সিডও সনদ ও বাংলাদেশের নারী

দিল মনোয়ারা মনু
Published : 3 Sept 2016, 04:03 AM
Updated : 3 Sept 2016, 04:03 AM

বিশ্বের সব দেশে নারীরা অধিকার আদায়ের আন্দোলন করছেন। সিডও সনদসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নীতিমালাকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী নারী আন্দোলন একসূত্রে গাঁথা হচ্ছে। এভাবেই ক্রমাগত নারী আন্দোলন শক্তি সঞ্চয় করে চলেছে।

জাপান আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলন আর আমাদের জাতীয় নারী আন্দোলন অভিন্ন; বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এসব আন্দোলনের মূলকথা নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করা। এখানে যেমন প্রয়োজন পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা তেমনি রয়েছে রাষ্ট্রের বিশেষ দায়িত্ব।

৩ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সিডও দিবস। সিডও হল জাতিসংঘের 'নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ' সনদ। ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ সিডও সনদ গ্রহণ করে। এর পাঁচ বছর পর ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকার সিডও অনুমোদন করে। তবে সিডওর প্রাণ হিসেবে চিহ্নিত দুটি ধারার ওপর থেকে সংরক্ষণ তুলে না নেওয়া হয়নি এখনও।

ফলে কাগজে-কলমে নারীর অধিকারের কথা স্বীকৃত হলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন নেই। শিক্ষায় কর্ উদ্দীপনায় পুরুষের পাশাপাশি নারীদের আসার চেষ্টা দৃশ্যমান হলেও তাঁরা কর্মক্ষেত্রে ও সমাজজীবনে অহরহ নির্যাতিত হচ্ছেন।

বিশ্বের অনুন্নত অংশে শিক্ষায় ও কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকায়, সর্বোপরি ধর্মীয় সংস্কার ও সামাজিক নিস্পেষণের জাঁতাকলে পড়ে নারী যেমন তাঁর প্রাপ্য অধিকার পাচ্ছেন না, তেমনি নির্যাতিত নিগৃহীত হচ্ছেন নানাভাবে। নারীর প্রতি সহিংসতা নানাভাবে নানা কৌশলে ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, ৮৭ ভাগ নারী নিজগৃহে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন।

নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধের জন্য কত কথা বারবার বলছি– সভা, সেমিনার, গোলটেবিলের আলোচনা শুনতে শুনতে ত্যক্তবিরক্ত হচ্ছি। এটা যেমন সত্য; কিন্তু না বলেই বা উপায় কী?

একই ঘটনা যদি বারবার ঘটতে থাকে বা এর মাত্রা ও নিমর্মতা যদি সমাজকে ক্রমাগত বিদীর্ণ করতে থাকে, নারীর অস্তিত্ব যদি হুমকির মুখে পড়ে বিপন্ন হয়ে ওঠে, তবে না বলে কি পারা যায়? যদিও জানি, দীর্ঘদিন ধরে বারবার বলেও এর তেমন টেকসই কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। কিন্তু লক্ষ্য পূরণের আগে লড়াই থামালে তো চলবে না; লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

অতীতে নারী নির্যাতনের সূত্রপাত হয়েছিল আইনের বাস্তবায়ন ও নীতিমালার সঠিক প্রফলন না ঘটায়; এখনও যা অব্যাহত রয়েছে। নারী নির্যাতনের হার বৃদ্ধি এবং নিত্যনতুন ধরনের কথা বিবেচনায় আনলে শঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না। কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নির্যাতকরা শিখে নিয়েছে নিপীড়ন ও নির্মমতার নানা কৌশল। এসিড থেকে আগ্নেয়াস্ত্র সবই প্রয়োগ করা হচ্ছে নারীর উপর।

কিন্তু আমরা এ-ও জানি, নারীরা সব বাধাকে তুচ্ছ করে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে সামিল হচ্ছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা উদ্যোগের মধ্য দিয়ে নারীরা অগ্রগতির পথে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছেন। নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও তাঁরা ভূমিকা রাখছেন। ভূমিকা রাখছেন কৃষিতে, কলকারখানায় ও পোষাক শিল্পে। সাহিত্য, বিজ্ঞান, ক্রীড়া, সাংবাদিকতা, জাতিসংঘ শান্তি মিশনে অংশগ্রহণ এবং সবশেষ পর্বতারোহণের মতো চ্যালেঞ্জিং উদ্যোগেও সফল হচ্ছেন তাঁরা।

কিন্তু এরপরও বড় সত্য হচ্ছে, সব ক্ষেত্রে নারীরা এখনও সমানভাবে এগিয়ে আসতে পারছেন না। নারীর ক্ষমতায়ন ঘটেনি সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবারসহ সব অঙ্গনে। নারীর অগ্রগতির পথ অবাধ ও উন্মুক্ত করতে তাঁদের ক্ষমতায়নের কোনো বিকল্প নেই।

বছরে কয়েক আগে নেপালের কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে সম্মিলিত উদ্যোগ শীর্ষক দুদিনব্যাপী সেমিনারে দক্ষিণ এশিয়ার নারী নেত্রীরা নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাঁরা সহিংসতা বন্ধে নীরবতা ভেঙে নারীদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

যদিও নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে বাংলাদেশ সরকার নানা ধরনের আইন প্রণয়নসহ আন্তর্জাতিক নীতিমালায় স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, আইন প্রণয়ন করেও তার সঠিক প্রয়োগের অভাবে এই সহিংসতা বন্ধ করা যাচ্ছে না।

কমনওয়েলথ সচিবালয় আয়োজিত এক সম্মেলনে নারী উদ্যোক্তারা ৭০০ মিলিয়ন ডলার অর্থের জন্য তহবিল গঠন করেছিলেন। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব বিজনেস অ্যান্ড প্রফেসনাল উইমেন্স ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ফ্রেডা মিরিকলিস তখন বলেন, নারীদের পেছনে বিনিয়োগ বাড়ালে তা শুধু পরিবার নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের টেকসই উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে নারীকে শুধু নারী বলে বাধাগ্রস্ত হতে হয়। বিনিয়োগের স্বল্পতা ও জ্ঞানের অভাব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁদের নিরুৎসাহিত করছে।

কমনওয়েলথ নারীদের সম্মেলনে প্রতিনিধিরা নারীকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বেশি করে যুক্ত হওয়ার রূপরেখা প্রণয়নে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁরা মনে করেন, এতে দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বাড়বে এবং দেশের অর্থনীতিতে নারীর ভূমিকা শক্ত-মজবুত হবে।

নারীর ক্ষমতায়নের প্রথম ও প্রধান শর্ত হচ্ছে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতার মূল্য বুঝতে পেরেছেন বলেই আজকের নারীরা অনেকেই বিস্তৃত কর্মক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ছেন। নারীরা বুঝতে পেরেছেন, পুরুষের সমকক্ষ হওয়া মানে নারীত্ব বিসর্জন দেওয়া নয়।

নারীর কল্যাণময়ী মূর্তির সঙ্গে আধুনিক ভাবমূর্তির কোনো বিরোধ নেই। সমাজ, পরিবার, রাষ্ট্র– সব ক্ষেত্রে সমানভাবে ক্ষমতায়িত হলে নারীর প্রতি সহিংসতা বহুলাংশে হ্রাস পাবে। ইদানীং নারী নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা ও বর্বরোচিত কৌশল আমাদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে। এর কারণ মূলত নির্যাতনকারী পুরুষের পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা, ধর্মীয় বিভ্রান্তি, অপরাধ করে শাস্তি না পাওয়ার দৃষ্টান্তের আধিক্য, রাষ্ট্রের কার্যত উদাসীনতা এবং পুরুষশাসিত সমাজে নারীর অসমতা ও অসহায়তা।

নারীর ক্ষমতায়ন ঘটলে এই অসমতা দূর হবে। যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে নারী রুখে দাঁড়াতে পারবেন। যদিও আমাদের সমাজের নারীরা ক্রমশ পুরুষের আধিপত্য ভাঙছেন, তবুও এ কথা অনস্বীকার্য যে প্রগতিশীলতা স্বাধিকার ও অর্থনেতিক স্বয়ম্ভরতার তাৎপর্য অনুভব করতে পারছেন আমাদের নারী সমাজের সীমিত একটা অংশ।

তাই বিস্তৃত অঙ্গনে প্রত্যেক নারীকে তাঁর নিজের উপর আস্থা রাখতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, তাঁদের অনুপ্রাণিত করতে হবে; ভাবতে হবে পুরুষের সমকক্ষ হিসেবে। প্রচলিত মানদণ্ডে নিজেকে না মেপে, গতানুগতিক স্রোতে গা না ভাসিয়ে শক্তি অর্জন করতে হবে তাঁকে স্রোতের মুখ ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে।

নারীর ক্ষমতায়ন, সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়ন দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক পরিকল্পনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই অব্যাহত শোষণ, নির্যাতন, বৈষম্য থেকে নারী সমাজের মুক্তি অর্জনে সমতাপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকার, রাজনৈতিক দলসমূহ ও সুশীল সমাজকে সমন্বিত প্রয়াসে উদ্যোগী হতে হবে।

পরিবারকেও নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে গড়তে হবে। অধিকার সচেতন, শিক্ষিত ও সুনাগরিক হয়ে ওঠার প্রাথমিক শিক্ষা নারী পেয়ে থাকে তাঁর পরিবার থেকেই।

পাশবিকতা, নিষ্ঠুরতা ও ধর্মীয় অন্ধকারের ব্যাপক প্রসারের ফলে আজ আমাদের মানবতা, গণতন্ত্র বিপন্ন-লাঞ্ছিত হচ্ছে। তাই নারী-পুরুষ নির্শেষে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সবাইকে একতাবদ্ধ হয়ে এই অপশক্তি রোধ করতে হবে। সেই লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে একমাত্র ক্ষমতায়িত নারী আর তাঁদের সাহস-প্রেরণা যোগাবে বৈশ্বিক নীতিমালা, পরিবার, মুক্তবুদ্ধির সমাজ এবং গণতন্ত্রের অর্থবহ চর্চা।

এর পাশাপাশি এই মুহূর্তে যা জরুরি তা হল, বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পারিবারিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সমান অংশীদারিত্বের যথাযথ শিক্ষা, তথ্য ও প্রযুক্তি ব্যবহারের নিরবিচ্ছিন্ন, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ। এর ফলে আজকের ক্ষমতায়িত নারীই উপহার দিতে পারবে আগামীর জন্য সৃজনশীল নতুন প্রজন্ম।

স্বাধীনতার এত বছর পরও নারীর জীবনমানের উন্নতি হয়নি। উন্নয়ন ঘটেনি নারীর প্রতি সামাজিক মূল্যবোধের। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রণীত আইনের বাস্তবায়ন ঘটেনি; প্রচলিত আইনের সংস্কার যথোপযুক্তভাবে হয়নি।

বিবাহবিচ্ছেদ, অভিভাবকত্ব ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার বিষয়ক আইনগুলোতে নারী-পুরুষের মধ্যে বিরাট ব্যবধান তৈরি করেছে। কাজেই সাংবিধানিক অধিকার ও আইনি সুবিধা আজ নারীর জন্য খুব প্রয়োজন।

আজকের নারী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে পূর্ণ মানবিক দৃষ্টীভঙ্গিতে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে নারীকে বিবেচনা ও মূল্যায়ন করা; নারী-পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক সমতাপূর্ণ ও বৈষম্যমুক্ত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠা করা। আর তা সম্ভব হলে গোটা সমাজ সম-অধিকার ও সমমর্যাদাভিত্তিক হওয়ার পথে অনেক দূর এগিয়ে যাবে।