পরীক্ষা-সংস্কৃতি নয়, চাই মূল্যায়ন ব্যবস্থা

গৌতম রায়
Published : 15 Sept 2016, 02:47 AM
Updated : 15 Sept 2016, 02:47 AM

প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির পর থেকে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থী কী কী শিখবে– তা সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট করা আছে। প্রাথমিক স্তরে এগুলোকে 'অর্জন উপযোগী যোগ্যতা' ও মাধ্যমিক স্তরে 'শিখনফল' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

অর্জন উপযোগী যোগ্যতার আবার ভাগ আছে– ১. বিষয়ভিত্তিক, ২. শ্রেণিভিত্তিক ও ৩. প্রান্তিক। প্রতিটি শ্রেণির লেখাপড়া শেষ করার পর শিক্ষার্থীরা প্রতিটি বিষয়ে আলাদা আলাদাভাবে কী কী শিখবে তা যেমন দেওয়া আছে; তেমনি পুরো প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করার পর সামগ্রিকভাবে কী কী যোগ্যতা অর্জন করবে, তাও নির্দিষ্ট করা আছে। এই সামগ্রিক যোগ্যতাকে একত্রে বলা হচ্ছে 'প্রান্তিক যোগ্যতা'।

যদিও প্রাথমিক শ্রেণির শিক্ষাক্রম দীর্ঘদিন ধরে এসব শ্রেণিভিত্তিক ও বিষয়ভিত্তিক অর্জন উপযোগী যোগ্যতা অনুসারে তৈরি ও ব্যবহৃত; কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া শিক্ষার্থীদের প্রান্তিক বা শ্রেণিভিত্তিক ও বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতা অনুসারে মূল্যায়ন করা হয় না। প্রাথমিক স্তরের মত মাধ্যমিকেও একইভাবে প্রতিটি শ্রেণি ও বিষয়ের জন্য আলাদাভাবে শিখনফল নির্ধারণ করা আছে।

প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্তরে অর্জন উপযোগী যোগ্যতা বা শিখনফলের ওপর ভিত্তি করে পাঠ্যবইসমূহ লেখা হয়েছে। যতগুলো অর্জন উপযোগী যোগ্যতা বা শিখনফল রয়েছে, তার সবগুলো অবশ্য পাঠ্যবইতে প্রতিফলিত করা সম্ভব নয় এবং সেটি উচিতও নয়। তবে পাঠ্যপুস্তক রচনার নিয়মকানুন মেনে সর্বোচ্চসংখ্যক যোগ্যতা বা শিখনফল পাঠ্যপুস্তকে প্রতিফলিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।

সুতরাং বলা যায়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার মূল আয়োজন এসব অর্জন উপযোগী যোগ্যতা ও শিখনফল কেন্দ্র করে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যপুস্তকগুলোর মত শিক্ষক নির্দেশিকাসমূহও সেভাবেই তৈরি। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কি এসব যোগ্যতা ও শিখনফল অনুসারে মূল্যায়ন করা হচ্ছে? যেসব পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে ও যেভাবে পরীক্ষা গ্রহণ করা হচ্ছে, তাতে শিক্ষার্থীরা এসব যোগ্যতা ও শিখন অর্জন করছে কি না, তা যাচাই করা কি সম্ভব হচ্ছে? উত্তর হবে– 'না'।

তাহলে কেন এত এত পরীক্ষা দিতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের? কী উদ্দেশ্যে সারা বছর তাদের কেবল পরীক্ষার জন্যই প্রস্তুতি নিতে নিতে সময় পার হয়ে যায়?

শিক্ষার্থীদের প্রতিনিয়ত প্রচুর পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। নানা ধরনের ক্লাশ টেস্ট তো আছেই, একটু 'ভালো' বলে পরিচিত বিদ্যালয়গুলো প্রতিনিয়তই নানা ধরনের পরীক্ষা নেওয়া হয় ক্লাশে। এসব বাদ দিলে ষান্মাসিক, বার্ষিক এবং পাবলিক পরীক্ষা রয়েছে। এগুলোর কোনোটিতে কি শিক্ষার্থীরা অর্জন উপযোগী যোগ্যতা বা শিখনফল অর্জন করছে কি না, তা যাচাই করা হয়? আবারও উত্তর হবে– 'না'।

তাহলে শিক্ষার্থীদের কেন এত পরীক্ষা দিতে হচ্ছে নিয়মিত? শুধু বই থেকে যা শিখছে, সেগুলো যাচাই করতে? কনটেন্ট-ভিত্তিক শিখন যাচাইয়ের জন্য এত পরীক্ষার আয়োজন কি সুস্থ প্রতিযোগিতার জন্ম দেয়?

বর্তমানে শিক্ষার্থীদের চারটি পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়। এগুলো হল, পঞ্চম শ্রেণির পর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা (পিইসি), অষ্টম শ্রেণির পর জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি), দশম শ্রেণির পর সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও দ্বাদশ শ্রেণির পর হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষা।

এ চারটি পরীক্ষার আয়োজন করতে গিয়ে সরকারকে বিপুল আয়োজন করতে হয়। তার চেয়েও বেশি আয়োজনের মুখে পড়তে হয় শিক্ষার্থীদের ও তাদের মা-বাবাদের। কিছুদিন আগে একবার সিদ্ধান্ত হয়েছিল– এ বছর থেকে পঞ্চম শ্রেণির পর যে পরীক্ষাটি হয় সেটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। কারণ, 'জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০'-এর সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ এখন পাঁচ বছর থেকে আট বছর হয়েছে, অর্থাৎ পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছে। সে অনুযায়ী পঞ্চম শ্রেণির পর পাবলিক পরীক্ষাটির যৌক্তিকতা থাকে না। কিন্তু কী এক অজ্ঞাত কারণে এ বছরও সেটি নেওয়া হচ্ছে।

এ প্রশ্নটি এখন নিয়মিতই উঠছে যে, এতগুলো পরীক্ষার আদৌ দরকার আছে কি না? আমার মত হচ্ছে, এতগুলো পাবলিক পরীক্ষা তো নয়ই; বরং বিদ্যালয়ের নেওয়া বার্ষিক পরীক্ষা ছাড়া ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক বা অন্যান্য পরীক্ষাও বন্ধ করে দেওয়া হোক।

আমি পরীক্ষার বিরুদ্ধে নই, কিন্তু আমার অবস্থান কার্যকর মূল্যায়নের পক্ষে ও পরীক্ষা-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে।

বাংলাদেশের গত বিশ বছরের শিক্ষাব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আমরা দিন দিন পরীক্ষানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার দিকে ঝুঁকছি। মনে হচ্ছে, পড়ালেখা আসলে গৌণ বিষয়; শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মূল টার্গেট বরং পরীক্ষা। মনে হচ্ছে, শেখার প্রয়োজন নেই; ভালো গ্রেড পাওয়াই মূল লক্ষ্য।

পরীক্ষার মাধ্যমে যদি দেখা হত শিক্ষার্থীরা অর্জন উপযোগী যোগ্যতা বা শিখনফল কতটুকু শিখছে, তাহলে হয়তো এতগুলো পরীক্ষার যৌক্তিকতা থাকত। শিক্ষার্থীদের সামনে এখন জিপিএ-৫ নামের একটি টার্গেট রয়েছে। কে কিভাবে এ টার্গেটে যেতে পারে তারই এক উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা চলছে এখন। এই অবাধ ও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার তোড়ে 'শিক্ষা' কতটুকু হল, সে খবর কে রাখবে?

পরীক্ষার কারণে শিক্ষার্থীরা যে কিছুই শিখছে না, তা বলা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। বরং এতগুলো পরীক্ষা না থাকলে তাদের শিখনটুকু যে আরও মজবুত হত, তা বলার চেষ্টা করছি এখানে।

পরীক্ষাকে আমরা সাধারণ পড়ালেখার শেষ ধাপ হিসেবে চিহ্নিত করি। আর এর ফল হিসেবে খাতা-কলমনির্ভর পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যেভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে, সেটিই আসলে পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য নষ্ট করে ফেলেছে। যে শিক্ষার্থীর মুখস্থবিদ্যার জোর নেই, তার শতগুণ থাকা সত্ত্বেও ভালোভাবে মূল্যায়িত হবে না। সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তরও আজকাল নোট বা গাইড বইতে পাওয়া যায় এবং সেগুলো মুখস্থ করে পার পাওয়া যায়। আর খাতায় তেমন কিছু না লিখেও কিংবা অপ্রাসঙ্গিক উত্তর লিখেও নম্বর পাওয়ার বিষয়টি তো এখন অন্যতম আলোচিত বিষয়। এর সত্য-মিথ্যা কতটুকু তা সুনির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল, কিন্তু এসব নিয়ে আজকাল সামাজিক মিডিয়াতে বেশ আলোচনা হয়।

আমার প্রস্তাব থাকবে, দ্বাদশ শ্রেণির আগে সব পাবলিক পরীক্ষার আয়োজন বন্ধ করা হোক। এমনকি বিদ্যালয়ের নানাবিধ আনুষ্ঠানিক পরীক্ষাও উঠিয়ে দেওয়া হোক। এ সময়টুকুতে শিক্ষার্থীরা কেবল 'মডিফায়েড' বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নেবে। মডিফায়েড এ অর্থে যে, প্রচলিত বার্ষিক পরীক্ষার বদলে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট কিছু দক্ষতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে বার্ষিক পরীক্ষার আয়োজন করা হবে, যা অর্জন উপযোগী যোগ্যতা ও শিখনফল যাচাইয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। আর বার্ষিক পরীক্ষার মূল লক্ষ্য হবে দুটো। এক. সীমিত পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর দক্ষতা ও দুর্বলতা যাচাই করে সে অনুসারে ফিডব্যাক দেওয়া। দুই. লেখাপড়ার শেষ ধাপ হিসেবে নয়; বরং শিখন-শেখানো কার্যক্রমের স্বাভাবিক ও নিয়মিত ধাপ হিসেবে পরীক্ষা পদ্ধতির সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহার নিশ্চিত করা, যার সঙ্গে গ্রেডের সম্পর্ক হবে গৌণ, শিখনের সম্পর্ক হবে মুখ্য।

আরও ভালো হত যদি বলতে পারতাম বার্ষিক পরীক্ষাটুকুও তুলে দেওয়া হোক। আমাদের শিক্ষকগণ যদি খাতা-কলমভিত্তিক পরীক্ষা না নিয়ে শ্রেণিতে সারা বছর ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা ও উন্নতির বিষয়গুলো ক্রমাগত তুলে ধরতে পারতেন এবং সে অনুসারে শিক্ষার উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে পারতেন, তাহলে বার্ষিক পরীক্ষারও প্রয়োজন হত না।

বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের রোল নম্বর দেওয়ার মতো ভুল কাজটিও আমরা করি। আপাতদৃষ্টিতে এটিকে ঠিক মনে হলেও দিনশেষে তা অসুস্থ প্রতিযোগিতারই সৃষ্টি করে। মনে করা হয়, এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভালো ফল করার প্রবণতা সৃষ্টি হবে। এটি আংশিকভাবে ঠিক; এ প্রবণতার নেতিবাচক দিকই বেশি। আমরা নানা ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের উদাহরণ দিই, কিন্তু তাদের শিক্ষাব্যবস্থার ইতিবাচক দিকগুলোর কতটা গ্রহণ করি? একটু খোঁজ নিলেই জানা যাবে, অনেক দেশে এ ধরনের পরীক্ষাভিত্তিক রোল নম্বর নির্ধারণের প্রচলন নেই।

বলা প্রয়োজন, দ্বাদশ শ্রেণির আগে বার্ষিক পরীক্ষা ছাড়া অন্য সব পরীক্ষা বন্ধ করলেই যে শিক্ষার গুণগত মানে রাতারাতি পরিবর্তন চলে আসবে, তা নয়। বরং হাঁফ ছাড়ার আনন্দে ও নির্ঝঞ্ঝাট থাকার আতিশয্যে প্রথমদিকে লেখাপড়ায় ঢিল দিতে পারে অনেক শিক্ষার্থী, এমনকি বিদ্যালয়ও। এটি শিক্ষকদের জন্যও প্রযোজ্য হতে পারে। স্বল্প সময়ের জন্য এর নেতিবাচক দিকগুলোই বরং প্রকটভাবে ফুটে উঠতে পারে আমাদের সামনে। সেজন্য একসঙ্গে সব পরীক্ষা বন্ধ না করে আস্তে আস্তে দু-তিন বছর সময় নিয়ে পরীক্ষাগুলো বন্ধ করা উচিত।

লেখাপড়া থেকে শিক্ষার্থীদের যতটুকু উপকৃত হওয়ার কথা, পরীক্ষা ও বল্গাহীন প্রতিযোগিতার সংস্কৃতিতে তারা উপকৃত হয় তার থেকে কম। প্রচলিত ধরনের পরীক্ষা লেখাপড়াকে আনন্দহীন করে তোলে। পরীক্ষাকেও আনন্দময় করে তোলা যায়, কিন্তু তার জন্য যে ধরনের দক্ষতা ও ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন, সেটির অভাব আছে আমাদের। প্রতিবছর পাবলিক পরীক্ষার আয়োজন করতে গিয়ে যে পরিমাণ বিপুল অর্থ খরচ হয় সরকারের (শ্রম ও সময়ও বিবেচনা নেওয়া দরকার), সেই অর্থ বিদ্যালয়ে বিনিয়োগ করে আমাদের শিক্ষকদের আনন্দময় পন্থায় নিত্যদিনের মূল্যায়ন ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হোক। তাতে খাতা-কলমভিত্তিক পরীক্ষা না নিয়েও শিক্ষার্থীদের যেমন মূল্যায়ন করার উপায়সমূহ প্রতিনিয়ত প্রয়োগ করা যাবে, তেমনি আস্তে আস্তে বাড়বে শিক্ষার গুণগত মান।