তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা: ইতিহাসের পুনর্পাঠ

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 3 Oct 2016, 04:18 AM
Updated : 3 Oct 2016, 04:18 AM

প্রাকৃতজন অধ্যয়ন শাস্ত্রের (Subaltern Studies) জনক রণজিৎ গুহ ঔপনিবেশিক সূত্রে প্রাপ্ত এলিটবাদের প্রভাব মুক্ত হয়ে নিম্নবর্গের অবস্থান হতে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস পুনর্পাঠের চেষ্টা করেছেন। রণজিৎ গুহের ইতিহাসের পুনঃঅনুসন্ধান ইতিহাসের কোনো নির্মোহ পাঠ নয়, বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ, বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর প্রেক্ষাপট হতে ঐতিহাসিক ঘটনাবলি বোঝার প্রচেষ্টা। ফলে, এলিট-কেন্দ্রিক ভারতীয় ইতিহাসের যে ব্যাখ্যা তাঁর থেকে প্রাকৃতজন অধ্যয়ন শাস্ত্রের অনুসারী ইতিহাসবিদদের ঐতিহাসিক ঘটনাবলির ব্যাখ্য়ায় রয়েছে বড় দাগে প্রভেদ।

শারমিন আহমেদ তাঁর 'তাজউদ্দীন আহমেদ নেতা ও পিতা' গ্রন্থে রণজিৎ গুহ বা প্রাকৃতজন অধ্যয়ন শাস্ত্রের অনুসারী ইতিহাসবিদদের মতো নিম্নবর্গের অবস্থান হতে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ না করলেও, পূর্বোক্ত ইতিহাসবিদদের মতোই ইতিহাসের ভিন্ন ব্যাখ্যা অনুসন্ধান করেছেন। শারমিন প্রতিষ্ঠিত, প্রচলিত ইতিহাসের পুনঃঅধ্যায়ন করলেও তিনি নির্মোহ হতে পারেননি এক জায়গায়; সেটা হল, তাঁর বাবা তাজউদ্দীন আহমেদের ক্ষেত্রে। সেটার প্রয়োজনও নেই অবশ্য, কারণ ইতিহাসের পাঠ কখনোই সম্পূর্ণ নির্মোহভাবে সম্ভব নয়।

আমরা সবাই কোনো না কোনো প্রিজম বা বীক্ষণ-যন্ত্রের সাহায্যে ইতিহাস পাঠ করি। শারমিন বাংলাদেশের অভ্যুয়কালীন এবং অভ্যুদয়-পরবর্তী একটি কালপর্বকে পর্যবেক্ষণ করেছেন, তাঁর পিতা তাজউদ্দীন আহমেদ যে বীক্ষণ-যন্ত্রের আলোকে সে সময়কার ইতিহাস দেখেছেন, সেই আলোকে। কৈশোরের চপলতার সাথে প্রাপ্তবয়সের প্রাজ্ঞতার অভূতপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়ে তুলে নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়।

লেখক হিসেবে শারমিনের কৃতিত্ব এখানেই যে, তিনি শুধু ওখানেই আবদ্ধ না থেকে তৎকালীন ইতিহাস বোঝার চেষ্টা করেছেন ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকেও। আর এ ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে তিনি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই ব্যক্তিত্বের আন্তঃসম্পর্ক; দেশ, জাতি, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাঁদের ভাবনা-চিন্তা এবং তাঁদের বৈপরীত্য। এটা করতে গিয়ে তিনি ইতিহাসের কিছু রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করিয়েছেন; এ বাস্তবতার পুনর্মূল্যায়ণ, পুনঃঅধ্যয়ন জাতি হিসেবে আমাদের সমৃদ্ধ করবে বলেই আমার মনে হয়েছে। যে দুজন ব্যক্তিত্বের আন্তঃসম্পর্ক শারমিনের গ্রন্থের মূল উপজীব্য তাঁর একজন হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং আরেকজন তাজউদ্দীন আহমদ।

বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে সম্পর্ক আধুনিক মানব ইতিহাসের দুজন গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাবিদ, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের জনক কার্ল মার্ক্স এবং ফ্রেডারিক এঙ্গেলসের মতো হতে পারত। এঙ্গেলস নিজে একজন বড় মাপের চিন্তাবিদ হওয়া সত্ত্বেও সমস্ত ব্যাপারেই মার্ক্সকে গুরু মেনেছেন, ফলে মার্ক্সের কোনো চিন্তাধারার সাথেই তিনি দ্বিমত করেননি এবং তাঁদের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কে কখনোই চিড় ধরেনি।

এঙ্গেলসের মতো তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুকে সব ব্যাপারে নেতা মানলেও এবং মুসলিম লীগের রাজনীতি দিয়ে দুজনের রাজনৈতিক জীবন শুরু হলেও রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে এ দুজন ব্যক্তিত্ব প্রভাবিত হয়েছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী রাজনৈতিক চিন্তাধারা দ্বারা। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রভাবে বঙ্গবন্ধু শুরু থেকেই ছিলেন পাশ্চাত্যের উদারনৈতিক গণতন্ত্র এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতির সমর্থক। অন্যদিকে, তাজউদ্দীন আহমেদ প্রভাবিত হয়েছিলেন সমাজতান্ত্রিক চিন্তা চেতনার দ্বারা।

অবশ্য মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারাতে পরিবর্তন ঘটে এবং তাজউদ্দীনের মতো তিনিও পুঁজিবাদী অর্থনীতির পরিবর্তে সমাজতান্ত্রিক ধারায় দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করেন।

শুরু থেকে এ বিপরীতমুখী চিন্তাধারাই খুব সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন এবং মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী দেশ ও জাতি গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে তাঁদের চিন্তা ও কর্ম পদ্ধতির মধ্যে ফারাক তৈরি করে। তবে এ ফারাক কখনোই দুজন ব্যক্তিত্বের মাঝে দ্বন্দ্ব তৈরি করেনি। মুজিব এবং তাজউদ্দীনের সম্পর্ককে অনেকটা মহাত্মা গান্ধী এবং জওহরলাল নেহেরুর মাঝে যে সম্পর্ক ছিল, সে রকম বলা যায়।

নেহেরু গান্ধীকে সবসময় তাঁর নেতা এবং গুরু মনে করলেও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন এবং স্বাধীনতা-উত্তর ভারত গড়ে তোলা নিয়ে গান্ধী এবং নেহেরুর চিন্তাধারা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। এ বৈপরীত্য সত্ত্বেও নেহেরু যেমন গান্ধীর কোনো সিন্ধান্ত চ্যালেঞ্জ না করে বিনাবাক্যে মেনে নিয়েছেন, তাজউদ্দীনও তেমনি বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলেও মেনে নিয়েছেন এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি সবসময় অনুগত থেকেছেন।

দুজনের চিন্তাধারার বৈপরীত্যের বড় আকারে প্রথম প্রকাশ দেখা যায় স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দানের বিষয়টি নিয়ে। শারমিন দাবি করেছেন, তাজউদ্দীন মুজিবের সাথে আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেবেন– এ ব্যাপারে কথা বলেছিলেন এবং মুজিব এতে রাজি হয়েছিলেন। তিনি মুক্তিসংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্বের উদাহারণ টেনে বঙ্গবন্ধুকে আত্মগোপনে গিয়ে নেতৃত্ব দিতে বলেছিলেন। বস্তুত এ জায়গাটিতে বঙ্গবন্ধুর সাথে তাজউদ্দিনের চিন্তাধারার মৌলিক তফাত ধরা পড়ে।

বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজস্ব ব্যক্তিত্বের কারণে বাম রাজনীতিকদের মতো আত্মগোপনে যাওয়ার রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। আত্মগোপন বা আন্ডারগ্রাউন্ডে যাওয়ার বিষয়টিকে তিনি কাপুরুষোচিত বিষয় মনে করতেন। ফলে, পাকিস্তান আমলে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে তিনি কখনও আত্মগোপনে না গিয়ে বরং জেলে গিয়েছেন, আদালতের মুখোমুখি হয়েছেন। পাশাপাশি তিনি বিদেশে থেকেও আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। অপরদিকে, বাম চিন্তাধারায় প্রভাবিত তাজউদ্দীন আহমেদ মনে করেছেন, বঙ্গবন্ধুর উচিত লেনিন, মাও বা ফিদেল কাস্ত্রোর মতো আত্মগোপন বা ভিন্ন দেশে গিয়ে মুক্তিসংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া।

১৯৭১ সালে মুজিব পরিণত হয়েছিলেন বাঙালির জাতিসত্তার প্রতীক হিসেবে। জাতি হিসেবে বাঙালির মান, সম্মান, সাহসিকতা সবকিছুর মূর্ত প্রতীক তখন বঙ্গবন্ধু। তাই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ প্রবল পরাক্রমশালী পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন নিরস্ত্র, ঘুমন্ত বাঙালির ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে মুহূর্তে তিনি নিজের জীবন বিপন্ন হতে পারে জেনেও আত্মগোপনে না গিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মোকাবিলা করা জাতির নেতা হিসেবে শ্রেয় মনে করেছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সামনে তিনি বাঙালি জাতিকে দুর্বল বা ভীরু হিসেবে প্রমাণ করতে চাননি। তিনি ভেবেছিলেন ওই মুহূর্তে আত্মগোপনের সিদ্ধান্ত পাকিস্তানি সামরিক জান্তার কাছে বাঙালি জাতির ভীরুতার প্রতীক হিসেবে প্রতীয়মান হবে। তাই তিনি সারা জীবন যে কাজটি করেননি অর্থাৎ, আত্মগোপনে না যাওয়া– সে সিদ্ধান্তেই অটল থাকেন।

তবে বঙ্গবন্ধুর আত্মগোপনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিক বলে প্রতীয়মান হয় না। তিনি যে অনেক ভেবেচিন্তে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন– সেটি বোঝা যায় শহীদ প্রকৌশলী এ. কে. এম. নুরুল হককে ২৫ মার্চের আগে ট্রান্সমিটার জোগাড় করতে বলা, যে ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা প্রেরণ করেন। অর্থাৎ, জাতি যে সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের দিকে এগোচ্ছে– এ বিষয়ে তিনি পুরোপুরি সচেতন ছিলেন। এবং এ মুক্তিসংগ্রামে তিনি কী ভূমিকা পালন করবেন– সে ব্যাপারেও মনঃস্থির করে রেখেছিলেন।

ইতিহাস প্রমাণ করে বঙ্গবন্ধুর এ ভূমিকা সঠিক ছিল; বাংলার মুক্তিসংগ্রামীদের কাছে তখন 'বাঙলা মা' এবং বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করা সমার্থক হয়ে উঠেছিল। আর এ মুক্ত করার লড়াই যাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছিল, তিনি হলেন তাজউদ্দীন।

জাতির সবচেয়ে সংকটময় মুহূর্তে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন এবং এ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসের যুগ-সন্ধিক্ষণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তাজউদ্দীন। বস্তুত, ২৫ মার্চ পরবর্তী সময়ে জাতীয়, আন্তর্জাতিক নানা ষড়যন্ত্র, সংকট মোকাবিলা করে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করা এবং সফলভাবে এর নেতৃত্ব দেওয়ার দুরূহ কাজটি অত্যন্ত সফলতার সাথে তাজউদ্দীন পরিচালনা করতে পেরেছিলেন বলেই বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করতে পেরেছিল।

শারমিন আহমদ অবশ্য শুধুমাত্র তাজউদ্দীন আহমদের এ গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাকেই মুক্তিযুদ্ধের মূল নিয়ামক হিসাবে দেখতে চান। অপরদিকে, বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী হওয়ার সিদ্ধান্ত তাঁর কাছে 'চরম নেতিবাচক' হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দী হওয়ার সিদ্ধান্ত এবং একইসাথে শেখ মণি, সিরাজুল আলম খান প্রমুখের নেতৃত্বে 'বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স' (বিএলএফ) গঠন করা, যেটি সাধারণের মাঝে 'মুজিব বাহিনী' নামে পরিচিত ছিল, দুটোকে একসাথে মিলিয়ে ব্যরিস্টার আমিরুল ইসলামকে উদ্ধৃত (পৃষ্ঠা ১৪৯ এবং ১৫১) করে শারমিন বঙ্গবন্ধু 'স্বাধীনতার জন্য নেগশিয়েটেড সেটেলমেন্ট' চেয়েছিলেন– এ রকম একটা অণুসিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। এটা আমার কাছে মুজিব সম্পর্কে অতীব সরলীকৃত বিশ্লেষণ মনে হয়েছে।

শারমিন আহমদের লেখা থেকেই জানা যায়, মুজিব ষাটের দশকের শুরু থেকেই কীভাবে দেশকে স্বাধীন করা যায়– এ নিয়ে চিন্তাভাবনা এবং কাজ শুরু করেছিলেন। ফলে তিনি 'নেগশিয়েটেড সেটেলমেন্ট'এ যাবেন– এটা একধরনের স্ববিরোধী যুক্তি হয়ে যায়। আর বঙ্গবন্ধু যখন তাঁর কোনো সহচরকে এ ব্যাপারে কিছু বলেননি বা ইঙ্গিত করেননি, বরং উল্টো নূরুল হকের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন, সেখানে শুধুমাত্র ধারণার (Speculation) উপর ভিত্তি করে মুজিব সম্পর্কে এ ধরনের সিদ্ধান্ত জামায়াত, মুসলিম লীগসহ যে সমস্ত দল স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, মুজিবকে তাঁরা যেভাবে মূল্যায়ন করে, সে মূল্যায়নকেই শক্তিশালী করবে।

১৯৭১ সালে যারা বিএলএফ গঠন করেছিলেন তাঁদের কেউ কেউ যেমন সিরাজুল আলম খান স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরোধিতায় নেমেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন হঠাৎ করে কেন বিএলএফ গঠন করা হল, তার লক্ষ্য, উদেশ্য কী ছিল– ইতিহাসের এ বিষয়টা এখন পর্যন্ত ততটা পরিষ্কার নয় নির্ভরযোগ্য গবেষণার অভাবে। তবে উল্লেখ্য যে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন শুধু বিএলএফই নয়, ভারত এবং বাংলাদেশে মুজিবনগর সরকারের বাইরে আরও অনেক বাহিনী গঠিত হয়েছিল, যাদের কেউ কেউ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করলেও তারা একইসাথে মুজিবনগর সরকারের অধীন মুক্তিবাহীনির সাথেও লড়াই করেছিল। বিশেষত, সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বাধীন সর্বহারা এবং 'চীনপন্থী' বিভিন্ন বাম দল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ গ্রুপগুলো বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত প্রথম সরকার অস্থিতিশীল করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে দেশ এবং জাতি গঠন বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে তাজউদ্দীনের চিন্তাধারার তফাৎ আরও প্রকটভাবে ধরা পড়ে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ তাজউদ্দীন দেশ প্রশ্নে এগোতে চাইলেন 'প্র্যাগমেটিক অ্যাপ্রোচ' থেকে।

অপরদিকে বঙ্গবন্ধুর কাছে বাঙালি মানে তখন ক্ষুদিরাম, সূর্যসেনদের মতো নিবেদিত প্রাণ বাঙালি; কিন্তু এ বাঙালি যে একইসাথে আবার মীর জাফর, গোলাম আজম– এ বিষয়টাকে তিনি আমলে নিলেন না। ফলে, খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে তাঁর দলের দক্ষিণপন্থী যে অংশটি যারা ১৯৭১ সালে গোপনে পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন করতে চেয়েছিল এবং যুদ্ধকালীন নানাভাবে তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধাচারণ করে আসছিল তাঁদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বুঝতে পারলেন না। আর এ বুঝতে না পারা ফল হচ্ছে তাজউদ্দিনসহ বাংলাদেশ প্রশ্নে নিবেদিত প্রাণ কিছু ব্যক্তিকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেওয়া।

আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থী অংশটিসহ স্বাধীনতাবিরোধী দল ও ব্যক্তিসমূহের কাছে উদারনৈতিক চরিত্রের অধিকারী বঙ্গবন্ধুর চেয়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া, প্রাগম্যাটিক অ্যাপ্রোচের তাজউদ্দীন অনেক ভীতির কারণ ছিলেন, যিনি শুরু থেকেই পাকিস্তানি যুদ্ধপরাধীসহ সকল যুদ্ধপরাধীর বিচার প্রশ্নে ছিলেন অনমনীয়। বস্তুত, যুদ্ধপরাধীদের বিচার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর সাথে তাজউদ্দীনের দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

শারমিন আহমদ উল্লেখ করেছেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে জাতীয়ভাবে ও সংসদীয় সিদ্ধান্তের মধ্যে না গিয়ে একক সিদ্ধান্তে ও আকস্মিকভাবে যুদ্ধপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত রাজাকার, আল বদরদের ক্ষমা করে দেন। এর ফলে ১৯৭২ সালের দালাল আদেশে অভিযুক্ত ২৬ হাজার আসামি মুক্তিলাভ করে।

শারমিন লিখেছেন–

"সুনির্দিষ্ট বড় অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সাধারণ ক্ষমা প্রদান করা হয়নি বলা হলেও দেখা যায় যে অনেক বড় অপরাধী ও খুনি এই সাধারণ ক্ষমার বদৌলতে মুক্তি লাভ করে।" (পৃষ্ঠা ১৭৬)

উদাহারণ হিসেবে তিনি শহীদ বুদ্ধিজীবি-সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সারের অপহরণকারী ও তাঁর হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত দশ বছর সাজাপ্রাপ্ত, আল বদরের সদস্য খালেক মজুমদার এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী ও চিকিৎসক ডা. আলীম চৌধুরীর হত্যার সাথে জড়িত মওলানা আব্দুল মান্নানের কথা উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া আরও উল্লেখযোগ্য যারা ক্ষমাপ্রাপ্ত হন তারা হলেন, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ক্যাবিনেটের প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান, গভর্নর মালিক এবং তার ক্যাবিনেটের মন্ত্রী মওলানা মোহাম্মদ ইসহাক প্রমুখ।

অপরদিকে শারমিন আহমদের মতে, তাজউদ্দীন দালাল আদেশে আটক সকলের বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পরেই যাদের বিরুদ্ধে বড় অপরাধ প্রমাণিত হয়নি তাঁদের বিবেচনা সাপেক্ষে ক্ষমা করার পক্ষপাতী ছিলেন। বিচার-বিহীন ক্ষমা করার ফলে কারা সত্যিকার অপরাধী আর কারা নির্দোষ– এ বিষয়টি বোঝার অবকাশ রইল না বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।

বাঙালি যুদ্ধপরাধীদের পাশাপাশি ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য প্রণীত হয়েছিল 'ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট'। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, যাদের সংখ্যা নানা আন্তর্জাতিক চাপের কারণে ১৫০০ হতে কমিয়ে ১৯৫ জনে স্থির করা হয়েছিল, এদের বিচারের প্রশ্নে তাজউদ্দীন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই অনমনীয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন এই ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীকে ভারত থেকে ঢাকায় ফিরিয়ে এনে বিচার করা হবে বলে ঘোষণা দেন।

৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দীর বিচার যুদ্ধবিধস্ত বাংলাদেশে করা সম্ভব না হলেও, ওই ১৯৫ জনকেও বিচার না করে বঙ্গবন্ধু তাদের ক্ষমা করে দেন বলে শারমিন উল্লেখ করেছেন। জে. এন. দীক্ষিতের 'Liberation and Beyond: Indo-Bangladesh Relations' গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করে তিনি লিখেছেন–

"এমনকি এই স্বল্পসংখ্যক যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ সরকার সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ কিংবা মামলার নথিপত্র প্রস্তুতির ব্যাপারে তেমন তৎপর ছিল না।" (পৃষ্ঠা ১৭৯)

শারমিন আহমদ বাংলাদেশের ইতিহাসে দালালদের এবং পাকিস্তানের ১৯৫ জন সেনাসদস্যের বিচার করতে না পারার ব্যর্থতা মারাত্মক ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলে অভিহিত করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর আরেকটি বড় রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত ছিল 'বাকশাল' গঠনের মাধ্যমে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম। শুধুমাত্র দলের সাথে যুক্ত থাকার জন্য বাকশালের সাধারণ সদস্য হলেও, বাকশাল প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর সাথে তাজউদ্দীন শুধু পুরোপুরি দ্বিমত পোষণই করেননি, বরং অত্যন্ত কঠিন ভাষায় এর সমালোচনা করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেন–

"যে গণতন্ত্রের গুণগান করেছি আমরা সবসময়, আজকে আপনি একটি কলমের খোঁচায় সেই গণতন্ত্রকে শেষ করে দিয়ে দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা করতে যাছেন।…বাই টেকিং দিস স্টেপ ইউ আর ক্লোজিং অল দ্য ডোরস টু রিমুভ ইউ পিসফুলি ফ্রম ইউর পজিশন।" (পৃষ্ঠা ১৯২)

দল হিসেবে আজকে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা হল, গণতন্ত্রের জন্য আজীবন লড়াইকারী বঙ্গবন্ধু কেন বাকশাল গঠনের সিধান্ত নিলেন– সে প্রশ্নের মুখোমুখি না হওয়া। ভারত কখনোই বাকশাল গঠন ভালো চোখে দেখেনি। একদলীয় শাসন কায়েমের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কোনো চাপ ছিল– এ ধরনের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। আর বঙ্গবন্ধু সারা জীবন বহু আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করেই রাজনীতি করেছেন। ন্যাপ এবং সিপিবির মতো দুর্বল দলের কাঁধে বাকশাল গঠনের সিধান্তের দায় চাপিয়ে এর সঠিক কারণ জানা যাবে না।

বঙ্গবন্ধু হয়তো মহৎ উদ্দেশ্য এবং অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে বাকশাল গঠন করেছিলেন, কিন্তু ঔপনিবেশিকত্তোর দেশসমূহের জাতি গঠনের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি যে, এ ধরনের উদ্যোগ আখেরে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারেনি।

শারমিন আহমদ যথার্থই বলেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে ট্রাজিক অধ্যায় হচ্ছে বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দীনের মধ্যে বিচ্ছেদ। বস্তুত এ বিচ্ছেদের ফল হচ্ছে ১৯৭৫ পরবর্তী সময় থেকে দীর্ঘ ২১ বছর বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের ভাবধারা থেকে দেশকে বিচ্ছিন্ন করে পাকিস্তানি ভাবধারায় দেশকে নিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা।

মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত স্বাধীন হলেও, আজকের যে ভারত, সেখানে গান্ধীর স্বপ্নের কোনো প্রতিফলন নেই, বরং এটি গড়ে উঠেছে নেহেরুর স্বপ্ন কেন্দ্র করে। আজকের যে আধুনিক চীন, সেটি কিন্তু মাওয়ের চীন নয়, এটি হল দেং শিয়াও পিংয়ের চীন।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও 'the irony of history' হল, আজকের বাংলাদেশ কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ নয়। এটি তাজউদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সে স্বপ্নেরই প্রতিফলন হল আজকের বাংলাদেশ।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনার বিচার নিয়ে চিন্তাভাবনা, বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবার সার্ক সম্মেলনে পাকিস্তান না যাওয়ার সিদ্ধান্ত, এবং এর পাশাপাশি বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চার মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্টা– এসব পদক্ষেপের মধ্যে দিয়ে শেখ হাসিনা এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগ মূলত তাজউদ্দীনের চিন্তাধারার আলোকেই বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।