ফাঁসিতেই কি শেষ, জামায়াতের অর্থসাম্রাজ্যের কী হবে?

মো. আনোয়ার হোসেনমো. আনোয়ার হোসেন
Published : 3 Sept 2016, 06:54 PM
Updated : 3 Sept 2016, 06:54 PM

রাত আটটায় এ লেখা যখন লিখতে বসেছি তখন একাত্তরের বদর বাহিনীর কমান্ডার, জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা, বর্তমান জামায়াতের অর্থসাম্রাজ্যের প্রধান স্তম্ভ, মহাবিত্তশালী টাইকুন, চট্টগ্রামের কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসীমকে অবর্ণনীয় নির্যাতন ও হত্যার সরাসরি নির্দেশদাতা মীর কাসেম আলীর ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। সর্বমোট ৪৫ জন আত্মীয়-স্বজন এসেছিলেন তার সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা করতে। তাদের মধ্যে মোট ৩৮ জনকে কাসিমপুর কারাভ্যন্তরে প্রবেশ করে মীর কাসেমের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ৬টা ৩৫ মিনিটে সাক্ষাত শেষে তারা ফিরে গেছেন।

প্রায় তিন ঘণ্টা সাক্ষাতের পর কারাগারের বাইরে এসে মীর কাসেমের স্ত্রী বলেন, "যারা ফাঁসি দিচ্ছে তারা জয়ী হবে না। এই মৃত্যু ইসলামের জন্য মৃত্যু। এই মৃত্যু শহীদের শামিল।"

এমন উক্তি এর আগের যুদ্ধাপরাধী দণ্ডপ্রাপ্তদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের মুখে আমরা শুনেছি। একাত্তরের কৃতকর্মের জন্য সামান্য পরিতাপ বা অনুশোচনাও এদের হয়নি। তবে একটা ব্যতিক্রম দেখছি এবার। এর আগে জামায়াত ও বিএনপির অন্য শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির আগে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো যেভাবে সরাসরি সংবাদ প্রচার করেছে, এবার তার ব্যতিক্রম লক্ষ্য করেছি। তার একটি কারণ হয়তো এই যে, এবারের অপরাধীর ফাঁসি ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হচ্ছে না। কেরানীগঞ্জে সে কারাগার স্থানান্তরিত হবার পর এই প্রথম ঢাকা থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে কাসিমপুর কারাগারের ফাঁসির মঞ্চে দণ্ড কার্যকর হবে।

দূরত্বের এই কারণ ছাড়াও গত পয়লা জুলাই হলি আর্টিজানে নারকীয় জঙ্গি আক্রমণ ও হত্যাযজ্ঞের সময় টিভি চ্যানেলগুলোর অনিয়ন্ত্রিত সম্প্রচার কিংবা ইতোপূর্বে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের অযাচিত চলতি বর্ণনা যেভাবে সমালোচিত হয়েছিল, তারপর সম্ভবত স্বনিয়ন্ত্রণ ও সরকারি নিয়ন্ত্রণ উভয়ের প্রয়োগে মীর কাসেমের ফাঁসির খবর প্রচারে এবারে আমরা পরিমিতিবোধ আমরা দেখছি।

শেখার বা দায়িত্বশীল হয়ে ওঠার আসলে শেষ নেই। নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষ ও প্রতিষ্ঠান তার স্বাক্ষর রাখছে।

আর হয়তো কয়েক ঘণ্টা। ফাঁসি কার্যকর হবে। একাত্তরের ঘাতক মীর কাসেম আলী কি স্বপ্নেও তা কখনও ভেবেছিল? এ দেশ তারা দখল করে নিয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে। মুক্তিযোদ্ধা নামধারী জেনারেল জিয়াউর রহমানকে প্রথমে এবং পরে জেনারেল এরশাদ ও বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়াকে সামনে রেখে, পরাজিত পাকিস্তানের দালাল জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দল ও গোষ্ঠীর এজেন্ট যারা রাষ্ট্রপ্রশাসন, সেনাবাহিনী, বিচার বিভাগ, গোয়েন্দা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষায়তন, মিডিয়া এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে শক্ত অবস্থা গড়ে তুলেছিল, তাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী মীর কাসেমের ভাবনায়ও আসবার কথা নয় যে, তার ফাঁসি হবে এই বাংলায়– জীবন বাঁচাতে তার দেওয়া দুশ কোটি টাকার মার্কিন ও ইউরোপীয় লবিস্ট ব্যর্থ হবে। ব্যর্থ হবে মার্কিন প্রশাসন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সৌদি আরবের বাদশা বা তুরস্কের রাষ্ট্রপতি এরদোগান এবং এদেশে জামায়াতকে রক্ষাকারী বেগম খালেদা জিয়া ও তাঁর দল বিএনপি।

এখন এই সময়ে এক এক করে তুরুপের সকল তাস ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। তা সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশের অতিসাধারণ মানুষের অনিঃশেষ মনোবল, বহুনদী রক্তে কেনা বাংলাদেশের প্রতি তাদের অকৃত্রিম ভালোবাসা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু নামটির প্রতি গভীর মমতা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আস্থা আছে এমন রাজনৈতিক শক্তির শক্তিশালী ঐক্য। আমাদের অশেষ সৌভাগ্য যে, এ সব কিছুর সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছিল কঠিন বিপদে কাণ্ডারী হিসেবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ়চেতা ও অনমনীয়, প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব।

শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের কাছে তিনি নিজেকে সেই উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যেখানে বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, অপার সম্ভাবনার দেশে পরিণত হয়েছে। জঙ্গি দমনে উন্নত বিশ্বের পারঙ্গমতাও অর্জন করছে। সে কারণেই ব্যর্থ হয়েছে ষড়যন্ত্রকারীদের নীল-নকশা।

এখন রাত সাড়ে দশটা। ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। বাইরে শ্লোগান শোনা যাচ্ছে। প্রশ্ন হল, একাত্তরের এই ঘাতকের ফাঁসির পর তার অর্থসাম্রাজ্যের কী হবে? জামায়াতে ইসলামীর নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংক, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য অর্থপ্রতিষ্ঠানের কী হবে?

এসব প্রশ্নে সরকারের খুব বেশি মাথাব্যথা আমরা লক্ষ্য করিনি। আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত নেতা-কর্মীদের দৃষ্টি সেসবের প্রতি, যেমনটা ছিল স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ লুটপাটের প্রতি। বঙ্গবন্ধু যাদের নাম দিয়েছিলেন, 'চাঁটার দল'।

এ ক্ষেত্রেও আবার তাকাতে হবে আমাদের কাণ্ডারি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি। যে অবিচল চিত্তে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ আপনি এগিয়ে নিয়ে এসেছেন, তা কার্যকর করছেন, সেই একই চিত্তে ও দৃঢ়তায় আপনি জামায়াতের উপর নির্ধারক আঘাতটি হানুন। তাদের অর্থসাম্রাজ্যের উপর কঠোর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ জারি করে এদের শুকিয়ে মারার ব্যবস্থা নিন। বাংলার মানুষের বহু রক্ত এরা গত চার দশক ধরে শুষে নিচ্ছে। এবার তার উল্টোটা হোক। তাহলেই কেবল জঙ্গি অর্থায়নের পথ বন্ধ হবে– অপার শান্তি-মানবিকতা ও অব্যাহত প্রগতির দেশ হবে বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার সিংহদ্বারে পৌঁছে যাবে এদেশের ওইসব মানুষ যারা এদেশ সৃষ্টি করেছে শুধু নয়, তাকে বুক আগলে রক্ষাও করছে।