চায়ের কাপের আড়ালের গল্প

অনিকেত সন্ধানী
Published : 16 Sept 2016, 01:19 PM
Updated : 16 Sept 2016, 01:19 PM

পত্রিকায় ছাপানো সব খবর ঠিক খবর হয়ে ওঠে না। কিছু ক্ষেত্রে পাঠক চোখ বুলায়, কিন্ত মনে রাখে না। পড়ে বটে, কিন্ত প্রতিক্রিয়া দেখায় না। এভাবেই ছাপা হয়েও 'জীবন পাতার অনেক খবর রয়ে যায় অগোচরে'। কিছু খবর গোচরে আসে, আর কিছু খবর অগোচরে চলে যায়। এই গোচরাগোচরের ভিত্তিতে একটি সমাজের চরিত্র বোঝা যায়।

সপ্তাহ কয়েক আগে খবরটা ছাপা হয়েছিল বেশ কয়েকটা দৈনিক পত্রিকা এবং অনলাইন পোর্টালে; 'সিলেটে চা বাগানে অনাহারে সাত জনের অকালমৃত্যু'। কিন্ত খবরটা ঠিক খবর হয়ে ওঠেনি। চা-শ্রমিকপল্লীর কোন দেয়ালে আমাদের মানবিকতা, মানবতাবোধ প্রতিহত হয়, ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না সেটা বোঝা কঠিন। সব ভোঁতা হয়ে গিয়েছে যেন। বুর্জোয়া চিন্তাধারায় আস্থাশীল এবং পরিচালিতদের কথা বাদ দেওয়াই সমীচিন। 'দুঃখিনী নারীর নয়নেরও নীর, তারা দেখেও দেখে না', শুধু ইতিহাস নয় বর্তমানও তার সাক্ষী।

কিন্ত এখন সাম্য এবং বাম ভাবাদর্শে আস্থাশীল এবং পরিচালিতরাও বাবু হয়ে গিয়েছেন। অনাহারী মানুষকে বাদ দিয়েই তারা এখন মানবিক ধ্বজা ধরেন। আর তাদের তথাকথিত উচ্চমার্গীয় চিন্তা-ভাবনার প্রকাশ এবং প্রচারের জন্য আছে পরিবেশ, আছে কয়লা আর আছে ময়লা, নেই শুধু মানুষ। তাদের রাজপথের দ্রোহ আর লড়াই-সংগ্রামের বিকল্প এখন ফেসবুক আর অনলাইনে কথাদ্রোহ। ফলাফল দাঁড়াল এই, চা-শ্রমিকপল্লীগুলি হয়ে গেল আমাদের মূল জনপদ এবং জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ। যেখানে জীবনে প্রতিনিয়ত আঘাত করে যায় অভাব আর অনাহার, নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আর কলহ।

২০১১ সালে একবার শ্রীমঙ্গলে বাংলাদেশ চা ইনস্টিটিউটের লাগোয়া চা-বাগানের শ্রমিকদের আবাসস্থল এই বিচ্ছিন্ন পল্লীগুলি স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হয়েছিল। আবাসস্থল বলতে একটার সঙ্গে আরেকটা লাগোয়া একের পর এক খুপড়ি ঘর। সামনে হাত কয়েক খালি জমিন। গতর খাটিয়ে ওরা খুপড়িগুলি যতই পরিস্কার রাখুক না কেন, পর্যাপ্ত আলো আর বাতাসের অভাবে সেখানকার পরিবেশ মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। আর বৃষ্টির দিনে স্যাঁতস্যাতে কাদা আর শেওলা মিলে যে এঁদো পরিবেশের তৈরি হয়, সেখানে সহজে রোগ-ব্যারাম বাসা বাঁধে।

একদা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় দারিদ্রপীড়িত জেলে-পল্লীজীবনের স্বরূপ বর্ণনা করেছিলেন এভাবে:

"টিকিয়া থাকিবার নির্মম অনমনীয় প্রয়োজনে নিজেদের মধ্যে রেষারেষি কাড়াকাড়ি করিয়া তাহারা হয়রান হয়। জন্মের অভ্যর্থনা এখানে গম্ভীর, নিরুৎসব, বিষন্ন। জীবনের স্বাদ এখানে শুধু ক্ষুধা ও পিপাসায়, কাম ও মমতায়, স্বার্থ ও সংকীর্ণতায়। আর দেশী মদে। তালের রস গাঁজিয়া যে মদ হয়, ক্ষুধার অন্ন পচিয়া যে মদ হয়। ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্রপল্লীতে। এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।"

এই বর্ণনা যেন সিলেটের চা-শ্রমিকপল্লীরই আসল চিত্র।

এই পল্লীগুলির পাশেই আছে বাজার যেখানে ওরা চাল-ডাল কিনে। সেখানে কোক আর পেপসির বিজ্ঞাপনও সাঁটা আছে দোকানের সাইনবোর্ডে। যাদের দুই বেলা পেটপুরে খাবার জুটে না, মুনাফার জন্য তাদের প্রতিও হাত বাড়িয়ে আছে এই বহুজাতিক দানব কোম্পানিগুলি। অবশ্য পুঁজির কোনো লাজ-শরমের বালাই নেই। মুনাফার জন্য বন-বাদাড়, ভাগাড় সব জায়গায় সে যায়। এটাই অর্থনীতির নিয়ম।

এই বাজারের পাশেই আছে পাকা বাজার যেখানে ভদ্রলোকেরাই যেতে পারে। চা-শ্রমিকদের সেখানে যাওয়ার রাস্তাও নেই। অবশ্য ওখানে ওদের যাওয়ার দরকারও নেই। পাকা বাজারের দোকানগুলি মূলত চা-বাগানের বাবুদের প্রয়োজন আর সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসা সৌন্দর্যপিপাসু নাগরিক পরিব্রাজকদের চাহিদা মিটানোর জন্য। এসব বাবু আর পরিব্রাজকদের সঙ্গে চা-শ্রমিকদের একই গ্রহের জীব ভাবাটাই মূর্খতার সামিল। পাকা বাজারে ওদের যাওয়ার রাস্তা না থাকায় ভালোই হয়েছে। ওখানে সাত স্তরের চায়ের কাপ হাতে নিয়ে পরিব্রাজকরা যে আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠে, তা দেখে চা-শ্রমিকদের মনে কী ভাবনার উদয় হত কে জানে?

আমরা যেমন এই চা-পল্লীগুলি এড়িয়ে চলি, তেমনি অর্থনীতির কিছু নিয়মও যেন তাদের এড়িয়ে যায়। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গ্রামে-গঞ্জে সব খাতেই মজুরির হার বেড়েছে ইতোমধ্যে এবং বাড়ছে। এটাই স্বাভাবিক। অনেক আগে, সেই পঞ্চাশের দশকের শুরুতে একজন ক্যারিবিয়ান অর্থনীতিবিদ, আর্থার লুইস, শহর এবং গ্রাম, কৃষি এবং শিল্প খাতে মজুরির মধ্যে ক্রমশ সমতা লাভের বিষয়টি একটি তত্ত্বের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে গিয়েছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি সেই ত্তত্বের বাইরে দিয়ে হাঁটছে না। শুধু চা-বাগানগুলিই ব্যতিক্রম। এখানেই শুধু শ্রমিকদের মজুরি বাড়ে না।

এই ব্যতিক্রমের জন্য অনেকে বাজার অর্থনীতিকে দোষ দেন। কিন্ত বিষয়টি আসলে সম্পূর্ণ উল্টো। বাজার অর্থনীতিকে অন্য সব খাতে স্বাধীনভাবে চলতে দিলেও, চা-বাগানে কেবল তাকে বাধাই দেওয়া হয়নি, রীতিমতো নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছে। সেখানকার শ্রমবাজার মুক্ত নয়, মুক্ত নয় সেখানকার শ্রমিকরা। চা-শ্রমিকের ছেলে বা মেয়ে চা শ্রমিকই হবে, সেটাই নিয়ম সেখানে। বংশপরম্পরায় সেটাই চলে আসেছে সেখানে। শ্রমবাজারের এই আদলটি একটি দাসত্বের পরিকাঠামো যা মুক্তবাজার অর্থনীতির মৌলিক নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

সেখানে মজুরিও চাহিদা এবং যোগানের মাধ্যমে নির্ধারিত হয় না। বরং সেটা নির্ধারিত হয় বাজার ব্যবস্থার বাইরে। গার্মেন্টসের ক্ষেত্রেও মজুরি নির্ধারিত হয় বাজার ব্যবস্থার বাইরে। কিন্ত সেখানে বাজার ব্যবস্থা যেহেতু একটি গ্রহণযোগ্য মজুরি নিশ্চিত করতে পারে না, হস্তক্ষেপের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মজুরি বাড়ানো হয়। চা-শ্রমিকদের ক্ষেত্রে করা হয় সম্পূর্ণ উল্টো কাজ। এ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মুক্তবাজার মজুরির যে হার নির্ধারণ করা হয়, হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সেটা কমানো হয়।

একই প্রতিষ্ঠানের কী দ্বিমুখী আচরণ!। আর উভয় ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি হল রাষ্ট্র।

কেন করা হচ্ছে এই আচরণ? চা-শ্রমিকদের জাত-বর্ণের ভিন্নতাই কি এর কারণ? এক সময় বাংলাদেশের চা-খাত ছিল রপ্তানিমুখী এবং দেশের অর্থনীতিতে চা-শিল্পের অবদানও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কিন্ত এসব কারণও একটি বিশেষ জাত-বর্ণের শ্রমিকদের প্রতি রাষ্ট্রের এমন বিমাতাসুলভ আচরণ অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা এবং মানবতার বিচারে গ্রহণযোগ্যতা দেয় না। বাংলাদেশে কত আন্দোলন হয়েছে। কিন্ত চা-শ্রমিকদের জন্য কিছু হয়নি। তারা না খেয়ে মরে গেলেও সেটা তথ্য হিসেবে পত্রিকায় আসে কিন্ত খবর হয় না।

বাংলাদেশ বর্তমানে চা আমদানি করে। অর্থাৎ দশকের দশকের পর একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর শ্রম চুষে নিয়েও এই খাত দেশের চাহিদা মিটানোর সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। তাহলে এখনও দেশের কোন প্রয়োজনে এবং কার স্বার্থে তাদেরকে অর্থনৈতিক বেড়ি দিয়ে আটকিয়ে রেখে একটি মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য করা?

চা-বাগানের মালিক কারা সেটা পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায় স্বার্থটা আসলে কার রক্ষা হচ্ছে। তারা থাকেন ঢাকায়। বছরে কয়েকবার বাগানে আসেন বটে, তবে সেটা পিকনিক করার জন্য। তাদের মূল ব্যবসা ভিন্ন। তাদের ছেলেমেয়েরা জজ-ব্যারিস্টার, অথবা বিলেত-নিউইয়র্কে বসবাস করেন। তাদের নিয়োজিত কর্মকর্তাগণ বাগানগুলি চালান এবং তাদের হাতে মুনাফার টাকা তুলে দেন। তাদের স্বার্থ দেখার জন্য রাষ্ট্র কেন হাজার হাজার মানুষকে মানবেতর জীবনের কানাগলিতে ঠেলে দিবে। আর আমাদের কানা বিবেক এ বিষয়ে আর কতদিন কানা থাকার অভিনয় করে যাবে?

স্বপ্ন এবং আশা মানুষকে সামনের দিকে নিয়ে যায়। দশকের পর দশক রাষ্ট্রে চোখকানা নীতির শিকার এই চা বাগানের শ্রমিকদের কোনো স্বপ্ন বা আশা নেই। তাদের না আছে শিক্ষা, না আছে চা-বাগানের বাইরের জীবন সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান। বিষয়টা এমন নয় যে, আজকে যদি ওদের স্বাধীনতা দেওয়া হয় তাহলে ওরা অর্থনীতির মুলধারায় সম্পৃক্ত হয়ে যেতে পারবে। আজন্ম অন্ধকারে থাকা কারও সামনে হঠাৎ আলো যেমন তাকে দিক-বিদিক করে দেয়, ওদের অবস্থাও তেমনি হবে।

যা করা দরকার, প্রথমে ওদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা। যেহেতু ওদের শ্রমের বাজার মুক্তবাজার অর্থনীতির নীতি মেনে চলে না, সরকারের উচিত ওদের জন্য একটি যৌক্তিক, ন্যায্য এবং অন্যান্য খাতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মজুরির কাঠামো ঘোষণা এবং তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।

দ্বিতীয়ত, দরকার ওদের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্ছলের মানুষ যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা পেয়ে এসেছে, দশকের পর দশক চা-শ্রমিকেরা তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এরা তাই মূল জনগোষ্ঠী থেকে পিছিয়ে পড়েছে। তাই ওদের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে একটু বেশি বিনিয়োগ করাটাই হচ্ছে বিবেকের ডাক। আর শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতের এ বর্ধিত বিনিয়োগের সুবিধা নিতে তাদেরকে প্রণোদিত করতে হবে।

শিক্ষাই পারবে ওদেরকে অর্থনীতির মূল খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার মতো যোগ্য করে তুলতে। মানুষের যোগ্যতা যত বেশি, তার সু্যোগ তত বেশি। যার সুযোগ যত বেশি, তার জীবনের মান তত। এটাই উন্নয়নের মূল সূত্র। এই ঈদে যখন আপনি চায়ের কাপে চুমুক দিবেন, অন্তত একবার ভাবুন কাপের পিছনের এই মানুষজনের কথা।