কোরবানির প্রথা, লাল নদী দর্শন ও কিছু ভাবনার খোরাক

আকতার হোসেন
Published : 22 Sept 2016, 02:09 PM
Updated : 22 Sept 2016, 02:09 PM

এবার ঈদুল আযহার দিন প্রবল বর্ষণের কারণে ঢাকার রাজপথে সৃষ্ট 'লাল নদী' দেখে অনেকে অবাক হয়েছেন। অথচ এমন লাল নদী অনেক আগেই ড. মীজান রহমান দেখতে পেয়েছিলেন। কানাডার অটোয়াস্থ কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের খ্যাতনামা অধ্যাপক মীজান রহমান তাঁর 'লাল নদী' গ্রন্থে আজ থেকে ১৫ বছর আগে তার বর্ণনা দিয়েছেন।

তিনি লিখেছিলেন–

"আমার স্বপনের সংক্ষিপ্ত বিবরণটা দেই তাহলে। আমি একটি নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে আছি… হঠাৎ চোখে পড়ল এক অদ্ভুত দৃশ্য। নদীর কূলে একটা জায়গায় স্তূপ করে রাখা হাজার হাজার গরুর চামড়া। একটার পর একটা তাক করে সাজানো। চামড়াগুলো এত সুন্দর করে ছড়ানো যে মাথার শিং দুটিও অক্ষত রয়ে গেছে… কিন্তু গরুর চামড়া দেখে আমি বিচলিত হইনি। বিচলিত হয়েছিলাম নদীটির রং দেখে। লাল রঙয়ের পানি। লাল রঙয়ের নদী আপনারা দেখেছেন কখনো? মুক্তিযুদ্ধের সময় হয়তো আপনারা দেখেছেন অনেকে, কিন্তু আমি দেখিনি। এবারই আমি প্রথম দেখলাম লাল দরিয়া। করমচার চেয়েও লাল। গোলাপের চেয়েও লাল। রক্তের মতো। ঠিক রক্তের মতো লাল।"

মীজান রহমান গত বছরের ৫ জানুয়ারি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তা না হলে তিনি তাঁর স্বপনের 'লাল নদী' প্রিয় বাংলাদেশে বসেই বাস্তবে দেখতে পারতেন! মীজান রহমান দেখে যেতে পারেননি। তবে যারা এবার ঈদে সেই নাল নদী দেখলেন তাদের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হল কে জানে!

অনেকে অবশ্য এর জন্য প্রশাসনকে দায়ী করছেন। ঠিকমতো তাদের দায়িত্ব পালন করলে হয়তো এমন অবস্থা হত না। কেউ বলছেন, এর পেছনে নাগরিকদের সচেতনতার অভাব রয়েছে। যত্রতত্র পলিথিন ব্যাগ, চিপসের প্যাকেট, কারখানার বর্জ্য ইত্যাদি ফেলে অচল করে দিয়েছে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা। যদি বৃষ্টির পানি ঠিকমতো ড্রেন দিয়ে চলে যেত তবে এই লাল নদী কাউকে দেখতে হত না। আসলে কি কথা ঠিক? লাল নদী হয়তো দেখতে হত না, তবে লাল নদীর উৎস কি বন্ধ হত?

জানা গেছে এ বছর ঈদ উপলক্ষে গোটা বিশ্বে এক কোটিরও বেশি পশু কোরবানি দেওয়া হয়েছে। শুধু ইন্দোনেশিয়াতেই ছয় লাখ পশু জবাই করা হয়েছে। সমগ্র বাংলাদেশের কথা বাদ দিন। একবার ভেবে দেখুন ঢাকা শহরে কত পশু কোরবানি হলে এমন রক্ত নদী বয়ে যেতে পারে।

কোরবানিতে আল্লাহ খুশি হন। তাই সবাইকে পশু কোরবানি দিতে হয়। কোরবানির পেছনের কথা হল, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের পরীক্ষা নেন যে, তারা তাঁর কথামতো যার যার প্রিয় বস্তুকে কোরবানি (যার অর্থ হল ত্যাগ করা) করতে পারে কি না। প্রশ্ন হল, চেনা নেই জানা নেই হাটের থেকে দুদিন আগে কিনে আনা একটি পশু কী করে আমাদের প্রিয় হয়ে যায়? তাছাড়া ত্যাগ করার কথা 'বস্তু' সেটা কখন প্রাণিতে রূপ নিল সেটাই ভাবার বিষয়।

আমার কাছে পাকিস্তান আমলের ছাপানো দুটি কোরআন শরীফ আছে; আমি সেখানে 'বস্তু'ই দেখতে পাই। কিন্তু ইদানিং ছাপানো আর একটি কোরআন শরীফে দেখলাম 'বস্তু'র জায়গায় 'প্রাণি' লেখা হয়েছে। নানা বই-পুস্তক ঘেঁটে দেখা গেল, সে-ই মিশ্র উক্তি।

যাই হোক আমরা জানি, কোরবানির আদি ঘটনা। তারপরও একটি মিসিং লিংক থেকেই যায়। যারা ধর্ম নিয়ে পড়াশুনা করেন তাদের কাছে হয়তো জিনিসটা বোঝা সহজ। কিন্তু আমি যেটা বুঝতে পারি না সেটা হল, 'ঈদুল আযহা' কী করে 'কোরবানির ঈদ' হয়ে গেল। এই ঈদ এলেই চারদিকে শুধু একটাই কথা শোনা যায়: 'কোরবানি', 'কোরবানি' আর 'কোরবানি'। কোরবানির হাট, কোরবানির মূল্যহ্রাস, কোরবানির ফ্যাশন, কোরবানির ছুটি… উঠতে কোরবানি, বসতে কোরবানি; সবটাই কোরবানি। ঈদ কোথায়?

কাজী নজরুল ইসলাম যেমন লিখে গেছেন, 'ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ'– তেমনি করে কি অন্য কেউ কিছু লিখেছেন কীসের শেষে আসে এই কোরবানির ঈদ?

আমার জানা মতে, মুসলমানদের জন্য ফরজ বা বাধ্যতামূলক কাজ এই কোরবানি দেওয়া নয়। পশু কোরবানিকে সুন্নত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) যে সমস্ত কাজ করে গেছেন বা যে নির্দেশ দিয়ে গেছেন সেগুলো পালন করা সুন্নত। যেমন তিনি দাড়ি রাখতেন তাই মুসলমান পুরুষরা দাড়ি রাখে সুন্নত লাভের আশায়। আমদের নবী (সা.) খাবারের পর মিষ্টি খেতেন, তাই শোনা যায় মিষ্টি হল সুন্নত। সুন্নতের তালিকা অনেক বড়। তবে ফরজের তালিকাতে আছে মাত্র পাঁচটি বিষয়– (১) মহান আল্লাহর ওপর, তাঁর রসুলগণের ওপর এবং আসমানি কিতাবসমূহের ওপর বিশ্বাস করা, যাকে অনেকে 'কলেমা' বলেন; (২) নামাজ বা সালাত; (৩) রোজা; (৪) হজ্জ এবং (৫) যাকাত।

এ পাঁচটি ফরজের মধ্য দুটি হল কন্ডিশনাল বা শর্তযুক্ত। সে দুটি হল হজ্জ এবং যাকাত। যাকাত কেন কন্ডিশনাল তাঁর উত্তর সহজ। যিনি বিত্তবান বা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ধনসম্পদ বা সোনাদানা যার আছে শুধু সেই ব্যক্তি যাকাত দেবে। যারা গরীব তারা যাকাত দেবে না, বরং যাকাত নেবে। আর হজ্জের ব্যাপারে শর্ত হল যিনি পবিত্র নগরী মক্কাতে যাওয়ার মতো স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সমর্থ তিনি অবশ্যই একবার হলেও যেন হজ্জ পালন করেন। এই যে শর্তযুক্ত ফরজ হজ্জ, এর নানা নিয়ম-নীতির এক পর্যায়ে গিয়ে কোরবানি দেওয়ার রেওয়াজ আছে। অনেকেই হয়তো জানেন, তবুও হজ্জ পালনের সময় বিভিন্ন করণীয় বিষয়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় উল্লেখ করছি।

হজ্জের ফরজ তিনটি– (১) ইহরাম বাঁধা; (২) নির্দিষ্ট সময়ে আরাফাতের ময়দানে অবস্থান; (৩) তাওয়াফ জিয়ারত। এই তো গেল মূল অংশ, এরপর হজ্জের ওয়াজিব অংশগুলো হল; মুযদালিফায় অবস্থান, সাফা-মারওয়া সায়ী করা, শয়তানকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংখ্যার পাথর নিক্ষেপ, মাথার চুল কাটা ইত্যাদি। এরপরও রয়েছে কিছু সুন্নত। যেমন: মিনার উদ্দেশে রওনা হওয়া, নির্দিষ্ট কিছু নামাজ পড়া, গোসল করা, মক্কায় প্রবেশ ইত্যাদি।

যেটি বলার জন্য এত কিছু বলা তা হল, সব হাজীর জন্য নয়, কিছু কিছু হাজীর ক্ষেত্রে হজ্জের একদম শেষে এসে পশু কোরবানি দিতে বলা হয়েছে (বিস্তারিত জানতে বিজ্ঞ লোকদের পরামর্শ নিতে অনুরোধ করব কিংবা সহি কেতাবসমূহ পাঠ করে দেখতে পারেন)।

প্রথম কথা হল, হজ্জ সবার জন্য নয়। দ্বিতীয়ত এক ব্যক্তির প্রতি বছর হজ্জ করার কথা নয়। তাছাড়া হজ্জ পালনের অনেক নিয়মের একটি যা কি না একদম শেষের দিকে করা হয়, তা হল পশু কোরবানি। তা-ও আবার কোরবানি সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। তাহলে যেটা মক্কাতে বসে হাজীরা করেন সেটা আমরা বাংলাদেশে বা বিশ্বের নানা দেশে বসে করি কেন?

মিসিং লিংক এজন্য বলছি যে, যিনি হজ্জ পালনের জন্য পবিত্র মক্কা নগরীতে যাননি বা যেতে পারেননি তিনি কেন ঢাকায় বসে কোরবানি দেন? আর কোরবানি যদি দেবেনই তাহলে তার জন্য ঢাকায় বসে শয়তানের উদ্দেশে পাথর মারা কিংবা সাফা-মারওয়ার মতো দৌড়ে আসা– এ সমস্ত কিছু নিয়ম নেই কেন? শুধু গরুর হাট থেকে গরু কিনে বসে থাকা যে, কখন মক্কা থেকে খবর আসবে হজ্জ শেষ– তারপর শুরু হবে ছুরিকাঁচি নিয়ে কোরবানির প্রস্তুতি! তা-ও আবার জীবনে একবার নয়, গত বছর কিংবা তার আগের বছরগুলোতে নিয়মিত কোরবানি দেওয়ার পরও এ বছর দিতে হল, আগামী বছরগুলোতেও দিতে হবে।

আমরা ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের মা-বাবা তাদের নামে, আমরা যারা ছোট ছিলাম সেই সমস্ত সন্তানদের নামে, তাদের মৃত পিতামাতার নামে কোরবানি দিতেন। এখন আমরাও আমাদের নামে, আমাদের সন্তানদের নামে এবং আমাদের মৃত বা জীবিত পিতামাতাদের নামে কোরবানি দিচ্ছি। আমাদের সন্তানরাও তাই করবে। ছোটবেলায় আমাদের যখন পরীক্ষা নেওয়ার কথা না বা নিষ্পাপ শিশু ছিলাম তখনও আমাদের পরীক্ষার নামে পশু কোরবানি করা হত। মৃত মানুষ যারা পরীক্ষার বাইরে চলে গেছেন তাদের নামেও কোরবানি দেওয়া হয়। সমস্ত জীবনে শুধু একবার কোরবানি দিলে কি কোনো নিয়ম বা নির্দেশ অমান্য করা হবে?

সাধারণত এক পরীক্ষা একবারই দিতে হয়। কিন্তু একই পরীক্ষা সারা জীবন দিতে হচ্ছে তেমন শক্ত নিয়ম আমাদের জন্য কি সত্যি লিখে রাখা আছে? প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার বিধান কিন্তু ছয় ওয়াক্ত করার সুযোগ নেই। রোজার মাসে পুরো মাস ধরে রোজার কথা বলা আছে (চাঁদ দেখে রোজার নিয়ত কর… চাঁদ দেখে রোজা ভাঙ)। কিন্তু ত্রিশ রোজাকে একত্রিশ করার সুযোগ নেই।

তাই ভাবছি প্রতিটি বছর কোরবানি দিতে হবে এমন একটি নিয়ম যদি থেকে থাকে সেটা বহুল শ্রুত নয় কেন? সহজভাবে তার উত্তর পাইনি বলেই এই প্রশ্ন রাখছি। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল, পরীক্ষা আমার, কিন্তু পরীক্ষা তো দেয় একটি অচেনা অজানা পশু, যার কোনো পাপ নেই, পুণ্য নেই।

মীজান রহমান তাঁর 'লাল নদী'তে লিখেছিলেন–

"জীবের কষ্ট বোঝার ক্ষমতা আমাদের নেই, জীবের ভাষা বুঝতে যে-দরদ লাগে সে-দরদ নিয়ে আমরা জন্মাইনি… আর কিছু না বুঝলেও এটুকু বুঝি যে ওরা একেবারে নির্বোধ নয়। ওদেরও বুদ্ধি আছে, চিন্তা করবার ক্ষমতা আছে। ওরাও সুখ বোঝে, দুঃখ বোঝে। ওরাও ভয় পায়, চিৎকার করে কাঁদতে পারে, বিপদের আভাস পেলে মায়ের কাছে ছুটতে পারে আশ্রয়ের জন্য।"

দিনে দিনে কোরবানির অনেক প্রথাই পরিবর্তন হচ্ছে। এমন দিন হয়তো আসতে পারে যে ডিজিটাল পদ্ধতিতে টাকা পাঠিয়ে দিলে একটা কনফার্মেশন এসে যাবে। তারপর সেই কনফার্মেশনের কোড নিয়ে বসে থাকবেন। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ দেখবেন আর একটি মেসেজ চলে আসবে– 'আপনার কোরবানির কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। আমাদের সেবা নেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।' যাকে ডিজিটাল কোরবানি বলা যেতে পারে। কেন না কোরবানির বেসিক নিয়ম ঠিক রেখে কোথায় কীভাবে কোরবানি দেওয়া হল সেই খবর তো এখনই রাখা হচ্ছে না।

আমরা বাড়ির সামনে বসে কোরবানি দিই, কিন্তু আরব দেশেও নির্দিষ্ট কসাইখানায় গিয়ে কোরবানি দিতে হয়। শুধু ভরসা ও বিশ্বাস করে আমেরিকা-কানাডার মতো দেশের মানুষ গ্রোসারি স্টোরে গিয়ে ভাগের টাকা দিয়ে আসে। তারপর কোরবানির দিন মাংস নিতে গেলে দোকানদার একটা প্যাকেট ধরিয়ে দেয়। আমরাও সেই মাংসকে কোরবানির মাংস বলে পরম সুখে খাই। কোথায় গেল কোরবানির তিন ভাগের বাকি দুই ভাগ, তা কেউ ভেবে দেখে না।

এই যখন বর্তমান অবস্থা, আগামীতে কী হয় কে জানে। কোরবানি যদি চলতেই থাকে তবে এই ডিজিটাল ব্যবস্থাটি মনের আনন্দে স্বাগত জানাতে হবে। কেন না তাতে 'লাল নদী' দেখার ভয় থাকবে না।