জিয়াকে নিয়ে রাজনীতি: কার লাভ কার ক্ষতি?

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 10 Sept 2016, 10:04 AM
Updated : 10 Sept 2016, 10:04 AM

একটা বিষয় মাথায় রাখা দরকার অনেক সময় আমরা নেগেটিভভাবেও মানুষকে জনপ্রিয় করে তুলি। তার আগে একটা কথা বলি, আজ যারা তারুণ্যে তাদের কাছে জিয়াউর রহমানের ইমেজ আদৌ কী? আমাদের কাছে যেমন গান্ধী, জিন্নাহ ঝাপসা-ফ্যাঁকাসে, এদের কাছে জিয়াও তা-ই। সময়ের হাত ধরে কে উদ্ভাসিত হবেন আর কে নিস্প্রভ হবেন– সেটা তাঁদের কাজেরই পরিচয়।

কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আওয়ামী লীগ খুঁটি গেড়ে বসার পরও জিয়াউর রহমানই ঘুরেফিরে খবরে আসে। বিএনপি এখন সংসদে নেই। তাদের কোনো আন্দোলনের ডাক সফলতা দূরে থাক, ঢেউ জাগাতে পারে না। অন্যদিকে একচ্ছত্র আধিপত্যে সরকার আছে আসনে। তারপরও কিন্তু এরাই হয়ে উঠছে খবরের বিষয়।

খেয়াল করবেন, 'নাই', 'নাই' করেও একটি বিরোধী দল আছে। তাদের একজন সংসদ নেতাও আছেন। কিন্তু তারা এভাবে সংবাদ শিরোনাম হতে পারছেন না। এর মানে এই জাতীয় পার্টি আসলে রাজনীতিতে বিএনপির তুলনায় দুর্বল এবং আলোড়নহীন। তাদের সুযোগ ছিল জনগণের কাছে যাওয়ার, দায়িত্বশীল হওয়ার। সেটা তারা পারছে না। না পারার কারণ নেই কোনো। জনাব এরশাদ একজন চতুর ব্যক্তি। কিন্তু তাঁর মিথ্যা আর ঘন ঘন মত বদলানোর রাজনীতি দলকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

নিন্দুকেরা বলেন, ভাইকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে ওদিকে 'লাইন ম্যানেজ' করা আর এদিকে সরকারের হালুয়া-রুটির ভাগ নিচ্ছে তারা। এভাবে কি হয়? হয় না বলেই 'সাইলেন্ট মেজরিটি'র নামে ঘাপটি মারা বিএনপিই চলে আসে কেন্দ্রবিন্দুতে।

যতটা তারা আসে তার চেয়ে অনেক বেশি নিয়ে আসা হয়। সরকারের একদিকে যেমন ভালো কাজ আর উন্নয়ন, আরেক দিকে বিএনপি ঘায়েলের চেষ্টায় মনে হয় তারা জোর করে হলেও দলের বারোটা বাজাবে। একটার পর একটা ইস্যুতে বিএনপিকে সামনে আনার শেষ চেষ্টা দেখলাম জিয়াউর রহমানের পদক অপসারণের ভেতর দিয়ে। অপসারণ বিষয়টা কি এমন কিছু? এ দেশের মানুষ এত হাঁদারাম নয় যে, ইতিহাস জানে না। তাদের জোর করে ইতিহাস বা চেতনা 'পুশ' করা আনেকটা বাচ্চাদের ইনজেকশান দেওয়ার মতো। এতে বাচ্চারা কিন্তু ভয় পায়।

বাংলাদেশে যারা মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি বা চেতনার কথা বলেন তাদের এই অভ্যাসটা মজ্জাগত। তারা এমনভাবে বলেন যাতে মানুষের আঁতে ঘা লাগে। অথচ এদের দ্বারা আসলে কি কোনো বড় কাজ হয়েছে? তারা কি পেরেছেন এ দেশ থেকে মৌলবাদ বা জামায়াতের রাজনীতি হটাতে? হটানোর কথা দূরে থাক, মানুষের মনে এদের বিরুদ্ধে ঘৃণা জাগানোর কাজটিও করতে পারেনি তারা।

আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বা শাস্তির অভিনন্দন তারা কুড়াতে চাইলেও মূলত এটি শেখ হাসিনার অবদান। তাঁর দৃঢতা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির পালাবদলে পরিস্থিতি অনুকূলে না এলে এ কাজ করা যেত না। সরকারের অনমনীয় মনোভাবের পরও কত হাঙ্গামা! আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর টেলিফোন ঠেকাতে পারতেন তারা? পারতেন জামায়াতি লবিং ও অর্থের মোকাবিলা করতে? ফলে এদের কথামতো যদি জিয়ার বিরোধিতা বা বিএনপি নির্মূলের চেষ্টা হয়, তার ফলাফল কী হবে বা হতে পারে বলা মুশকিল।

খবরে দেখলাম একজন মন্ত্রী বলেছেন, জিয়ার কবরে তাঁর লাশ বা শরীরের কোনো অংশ থাকলে তিনি নাকে খত দেবেন। বুঝলাম নেই, কিন্তু আপনি এতদিন কোথায় ছিলেন? সে ঘটনা তো নয় নয় করে ৩৭ বছরে পা দিয়েছে। কোনোদিন কি আপনার এটা মনে হয়নি? হলে বলেননি কেন, জনাব?

আমরা তখন তারুণ্যে। আমাদের বাসা থেকে হাঁটা দূরত্বে নিহত জিয়া-পরবর্তী ঘটনা অবলোকনের জন্য গিয়েছিলাম সার্কিট হাউসে। রাতভর গোলাগুলি আর বৃষ্টির শব্দে আমরা ঘুমাতে পারিনি। এক পর্যায়ে প্রয়াত পিতা আমাদের খাটের তলায় লুকিয়ে থাকতে আদেশ দিয়েছিলেন। সকালে সব সুনসান। তখন তো এত মিডিয়া ছিল না। মোবাইল নেই। কম্পিউটার নেই। দেশের রেডিও-টিভি চলত ঘণ্টা মেপে। সাতসকালে আমরা গেলাম এক বন্ধুকে এইচএসসি পাস করানোর কাজে গ্রামের কলেজে। তার পরীক্ষাও হয়েছিল। ফেরার পথে দেখি রাস্তায় রাস্তায় সেনাবাহিনীর লোকজন টহল দিচ্ছে। আমরা তবু গা করিনি। তখন বাংলাদেশে ক্যু একটি নৈমিত্তিক ঘটনা। যার ইচ্ছা সেই পারত ট্যাংক কামান নিয়ে বেরিয়ে পড়তে! টাইম লিখেছিল, 'দ্য ক্যু ক্যু ল্যান্ড।' সেই জনপদে সেনারা ১৫ আগস্টের পর ধরে নিয়েছিল– এটাই নিয়ম।

কিন্তু শহরের কাছে আসতেই দেখি ঘটনা ভিন্ন। চেকপোস্ট বসে গেছে। সব ঝামেলা পেরিয়ে বাসায় ঢুকে শুনি জিয়াকে হত্যা করা হয়েছে। তখন যা বয়স তাতে ভয় বলে কিছু থাকে না। ছিল উত্তেজনা। সবার চোখ এড়িয়ে সার্কিট হাউসে গিয়ে দেখি কৌতূহলী মানুষদের পুলিশ বেষ্টনী দিয়ে রেখেছে। যতদূর মনে পড়ে, ফিলিপিনো হাওয়াই সার্ট গায়ে এক ঝলক দেখা দিয়েছিলেন বি চৌধুরী। আর আলমগীর নামে আমাদের কিঞ্চিত বড় এক ভাই ভাষণ দিচ্ছিলেন। তিনি বিএনপির ছাত্রদলের রাজনীতি করতেন। পরে আমেরিকা চলে যান।

সার্কিট হাউস থেকে জিয়ার লাশ নিয়ে যাওয়া হয় রাঙ্গুনিয়ায়। সেখানে তাঁর দাফন করার সময়ই রটে যায় মারাত্মকভাবে আহত ও নিহত জেনারেলের শরীর চেনারও নাকি উপায় নেই। এরপরের ঘটনা বিচ্ছিন্নতার। আমরা চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্ন থাকার কয়েক দিন পর দেশের শাসনভার যখন ঢাকার নিয়ন্ত্রণে, তখন তাঁকে আবারও দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। এত বছর পর সে কবরে কী আছে কী নেই– এ তর্ক কি আওয়ামী লীগকে কোনোভাবে লাভবান করবে? না, তাঁর বিরুদ্ধে মানুষের মনে অন্য কোনো অনুভূতি জাগাবে?

আমি যখন কম্বোডিয়ায় জাদুঘর দেখতে যাই তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। আলো-আঁধারিতে দেখা সেই স্কুলঘরটি আমাদের মতো যুদ্ধাপরাধীদের জঘন্য কর্মকাণ্ডের দলিল বহন করছে। আছে পলপটের ছবি এবং নৃশংসতার যত নজির। কিন্তু তারা একটিও সরায়নি। যে যখন যা করেছে বা ভুল করেছে তা অবিকৃত রাখার নামই তো ইতিহাস। মানুষ সবচেয়ে বড় বিচারক।

জিয়াউর রহমানের দল কেন গঠিত হয়েছিল, কারা গঠন করেছিল, কারা মন্ত্রী হয়েছিল– সেসব কারো অজানা নয়। এর ভেতরেই আছে পাকিস্তানের ছায়া। আছে পরবর্তীকালে রাজাকারদের পুর্নবাসনের সূচনা। তারা এ দেশকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রজন্মে ভরে ফেলার চক্রান্তে আমাদের অর্জন নিয়ে খেলেছিল। ঘোষণা, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ বিতর্কিত করার অপচেষ্টা সফল হয়নি, বরং সময়ের হাত ধরে তারাই আজ নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে।

বিএনপির নেতাকে মানুষ খোলা মিডিয়ার মাধ্যমে চিনছে, জানছে। এমন সময় ওই পদকটি অপসারণের ভেতর দিয়ে সহানুভূতি জাগানোর চেষ্টা কেন? ওই পদক কেন দেওয়া হয়েছিল আর কারা দিয়েছিল– সেটাই বরং মানুষ জানুক, দেখুক। তারপর সিদ্ধান্ত নিক। ঘৃণার জায়গাটা আপনারা কেন জোর করে সহানুভূতির করে তুলছেন?

ইতিহাস কি মুজিব-কোট পরা কিছু মানুষের হাতে বন্দী কিছু? তাজউদ্দীন নিজেও সবসময় মুজিব-কোট পরিধান করতেন না। অথচ তিনি নেতা ও দলের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। আর মুজিব-কোট না-খোলা মোশতাক ছিলেন মীরজাফর।

আমি মনে করি, বিএনপি যেসব ভুল করেছে বা ইতিহাস নিয়ে খেলেছে তাকে সেভাবেই থাকতে দিলে মানুষ জানবে এবং ঘৃণা করবে। এ দেশের জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি লাখো মানুষ এর সঙ্গে জড়িয়ে। দেশে-বিদেশে অজস্র প্রমাণ আর দলিল। তারা কয়টা সামলাবে?

জনগণ কি এতই বোকা যে তারা জানতে চাইবে না জিয়াউর রহমানই যদি সব, বঙ্গবন্ধুকে কেন ধরে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তান? কেন আত্মসমর্পণ করেছিল যৌথ বাহিনীর কাছে যেখানে জিয়ার ছায়া পর্যন্ত নেই? কেন তাজউদ্দীন বা সৈয়দ নজরুল ছিলেন সরকারপ্রধান? এসব না ভেবে গায়ের জোরে সব কিছু পাল্টে দেওয়া বা জিয়ার কবর, জিয়ার পদক নিয়ে ছেলেমানুষী বা আবেগের রাজনীতি যদি কাল হয়ে দাঁড়ায় সেটা কি সুখের কিছু হবে?

কেন যেন বড় কাজগুলোর দিকে নজর না দিয়ে সরকারের কিছু মন্ত্রী ও দলের একাংশ বিএনপিকে 'নেগেটিভ পপুলারিটি' দিতে লেগে আছেন। মানুষ যখন আনন্দে-সুখে-শান্তিতে থাকতে মরিয়া এবং নিজেদের ভবিষ্যত নির্মাণে ব্যস্ত, তাদের জীবনে তখন অশান্তির রাজনীতি উসকে দিচ্ছে কারা? বিএনপি নিজেই যখন ইস্যুহারা দিশেহারা তখন যারা এসব করছেন তাদের কথা জানি না, আমরা এটুকু জানি সুযোগ মিললে এরা দেশের চেহারা পাল্টে দেবে। সেটা না হওয়ার জন্য শেখ হাসিনার হাত শক্তিশালী করা আর যাবতীয় দুর্নীতি দমন করার সময় এখন। পারলে তা করুন, না পারলে চুপ থাকুন।

মানুষকে শান্তিতে উন্নয়ন ভোগ করার সুযোগ তো দেবেন, না কি?