জলবায়ু পরিবর্তন এবং বাংলাদেশে পরিবেশ পরিকল্পনার সীমাবদ্ধতা

আদনান মোর্শেদ
Published : 5 Nov 2011, 05:47 PM
Updated : 5 Nov 2011, 05:47 PM

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে বাংলাদেশে চিন্তাচেতনায় একটি মৌলিক সীমাবদ্ধতা রয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞ আলোচকরা এবং সেই সাথে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরাও, একপাক্ষিকভাবে একটি ভয়াবহ বিপর্যয়ের ওপরেই শুধু আলোকপাত করছেন যাকে আমি বলবো "দক্ষিনাঞ্চলীয় হুমকি": অর্থাৎ, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলীয় উপকূলের একটি বিরাট অংশ বঙ্গোপসাগর গ্রাস করে ফেলবে। তা ছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলে মাটির নিচের মিঠাপানির জলাধার স্তর ক্রমাগত লবণাক্ত হবে এবং একটি বিশাল উপকূলীয় জনগোষ্ঠী তাদের বাসভূমি হারিয়ে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিনত হবে। এল গোরের বিখ্যাত ডকুমেন্টারি, এন ইনকনভেনিয়েন্ট ট্রুথ (২০০৬), এই ধারণা সম্পর্কে জন সচেতনতা বাড়াতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর যে সমতল দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে বলে আশংকা করা হয় তার মধ্যে বাংলাদেশ আর মালদ্বীপ অন্যতম।

বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন নীতিমালায় দক্ষিণাঞ্চলীয় হুমকিকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু এই হুমকির ওপরে নীতিনির্ধারকদের একতরফা আলোচনার ফলে দেশের অন্যান্য পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকাগুলো নীতিমালা নির্ধারণ বিতর্কে অবহেলিত হচ্ছে। যেমন, দেশের ভৌগোলিক কেন্দ্রে অবস্থিত ঢাকার অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং এর সাথে প্রভাবশালী মহলের বিবেকহীন ভুমিদস্যুতা ও পরিবেশবিরুদ্ধ শিল্পায়ন কোনো অংশেই জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির চেয়ে কম তো নয়ই, বরং অনেক বেশি গুরুতর। এখানে একটি তুলনামূলক আলোচনা আসতে পারে। গত শতাব্দিতে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হার ছিল ১.৮ আর ৪ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের ভেতরে। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, এই হারে উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর গড়ে ৩.২ মিমি করে বাড়ছে। এই হারে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৫ ফুট বেড়ে বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলের ১২.৫ মাইল প্রস্থ একটি উপকূলীয় বেষ্টনী সাগর গহ্বরে যেতে লাগবে ৩৭৫ বছর (জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যান্য সম্ভাবনাগুলোকে গণনায় না এনে)। ১০০ মাইল যেতে লাগবে ৩০৮০ বছর।

এর বিপরীতে ঢাকার প্রলয়ঙ্করী নগরায়নের ফলে পরিবেশগত হুমকি অনেক বেশি আসন্ন। বৈধ ও অবৈধ আবাসন প্রকল্পগুলো যেভাবে ঢাকার জল-স্থল ভৌগোলিকতাকে ধংস করছে তাতে এই দেশের নদীমাতৃক বদ্বীপের চরিত্র পাল্টে যেতে তিন দশকের বেশি সময় লাগবে না। যে নদীগুলো — বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, তুরাগ, বালু, এবং শীতলক্ষ্যা — ঢাকা বা বাংলাদেশের ভৌগোলিক কেন্দ্রের সীমানা নির্ধারন করেছে সেগুলো আজ শিল্পবর্জ্যের নালায় পরিণত হয়ে রাসায়নিকভাবে মৃতপ্রায়। ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকার জনসংখ্যা তিন কোটি ছাড়িয়ে গেলে আবাসনের জন্য সৃষ্টি হবে একটি ভীতিকর নগর দানব যেটা সমস্ত নদীনালা খালবিল গ্রাস করে ফেলবে। ঢাকা পরিণত হবে একটি আলোবাতাসহীন ইট এবং কনক্রিটের জঙ্গলে। একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ঢাকা প্রতিদিন ২২০ হেক্টর জলাভূমি হারাচ্ছে ভুমিদস্যুদের কাছে। হাজারিবাগের টেনারীগুলো প্রতিদিন গড়ে ২২,০০০ কিউবিক লিটার অপরিশোধিত তরল বর্জ্য এবং ১৯ টন ঘন বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় ঢেলে দিচ্ছে। ঢাকার পশ্চিম , দক্ষিন এবং পূর্ব সীমানায় নদীতীরগুলো ঘিরে আছে ইটভাটা যেগুলো ঢাকার ৩৯% বায়ুদুষণের জন্য দায়ী। এই ইটভাটাগুলোর জালানি চাহিদা মেটাতে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে দেশের বনাঞ্চলগুলো।

ঢাকার দানবীয় নগরায়নকে জলবায়ু সম্পর্কিত নীতিমালার বাইরে চিন্তা করা হবে দেশের ভবিষ্যতের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। এখানে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলাদেশের নগরায়নের প্রক্রিয়াকে দেখা যেতে পারে। বর্তমান বিশ্বে নগরকে ক্রমশ দেখে হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের মূল যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে। পৃথিবীর মোট স্থলভূমির মাত্র ৩% নগর এলাকা অথচ এই ক্ষুদ্র স্থান সীমার ভেতরে বাস করছে পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ। পৃথিবীর মোট গ্রিন হাউস গ্যাসের ৮০% তৈরি করছে শহর ও নগর কেন্দ্রগুলো। ২০৫০ সালের ভেতরে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৭৫% বাস করবে নগর এলাকায় এবং এই নগরায়ন প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বেশি অগ্রযাত্রা ঘটবে এশিয়ায়। ২০১৫ সালের মধ্যে পৃথিবীর বৃহত্তম ২১ মহানগরের ১২ টি হবে এশিয়ায় অথবা ৫ টি হবে ভারত উপমহাদেশে। ২০৩০ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর নগর জনসংখ্যা হবে ৫৬%।

কাজেই সুষ্ঠু নগর পরিকল্পনার মাধ্যমে পরিবেশ ভারসাম্য তৈরিতে নীতিমালা প্রণয়ন মানসিকতায় আনতে হবে কাঠামোগত পরিবর্তন। বৈশ্বিক উষ্ণতার বিষয়টি আজ একটি রাজনৈতিক বিতর্কে পরিনত হয়েছে। মুক্তবাজার, প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক, এবং ডানপন্থী অর্থনীতির প্রবক্তারা বৈশ্বিক উষ্ণতাকে মানবসৃষ্ট নয় বরং প্রকৃতির আবর্তনশীল খেয়াল বলে দাবি করছেন। মানব উন্নয়নে প্রাকৃতিক সম্পদের অফুরন্ত ব্যবহার তাদের মূল দর্শন। অন্যদিকে পরিবেশবাদীরা বলছেন বৈশ্বিক উষ্ণতা মানবজাতির অপসৃষ্টি। তাদের মতে মুক্তবাজারের অবারিত শিল্পায়ন ও তার ফলে আগ্রাসী জালানি চাহিদা এবং ভোগবাদী আধুনিক জীবনযাত্রা প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপরে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করেছে। কাজেই প্রাকৃতিক সম্পদের সচেতন ব্যবহার এবং পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের নীতিমালাকে প্রাধান্য দিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিজ্ঞানও এই রাজনৈতিক সমীকরণের বাইরে নয়। কিন্ত অপরিকল্পিত নগরায়নের বিভিন্ন পরিবেশগত দিকগুলোকে পর্যালোচনা করলে এই রাজনীতিকরণ অবান্তর মনে হয়। কারণ মহানগরের বিশাল কার্বন পদাঙ্ক, যেমন কলকারখানা, জালানিগ্রাহী যানবাহন এবং ঘন দালান সমাবেশ, সরাসরি বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়াচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা আজকাল মতামত দিচ্ছেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ বিপর্যয়কে রৈখিকভাবে প্রাধান্য না দিয়ে এর সাথে দেশের সামগ্র্রিক নগরায়ন প্রক্রিয়াকে সংযুক্ত করতে হবে। তা নাহলে বর্তমানের ভারসাম্যহীন নগরায়ন গ্রাস করবে এই দেশের নদী আর স্থলের নাজুক ভৌগলিক সংযোগ ব্যবস্থাকে। ঢাকা যেভাবে বেড়েই চলেছে , বিশেষ করে পশ্চিম, পূর্ব, এবং উত্তর দিকে , তাতে ঢাকার সীমানা দ্রুতই পশ্চিমে তুরাগ নদীকে ভরাট করে এবং উত্তরপশ্চিমে ঢাকা-আরিচা মহা সড়ক ধরে বেড়ে আরিচা ঘাট পর্যন্ত পৌছে যাবে। সবচেয়ে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে শহরের পূর্ব সীমানায়। বালু নদী ভরাট হয়ে শহর শীতলক্ষ্যা পর্যন্ত আগ্রাসন চালাবে ২০২৫ সালের মধ্যে। ঢাকার পূর্বসীমানায় তাকালেই দেখা যাবে নিচুজলাভূমি এবং কৃষিজমি গ্রাস করে গড়ে উঠছে বিভিন্ন ইউটোপিয়া: গ্রীন মডেল টাউন, আনন্দনগর, আফতাবনগর, সোমালি প্রজেক্ট, ইত্যাদি। ঢাকা সিটি বাইপাস আর ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক হবে এরকম দানবীয় নগরবৃদ্ধির মেরুদণ্ড। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলীয় উপকূল হারিয়ে যাবার অনেক আগেই এ ধরনের অপরিকল্পিত নগরায়ন হবে এই দেশের অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।

আদনান মোর্শেদ: স্থপতি এবং নগর পরিকল্পনাবিদ, সহযোগী অধ্যাপক, কাথলিক ইউনিভার্সিটি অফ এমেরিকা, ওয়াশিংটন, ডি সি (লেখাটি সম্প্রতি ওয়াশিংটনের থিন্ক ট্যান্ক উড্রো উইলসন সেন্টার-এ সমর্পিত প্রবন্ধের ওপরে ভিত্তি করে তৈরি)