ফারজানাকে অভিনন্দন!

আহমাদ মাযহারআহমাদ মাযহার
Published : 15 Nov 2011, 01:07 PM
Updated : 15 Nov 2011, 01:07 PM

ফারজানার বিয়ে হয়েছিল শওকত আলী খান ওরফে হীরনের সঙ্গে। বর হীরন পটুয়াখালির কলাপাড়ার চাকামইয়া ইউনিয়নের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। শিক্ষকের পক্ষ থেকে এই ধরনের প্রস্তাব কেবল অপরাধজনকই নয়, কলঙ্কজনকও। প্রাথমিক স্কুল শিক্ষকের দায়িত্ব শিশুদের মধ্যে উন্নত মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা। যৌতুক যে একটি খারাপ প্রথা এবং একে নির্মূল করার ব্যাপারে যেখানে শিক্ষিত মানুষমাত্রেরই ভূমিকা রাখা উচিত, সেই বিবেচনাতেও শিক্ষিত মানুষ হিসাবে এই মূল্যবোধের প্রচার করবার কথা শিক্ষকেরই। সেদিক থেকেও যৌতুকবিরোধী বক্তব্য রাখবার কথা তাঁরই। কিন্তু আশ্চর্য যে বর শওকত আলী খান ওরফে হীরন রাষ্ট্র কর্তৃক নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও এবং তথাকথিত অর্থে শিক্ষিত হয়েও এই যৌতুক দাবি করেছেন। শুধু তাই নয়, একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হয়ে, নিজে একজন নারী হয়ে বরের ফুফু তাহমিনা বেগম যৌতুকের প্রস্তাবটি জোরের সঙ্গে উত্থাপন করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি নিজেও পুরুষতান্ত্রিকতারই প্রতিনিধিত্ব করলেন।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সম্পত্তির ওপর মেয়েদের অধিকারের বৈষম্যের সুযোগে যৌতুকপ্রথা এখনও সমাজে প্রবলভাবে রয়ে গেছে। সম্পত্তির ওপর নারীর অধিকার যথার্থ মানবাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত যৌতুক দূর করা কঠিন হবে। ফারজানার যৌতুক-প্রত্যাশী বর ও বরের পরিবার এই যে প্রতিহত হলো এতে খানিকটা চিকিৎসা হলো সমাজের। এই বিবেচনায় ফারজানার সাহসী ভূমিকার জন্য আমাদের অভিনন্দন জানাতেই হবে!


আমাদের সমাজে যৌতুক দীর্ঘকাল ধরে গড়ে-ওঠা এক ব্যধি। এর বিরুদ্ধে কেবল আইন করে এর প্রতিকার করা সম্ভব হবে না। অনানুষ্ঠানিকভাবে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত সব ধরনের পরিবারেই এই ব্যধি এখনও দিব্যি টিকে আছে, কেবল যে টিকেই আছে তা নয়, নির্ভয়ে এর অনুসরণ হয়ে চলেছে। এর কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুই পক্ষই নানা সামাজিক আচার বা শোভন আচরণের আড়ালে এই প্রক্রিয়াকে মেনে নেয়। একপক্ষ গররাজি থাকলেও প্রতিরোধের চেষ্টা হয় কমই। সমাজের এতটাই গভীরে এর শেকড়বাকর যে আইনের আশ্রয় প্রায় নেয়াই হয় না। এ ধরনের সামাজিক ব্যাধি দূর করতে হবে সামাজিক-সাংগঠনিক কর্মপ্রক্রিয়ার মাধ্যমেই। যে পরিবার যৌতুক চাইবে সে পরিবারকে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করতে হবে।

আমরা দেখছি যে কিছু এনজিও যৌতুকপ্রথার বিরুদ্ধে নানা কর্মসূচি পালন করছে। এসব কর্মসূচি হয়তো কিছুটা ইতিবাচক ভূমিকাও পালন করে! কিন্তু আমার মনে হয় বিদেশি সাহায্যে পরিচালিত এনজিওগুলোর তৎপরতায় এই ব্যাধি দূর করা সম্ভব হবে না। কারণ বিদেশি সাহায্য নিজেদের আত্মার জাগরণ ঘটাতে সহায়তা করতে পারে না। এর জন্য দরকার নিজেদের সচেতনতা। বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক স্থানীয় সচেতন মানুষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের তৎপরতা বাড়িয়ে, যৌতুকের প্রত্যাশাকে নিচুস্তরের কাজ হিসাবে সমাজে প্রতীয়মান করে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে তুলনামূলকভাবে বেশি কার্যকর হবে। এসব ক্ষেত্রে যেহেতু সরকার যৌতুকের বিরুদ্ধে আইন করেছে ও আইন প্রয়োগে অঙ্গীকারাবদ্ধ সুতরাং সরকার এই ধরনের সামাজিক সংগঠনকে সহায়তা দিতে পারে।

মেয়েরা এখন দলে দলে লেখাপড়া শিখছে এবং পেশাগত কাজে অংশ নিয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। নিজেদের জীবনপ্রবাহকে পরিচালিত করছে নিজেরাই। মেয়েদের উন্নতির জন্য সামাজিক সাংগঠনিক তৎপরতা বাড়াতে থাকলে একসময় এর থেকে সুফল আসবে, পুরুষতান্ত্রিক প্রথা নারীদেরকে আর নিজেদের ব্যবহার্য সামগ্রী ভাবতে পারবে না। মেয়েদের সচেতন প্রতিবাদী অবস্থানের মাধ্যমেই এই মারাত্মক ব্যাধি আমাদের সমাজ থেকে দূর করবার চেষ্টা করতে হবে। সামাজিক সংগঠনের সহযোগিতা আইন প্রয়োগে সুবিধা যোগাতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে যৌতুকবিরোধী অবস্থান ঘোষণা করতে হবে। তাহলে যৌতুকের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যানের সাহস মেয়েরা নিজেরাই দেখাতে পারবে বেশি করে। এ ধরনের প্রস্তাব উত্থাপন করতেই সাহস পাবে না বরপক্ষ। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বরপক্ষ যৌতুক দাবি করলে যে কনে এতটা তীব্রভাবে এর বিরোধিতা করতে পারবে এমন ধারণা নিশ্চয়ই ছিল না বলেই তারা যৌতুক চাইতে সাহস পেয়েছিল।

যৌতুকের ভুক্তভোগী ফারজানা ছাত্রজীবনে যৌতুকবিরোধী আন্দোলন করেছেন। নিজের জীবনে এসে যৌতুকপ্রস্তাবের মুখোমুখি হয়ে তিনি তাঁর সেই দিকনির্দেশনা হারান নি। আর সে-কারণেই তিনি প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। নিঃসন্দেহে ফারজানার স্পষ্ট ভূমিকা অন্য মেয়েদেরও উজ্জীবিত করবে। আর গণমাধ্যম পারে এই উজ্জীবনী শক্তিকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে। শওকত আলী হীরনের যেন শাস্তি হয় এবং এই শাস্তির খবর ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় গণমাধ্যমে– এ প্রত্যাশা করি!

আহমাদ মাযহার : প্রাবন্ধিক ও গবেষক।