী, মায়ানমারের নেত্রী অং সান সুচি এই তালিকায় স্থান পেয়েছেন।

চলমান সেপ্টেম্বর মাসেই জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন ইউএন উওম্যান তাঁকে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য 'প্লানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন' এবং গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফোরাম 'এজেন্ট অব চেইঞ্জ অ্যাওয়ার্ড'এ ভূষিত করেছে। গত বছর পেয়েছেন জাতিসংঘের 'পলিসি লিডারশিপ' ক্যাটাগরিতে 'চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ' পুরস্কার। টেকসই উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও সবার জন্য মর্যাদাপূর্ণ জীবনের স্বপ্নদর্শী বিশ্বনেতারা এটি পেয়ে থাকেন। ওদিকে সম্প্রতি কানাডার আন্তর্জাতিক উন্নয়ন মন্ত্রী মেরি ক্লড বিবেউ সম্প্রতি বলেছেন, "শেখ হাসিনা নারীউন্নয়নের স্তম্ভ।"

বিশ্ব এখন ধর্মের নামে জঙ্গি-সন্ত্রাস মোকাবেলায় ব্যস্ত। এ সময় লৌহমানবীর দৃঢ়তায় বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ মোকাবেলা করছেন শেখ হাসিনা। ১ জুলাই, ২০১৬ ঢাকার হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি-হামলায় বিদেশিরা নিহত হলে অনেকেই বাংলাদেশের ভবিষ্যত বিপন্ন হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনা দক্ষ হাতে যেভাবে পদক্ষেপ নিয়েছেন, তাতে জঙ্গিরা একেবারে কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। এ সংগ্রামে যে প্রায় গোটা বিশ্ব তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, এটাও তাঁর এক সাফল্য।

একসময়কার তলাবিহীন ঝুড়ি কিংবা দুর্নীতিতে পরপর পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশের গায়ে এভাবেই শেখ হাসিনা ভিন্ন এত তকমা লাগিয়ে দিয়েছেন। তাঁর দূরদর্শিতায়, দক্ষ নেতৃত্বে ও মানবিক ছোঁয়ায় বাংলাদেশ কেবল এক উদীয়মান শক্তি কেবল নয়, দুনিয়াজোড়া এক বিস্ময়েরও নাম বটে। শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে বাংলাদেশে বেড়েছে মাথাপিছু বার্ষিক আয় ও গড় আয়ু। কৃষি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার অর্জনগুলোও তাক লাগিয়ে দেবার মতো। উন্নতির প্রায় সব সূচকে অনেক এগিয়ে গেছে দেশ।

এত অর্জনের মাঝেও শেখ হাসিনা ব্যক্তিজীবনে একজন মা এবং তাঁকে রত্নগর্ভাই বলা যেতে পারে। তাঁর ছেলে, সজীব ওয়াজেদ জয় একজন হার্ভার্ড গ্রাজুয়েট। ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার তিনি। প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ নেতা হিসেবে দেশের অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন জয়। এ বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্যবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে জয় পেয়েছেন 'আইসিটি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড'। জয়ের বোন, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল প্রতিবন্ধীদের সামগ্রিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনার কন্যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক ২৫ সদস্য বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা পরিষদের সন্মানিত সদস্যও। ক্ষমতাসীনদের সন্তানদের বখে যাওয়ার ভুরি ভুরি নজিরের বিপরীতে জয়-পুতুলের এহেন অর্জন সৌভাগ্যের বিষয়। মাতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর জন্য অসামান্য প্রাপ্তিও বটে।

২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধুকন্যার ৬৯তম জন্মদিন। তাঁর জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাই। বাংলাদেশের জন্য, পৃথিবীর অনেক ভালো কাজের জন্যও তাঁর দীর্ঘকাল সুস্থভাবে বেঁচে থাকা দরকার। তাঁর নেতৃত্বের ছোঁয়ায় বাংলাদেশ অনেকদূর যাবে বলেই আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস।

জন্মদিনের উপহার হিসেবে তাঁর জন্য দুটো লাইন:

'যোগ্য বাবার যোগ্য কন্যা,

হাসিনা তুমি অনন্যা।'

চিয়ার্স!