ফ্রান্সে বুরকিনি বিতর্ক ও বাংলাদেশের হিজাব-সংস্কৃতি

কাজল দাস
Published : 6 Sept 2016, 06:22 AM
Updated : 6 Sept 2016, 06:22 AM

সাম্প্রতিক সময়ে ফ্রান্সের নিস শহরে জনসভার উপর তিউনিসীয় বংশোদ্ভূত ফরাসি এক নাগরিকের লরি তুলে দিয়ে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ঘটানোর জেরে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক তোলপাড় চলছে। এর মাস আটেক আগে রাজধানী প্যারিসও সন্ত্রাসী হামলায় রক্তাক্ত হয়। এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ফ্রান্সসহ পশ্চিমা সমাজে 'ইসলাম' নিয়ে নতুন করে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। একই সঙ্গে নেওয়া হচ্ছে 'ইসলামবিরোধী' কিছু পদক্ষেপও। এরই ধারাবাহিকতায় কান্স শহরের মেয়র ফরাসি মুসলিম নারীদের জন্য শরীর ঢেকে গোছল করা বা সাঁতারের বিশেষ পোশাক 'বুরকিনি' নিষিদ্ধ করেছেন।

বুরকিনি অবশ্য মোটেও ধর্মীয় সিম্বল বা প্রতীকী কোনো পোশাক নয়; সাতারু, ডাইভার বা সার্ফাররা এটা অনেক আগ থেকেই পরছেন। অথচ কান্স শহরের মেয়র এটাকে চিহ্নিত করেছেন 'চরম্পন্থী ইসলামের পোশাক' হিসেবে। (হাফিংটন পোস্ট, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬)। একইসঙ্গে পোশাকটি ফ্রান্সের আরও ৩০টি নগরে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

যদিও গত আগস্টে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কোর্ট এই নিষেধাজ্ঞার উপর রুল জারি করেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টও বুরকিনি নিষিদ্ধ করার পক্ষে মত দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, এ ধরনের পোশাক তাঁদের ঐতিহ্যের পরিপন্থী এবং এটা ফ্রান্সের জাতীয় মুক্তির প্রতীক– ১৮৩০ সালে ইউজিন ডেলাক্রয়ের আঁকা বিখ্যাত চিত্রকর্ম 'লিবার্টি লিডিং দ্য পিপল' এর উন্মুক্ত ও স্বাধীন নারীর ধারণা– তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তিনি বলেছেন, উন্মুক্ত বক্ষের নারী– এটা তাঁর স্বাধীনতাই প্রকাশ করেছে।

অবশ্য ফ্রান্সে বা ইউরোপের অনেক দেশে বোরকা অনেকাংশে নিষিদ্ধ, কোথাও কোথাও নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। কোথাও নিষিদ্ধকরণ নিয়ে ধর্মীয় সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। এমনকী এই বোরকাকে নারীর স্বাধীনতার বিষয় উল্লেখ করে মন্তব্য করেছেন ভারতীয় বিখ্যাত লেখিকা অরুন্ধতী রায়, আমেরিকান বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি পর্যন্ত। এ ছাড়া ইউরোপের অনেক নারী অধিকার সুরক্ষার কর্মীরাও বুরকিনির পক্ষে মত দিয়েছেন।

সমাজের প্রতিটি ঘটনা বা ক্রিয়া ব্যাখ্যা করার জন্য যেমন তার 'পার্টিকুলার সোশ্যাল সেটিংস' বা বিদ্যমান সামাজিক ব্যবস্থা বিবেচনায় নিতে হয়, তেমনি সেটিকে একটা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকেও দেখা খুব জরুরি। পদ্ধতিগতভাবে এটা জরুরি; কারণ, এই যে বিদ্যমান ক্রিয়া তার একটা প্রভাব সমাজে তৈরি হয়। এটা সাময়িক হতে পারে, আবার দীর্ঘস্থায়ীও হতে পারে। এই প্রভাবের ফল ইতিবাচক (উদার) হতে পারে, আবার নেতিবাচকও (রক্ষণশীল) হতে পারে। নেতিবাচক ও ইতিবাচক ফলাফলের বস্তুগত এবং অবস্তুগত প্রভাব দুই-ই হতে পারে।

মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে কয়েকটা প্রত্যয় বোঝা দরকার। যেমন: বোরকা বা পর্দা কী? পোশাক হিসেবে এটা পরার ভৌগলিক তাৎপর্য কী? এর সামাজিক/সাংস্কৃতিক তাৎপর্যই বা কী? এই পোশাক শুধুমাত্র কেন নারীর জন্য প্রযোজ্য হবে? এই পোশাক পরার ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগের সংস্কৃতি আছে কি না? যদি বলপ্রয়োগ করা হয়ে থাকে তাহলে কারা করছেন? কেন করছেন? যারা এটা পরছেন তার নিট সামাজিক আউটলুক কী, মানে আধুনিক সমাজের ব্যক্তিস্বাধীনতার যে জায়গা সেখানে এটা কীভাবে ব্যক্তির জীবনকে প্রভাবিত করছে?

পর্দাপ্রথার যে সামাজিক ইতিহাস রয়েছে, সেখান থেকে জানা যায়, বর্তমান সময়ে ইসলামি সমাজে নারীর মূল্যবোধের অন্যতম একটি উপাদান এই পর্দা হলেও তার উৎপত্তি ইসলাম আবির্ভাবের আগে এবং মূল আরব ভূখণ্ডে এটা বিস্তৃত ছিল। এর প্রয়োজনীয়তা মূলত ছিল ভৌগলিক। যারা এটা পরিধান করতেন তাঁরা মূলত প্রি–মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন, যেমন: প্যাগান ধর্মের অনুসারীরা। এরপর অনেক আব্রাহামিক অনুসারীও এটা পরেছেন।

পবিত্র কোরানে সরাসরি পর্দার কথা খুব কম উল্লেখিত আছে। তবে বিভিন্ন হাদিসে অসংখ্য বিধান রাখা আছে নারীর পর্দা রক্ষার ব্যাপারে। বাইবেলেও নারীর পর্দার কথা উল্লেখ রয়েছে। খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্মে নারীদের মধ্যে মাথা ঢেকে রাখার স্কার্ফ প্রচলিত আছে, যা এখনও দেখা যায়।

হিন্দু বিধানে সরাসরি কোনো পর্দার উল্লেখ না থাকলেও মূলত ১৩ ও ১৪ শতকের দিকে হিন্দু সমাজে এর ব্যাপক প্রসার ঘটে। এখানে নারীদের ক্ষেত্রেও মাথায় ঘোমটা দেওয়ার নিয়ম চালু হয়। জানামতে, বৌদ্ধ ধর্মে নারীদের জন্য এ রকম কোনো বিধান তেমন খুঁজে পাওয়া যায়নি।

বর্তমান সময়ে পর্দাপ্রথার এই রূপ কেবল জোরালোভাবে ইসলামি সমাজের মূল্যবোধের সঙ্গেই টিকে আছে। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, অন্যান্য ধর্মের নারীদের থেকে মুসলিম নারীদের পর্দার জায়গাটা স্বতন্ত্র ও আলাদা। ইসলামে নারীর জন্য পর্দাকে বিধান করা হয়েছে। এটা 'ফরজ' কাজ বলে গণ্য; এর ব্যত্যয় হলে শাস্তির বিধানও রয়েছে। এই শাস্তি বিধানের জায়গাটা আমাদের বিবেচ্য বিষয়। কারণ, এর সঙ্গে একজন নারীর ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বা ইচ্ছার বিষয় জড়িত, তাঁর শরীর ও যৌন-স্বাধীনতার প্রশ্ন জড়িত। বিভিন্ন মুসলিম দেশে নারীদের পর্দার জন্য যে পোশাক পরানো হয়, অনেক ক্ষেত্রে তা নারীর স্বাভাবিক চলাফেরার জন্য উপযোগী নয়। আফগানিস্তান, পাকিনস্তান ও ইরানে এ ধরনের পোশাক বা বোরকা বেশি দেখা যায়।

একজন নারী তিনি যে ধর্মের হোক না কেন, তাঁকে পর্দা করতে হবে কেন? সাধারণত যেসব কারণে বিভিন্ন ধর্মে নারীদের পর্দা করতে বলা হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু বক্তব্য আছে। যেমন: শালীনতা বজায় রাখা, পরপুরুষ থেকে আব্রু রাখা, সৌন্দর্যের ব্যাপার প্রাধান্য দেওয়াসহ নারীর নম্র হওয়া, উত্ত্যক্ত না করা, স্বামী ও পরিবারের বাইরে তাঁকে যেতে না দেওয়া, তাঁর বক্ষদেশ যেন তা অপ্রদর্শিত রাখা হয়, নারী যেন জোরে না হাঁটে ইত্যাদি। এ রকম অসংখ্য নেতিবাচক ধারণা দিয়েই মূলত নারীকে ঘিরে রাখার জন্য সমাজে পর্দা এখনও প্রচলিত আছে।

এই যে পর্দাকাহিনী– এখানে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হল, এর প্রয়োজনীয়তার কোনো একটি দিকও নারীর জন্য নয়; সেটা পুরোপুরি পুরুষের জন্য, নারীকে তাঁর অধীনে রাখার জন্য, নারীর অবস্থানকে অবদমিত রাখার জন্য।

নারীকে বিভিন্ন সমাজ ও ধর্ম বিভিন্নভাবে অবদমিত করেছে। কেউ তাঁর হাতে চুড়ি পরিয়েছে, কেউ পায়ে বেড়ি পরিয়েছে। আর ইসলামি সমাজ তাঁকে পরিয়েছে পর্দা। এটা সম্পূর্ণ পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা বা নারীর উপর পুরুষের জেলাসির ফল। তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে পুরুষের কর্তৃত্ব-ক্ষমতা-সম্পদ ধরে রাখার জন্য নারীকে গৃহবন্দী করার ঐতিহাসিক লিগ্যাসি; যার মধ্যে দিয়ে উৎপত্তি হয়েছে পুরুষতন্ত্রের, পিতৃতন্ত্রের।

পৃথিবীর সব ধর্ম, যা কার্যত পুরুষতান্ত্রিকতা দ্বারাই প্রাধান্য পেয়েছে। সে দিক থেকে নারীর জন্য সমাজে পর্দাপ্রথা একটা নেতিবাচক উপাদান এবং সেই সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিকও বটে।

এখন প্রশ্ন হল, এই অপ্রাসঙ্গিক বিষয় সমাজে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেলে কী হতে পারে? ধর্মের অনেক বিধি বা নিষেধাজ্ঞা– যেমন: পৃথিবীর চারিদিকে সূর্য ঘোরে– এ ধরনের নানা ধারণা ক্ষয়িষ্ণু হতে চলেছে। রাষ্ট্র থেকে ধর্ম আলাদা হচ্ছে। তবুও কেন অনেক কিছু অসংগতি থেকে যাচ্ছে।

পর্দা নারীর জন্য একটা ডিসকন্টেন্ট। আবার এটা অস্বীকার করারও উপায় নেই যে, কাউকে জোর করে পর্দা থেকে বের করে আনা যাবে না। ব্যক্তির ইচ্ছা তাঁর এজেন্সি। তিনি এটা প্রকাশ করতেই চাইবেনই যে কোনোভাবে। যেমন: কারো আত্মহত্যার ইচ্ছা করতেই পারে। কথা হল, তিনি কেন করবেন? একইভাবে প্রশ্ন হল, কোনো নারী পর্দা করতে বা বোরকা পরতেই পারেন, কিন্তু তিনি কেন করবেন?

আজকের ফ্রান্স বা বাংলাদেশের কনটেক্সটে নারীর জন্য পর্দা, সে যে ধর্মের ক্ষেত্রেই হোক না কেন, এটা নিষিদ্ধ বা চালু করার ক্ষেত্রে যে বিষয় গুরুত্বপূর্ণ তা হল, এই পর্দা নারীর জন্য নাকি এটা পুরুষের জন্য। এই আদর্শিক বা আইডিওলজিক্যাল প্রশ্ন খুবই জরুরি। একজন নারী যখনই পর্দা করছেন তিনি তখনই পুরুষতন্ত্রের বিধান লালন করছেন। এই পোশাকের, ক্ষেত্র বিশেষে, ভৌগলিক কোনো সুবিধা ছাড়া আর যা আছে তা সবই অসুবিধাজনক এবং তার পুরোটা ভোগান্তি কেবল নারীকেই নিতে হয়।

নারীকে রোদের মধ্যে অতিরিক্ত কাপড় পরতে হবে, তাঁর গতিবিধি শ্লথ হবে, তাঁর সৌন্দর্যের প্রকাশ কেবল সুনির্দিষ্ট পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য হবে, তাঁকে সবসময় নতজানু হয়ে চলতে হবে।

এ বিষয়গুলো প্রধানত নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, যা উদ্ভূত হয়েছে কেবল পর্দাপ্রথা থেকে। এটা নারীর উপর পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতির চাপিয়ে দেওয়া অবদমন, তাঁর সঙ্গে কোনো উপযোগিতার প্রশ্ন নেই।

ফ্রান্সে বর্তমান সময়ে মুসলিম নারীরা যে পর্দা করছেন বা হিজাব করছেন বা বুরকিনি পরছেন, সেখানেও এ বিষয়টা জরুরি যে, তাঁরা কি কেবল নিজদের ইচ্ছার প্রকাশ করছেন নাকি প্রথাগত পুরুষতান্ত্রিক ধর্মীয় মূল্যবোধকে লালন করছেন? এবং এটা একজন নারীকে মানসিক ও সামাজিক দিক থেকে পুরুষের সমকক্ষতা অর্জনের প্রশ্নে কীভাবে পিছিয়ে রাখছে– সেই জায়গা থেকেই বিষয়টি অনুধাবন করা জরুরি।

একইভাবে বর্তমান সময়ে হিজাব প্রসঙ্গটি ব্যাপক আলোচিত বাংলাদেশের সমাজের ক্ষেত্রেও। ৭০, ৮০, এমনকি ৯০ দশকের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশে নারীদের ক্ষেত্রে সনাতনী বোরকা ছাড়া এ ধরনের পোশাক পরিচিত ছিল না। কিন্তু বর্তমানে দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে হিজাব পরিহিতা নারীর সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বেশি। এর কারণ কী এবং এর ফলাফল কী হতে পারে? এটি ভাবার বিষয়।

যদি বাংলাদেশ ও ইউরোপের নারীদের হিজাব পরার কারণ এনালিসিস করি তাহলে দেখা যাবে এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কিছু কারণ রয়েছে, যেসব কারণে দিন দিন এই পোশাকের ব্যবহার বাড়ছে। ইউরোপে মুসলিম নারী মূলত হিজাব পরছেন যতটা না তাঁর নিজের জন্য, তার চেয়ে বেশি সেখানকার পুরুষের প্রভাবে। এখানে পুরুষের এই প্রভাব পুরোটাই ধর্মচেতনা থেকে আগত। আবার একইসঙ্গে সেখানে ফ্যাশন হিসেবেও কাজ করছে।

এই যে বুরকিনি– এটা কিন্তু যতটা না ধর্মীয় চিন্তার প্রভাব তাঁর চেয়ে বেশি ফ্যাশন চিন্তার প্রভাব। তবে এ ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য সেটা হল, পশ্চিমা মূল্যবোধের সঙ্গে ইসলামি মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব। বিশেষ করে, পশ্চিমে নারীরা যে ধরনের পোশাক পরেন, সেটার সঙ্গে ইসলামি মূল্যবোধসম্পন্ন লোকজন রি-অ্যাক্ট করছেন, পুরুষেরা বেশি করছেন। আবার পশ্চিমা নারীদের এই পোশাক তাঁদের শরীরের উপর স্বাধীনতা ও ব্যক্তিইচ্ছার প্রকাশ।

ফলে এখানে নারী যে ভ্যালু কনফ্লিক্টের শিকার হচ্ছেন, সেটা যতটা না তাঁর জন্য তার চেয়েও বেশি সেখানকার মুসলিম পুরুষের জন্য। একইভাবে এটা ঠিক যে ইউরোপে থাকা অনেক মুসলিম নারীও পর্দা বা হিজাব পরতে পছন্দ করেন না।

কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নারীদের হিজাবের বিষয়টা এত কালচারাল কনফ্লিক্টের ফলাফল নয়। এখানে মূলতঃ ধর্মীয় রাজনীতিই বিদ্যমান। বিশেষ করে, সমাজে শিক্ষার হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যত বেশি কোরানিক ব্যাখার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে ততই তারা বাঙালির সাংস্কৃতিক মিশ্রণ থেকে বের হয়ে আসছে। তাঁরা ওয়াহিবিজমের ব্যাখ্যা গ্রহণ করছেন। নারীদের তাই পর্দার বিষয়টি মানতে হচ্ছে বাধ্যতামূলকভাবে।

একইভাবে পরিবারের শিশুদের নাম ইসলামি মূলবোধ অনুসারে রাখছেন, সব বিজাতীয় সংস্কৃতি বর্জন করছেন। সব ক্ষেত্রেই ধর্মীয় সাংস্কৃতিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। তার সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রিয় সংস্কৃতির ফ্যাশনও যুক্ত আছে। নারী নিচে জিন্স প্যান্ট পরার স্বাচ্ছ্যন্দ্যের সঙ্গে যেমন নিজেকে 'আধুনিকা' ভাবছেন ঠিক তেমনি একইসঙ্গে তাঁর মাথায় হিজাব দিয়ে ধর্মীয় মূল্যবোধও বজায় রাখছেন।

এই জায়গাটা খুব সাইকোলজিক্যাল। মানসিকভাবে এটা কেবল ছড়াচ্ছেই দিন দিন। এখানে পর্দা বা হিজাব থাকা না-থাকার প্রশ্নে যাওয়ার আগে আমাদের দেখা দরকার এই পোশাক নারী কেন পরে? অনেকেই বলছেন, নারী তাঁর নিজের ইচ্ছাতেই এ পোশাক পরছেন। বিষয়টি ঠিক নয়। প্রথমত, হিজাব বা পর্দা কখনও নারীর জন্য বিবেচ্য পোশাক নয়। তারপর এটি পরা না-পরা তাঁর ইচ্ছা-নিরপেক্ষ নয়। এটা প্রতিটি মুসলিম নারীকে পরা জন্য বিধান চালু রাখা আছে।

এই চিন্তা নারীর মনোজগতে জন্ম দেওয়া হয়েছে এবং তাঁর মধ্যে এই পোশাক পরার সম্মতি উৎপাদন করা হয়েছে। এই সম্মতি আবার এসেছে ভয়ের সংস্কৃতি থেকেও। ফলে কোনোভাবেই পর্দা করা বা না-করা নারীর ইচ্ছা-নিরপেক্ষ নয়। তাঁকে ধর্মের কারণেই পরতে হয়। আবার তিনি যদি না পরতে চান তাহলে ধর্মের দোহাই দিয়ে পুরুষই তাঁকে বিভিন্ন নেতিবাচক চরিত্রে চিহ্নিত করেন। সে জন্য এখানে পর্দা নারীর নয়– এটা পুরষতন্ত্রের ডমিনেশনের ফল। নারী নিজের ইচ্ছায় পর্দা নয়, বরং তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধেই পুরুষতান্ত্রিক ডমিনেশন বহণ করে চলছে; তাঁকে এটা বোঝাতে হবে।

এই যে পর্দা বা হিজাবি সংস্কৃতি– এটা সমাজের জন্য যে ফলাফল নিয়ে আসে সেটা আসলে ইতিবাচক নয়। এটা ইউরপে বা আরবে বা অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ বা যে কোনো সমাজের জন্য নেতিবাচক যে ফল বয়ে আনবে তা হল, সমাজে রক্ষণশীলতা উৎপাদন করা ও তা ধরে রাখা। সমাজকে উদারনৈতিকতা থেকে পিছিয়ে দিতে এটা ভূমিকা রাখবে। আজকের মধ্যপ্রাচ্যে তাই-ই হচ্ছে। এ ধরনের অনুদার সমাজে নারীরা যদি পিছিয়ে থাকেন তাহলে একটি সার্বিক মৌলিক ও মানবিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি। এসব ক্ষেত্রে নারী–পুরুষের অসমতা বিকশিত হতে পারে। বিশেষ করে, রাজনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নারীর মতামত প্রাধান্য না পাওয়ায় একটি শক্তিশালী গণতন্ত্র অনুপস্থিত থাকে।

সমতার বিষয়টি সার্বিকভাবে উপেক্ষিত থাকে। নারীর সৃজনশীলতা ও মননশীলতার মতো বিষয় তো পিছিয়ে থাকেই। সে দিক থেকেই এই পর্দা বা হিজাবকে বিবেচনা করে দেখা দরকার।