নামে কী আসে যায়

পারভীন সুলতানা ঝুমা
Published : 19 Sept 2016, 04:12 AM
Updated : 19 Sept 2016, 04:12 AM

ইংরেজ কবি ও নাট্যকার শেক্সপিয়ারের 'রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট' নাটকের একটি সংলাপ হল– 'হোয়াটস ইন আ নেইম।' বাংলায় এর তর্জমা দাঁড়ায়, 'নামে কী আসে যায়'। নিঃসন্দেহে সবচেয়ে ব্যবহৃত উদ্ধৃতির একটি এটি। তবে নামে কিন্তু সত্যি সত্যি কিছু আসে যায়, বিশেষ করে মানুষের নামের ক্ষেত্রে। নিজের নামের প্রতি দুর্বলতা নেই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। পিতৃদত্ত ('মাতৃদত্ত' কেউ বলে না) নামটি পছন্দ না-ও হতে পারে, কিন্তু তা যদি বিকৃতভাবে উচ্চারিত হয় বা ভুল বানানে লেখা হয় তখন বিরক্তির সীমা থাকে না!

স্নাতক পর্যায়ে সাংবাদিকতা পড়তে গেলে প্রথম ক্লাসেই শিক্ষকদের কাছ থেকে এ বিষয়ে সতর্ক হওয়ার উপদেশ শোনা যায়। পরবর্তীতে সেই শিক্ষা বাস্তাবিক জীবনে প্রয়োগ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেও ছাপাখানার ভূতের কারণে হেরফের হলে ভৎর্সনা শোনা থেকে রেহাই পেয়েছেন এমন অভিজ্ঞতা কম সাংবাদিকের আছে। যারা আন্তর্জাতিক ডেস্কে কাজ করেন, পূর্ব ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা বা অপরিচিত অঞ্চলের অপরিচিত 'বিদঘুটে' নাম নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। বাংলায় অনুবাদ করতে গিয়ে গলদঘর্ম হতে হয় সহ-সম্পাদকদের। অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসে ফোন করে সঠিক উচ্চারণটি জেনে নিতে হয়।

মনে আছে, আশির দশকে যখন 'নিউ নেশন' পত্রিকার আন্তর্জাতিক ডেস্কে কাজ করতাম, তখন কয়েকটি নাম নিয়ে খটমট লাগত। তার মধ্যে একটি তৎকালীন সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী এডওয়ার্ড এমভসিভিস শেভানাজডে (এখনও ঠিকমতো লেখা হয়েছে কি না, জানি না)। প্রায়ই কম্পোজ বিভাগ থেকে কেউ না কেউ ছুটে এসে নামটি নিশ্চিত করে যেত। কারণ, আমাদের হাতের লেখা কপি নিয়ে তাদের কিছুটা সংশয় থাকত।

প্রত্যেক মা-বাবার কাছে সন্তানের নাম অনেক আবেগের। আকাঙ্ক্ষিত সন্তানের জন্য পৃথিবীর সেরা নামটি মা-বাবা চান সন্তানকে দিতে। সে জন্য কানা ছেলের নাম পদ্মলোচনও রাখা হয়। সন্তানের নামকরণ বিষয়টি ধর্মের দিক দিয়েও একটা জরুরি ব্যাপার। ইসলাম ধর্মে নবজাতকের নাম আকিকা দিয়ে রাখা সুন্নত। মেয়ে-শিশু হলে বকরি, ভেড়া, ছাগল যা-ই হোক একটি দিলে চলে। ছেলে-শিশুর জন্য দুটি। মেয়ে-শিশুর অভিভাবকদের এই আর্থিক সাশ্রয় কেন, তা বোধগম্য নয়। এমন তো নয় যে, ভবিষ্যতে মেয়ের জন্য যৌতুক দিতে হবে বলে জন্মলগ্নের সময় খরচটি একটু কমিয়ে দেওয়া হল। পৃথিবীর যে এলাকায় আমাদের ধর্ম এবং সংশ্লিষ্ট আচার-অনুষ্ঠানের উৎপত্তি সেখানে তো কন্যাপক্ষকে বরং যৌতুক দিতে হয়।

অন্য ধর্মে শিশুর নামকরণের ক্ষেত্রে এ ধরনের বৈষম্য আছে কি না, জানা নেই। গুগল ঘেঁটে দেখলাম, ইহুদি ধর্মে ছেলে ও মেয়ের নামকরণ হয় ভিন্ন প্রথায়।

যাহোক, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ছেলে-শিশুর জন্মের সময় সবাইকে শুনিয়ে এবং মেয়ে-শিশুর বেলায় তার কানে কানে আযান দেওয়ার রীতি, পৈত্রিক সম্পত্তির ক্ষেত্রে বোনের ভাইয়ের অর্ধেক পাওয়ার নিয়ম, সাক্ষ্য দেওয়ার সময় একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের সমান দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী– এ বিধানগুলো যে কারণে প্রবর্তিত হয়েছে, সে-ই একই কারণে আকিকার সময় ছেলে-সন্তানদের জন্য পশু জবাই হয় দ্বিগুণ। এ ধরনের বৈষম্য প্রতিটি ধর্মেই রয়েছে। তবে চর্চিত যুক্তি আবার হয়তো কেউ মনে করিয়ে দেবে যে, জাহেলিয়াতের যুগে মেয়ে-শিশুকে জ্যান্ত কবর দেওয়া হত, সেখানে আকিকায় একটি ছাগল জবাই বহুত কিছু।

নিজের নামের প্রতি অনুরাগ যা-ই থাকুক, কোনো কোনো সময় অপর কারও নাম শুনলে পিত্তি জ্বলে যায়, এমনকি ত্রাসও সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানের জাঁদরেল সামরিক শাসকের নাপিত বঙ্গবন্ধুর নাম বলে তাঁর চুল কাটতেন বলে গুজব চালু আছে। নাপিত যখন কিছুতেই আইয়ুব খানের চুল বাগে আনতে পারত না তখন নাকি সে বঙ্গবন্ধুর নাম বলত, আইয়ুব খানের চুল আপনা-আপানি খাড়া হয়ে যেত! নাপিত তখন স্বচ্ছন্দে চুল কাটতে পারত।

হিটলারের নাম বর্বরতা-নিষ্ঠুরতা মনে করিয়ে দেয়, গান্ধী আর মাদার তেরেসার নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে শান্তি আর সেবা। অনেক সময় কীর্তির চেয়ে নামই বড় হয়ে দাঁড়ায়। পেলে মানে ফুটবল, হিচকক মানে ভয়ের আর রহস্যময় ছবি। এ রকম নাম আর কাম সমর্থক হয়ে উঠেছে আরও অনেকের বেলায়।

চলচিত্র বা সাহিত্যের জগতের কিছু চরিত্রের নাম এতটা বাস্তবিক হয়ে ওঠে যে, মনে হয় যেন তারা সশরীরে পৃথিবীতে বিদ্যমান। শার্লক হোমসের নামে এখনও লন্ডনের ২২১, বেকার স্ট্রিটে চিঠি আসে। শেক্সপিয়ারের 'রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট' নাটকের রোমিও যদিও একজন প্রেমিক পুরুষ, কিন্তু বাংলাদেশে বখাটে আর রোমিওর নাম সমর্থক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে কী কারণে, তার ইতিহাস জানা নেই।

কবি সাহিত্যিকদের 'পেন নেইম' নেওয়ার প্রবণতা সব দেশে ও সমাজেই আছে। সেই নামের দাপটে তাদের আসল নাম বলা যায় চিরতরে হারিয়ে যায়। আর হারিয়ে যায় আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলের বিবাহিত নারীদের নাম। একসময় গ্রাম-শহর নির্বিশেষে নারীদের নাম বিয়ের পরপরই হারিয়ে যেত। 'তোমরা ভুলে গেছ মল্লিকাদির নাম' গানটি তো জীবন থেকেই নেওয়া। সম্ভ্রান্ত পরিবারের বেলায় তাঁরা হন 'বড় বউ', 'মেজ বউ', 'মিঞা বাড়ি বা চৌধুরী বাড়ির বউ'। আর দরিদ্র শ্রেণিতে হলে 'কামাইল্যার বউ' বা 'গোপারের বউ'। সন্তান জন্মের পর 'অমুকের মা', 'তমুকের মা'। ধীরে ধীরে তিনি নিজেই তাঁর নাম ভুলে যান। যদি কালেভদ্রে বাবার বাড়িতে যাওয়া হত তখন তাঁর নিজের নামটি শুনে হয়তো চমকে যেতেন।

বয়সে বড় যারা তাদের নাম ধরে ডাকা আমাদের দেশে চরম বেয়াদবি হলেও পাশ্চাত্যে দশ বছরের ছেলেকে পাশের বাড়ির সত্তর বছরের বৃদ্ধকে নির্দ্বিধায় 'মিস্টার জনসন' বা 'মিস্টার ডেভিড' বলে ডাকতে শোনা যায়। একসময় শ্বশুর, ভাসুরের নাম উচ্চারণ ছিল চরম বেয়াদবি। ভাসুর-স্বামীর নাম যদি কোনো ফল বা সবজি অথবা রঙের হত, তাহলে সেগুলোর নাম উচ্চারণ করাও ছিল নিষিদ্ধ। স্বামী-স্ত্রী পরষ্পরকে 'ওগো শুনছ', 'কোথায় গেলে' বলার চল এখনও আছে।

বিবাহিত মেয়েদের নামের পিছনের অংশ খসে গিয়ে সেখানে স্বামীর পদবি ব্যবহার করার রীতি কবে কখন শুরু হয় জানা নেই। এ অঞ্চলের নারীরা 'মিসেস অমুক', 'মিসেস তমুক' হতে শুরু করেন ব্রিটিশ আমলে। তাদের প্রকৃত নাম নিয়ে তখন কারও মাথাব্যথা ছিল না, এমনকি তাদের নিজেদেরও।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন একজন অত্যন্ত চৌকস ছাত্রীর সঙ্গে এ নিয়ে আমার কিঞ্চিত বিতর্ক হয়। তার মতে, নামের পিছনে স্বামীর পদবি ব্যবহার করাটা তার কাছে 'থ্রিলিং-থ্রিলিং' লাগে। জানি না মেয়েটি বিয়ের পর স্বামীর নাম গ্রহণ করে 'ধন্য' হয়েছিল কি না। একজন নারীবাদী লেখিকাকে দেখেছি নামের পেছনে তার বিখ্যাত স্বামীর নামের প্রায় পুরোটা জুড়ে রাখতেন। এ প্রসঙ্গে সেই নারীবাদী লেখিকাকে জিজ্ঞাস করলে উত্তর ছিল, "বুঝ না, যখন প্রথম লেখা শুরু করি কে আমাকে চিনত? স্বামীর নামটি তাই নিয়েছি।"

বুঝলাম বাপের নাম ভাঙানোর মতো স্বামীর নামও ভাঙানো যায়!

দুঃখ হয় পাশ্চাত্যের নারীদের জন্য। যতই তারা নারীর স্বাতন্ত্র্যের কথা বলুক, এ ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে আছে। বিয়ের পর 'মেইডেন নেইম' ঝেড়ে ফেলে দিতে হয়। লন্ডনে একটি কোর্স করতে গেলে একজন আমাকে জিজ্ঞাস করেন, "তোমার স্বামী মিস্টার সুলতানা কী করেন?"

আমি বললাম, "আমার স্বামী মিস্টার সুলতানা নয়, মিস্টার চৌধুরী।"

তিনি হা করে তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে।

আমার প্রবাসী কন্যা ও তার শাশুড়ি উভয়ের নামের পদবি 'চৌধুরী', কিন্তুু বানান ভিন্ন। তারা উভয়েই বাবার পদবি ব্যবহার করেন। কোনো কাজে তারা গেলে পদবির বানান দুরকম। এ ভুল সংশোধন করতে গিয়ে অন্যরা যখন শোনেন বৌ-শাশুড়ি একই চৌধুরী নয়, তখন তাদের দ্বিধাযুক্ত মুখ দেখে করুণাই হয়!

আমরা জপি সৃষ্টিকর্তার নাম। কবি বলেছেন, 'তোমরই নাম আমি বলব নানা ছলে।' বিপদে-আপদে তাঁর নাম আপনাআপনি মুখ থেকে বের হয়ে যায়। আল্লাহর ৯৯টি নামের একেকটি একেক অর্থ বহন করে। সব ধর্মের মানুষরাই সৃষ্টিকর্তার নাম নেয়, ধর্ম-অনুসারে নাম ভিন্ন হলেও গন্তব্য কিন্তু একটাই।

প্রেমিক-প্রেমিকার কাছে পরষ্পরের নাম সব কিছুর ঊর্ধ্বে। কবি বলেছেন, 'ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে।' সবার প্রিয় গান, 'যদি কাগজে লিখ নাম কাগজ ছিড়ে যাবে, পাথরে লিখ নাম পাথর ক্ষয়ে যাবে, হৃদয়ে লিখ নাম সে নাম রয়ে যাবে।' তারপরও নিজের হাতে ছুরি দিয়ে প্রেমিকার নাম লেখা অনেক তরুণের কাছে প্রেমপ্রদর্শনের এক মাধ্যম।

কিছু নাম আছে 'নিউটার জেন্ডার'। তার ভোগান্তি কীভাবে পোহাতে হয় এ ধরনের নামওয়ালাদের, তা বলে শেষ করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর শামীম আখতার নামের এক ছাত্রকে রোকেয়া হলের সঙ্গে অ্যাটাচ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। ছেলেটির তখন যে ভোগান্তি হয়েছে তাতে একসময় তার মনে হচ্ছিল যে, চিকিৎসকের কাছে গিয়ে লিঙ্গ পরিবর্তন করে নেওয়া বোধহয় এর চেয়ে অনেক বেশি সহজ ছিল!