সাইবারে সামাজিক নির্যাতন কিংবা অপরাধ ও প্রতিরোধ মডেল

কৌশিক আহমেদ
Published : 17 Nov 2011, 01:34 PM
Updated : 17 Nov 2011, 01:34 PM

ঘটনা এক: ৪ঠা নভেম্বর ডঃ জাফর ইকবালের লিখিত এক নিবন্ধের প্রেক্ষিতে তার কন্যাকে নিয়ে কদর্য মন্তব্যে লিপ্ত হয়েছে এক দল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী। জাফর ইকবাল লিখেছিলেন, 'আমি সোজাভাবে বিষয়টি এভাবে দেখি, যে সমাজে পুরুষ আর নারী সমান সমানভাবে পাশাপাশি থেকে কাজ করে, সেই সমাজকে মৌলবাদীদের, ধর্ম ব্যবসায়ীদের খুব ভয়। তাই মেয়েদের ঘরের ভেতর আটকে রাখতে পারলে সবচেয়ে ভালো। একান্তই যদি ঘরের ভেতর আটকে রাখা না যায় অন্তত বোরকার ভেতর আটকে রাখা যাক।' ('ওদের নিয়ে কেন স্বপ্ন দেখবোনা?', জাফর ইকবাল, দৈনিক প্রথম আলো, ৪ঠা নভেম্বর ২০১১) এর ফলে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া-চিত্র দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের হলো। সাইবার পরিসর ঘেটে তার কন্যার ছবি প্রকাশ করা হলো এবং সেখানে তাকে চিহ্নিত করা হলো কদর্য নানান বিশেষণে। এই ছবি প্রকাশ ও সেসব ছবিতে যে সব মন্তব্য করা হয়েছে তা সরাসরি যৌন হয়রানীমূলক নির্যাতন।

ঘটনা দুই: যুগান্তকারী ঘটনা এটি। যৌতুকের প্রতিবাদ স্বরূপ বিয়ের দিনই ফারজানা ইয়াসমীন (নিপা) তালাক দেয় শওকত আলী খান হীরণকে। এর পরপরই হীরণ তার ফেসবুক একাউন্টে ফারজানার ছবি, ফোন নম্বর প্রকাশ করে মন্তব্য করেন, 'এই সেই কন্যা সাহসিকা নিপা, বিয়ের নামে যে ব্যাবসার ফাদ (ফাঁদ) পেতেছে'। সাইবার পরিসরে এই মন্তব্য নির্যাতনমূলক।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ব্লগ বা যেকোনো সাইবার পরিসরে যদি কেউ কোনোরূপ নির্যাতনের শিকার হয় বা ব্যক্তির সাথে কোনো অপরাধ সংগঠিত হয় তবে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবার বিধান থাকা উচিত। দুঃখজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশে এমন বিশেষায়িত কোনো বিধান নেই। উপরোক্ত ঘটনা দুটি বিচার করলে বাংলাদেশ সরকারের উচিত সাইবার অপরাধ দমন বিধিমালা ও বিচার প্রক্রিয়া নির্মাণের বিষয়টি এ মুহূর্তে অগ্রাধিকার প্রদান করা।

সাইবার অপরাধ প্রধানত দুইভাগে ভাগ করা সম্ভব, এক) অর্থনৈতিক লেনদেন সংক্রান্ত অপরাধ; এবং দুই) সামাজিক অপরাধ। এই দুই ধরনের ভেতরে প্রথমোক্ত অপরাধসমূহ একদমই সাম্প্রতিক এবং ক্রমশ এর প্রকোপ বৃদ্ধি পাবে ই-কমার্সের বৃদ্ধির সাথে সাথে। তবে এ মুহূর্তে আমরা সামাজিক অপরাধসমূহকে এই আলোচনায় তুলে ধরতে চাই যেহেতু ইন্টারনেট ব্যবহাকারীরা ২০০৬ সাল থেকে ক্রমবর্ধমান হারে সাইবার পরিসরে ব্যক্তিগত মতামত তুলে ধরছেন এবং ফলে নির্যাতন ও অপরাধসমূহের বিস্তারও প্রায়শই চোখে পড়ে।

সাইবারে সামাজিক অপরাধ বলতে এ পর্যন্ত নিম্নোক্ত বিষয়গুলো চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে:

১. মৃত্যুর হুমকি: ব্লগ বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো পোস্ট, স্টাটাস বা মন্তব্যে অথবা ইমেইলে অথবা ফটো, অডিও, ভিডিও ফরমেটে বক্তব্য প্রকাশ করে অথবা অনলাইন পোস্টার/ব্যাজ/কার্টুন/ক্যারিকেচার তৈরি করে এবং এর পাশাপাশি ফোন করে অন্যকে জীবননাশ অথবা শারিরীক নির্যাতনের হুমকি প্রদান;

২. যৌণ হয়রানী: যৌনাত্মক/অশ্লীল বাক্য, বা শব্দ লিখে অথবা ফটো/ভিডিও/অডিও ফরমেটে বক্তব্য প্রকাশ করে এবং ছবি, ফোন নম্বর, ইমেইল এড্রেস ও ঠিকানা প্রকাশ করে অন্যকে যৌন হয়রানী ও অবমাননা বা উসকানি প্রদান;

৩. পর্নোগ্রাফি নির্মাণ: পর্নোগ্রাফিক সাইটে অন্যের ব্যক্তিগত ফটো/ভিডিও/অডিও প্রকাশ করে অথবা অন্যের নাম, পরিচয়কে পর্নো চরিত্র হিসাবে নির্মাণ করে সামাজিক মর্যাদা হানি, নিগ্রহ ও অবমাননা;

৪. প্রোফাইল ছিনতাই: অন্যের প্রোফাইল পরিচিতি, অবতার, ইমেজ, ইত্যাদি অবৈধ ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যবহার করে ডুপ্লিকেট নিক ও ভিন্ন পরিচিতি নির্মাণ ও অপব্যবহার;

৫. কপিরাইট ছিনতাই: অন্যের ব্লগ পোস্ট/লেখা/মৌলিক অনলাইন কনটেন্ট যেমন অডিও, ভিডিও ও ফটো নিজের নামে চালানো এবং লেখকের নাম ও তথ্যসূত্র হিসাবে ওয়েবসাইটের লিংক প্রদান না করা;

৬. ইমেইল এড্রেস স্প্যামারকে প্রদান: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম/ব্লগের সুত্রে প্রাপ্ত অন্যের ইমেইল এড্রেস, প্রোফাইল পরিচিতি বাণিজ্যিকভাবে কোনো স্প্যামারের কাছে সরবরাহ;

৭. হ্যাকিং: সোশ্যাল মিডিয়া বা ব্লগ বা ব্যক্তিগত অথবা কর্পোরেট ওয়েবসাইট হ্যাকিং এবং অননুমোদিত কোনো কিছু প্রকাশ; এবং

৮. পাইরেসি: অন্যের ওয়েবসাইটের মৌলিক ডিজাইন টেমপ্লেট/লোগো অথবা ওয়েব এপ্লিকেশন নকল/পাইরেসি;

৯. রাষ্ট্রীয় সংবিধান অবমাননা: রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের স্থপতি, জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পরিচয় স্থাপনকারী জাতীয় স্থাপনা, সিম্বল, লোগো, সংগীত যা গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত বিষয় নিয়ে ব্লগ পোস্ট/অডিও/ভিডিও/ফটো প্রকাশের মাধ্যমে অশ্লীল/কদর্য ও বিকৃতভাবে উপস্থাপন যা কোনো ব্যক্তির জাতীয়তাবাদী চেতনাকে বিপন্ন করে; এবং

১০. সাম্প্রদায়িক নিগ্রহ: যেকোনো সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবিশেষকে তার বর্ণ, ধর্ম পরিচয়কে উদ্দেশ্য করে ব্লগ পোস্ট/অডিও/ভিডিও/ফটো মাধ্যমে অশ্লীল/কদর্য ও বিকৃতভাবে উপস্থাপন।

ওয়েবে মৃত্যুর হুমকি, যৌণ হয়রানী, পর্নোগ্রাফি নির্মাণ, প্রোফাইল ও কপিরাইট ছিনতাই, ইমেইল এড্রেস স্প্যামারকে প্রদান, হ্যাকিং, পাইরেসি, রাষ্ট্রীয় সংবিধান অবমাননা, সাম্প্রদায়িক নিগ্রহ ইত্যাদি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের শিকার হলে বাস্তব জীবনের মতই মানুষ বিপর্যস্থ হয়ে পড়ে। কোন কোন সাইটের কর্তৃপক্ষ অভিযুক্তের সংশ্লিষ্ট ওয়েবে বিচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তবে এমন ক্ষুদ্র নিয়ন্ত্রণ কোনভাবেই উপরোক্ত অপরাধসমূহের যথার্থ বিচার হতে পারে না। বিশেষত অভিযুক্ত যখন অনায়াসে ভিন্ন নিকে নতুন পরিচয় নির্মাণ করে সেখানে পুনরায় ছারপত্র পেতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন ওয়েবের নিজস্ব মডারেশন পদ্ধতি ও সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে অপরাধ ও শাস্তি আরোপের ধারণাও বিভিন্ন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সাইট কর্তৃপক্ষও এসব অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত বলে প্রমাণ থাকতে পারে।

যে ব্যক্তি ওয়েবের কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে উপরোক্ত অপরাধ সংগঠন করে তাকে আইনের আওতায় আনা এখন সময়ের দাবী। অথচ বাংলাদেশে এমন নির্যাতনের শিকার মানুষেরা কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। কোথায় জানাবে, কার কাছে জানাবে, আদৌ কোনো আইন আছে কিনা এসব এখনও অস্পষ্ট অথবা অনির্মিত। সেজন্য যে কোনো ধরনের সাইবার সামাজিক অন্যায় বা অপরাধ নিয়ন্ত্রন বা প্রতিবিধানের জন্য সর্বাগ্রে অপরাধসমূহ চিহ্নিত করা প্রয়োজন। দীর্ঘদিন যাবত অনলাইন কমিউনিটির সাথে কাজ করার সুবাদে উপরোক্ত অপরাধসমূহ সংগঠিত হতে আমি দেখেছি। এর ব্যাপ্তি ও ধরণ আরো বিস্তারিত আলোচনার দাবী রাখে। তবে এসমস্ত অপরাধসমূহের বিপরীতে সম্ভাব্য একটা প্রতিরোধ মডেল হতে পারে এমন –
১. সাইবার থানা স্থাপন: কোনো নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেই অপরাধের শিকার ব্যক্তি এ থানায় রিপোর্ট করবেন। উচ্চতর তথ্যপ্রযুক্তি ও অনলাইন কর্মকান্ড সম্বন্ধে অভিজ্ঞ একটা প্রশাসনিক কাঠামো থাকবে ভার্চুয়াল থানার পেছনে। যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ইমেইল এড্রেস, ফোন নম্বরসহ রাষ্ট্রে প্রচলিত সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যাদের শাখা থাকবে। সাইবার থানা অভিযোগ নথিভূক্ত করে তদন্ত পরিচালনা করবেন।

২. নির্যাতনের আলামত সংরক্ষণ: নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি প্রমাণ স্বরূপ অপরাধ সংশ্লিষ্ট মন্তব্য, মেইল, ফটো, অডিও, ভিডিও, ইত্যাদি আলামত হিসাবে সংরক্ষণ বা সেভ করবেন এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে স্ক্রিন শট রাখবেন এবং সাইবার থানায় প্রেরণ করবেন।

৩. অভিযুক্তের তথ্য সংগ্রহ: অভিযুক্তের যত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সংক্রান্ত তথ্য জানা সম্ভব সেগুলি নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি সংগ্রহ করবেন ও সাইবার থানায় প্রেরণ করবেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় অভিযুক্তের নাম, ইমেইল এড্রেস, সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল, পূর্ববর্তী ব্লগ পোস্ট বা স্টাটাস, সম্ভব হলে আইপি এড্রেস, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিযুক্তের সাথে সম্পর্কযুক্ত অন্যান্য মানুষের নাম-ঠিকানা, ইত্যাদি।

৪. নির্যাতনের সংবাদ নিকটজনকে অবহিতকরণ: নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি নির্যাতনের সংবাদ তার কাছের মানুষকে অবশ্যই প্রমাণসহ অবহিত করবেন। সাক্ষ্য প্রমাণের জন্য তার সাহায্য প্রয়োজন হতে পারে।

৫. সংশ্লিষ্ট ওয়েবের কাছে অভিযোগ উপস্থাপন: নির্যাতনকারী যে ওয়েব ব্যবহার করে কোন অপরাধ সংগঠন করেন তার কর্তৃপক্ষ/স্থানীয় প্রতিনিধির কাছে অপরাধের শিকার ব্যক্তি লিখিতভাবে অভিযোগ উত্থাপন করবেন। এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে আন্তর্জাতিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর স্থানীয় দপ্তর স্থাপন ও বাংলা ভাষায় অভিযোগ পাঠানোর ব্যবস্থা রাখা আবশ্যিক করা উচিত।

৬. গ্রুপ/ফোরামে অভিযোগ উপস্থাপন: ওয়েব ব্যবহারকারীদের নানা সংগঠন/গ্রুপ বা ফোরাম এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রনাধীন কোন ফোরাম থাকলে অভিযোগকারী সম্বন্ধে ব্যবস্থা নেবার জন্য অনুরোধ করতে হবে। এসমস্ত গ্রুপ বা ফোরাম একটা জুরি বোর্ড তৈরি করে তাৎক্ষণিকভাবে নির্যাতনের সত্যতা যাচাই করতে পারে এবং উহার আওতাধীন শাস্তি আরোপ শেষে সাইবার থানাকে সুপারিশ করতে পারে।
৭. বিচার-ব্যবস্থা, শাস্তি প্রদান ও বিধিনিষেধ আরোপ: সাইবার থানা তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ ও তদন্ত পরিচালনা সাপেক্ষে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করবে এবং অভিযুক্তের অপরাধ প্রমাণিত হলে আদালত আইনানুসারে (আইনজ্ঞরা যে আইন শীঘ্রই তৈরি করবেন বলে আশা করা যায়) কারাদন্ডসহ নানারকম শাস্তি প্রদান করবেন।

উপরোক্ত প্রতিবিধান মডেল বাস্তবায়নের জন্য সরকার ও অনলাইন গোষ্ঠীকে প্রচলিত অপরাধসমূহের তত্ত্ব তালাশের জন্য একযোগে গবেষণা পরিচালনা ও বিশ্লেষণ করতে হবে। ইতোমধ্যে Shout against online harassment in Bangladesh (http://www.facebook.com/#!/groups/167836733291166/) নামে ফেসবুকে একটা গ্রুপ খোলা হয়েছে যেখানে কেউ যদি ওয়েবে কোনরূপ নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে, তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারে। যেকোন ধরনের হুমকি, যৌন নিপীড়ন, বর্ণ পরিচয়ের কারণে অবমাননাসহ যা যা নির্যাতন বলে অনুমান করা যায় সেগুলির ভিত্তিতে একটা আর্কাইভ তৈরি করার প্রচেষ্টা। অনলাইন নির্যাতন প্রতিরোধে যা তথ্য-ব্যাংক হিসাবে কাজ করবে। আইনজ্ঞরা এক্ষেত্রে এখনই যদি এগিয়ে না আসেন তবে বাংলাদেশের বর্ধিষ্ণু সাইবার পরিসর ক্রমশ ব্যবহার অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে জাতীয় উন্নয়নের পরিবর্তে একদল ভার্চুয়াল দাঙ্গা-ফ্যাসাদকারীর উদ্ভব ঘটবে এবং সাইবারে সামাজিক অপরাধের শিকার হবে দেশের প্রতিজন সাইবার ব্যবহারকারী যা নিরুৎসাহিত ও বাধাগ্রস্থ করবে তথ্য প্রযুক্তি প্রসার তথা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার বাস্তবতাকে।

কৌশিক আহমেদ : ব্লগার ও গল্পলেখক।