‘‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যামসমান’’ নহে

Published : 12 Sept 2016, 05:36 AM
Updated : 12 Sept 2016, 05:36 AM

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আখতার জাহান জলির অপমৃত্যুর ঘটনাটি আমাকে স্মৃতিকাতর করে তুলল। তিনি আত্মহত্যা করেছেন বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবসের আগের দিন, ৯ সেপ্টেম্বর। কী কাকতাল! ঘটনাটা জানার পর মনে ভেসে উঠল আরও একসারি সম্ভাবনাময় মুখ। যাদের কাউকে কাউকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম; কারও লেখা পড়ে বা অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম।

বিশ্বের আত্মহত্যাপ্রবণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ দশ নম্বরে রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশে প্রতি লাখে ৭ দশমিক ৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করে। ২০১৪ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী আত্মহত্যায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম; যা ২০১১ সালে ছিল ৩৮তম। অর্থাৎ আত্মহত্যার প্রবণতায় এগিয়েছে বাংলাদেশ! বিশ্বের অন্য দেশে যেখানে পুরুষের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি সেখানে বাংলাদেশের মেয়েরা বেশি আত্মহত্যা করে। কারণটা কী? অবশ্যই সামাজিক প্রতিকূলতা তার জন্য দায়ী। কিন্তু তারপরও কথা থাকে।

আখতার জাহান জলির কথাই ধরা যাক। তিনি লিখেছেন, শারীরিক-মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। এই দুপ্রকার চাপ মোকাবিলার জন্যই কিন্তু চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। একজন শিক্ষক হয়ে, সমাজের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি হয়ে, সম্ভাবনাময় মানুষ হয়ে কী উদাহরণ তিনি রেখে গেলেন সমাজের জন্য, তাঁর ছাত্রছাত্রীদের জন্য এবং তাঁর সন্তানের জন্য? হ্যাঁ, মানছি তাঁর অনেক সমস্যা ছিল। আবেগগত বেশ চাপের মধ্যে তিনি ছিলেন, সংসারটি টেকেনি। হয়তো ছিল ভালোবাসার মানুষের প্রতি অভিমান, ছিল বঞ্চনাও। তারপরও মৃত্যু কি কোনো সমাধান? কেন এত আদিগন্ত অভিমান থাকবে যে নিজেকে ধ্বংস করে ফেলতে হবে?

এমনিতেই আমরা বাঙালিরা আবেগপ্রবণ জাতি। তার ওপর মেয়েরা আবার এক কাঠি সরেস। আমরা আত্মহত্যা করি ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে আঘাত পেয়ে। আমরা মরে যেতে চাই বঞ্চনার শিকার হয়ে!

মনে পড়ছে কিছুদিন আগে ইউটিউবে একটি ভিডিও আপলোড করেছিল সাবেরা সুলতানা নামে একটি মেয়ে। সে মডেল ছিল। প্রেমিকের কাছ থেকে আঘাত পেয়ে সহ্য করতে পারেনি। নিজের শরীর কাটছিল ছুরি দিয়ে; কাঁদছিল প্রেমিকের প্রতি অভিমানে। তারপর আত্মহত্যা করে সে।

একই সঙ্গে আমার মনে পড়ছে সাংবাদিক ও কবি এবং আমার বন্ধু বাশিরা ইসলামের কথা। আমরা দুজন একই সঙ্গে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নে কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য পদে নির্বাচন করে জয় পেয়েছিলাম। বাশিরা ভালো কবিতা লিখত। ভালোবাসা নিয়ে আবেগগত জটিলতায় আত্মহত্যা করে সে। ঝরে যায় সম্ভাবনাময় একটি জীবন। আজও তার সদাহাস্যময় সুন্দর মুখ চোখে ভাসে।

মনে পড়ে আবৃত্তিশিল্পী ও কবি মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়ের কথা। নব্বই দশকে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে একসঙ্গে আবৃত্তি করেছি আমরা। এই সুকণ্ঠী, সম্ভাবনাময়, সৃজনশীল, প্রিয়দর্শিনী নারীও ভালোবাসার অভিমানে আত্মহত্যা করেন।

বাংলাদেশে অভিনয় জগতের অন্যতম সেরা শিল্পী ডলি আনোয়ারের (ইব্রাহিম) আত্মহত্যার কথাও ভুলতে পারি না কিছুতেই। 'সূর্যদীঘল বাড়ি' চলচ্চিত্রে তাঁর দুর্দান্ত অভিনয় বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ল্যাসিক হিসেবে গণ্য। ড.নীলিমা ইব্রাহিমের কন্যা এই কৃতিমান নারীর আত্মহত্যা আমাদের সংস্কৃতি জগত ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।

সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রী ও প্রতিশ্রুতিশীল সাংবাদিক নভেরা দীপিতার আত্মহত্যাও ভোলার নয়। বিবাহিত জীবনে ভালোবাসার প্রিয়জনের কাছ থেকে আঘাত পেয়েছিল সে। নভেরার লেখার হাত ছিল ভালো। সাংবাদিক হিসেবেও ক্যারিয়ার মাত্র শুরু করেছিল। কেন চলে যেতে হল তাকে পৃথিবী ছেড়ে?

কয়েক বছর আগে মডেল ও অভিনেত্রী মিতা নূরের আত্মহত্যা নিয়েও মিডিয়ায় সাড়া পড়ে। আপাতদৃষ্টিতে মিতা ছিলেন সুখী। খ্যাতিও ছিল তাঁর। ছিল সুন্দর গৃহকোণ। দাম্পত্য কলহ তাঁকে নিয়ে যায় মৃত্যুর পথে।

একই সঙ্গে চোখে ভেসে উঠছে জানা-অজানা একসারি অভিমানী মুখ। যারা কোনো এক অভিমান নিয়ে স্বেচ্ছায় চলে গেছে জীবন ছেড়ে।

প্রেম নামক একটি 'অবান্তর' সম্পর্ক কেন্দ্র করে অনেক নারী নিজের জীবনের ইতি ঘটান। 'আন্না কারেনিনা' উপন্যাসের নায়িকা আন্নার মতো তাঁরা মনে করেন, তাদের মৃত্যুর মাধ্যমে তাদের প্রেমিকদের অবিচারের প্রতিশোধ নেওয়া যাবে। তাদের ধারণা, মৃত্যুসংবাদ শোনার পর দুঃখে, কষ্টে, অনুশোচনায়, আত্মগ্লানিতে তাদের প্রেমিকরা বা স্বামীরা একেবারে ভেঙে পড়বেন। তাদের বুক ফেটে যাবে, জীবনের সব সুখ শেষ হয়ে যাবে। তাঁরা প্রেমিকা বা স্ত্রীর শোকে দিনরাত কান্নাকাটি করবেন।

কিন্তু বাস্তবে এই নারীদের মৃত্যুর পর প্রেমিকরা 'অশ্বডিম্ব প্রসব' ছাড়া আর কিছুই করবেন না! তাঁরা কান্নাকাটিও করবেন না, অনুশোচনা তো নয়-ই। বরং নতুন একটি বোকা-শিকার খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন!

কোনো কোনো মেয়ে আবার আত্মহত্যা করে প্রেমিক বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায়। তারা আশা করে শারীরিক সম্পর্ক হওয়ার পর প্রেমিক বিয়ে করবে। সেটি যখন হয় না তখন তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

ইউটিউবে সাবিরার ভিডিওটি অনেকেই দেখেছেন তামাশা দেখার মনোভাব নিয়ে। ধান্দাবাজ পুরুষদের কাছে প্রেমিকার আত্মহত্যা এক ধরনের 'তামাশা' ছাড়া আর কিছু নয়। প্রেমের ছুতায় যে পুরুষের আগ্রহ শুধু শারীরিক সম্পর্ক গড়ার, নারীর উচিত ওই পুরুষটিকে টিস্যু পেপারের মতো ব্যবহার করার পর ঘৃণায় তাকে ত্যাগ করা। কিন্তু মেয়েরা মূলত বোকা। তারা আবেগে ভেসে যায় এবং ছেলেরা সেই আবেগের সুযোগ নেয়।

'ভার্জিনিটি', 'চেস্টিটি' ইত্যাদি কতগুলো পুরুষতান্ত্রিক শব্দমালা ও ধারণায় আচ্ছন্ন হয়ে নারী মনে করেন, শারীরিক সম্পর্ক যেহেতু হয়েছে, সুতরাং তিনি 'ব্যবহৃত' হয়েছেন। এখন বিয়েই তার গন্তব্য। সময় এসেছে এসব জঞ্জালমার্কা চিন্তা ছুঁড়ে ফেলার।

যে পুরুষ প্রেমিকার বিষয়ে আগ্রহী নয় তাঁকে সবলে ও ঘৃণায় ত্যাগ করা উচিত নারীরই। দায়িত্বহীন, নিষ্ঠুর কোনো পুরুষকে বিয়ে করে খামোখা সংসার নামক জাঁতায় পিষ্ট হওয়ার দরকারটা কী? শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে বলেই ক্যারিয়ার ফেলে বিয়ে করতে হবে– নারীর এমন সেকেলে ধারণাই তাঁকে ঠেলে দেয় আত্মহত্যার মতো হঠকারিতার পথে।

দাম্পত্য কলহ থেকে আত্মহত্যার পথ যাঁরা বেছে নেন তাঁরাও যথেষ্ট বোকা। প্রেম, বিয়ে, সংসার ইত্যাদি একজন মানুষের জীবনের একটি অংশ মাত্র। এর বাইরেও জীবনের বিরাট পরিধি রয়েছে, রয়েছে অনেক কাজ অনেক সম্ভাবনা। সুখী দাম্পত্য, টেকসই বিয়ে যদি না-ই হয়, সেটা দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হিসেবে মেনে নেওয়া প্রয়োজন। নারী-পুরুষ সবারই ডিভোর্সের পর কাউন্সেলিং নেওয়া প্রয়োজন যদি জীবন নিজের কাছে অর্থহীন বলে মনে হতে থাকে, কিংবা মনে হয় ব্যর্থ।দাম্পত্য জীবনের বাইরেও মানুষের যে বিশাল কর্মক্ষেত্র রয়েছে সেখানে মনোযোগ দিয়ে দুঃখ ভুলে থাকার চেষ্টা করাও কি যায় না?

মানুষের জীবন অপার সম্ভাবনাময়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ, দুর্ঘটনাতে যে মানুষ সর্বস্ব হারায় সে-ও কিন্তু বেঁচে থাকে। টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করে। একসময় না একসময় মাথা তুলে দাঁড়াতেও পারে। দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষও চিকিৎসার মাধ্যমে আরও কিছুদিন বেশি বাঁচার চেষ্টা করে। বেঁচে থাকার আশাই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। হতাশা মানুষকে নিয়ে যায় আত্মধ্বংসের পথে।

আত্মহত্যা থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য আমাদের দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, অফিসে, হাসপাতালে, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থায় কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন যেখানে মানসিক সংকটের সময় মিলবে সুপরামর্শ, পাওয়া যাবে আশার বাণী ও জীবনের দিকনির্দেশনা। স্যোশাল মিডিয়াও এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। কারও স্ট্যাটাসে যখন হতাশার ছায়া পড়তে থাকে ক্রমাগত, তখন তার বন্ধুরা যদি তার প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন তাহলে বাঁচানো সম্ভব অমূল্য একটি জীবন।

'আট বছর আগে একদিন' কবিতায় জীবনানন্দ লিখেছিলেন:

"অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়–
আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত– ক্লান্ত করে;"

হ্যাঁ, ক্লান্তি তো আসতেই পারে। তবু 'মরিবার সাধ' যেন না হয়। এই সাধ বড় বেশি বোকামি, বড় বেশি অর্থহীন। জীবন উপভোগ করার চেষ্টা করা প্রয়োজন– প্রয়োজন ব্যক্তিগত ও আবেগগত সুখ-দুঃখের বাইরে যে সুবিশাল জগৎ রয়েছে সেদিকে দৃষ্টি দেওয়ার। জীবন অনেক সময় শুকিয়ে যায় বটে, কিন্তু তার পাশাপাশি বহমান করুণাধারা কোথায় রয়েছে সেদিকেও তাকানো দরকার।

অভিমানে, ক্ষোভে স্বেচ্ছায় নিজের জীবনের ইতি ঘটানোর আগে এ বিশ্বের রূপ-ঐশ্বর্যের দিকে ফিরে তাকাতে হবে। তখন আর নিজের জীবন অর্থহীন বলে মনে হবে না, বরং ইচ্ছা হবে হাজার বছর বেঁচে থাকার।