নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন তিনটি প্রশ্নের মীমাংসা করে দিয়েছে

মনজুরুল হক
Published : 1 Nov 2011, 08:58 AM
Updated : 1 Nov 2011, 08:58 AM

গত কয়েক দিন যাবত দেশের মিডিয়ায় নাসিক বা নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে যেমন তোলপাড় দেখা গেল তেমনটি সাধারণত জাতীয় নির্বাচনে দেখা গেছে এর আগে। মিডিয়ার কল্যানে হোক আর সরকার এবং বিরোধীদলের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে হোক সমগ্র দেশের হাজারো খবরকে দূরে সরিয়ে প্রধান আলোচ্য হয়ে উঠেছিল নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। হতে পারে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর এটিই বড় ইভেন্ট। আরো হতে পারে গত কয়েক মাস যাবত সরকারের বিভিন্ন বিতর্কিত সিদ্ধান্ত, দেশের সামগ্রিক অবস্থা, দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতি, মূল্যস্ফীতিসহ অনেক বিষয়-আশয় মিলিয়ে মনে করা হয়েছিল প্রধান বিরোধীদলের অংশগ্রহণ এবং তাদের বিজয় জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। পর পর দুটি রোডমার্চ করার পর বিরোধীদলের মৃতপ্রায় ইমেজ পুনরুদ্ধারও এই নির্বাচনের আর একটি বিষয় ছিল। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হলো এবং তা বেশ শান্তিপূর্ণই হলো। যেমনটি সাধারণত এই জনপদে প্রায় দুর্লভ। নির্বাচনের ফলাফল এখানে মূখ্য আলোচ্য নয়। তবুও বলে নেয়া ভালো নির্বাচনে ডা: সেলিনা হায়াৎ আইভী বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন। এবং সরকার সমর্থিত অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শামীম ওসমান পরাজিত হয়েছেন। একেবারে শেষ মুহূর্তে বিএনপি প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এর পরের সন্দেশগুলো বেশ গতানুগতিক হলেও চমকপ্রদ। যেমন বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে এর আগে বিজয়ী প্রার্থীকে পরাজিত প্রার্থীর শুভেচ্ছা জানানোর রেওয়াজ ছিল না। ছিলো না পরাজয় মেনে নিয়ে বিজয়ীকে অভিনন্দন জানানোর প্রথাও। এবার সেটিই ঘটেছে। প্রথম দিন 'ষড়যন্ত্র করে হারানো হয়েছে' বললেও পরের দিনই শামীম ওসমান সংবাদ সম্মেলন ডেকে ডা: আইভীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এক নজরে দেখে নেয়া যাক নির্বাচন পরবর্তী সন্দেশগুলোঃ

ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেছেন, তার এ জয় সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে। জনতার জয় হবেই হবে। কারণ জনতা কখনও ভুল সিদ্ধান্ত নেয় না। জনতা সত্য ও সুন্দরের পক্ষে রায় দিয়েছে। শত চেষ্টা এবং ষড়যন্ত্র করেও তার প্রাপ্য বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, তার জয় চাঁদাবাজ ও ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে। এ সময় তিনি বলেন, তিনি আওয়ামী লীগে ছিলেন, আছেন, থাকবেন।

অন্য দিকে নিজ দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থীর নিশ্চিত পরাজয় আঁচ করতে পেরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শামীম ওসমানকে ঠেকাতেই 'মূলত' শেষ মুহূর্তে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। আওয়ামী লীগের সমর্থনবঞ্চিত মেয়র প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর বিজয়ের পথ 'সুগম' করে দিতে এ 'কৌশলী' ভূমিকা গ্রহণ করে দলটির হাইকমান্ড। একই সঙ্গে দলীয় সরকারের অধীনে 'সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়' বলে দলের বর্তমান অবস্থানও 'প্রমাণ' করতে চায় বিএনপি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন কমিশন চাইলেও সেনাবাহিনী মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করতে পারবে না– নাসিক নির্বাচনই তার প্রমাণ বলে দেখাতে চায় দলটি।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এটিএম শামসুল হুদা বলেছেন, সব আশঙ্কা পেছনে ফেলে প্রমাণিত হলো জনগণ চাইলে সুন্দর নির্বাচন সম্ভব। নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিষয়টি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত উল্লেখ করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে তার সমাধান আশা করেন সিইসি। নারায়ণগঞ্জের ভোটাররা সব শঙ্কাকে পেছনে ফেলে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে জনগণ চাইলে তারা যে কোনো প্রতিবন্ধকতা ভেঙে দিতে পারে। একটি সুন্দর ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ায় সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানান সিইসি। শেষ পর্যন্ত কোনো অঘটন ছাড়াই সম্পন্ন হয়েছে বহুল আলোচিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন।

এখানেই এই ভোটের অংক শেষ করা যেত। কিন্তু এটাই এই নির্বাচনের সারসংকলন নয়।

মহাজোট সরকার সংবিধানের সংশোধনী এনে 'নিরপেক্ষ' তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে। এটা নিয়ে সরকার এবং বিরোধীদলের অনেক কাদা ছোঁড়াছুড়িও হয়েছে। সরকারের তরফে বলা হয়েছে বিএনপির জন্য সবসময়ই আলোচনার দরজা খোলা ছিল, তারা আলোচনায় আসেনি, মতামতও জানায় নি। অন্য দিকে বিএনপি বলছে তাদের ডাকা হয়নি। সরকার একতরফাভাবে সংবিধান সংশোধন করেছে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকারে আসীন মহাজোট আইনত অনেক কিছুই করতে পারে। সেই থেকে বিএনপি বলে আসছে কোনো দলীয় সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না। কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না। এমনকি তারা 'যে কোনো মূল্যে' তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করেই আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে। তারই অংশ হিসেবে বিএনপি রোডমার্চ, এক দিনের হরতাল, দুদিনের হরতালসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। সেই স্ট্রাটিজিক্যাল ফর্মূলার অংশ হিসেবে এই নাসিক নির্বাচন ছিল বিএনপির কাছে সরকারের তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বিলুপ্তির এ্যাসিড টেস্ট। কিন্তু কেন এই সন্দেহ? কেনই বা নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বাধ্যবাধকতা? এর উত্তর মিলবে অনেক পুরোনো হয়ে যাওয়া বিএনপি আমলে মাগুরার সেই কুখ্যাত নির্বাচনের মডেলের দিকে তাকালে। সেই কুখ্যাত মাগুরা নির্বাচনের দগদগে ঘা যতই শুকিয়ে যাক না কেন রাজনীতির ভেতর-বাইরে তার বিষবাষ্প এখনো সমানতালে বিষের উদগিরণ করে চলেছে।

নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের আগে তিন জোটের ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের রাজনীতি একেবারে আনকোরা বিষয় হিসেবে আমদানি হয়েছিল 'নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার'। সেই রূপরেখায় অনেক দিকনির্দেশনাও ছিল। ৯০, ৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮-এ সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়েছে। এতে করে মনে হতে পারে আসলেই বুঝি সেই নির্বাচনগুলো অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ হয়েছিল! পাঁচ পাঁচটি বছর ধরে ক্ষমতাসীন দল সরকার পরিচালনা করে এবং এই পরিচালনার বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদ থাকলেও বিরোধীদলগুলো সরকারকে বাতিল করে না। সরকারের নেয়া সিদ্ধান্তসমূহের সমালোচনা করলেও বিরোধীদলসমূহ সরকারকে কালা,বোবা,অন্ধ এবং অথর্ব মনে করেনা। সেই বিরোধীদলগুলোই কেবল নির্বাচনের সময় এলেই সরকারকে আর বিশ্বাস করতে না পেরে সমাজের ইতি-উতি খুঁজে পেতে কিছু অবসরপ্রাপ্ত 'নিরপেক্ষ' মানুষ সৃষ্টি করে তাদেরই হাতে তিন মাস সময় দিয়ে নির্বাচন করায়। এবং উচ্চ শ্রেণীর বিভিন্ন পেশার মানুষগুলো রাতারাতি 'দেবশিশু' হয়ে ওঠেন। তাদের প্রধান থাকেন একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। বাকি নয় জন থাকেন তার উপদেষ্টা। সেই দশ জন তিন মাস দেশ চালান তো বটেই দেশের ভাগ্যবিধাতা হয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেন। তারপর শেক হ্যান্ড করে যার যার পেশায় ফিরে যান। এই অবিশ্বাসের বীজ থেকে অঙ্কুরিত অবিশ্বাস্য অভূতপূর্ব ব্যবস্থাও যে নিরপক্ষে আর নির্দলীয় ছিলনা তাও গত চার বারই প্রমান হয়েছে। যে দলই হেরেছে তারা কারচুপির অভিযোগ এনেছে। এটা ছিল এদেশের রাজনীতিতে 'বড় খোকাদের পুতুল খেলা'। কার্যত যা ছিল জাতির ললাটে অবিশ্বাসের এক কলঙ্ক তিলক।

আর এক অবিশ্বাসের বীজ বোনা হয়েছিল এর সাথে। এই কেয়ার-টেকার সরকারের শুরু থেকেই এর প্রধান রক্তবাহী ধমণী হিসেবে বিরাজ করছিল সেনাবাহিনী। অলিখিতভাবেই সেনাবাহিনী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্যতম অঙ্গ হয়ে বিরাজ করেছে। গত চার চারটি নির্বাচনেই পুলিশে আস্থা না রেখে সেনা মোতায়েন করতে হয়েছে। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে পুলিশ, বিডিআর, আনসার, গ্রাম পুলিশ কারো উপর আস্থা রাখা যাবে না। তারা হয় দলীয়, নয়ত দুর্নীতিপরায়ন। এমন ঢাকঢোল পিটিয়ে আর কোনো দেশে একটি বিশেষ বাহিনী ছাড়া বাকি সকল বাহিনীকে অবিশ্বাস করা এবং তাদের উপর আস্থা না রাখার নজির আর কোথাও আছে বলে জানা নেই। ধরেই নেয়া হয় যে সেনা মোতায়েন না হলে ভোট কারচুপি হবে! সরকারের লেঠেলরা ভোটবাক্স ডাকাতি করবে! সরকারের অনুগত আমলা-কর্মচারিরা সরকারের হয়ে দালালি করবে! কেবল মাত্র সেনা মোতায়েন হলেই সব কিছু স্ফটিল জলের মত পরিষ্কার আর নিষ্কলঙ্ক হয়ে উঠবে।

নাসিক নির্বাচন এই দুই অবিশ্বাসের ঘেরাটোপে বন্দী বিশ্বাসকে আবার জাগরুক করেছে। আমাদের বিদগ্ধ বিদ্বৎজনেরা বিভিন্ন টকশোতে বলে থাকেন; আমাদের একটি টি আর সেশন-এর মত নির্বাচন কমিশন নেই! অমন একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন থাকলে আমাদের গণতন্ত্রের ভিত মজবুত হতো। অর্থাৎ আমাদের নির্বাচন কমিশনের উপরও রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ বা সমাজের অপরাপর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের কোনো আস্থা নেই! নাসিক নির্বাচন সেই আস্থাহীনতার জগদ্দল পাথরেও আঘাত করে চূর্ণ করেছে। নির্বাচন কমিশন প্রমান করেছে তারা নিরপেক্ষ এবং নির্মোহ থেকে সেনা মোতায়েন ছাড়াও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে সক্ষম। যদিও সেনা মোতায়েন নিয়ে সরকার-নির্বাচন কমিশনের টানাপোড়েন ছিল এবং এখনো আছে।

আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে কী করবে সেটি দূরের ভাবনা। এই সময়ের কথা হচ্ছে তারা এই নাসিক নির্বাচনে রাজনীতির ছোট ছোট ব'ড়ের চাল দিয়ে বিরোধীদলের আস্ফালন, হুঙ্কারের বাউন্সার, গুগলিগুলো ব্যাকরণসম্মত ভঙ্গিতেই মোকাবেলা করেছে। তারা প্রমাণ করেছে দলীয় সরকারের অধীনেও সুষ্ঠু নির্বাচন করা যায়। তারা দেখিয়ে দিয়েছে সেনা মোতায়েন না করেও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা যায়। তারা প্রতিষ্ঠিত করেছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের 'ফসিল' নয়, নির্বাচিত দলীয় সরকারের 'হৃষ্টপুষ্ট দেহই' তুলনামূলক নিরপেক্ষতা দেখাতে পারে। এসব যদি আওয়ামী লীগের 'চাল' হয়, তাহলে বলতেই হবে তারা কিছু দুর্দান্ত চাল দিয়েছে। এসব যদি বিএনপি তথা প্রধান বিরোধীদলের 'চুন খেয়ে মুখ পোড়ানো' হয়, তাহলে বলতে হবে তারা তিনটি বিষয়েই অকৃতকার্য হয়েছে।

মনজুরুল হক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।