জিয়ার পদক বাতিলের সিদ্ধান্ত: ভুল শুধরানোর প্রক্রিয়া

সাব্বির হোসাইন
Published : 1 Sept 2016, 04:43 AM
Updated : 1 Sept 2016, 04:43 AM

স্বাধীনতা পদক হল বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা। এই পুরস্কার জাতীয় জীবনে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশের নাগরিক বা সংস্থাকে প্রদান করা হয়ে থাকে।

২০০৩ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার জিয়াউর রহমানকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক প্রদান করে। একই বছর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক সম্মাননা দেওয়া হয়। স্পষ্টত এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত ব্যক্তিদের একজন জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বঙ্গবন্ধুর সমকক্ষ করার লক্ষ্যে বিএনপির একটি অপচেষ্টা।

২৪ আগস্ট জাতীয় পুরস্কার সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে। এর আগে জুলাই মাসে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে একটি নথি কমিটিতে পাঠানো হয়; সেই নথিতে জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রপতি পদ, রাষ্ট্রপতি হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহণ এবং ১৯৭৫ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৭৯ সালের মার্চ পর্যন্ত অসাংবিধানিকভাবে ও অগণতান্ত্রিক উপায়ে রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়টি আদালতের রিট পিটিশন আদেশের মাধ্যমে অবৈধ ঘোষণার কথা উল্লেখ করা হয়।

আদালতের রায়ের ভিত্তিতে মন্ত্রিসভা কমিটি তাদের সুপারিশে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনকারী সাব্যস্ত করে বলেছে–

"সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের শাস্তি পাওয়া উচিত। যেন মানুষ সংবিধান লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে ভয় পায়।"

স্বাভাবিকভাবেই অসাংবিধানিক ও অবৈধভাবে রাষ্ট্রপরিচালনাকারী একজন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা প্রদান করা রাষ্ট্রের মূলনীতি ও আদর্শে আঘাত করার সামিল।

তাই জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক বাতিলের সিদ্ধান্তটি সময়োচিত এবং অতীতের ভুল শুধরানোর একটি যথাযথ প্রক্রিয়া। বিকৃত ইতিহাস প্রচার ও প্রতিষ্ঠার যে বিষবৃক্ষের বীজ বিএনপি রোপন করেছিল তাদের আত্মপ্রকাশের সূচনালগ্ন হতে, সেই বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলে সঠিক ইতিহাস চর্চার ধারা পুনঃপ্রবর্তনের জন্য এ কাজটি অত্যন্ত জরুরি ছিল।

বিএনপি শুধুমাত্র মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। সেই সময় সরকারে থাকা বিএনপি জিয়াউর রহমানকে দেওয়া এই পুরস্কারের মেডেল ও সম্মাননাপত্র বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষণ করে, যাতে বাংলাদেশের ইতিহাসের বিতর্কিত এই ব্যক্তি বাঙালির জনমনে দ্রুত প্রতিষ্ঠা পেতে পারেন। এ যেন গোয়েবলসীয় নীতি! মিথ্যাকে বার বার বললে, প্রচার করলে তা সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়; বিএনপি ঠিক এই কাজটিই করেছিল।

ব্যক্তিগতভাবে, আমার কাছে জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পদক দেওয়া আর হিটলারকে 'মানবতাবাদী' বলা প্রায় সমকক্ষীয় ব্যাপার। কারণ, আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই, তবে দেখব জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও বাঙালি জাতির প্রতি অন্যায় সংঘটনকারী একজন ব্যক্তি।

১৯৭২ সালে শুরু হওয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পরে জিয়াউর রহমান নিয়ন্ত্রিত সরকার স্থগিত করে দেয় এবং আটককৃত যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দেয়। ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর জিয়াউর রহমান অধীনস্ত সরকারের 'পাপেট রাষ্ট্রপতি' আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েমের মাধ্যমে দালাল আইন বাতিলকরণ অধ্যাদেশ জারি করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের কথা আগে থেকেই জানতেন জিয়াউর রহমান। শুধু তাই নয় এ বিষয়ে তাঁর সমর্থনও ছিল এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসকে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুক ও আবদুর রশীদের সাক্ষাৎকারে বিষয়টি সুস্পষ্ট।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রু, যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামীকে বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন জিয়াউর রহমান। তার শাসনামলে ১৯৭৬ সালের আগস্টে সব ধরনের রাজনৈতিক দলের রাজনীতি উন্মুক্ত করে 'রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ ঘোষণা' করা হয়। তখন 'ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি' নামক একটি দলের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী যুক্ত ছিল। পরে ১৯৭৯ সালের মে মাসে 'জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ' গঠন করে প্রকাশ্যে স্বাধীনতার শত্রু ও যুদ্ধাপরাধী এই সংগঠন বাংলাদেশে রাজনীতি শুরু করে।

যুদ্ধাপরাধীদের নাটের গুরু গোলাম আযম বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করার সুযোগ পান জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। ১৯৭৬ সালের ১৮ জানুয়ারি তৎকালীন 'জিয়াউর রহমান অধীনস্ত বাংলাদেশ সরকার' এক প্রেসনোট জারি করে। তাতে 'নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে' এমন ব্যক্তিরা তাদের নাগরিকত্ব ফিরে পেতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে পারবে বলা হয়। গোলাম আযম নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য আবেদন করেন। গোলাম আজমের মতো ঘৃণ্য রাজাকারকে নাগরিকত্ব দেওয়ার সাহস 'জিয়াউর রহমান অধীনস্ত প্রো-পাকিস্তানি সরকার' করেনি, তবে তারা 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি' পদ্ধতি অবলম্বন করে।

১৯৭৮ সালের ১১ জুলাই তৎকালীন সরকার গোলাম আযমকে তিন মাসের জন্য বাংলাদেশের ভিসা দেয়। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, তার মা অসুস্থ। ১৯৭৮ সালের ১১ আগস্ট গোলাম আযম পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রবেশ করেন।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পরে ধর্মনিরপেক্ষতার উল্টো পথে হাঁটা শুরু করে বাংলাদেশ; এর নেতৃত্বে ছিলেন জিয়াউর রহমান। তিনি পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকা। ১৯৭৮ সালের ১২ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সমর্থকদের আশ্বাস দিয়েছিলেন, হিন্দুর লেখা জাতীয় সঙ্গীত ও ইসলামী তাহজ্জীব ও তমুদ্দুনবিহীন জাতীয় পতাকা পরিবর্তন করা হবে।

জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়স্মৃতি তুলে দিয়েছিলেন পাকিস্তানিদের হাতে। তার শাসনামলে ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ভাইকে তৎকালীন ছয় কোটি টাকা মূল্যমানের S.S. Lightening জাহাজটি উপহার দেওয়া হয়। এই জাহাজটি ছিল মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের একটি স্মৃতিচিহ্ন।

জিয়াউর রহমান নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে 'ক্লিনজিং' চালিয়েছিলেন সামরিক বাহিনীতে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ১৯৭৮ সালের বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমান সরকার সন্দেহের তালিকায় থাকা যে কারো বিরুদ্ধেই চূড়ান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করত।

এমনকী পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে ভূমি নিয়ে যে বিরোধ ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তির আগ পর্যন্ত বিরাজমান ছিল– যা চরম সহিংসতার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল– তার সূচনাও হয় জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। সেই সময় ভূমিহীন, বাস্তুহীন, নদীভাঙা পীড়িত ও দরিদ্র বাঙালিদের অপরিকল্পিত পুনর্বাসন দেওয়া হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে। ফলে শুরু হয় বাঙালি-পাহাড়ি জাতিগত সহিংসতার।

এ রকম আরও অসংখ্য 'বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও বাঙালি জাতি'-বিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন জিয়াউর রহমান। এমন একজন কলঙ্কিত ব্যক্তিকে স্বাধীনতা পদক প্রদান করা রাষ্ট্র ও জাতির জন্য লজ্জাজনক এবং জাতীয় নৈতিকতার স্খলন।

বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের জাতীয় পুরস্কার সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিকে ধন্যবাদ জানাই অবৈধ-অসাংবিধানিক শাসক জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা পদক বাতিলের সুপারিশ করার জন্য।

জাতীয় নৈতিকতা অক্ষুণ্ন রাখা ও সঠিক ইতিহাস জাতিকে জানানোর প্রশ্নে জিয়াউর রহমানের মতো ব্যক্তির স্বাধীনতা পদক বাতিলের সিদ্ধান্ত যথাযথ ও যুগোপযোগী।