অনলাইনে খালেদা জিয়া: কতটুকু আশার কতটুকু আশঙ্কার

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 5 Sept 2016, 04:28 AM
Updated : 5 Sept 2016, 04:28 AM

বেগম খালেদা জিয়াকে অভিনন্দন জানানোর একটা অন্তত কারণ পাওয়া গেল। মাঝে মাঝে জনসমক্ষে হাজির হওয়া বিএনপি নেত্রীর এখন ঘোর দুর্দিন। এমন সময় কখনও আসবে তারা তা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেননি। যে দল শুরু থেকে গদিতে, যার জন্ম সেনা ছাউনিতে, দেশশাসনে না আসলে যার জন্মই হত না তার জনসম্পৃক্ততা কতখানি বাস্তব– এ যেন তার জ্বলন্ত উদাহরণ।

বিএনপি ভুলে গেছে মুসলিম লীগ বা জামাতের যে অংশ তাদের পেছনে থেকে শক্তি জুগিয়েছিল তারা এখন 'ফসিল'। বঙ্গবনধু হত্যাকাণ্ড, চার নেতার খুন আর ইতিহাস বিকৃতির কিছুটা সফলতার পর তাদের কাজ শেষ; বাকিটা ছিল জনগণের ওপর। সেই বিভ্রান্ত জনগণ সময়ের হাত ধরে আজ এমন এক জায়গায়– যেখানে মিথ্যার টিকে থাকাটা কঠিন। বিএনপি কোনোদিন ভাবতে পারেনি, 'ডিজিটাল যুগ' বলে একটা যুগ আসতে পারে, যখন ভারত বিরোধিতার সস্তা শ্লোগান দেওয়ার পর তাদের নেতাদের ভারত-ভজনা করার ছবি মানুষ জেনে যাবে মুহূর্তে। তাদের মাথায় আসেনি একদিন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া অবধি বাঙালি জেনে যাবে পাকিস্তানের দোসরদের অপকর্ম অথবা তাদের বিচার ও শাস্তি হতে পারে এ দেশে। সে কারণেই হয়তো তারা ডিজিটাল বাংলাদেশের ব্যাপারে আপত্তি না করলেও এ নিয়ে ব্যঙ্গ করত। ভাবখানা এই– এটি একটি অলীক কাজ।

আজ যখন বেগম জিয়া নিজে ফেসবুক ও টুইটারে যোগ দিলেন, তাঁকে ধন্যবাদ জানাব বইকি।

বিএনপি একদা আমাদের যৌবনে ছিল অপ্রতিরোধ্য দল। পেশিশক্তি আর নেগেটিভ রাজনীতির দৌড়ে এ দেশ যখন 'ছায়া পাকিস্তান' হওয়ার পথে, তখন ছিল তার রমরমা সময়। ধানের শীষে যোগ দেওয়ার তুমুল প্রতিযোগিতায় মধ্যরাতের খবর দেখা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম। বি চৌধুরী, মওদুদ আহমেদ, শাহ নাজমুল হুদা, কর্নেল অলি, আমীর খসরু, খোকা সাহেব, মীর্জা আব্বাসরা তখন দেশের 'বাবা-চাচা'। তখন প্রায় নিশ্চিত আওয়ামী লীগ ভারতের কংগ্রেসের মতো হয়ে গিয়েছে; তার জায়গা বিরোধী দলে চিরস্থায়ী।

অতএব কিছু পেতে হলে খালেদা জিয়ার কাছেই যেতে হবে। কত তত্ত্ব, কত আজগুবি কথা! কেউ বলেছিলেন জিয়াউর রহমান নাকি এ দেশের একমাত্র নেতা! কারো মতে, তিনি একটি তেলের ড্রামের ওপর দাঁড়িয়েই দেশ স্বাধীনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে তেলের ড্রামের 'তৈলমর্দন' এখন শেষ। এখন বিএনপির ছাত্রছাত্রীরা কোথায় কেউ জানে না। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ওপর চড়াও হওয়া ছাত্রদল অত অঘটনের পরও মেয়েদের ভোটে জিতে বেরিয়ে এসেছিল। নারীরা বলেছিলেন, যারা মারতে জানে তারা নাকি বাঁচাতেও জানে! সেই বিএনপি এবং তাদের অঙ্গ সংগঠনগুলো এখন নিস্ক্রিয় অথবা অর্ধমৃত।

যে যাকে বা যারা যাদের দায়ী করুক না কেন এটা মানতেই হবে বেগম জিয়ার ইমেজ আর 'অনাধুনিক' দর্শনও একটা বড় ব্যাপার।

কিন্তু যে ছবিটি দিয়ে 'ডিজিটালয়ন'এর শুরু বা যে ছবিটি মিডিয়ায় এসেছে তা আমার কাছে সন্দেহ ও উদ্বেগের মনে হয়েছে। তাঁর একপাশে বসা মীর্জা ফখরুলের চোখে-মুখে ছিল উদ্বেগ। নেত্রী এ কাজ ঠিকভাবে করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তার বলিরেখা দেখা গেছে মহাসচিবের কপালে, তবে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি আন্তরিক। আরেক পাশে বসা খন্দকার মোশারফেরও চোখে ভীতি। তাঁর পাশেই জনাব মওদুদ আহমেদ। ছবিটি ভালো করে দেখুন, তাঁর মুখে-চোখে প্রচ্ছন্ন কৌতুকের চিহ্ন। তিনি কোনটি হলে খুশি হতেন বলা মুশকিল। যেন চাইছেন দেখি না ম্যাডাম কী করে পারে। এটাই এখনকার বিএনপির সুরতহাল!

নেতাদের ভেতর আন্তরিকতা আর ভালোবাসার ঘাটতি, আদর্শের অভাব আর জামায়াতহীনতায় ক্লিশে এক ম্যাড়মেড়ে জাতীয়তাবাদী দল। ধন্যবাদ জানানোর পরও তাই আমার মতো মানুষের কাছে খালেদা জিয়ার ডিজিটালায়ন বিশাল এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন। কিন্তু কেন?

গোড়াতেই বলি, আমাদের দেশের কালচারে যারা টপে থাকেন বা শীর্ষ পদের লোক তাঁরা কখনও নিজেরা কিছু করেন না। যেমন ধরুন, কোনো ব্যাংকের নির্বাহী থেকে ক্লাবের সভাপতি কিংবা মন্ত্রী-মিনিষ্টার কেউ কোনোদিন নিজের বাণী বা বিবৃতি নিজে লেখেন বলে শুনেছেন, না দেখেছেন? এগুলো লিখে দেয় তাঁদের সচিব-সেক্রাটারি বা অধস্তন কেউ। মাঝে মাঝে তারা তা পড়ে শুনিয়ে অনুমোদন নেয়। পরে এমন হয় শীর্ষ ব্যক্তিটির নাম ব্যবহার করলেও তিনি তা পড়েন না, জানেন না, এমনকী খবর পর্যন্ত রাখেন না।

বাণী বা বিবৃতি দেওয়ার নিয়মকে আমি বলি 'মেহেরবানি'। এই মেহেরবানিতে যদি কখনো কোনো অঘটন বা সর্বনাশ ঘটে যায় তখন শুরু হয় দোষারোপের রাজনীতি।

খালেদা জিয়া নিয়মিত ফেসবুক বা টুইটার চালাবেন– এটা তিনি নিজেও বিশ্বাস করেন না! তাঁর সে সময় কোথায়? আগ্রহই-বা কোথায়? ফলে এই যে কাজ, এর পেছনে যেমন উপদেশক বা উপদেষ্টারা, তারা এসব অ্যাকাউন্ট চালাবেন। এদের আসল উদ্দেশ্য কী? কেন তারা এর ব্যবহার করবেন– সেটাই মূলকথা।

মানতে হবে বিএনপির রাজনীতি গঠনমূলক নয়। বিগত বছরগুলোতে তারা এ দেশের মানুষের জানমাল নিয়ে খেলতেও দ্বিধা করেনি! বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে এত হিংসা এত মারামারি আগে কখনও দেখা যায়নি। যে বিএনপি আগুন জ্বালিয়ে মানুষ মেরে বার্ন ইউনিটে কান্নার রোল তুলে যে সরকার পতন চেয়েছিল সেই সরকারের বিরুদ্ধে, তারা এখন মহাত্মা গান্ধীর 'শান্তিনীতি' মানবে কোন দুঃখে?

আমাদের সরকারের ভেতর গলদ অনেক। তাদের বড় সমস্যা দলের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা মোশতাক আর সুবিধাবাদীরা। আওয়ামী লীগ সরকারে থাকাকালীন কোনো কারণেই জনপ্রিয় দল থাকে না। শেখ হাসিনার দৃঢ়তা আর বলিষ্ঠতার কারণে যতটুকু আছে তার বাইরে কেবল চামচামি আর হালুয়া-রুটির গন্ধ! কাজেই জনগণকে রাগিয়ে তোলার ব্যাপারটা তেমন কঠিন কিছু না। তবে জনগণ রাগে না। কারণ, তাদের পেটে ভাত আছে। তাদের হাতে টাকা আছে। উন্নয়নের একটা সুবাতাস কিন্তু শরীরে লাগছে সবার। ফলে জাগানোর কাজ মাঠে মারা যাচ্ছে বারবার।

কিন্তু বিএনপির রাজনীতিতে যারা ষড়যন্ত্রের বলে দেশশাসনে যেতে চায় তারা বসে থাকবে? তারা এই ফেসবুক ও টুইটারকে নিশ্চিতভাবেই অন্য কাজে লাগাতে চাইবে।

আজকাল আমরা খোলা মিডিয়া বা অবাধ তথ্যপ্রবাহের আশীর্বাদ যেমন ভোগ করি তেমনি পোহাতে হয় এর দুর্ভোগও। বিএনপির ষড়যন্ত্রকারীরা যে কাজ মাঠে-ময়দানে করতে পার‍ছে না সে কাজ ইলেকট্রনিক মাধ্যমে অপব্যবহার করে হাসিল করতে চাইবে না– এমন ভাবা কি অযৌক্তিক?

এখন মানুষ সভা-সমাবেশে যেতে চায় না। আগের মতো মাঠে গিয়ে ভাষণ শোনার দিন নেই। সময়ের হাত ধরে ব্যস্ত মানুষ নিজেই একেকটি 'মিডিয়া'। যে কারণে দুনিয়ার দেশে দেশে আন্দোলন বা অপ-আন্দোলন বা সরকার পতনের মতো কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে ইলেকট্রনিক মিডিয়া তথা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম।

সেখানে এই ফেসবুক ও টুইটার কোন কারণে কে ব্যবহার করবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? বেগম জিয়ার জনপ্রিয়তা এখনও অনেক। আছে লেখাপড়া না-জানা আমজনতা ও ধর্মের মতো সংবেদনশীল বিষয়, আছে জামায়াতিদের ষড়যন্ত্র ও প্রতিহিংসা। সবকিছু মিলেমিশে তারা ফেসবুক ও টুইটার যোগে বেগম জিয়ার নামে অপপ্রচার চালিয়ে দেশের অনিষ্ট বা সরকার পতনের মতো কাজ করবে না– এমন গ্যারান্টি আছে?

সেনসিটিভ বাংলাদেশে ইতোমধ্যে আমরা রামুর ঘটনা দেখেছি। বিশ্বশান্তির প্রতীক গৌতমবুদ্ধের মূর্তি ভাঙা, সাম্প্রদায়িকতার আগুন জ্বালিয়ে জনপদ ছারখার করা দেখেছি আমরা। এমন ঘটনা বাংলাদেশে হিন্দুদের বেলায়ও ঘটেছে। ঘটেছে শান্তিপ্রিয় মুসলমান নিধনে। তাই ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘে ভয় পাব– এটাই স্বাভাবিক।

আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, খালেদা জিয়ার মতো ব্যাকফুটে থাকা নেত্রীর এই ডিজিটালায়নের পেছনে তাঁর পুত্র তারেক জিয়া ও বিএনপির মতলববাজদের হাত আছে। যারা সংসদীয় কায়দায় দেশের শাসনভার নিতে পারবে না জেনে অসাধু ও অনিষ্ট করার পথে গণ্ডগোল লাগাবে, তারাই আছে এর পেছনে!

আর যদি আমাদের এই দুশ্চিন্তা মিথ্যা প্রমাণ করে বেগম জিয়ার ইলেকট্রনিক আগমন আনন্দ আর ভালো কিছুর হয়ে ওঠে– বুঝতে হবে, আমাদের রাজনীতি ঠিক পথে হাঁটতে চাইছে।

অতীত বা বর্তমান এর কোনোটাই সমর্থন করে না বলে খালেদা জিয়ার ফেসবুক ও টুইটারে আগমন সন্দেহের হয়ে থাকল আপাতত। বাকিটা সময়ের হাতে।