প্রচারবিমুখ সংগ্রামী পুরুষ শিল্পী ইমদাদ হোসেন

কামাল লোহানী
Published : 1 Oct 2011, 07:23 PM
Updated : 14 Nov 2011, 04:38 PM

সংগ্রামী চিত্রকর ইমদাদ হোসেন আর নেই। অসাম্প্রদায়িক চেতনার বলিষ্ঠ মানুষটি ৮৫ বছরের জীবনে কেবল জনগণের মুক্তির কথাই চিন্তা করেছেন। নির্লোভ শিল্পী ইমদাদ হোসেন ছিলেন নিরহঙ্কারী প্রচারবিমুখ এক সংগ্রামী মানুষ। তাই তাঁর দীর্ঘজীবনের অধিকাংশ সময় জুড়েই রয়েছে ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত যুদ্ধের ইতিহাস। বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতি চর্চা ও সংরক্ষণে তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ এক কর্মী পুরুষ।

বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে কেরানীগঞ্জ রোহিতপুরে তাঁর পৈত্রিক নিবাস। কিন্তু জন্ম তাঁর চাঁদপুরে ১৯২৬ সালের ২১ নভেম্বর। শৈশব আর স্কুল শিক্ষা তার কেরানীগঞ্জেই। কিন্তু ১৯৪৮ সালে আর্ট কলেজের দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন ইমদাদ হোসেন। শিল্পী হামিদুর রহমান, খালেদ চৌধুরীদের সহশিক্ষার্থী হিসেবে এই শিক্ষাঙ্গনই তাকে সমৃদ্ধ করেছিল সংগ্রামে।

সেই পথ-পরিক্রমায়ই তিনি ভাষা সংগ্রামী থেকে মুক্তিযোদ্ধা। পাকিস্তান শাসনামল থেকে বৈষম্য, অধিকারহীনতার বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে নীরবেই এ দীর্ঘ জীবন কাটিয়ে দিয়ে গেলেন। এমদাদ ভাই এমন মানুষ ছিলেন যে কাজ করে কোন প্রচার চাইতেন না বলে তিনি কী করেছেন অনেকেই আমরা সে কথা যানি না। ফলে অনেকে তাঁর কীর্তিকে 'নিজ কৃতিত্ব' বলে দাবিও করেছেন।

এই প্রতিবাদী সংগ্রামী মানুষটি শিক্ষা জীবন থেকেই লড়াকু ছিলেন। তাইতো দেখি ভাষা আন্দোলনের সময় সহায়ক শক্তি হিসেবে আর্ট কলেজের শিক্ষার্থীরা শতশত হাতে লেখা পোস্টার দিয়ে সংগ্রামকে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। শিল্পী-শিক্ষক কামরুল হাসানের নেতৃত্বে ইমদাদ হোসেন, আমিনুল ইসলাম, নিজামুল হক প্রমুখ আঁকতে এসে লিখেছিলেন ভাষা আন্দোলনের পোস্টার। শুনেছি, ইমদাদ ভাই এত দ্রুত একটি পোস্টার লিখতেন যে মনে হতো মেশিন যেন। মিনিটে একটি করে পোস্টার লিখেছেন তিনি। তখনতো বহুবর্ণের ছাপানো পোস্টার ছিল না। খবরের কাগজে মাটির পাত্রে গোলানো রং দিয়ে লেখা হতো। লেখার হাতিয়ার ছিল পাটখড়িতে ন্যাকড়া পেচানো একটি 'কলম' যা পোস্টার লেখাতেই ব্যবহৃত হতো। শুধু কি তাই, এই দেশকে শত্রুমুক্ত করার চূড়ান্ত লড়াই পর্যায়ে চারুশিল্পীদেরও সংগঠিত করেছিলেন ইমদাদ ভাই চারুশিল্পী সংসদের মাধ্যমে।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, সেটি তারই সতীর্থ হামিদুর রহমান এবং ভাস্কর নভেরা আহমদের নকশায় নির্মিত কিন্তু আজও অসম্পূর্ণ, মুক্তিযুদ্ধোত্তর এই বাংলায় শিল্পী ইমদাদ হোসেন তাঁর সৃজনী প্রতিভার স্বাক্ষর হিসেবে নয় তার সংগ্রামের সহযোদ্ধাদের ইস্পাত দৃঢ় অঙ্গীকারের প্রতীক হিসেবে স্থাপন করলেন একটি 'লাল সূর্য'। শহীদ মিনারের মূলস্তম্ভের পেছনটা জুড়ে ঐ বিশাল আকৃতির লাল সূর্যের সামনে আজ যেই দাড়াক না তারই মনকে শক্তি আর সাহসে উদ্দীপ্ত করে। এই সূর্য সে উত্তাপ ছড়ায় সমবেত মানুষের মনে, তা যতদিন না আক্রান্ত হবে ততদিন শিল্পী ইমদাদ হোসেন স্মৃতিতে ভাস্মর হয়ে থাকবেন।

আগের দিনে অমর একুশে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষেও সারা মহল্লা, স্কুল কলেজ, সংস্থা সংগঠন থেকে শতশত ক্ষুদে সাময়িকী বা সংকলন বেরুতো। আজ অবশ্য বহু বছর থেকেই তার চল উঠে গেছে। তখনকার এ উদ্যোগেও ইমদাদ ভাই সহযোগী ছিলেন এবং বহু সংকলনের প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছেন স্বেচ্ছায়। পঞ্চাশ দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদ গঠিত হলে ইমদাদ ভাইরা অনেকেই তখন তাদের আমন্ত্রণলিপি কিংবা মঞ্চসজ্জা এমনকি আলোক বিন্যাসেও পরামর্শ দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে।

সামরিক শাসনকাল যখন শুরু হলো পাকিস্তানে, সেই সময় বাংলার সংস্কৃতিকে অগ্রাহ্য করে পাকিস্তানি কালচার বা তাহজীব-তমুদ্দুন চালু করতে চাইলো, তখন এই বাংলা রুখে দাড়িয়েছিল ভাষা সংগ্রামে উদ্দীপ্ত হয়ে। লড়ে গেছি আমরা প্রবল প্রতাপে, গৌরবে উজ্জল ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন ইমদাদ ভাই ও সহযোদ্ধা শিল্পী-সাহিত্যিকরা। রবীন্দ্র শতবর্ষ উদযাপনে এলো বাধা, তাকেও টপকে গিয়েছিলাম আমরা অমিত শক্তিতে বলীয়ান হয়ে। তখনই গড়ে উঠেছিল ছায়ানট নামের এই প্রতিষ্ঠানটি সংস্কৃতি সংগঠন হিসেবে, সমরনায়কদের শত বাধা আর রক্তচক্ষু সত্বেও রবীন্দ্রনাথকে আমাদের গৌরব বলে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলাম প্রতিবাদী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। সেই থেকে ইমদাদ ভাই, বিপ্লবী সহশিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুণ্ডুবাও ছিলেন এই লড়াইয়ে। প্রতিরোধে প্রতিবাদের লোকসংস্কৃতি উঠে এসেছিল। ইমদাদ ভাই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়েছেন পঞ্চাশ-ষাটের দশকে কিন্তু অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা গড়ে তুলেছিলেন এবং লালন করেছেন জীবনভর।

বাংলার আপামর জনগণের সহস্র বছরের লালিত সংস্কৃতি জীবন ও কর্ম সংস্কৃতির বহি:প্রকাশ পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ পালন, নবান্ন উৎসব, শারদোৎসব, বর্ষামঙ্গল, বসন্তোৎসব বঙ্গ-সংস্কৃতি– এই সব উৎসব ষাটের দশক থেকে নগর জীবনেও মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। এ সবের নেপথ্য কারিগরদের একজন ইমাদাদ ভাই। তিনি চলে গেলেন, রেখে গেলেন আদর্শ, লড়াই-সংগ্রামের অমর দৃষ্টান্ত। এরই মাঝে তিনি অমর হয়ে থাকবেন আমাদের মধ্যে।

কামাল লোহানী : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।