তিনিই ডোনাল্ড ট্রাম্প

এইচ এম মহসীন
Published : 26 Sept 2011, 02:31 AM
Updated : 1 Sept 2016, 03:09 PM

যুক্তরাষ্ট্রে আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের প্রচারণার উত্তাপ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও অনুভূত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী আলোচনার বিষয় ও আগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এ নির্বাচন। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেও এ নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই।

এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অন্যান্য বারের চেয়ে অনেকটাই ব্যতিক্রম। দেশটির ইতিহাসে প্রথম নারী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন হিলারি ক্লিনটন। তবে ডেমোক্র্যাট দলীয় হিলারির পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন ব্যক্তিগত ইমেইল ব্যবহার করায় তাঁর প্রার্থিতা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। আর অন্যদিকে এবারের নির্বাচনের সবচেয়ে 'দৃষ্টিকটু' বিষয় হচ্ছে রিপাবলিকান পার্টি থেকে বিতর্কিত ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পের মনোনয়ন লাভ।

যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের অন্যতম সৌন্দর্য হচ্ছে এখানে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা বা পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকলেও প্রধান দুদলের মনোনয়নের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সম্ভব। রিপাবলিকান দল থেকে ট্রাম্পের মনোনয়ন হচ্ছে এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

ট্রাম্প পৈতৃকসূত্রে পাওয়া রিয়্যাল এস্টেটের ব্যবসার বাইরেও দীর্ঘদিন টিভিতে রিয়্যালিটি শোর পরিচালনা করেছেন। গত বছর প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করার ঘোষণা দেওয়ার আগে উল্লেখযোগ্য কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা তাঁর ছিল না। তাই প্রাইমারি নির্বাচনের শুরুর দিকে ট্রাম্পকে অনেকেই তেমন গু‌রুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়নি। তবে ট্র্যাডিশনাল রাজনীতিবিরোধী, ইসলামবিদ্বেষী বা মেক্সিকানবিরোধী খোলামেলা বক্তব্যের মাধ্যমে, শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের মধ্যে তাদের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা (white supremacy) জাগিয়ে তুলে রক্ষণশীল রিপাবলিকান দলের তৃণমূল সমর্থকদের মন জয় করতে সফল হয়েছেন তিনি।

জনগণের ম্যান্ডেটে দলে মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে কারও কোনো আপত্তি থাকা উচিত নয়। তবে ট্রাম্পের বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করার মাধ্যমে সংবাদ শিরোনামে আসার ব্যাপারটি একেবারেই অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। ভিত্তিহীন মন্তব্য, প্রতিপক্ষের ওপর ব্যক্তিগত আক্রমণ, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে প্রতিনিয়ত অবজ্ঞা করে বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়া ট্রাম্পের 'নির্বাচনী ব্র্যান্ডে' পরিণত হয়েছে।

ট্রাম্পের প্রার্থিতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে তাঁর ভাবনা বা পরিকল্পনা নিয়ে বলার চেয়ে তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পায়। ট্রাম্প এমন একজন ব্যক্তি যাঁর মধ্যে বিন্দুমাত্র বিনয়, সহনশীলতা, সহমর্মিতা নেই। গত কয়েক মাসের নির্বাচনী প্রচারণায় অসংখ্যবার তিনি তাঁর রাজনৈতিক অপরিপক্কতা ও বদমেজাজের পরিচয় দিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন।

গত জুনে ডেমোক্র্যাট পার্টির বেশ কয়েকটি সংস্থার ইমেইল হ্যাক করার ঘটনা প্রকাশিত হয়। গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইসহ আইটি বিশেষজ্ঞদের মতে, ওই হ্যাকিংয়ের ঘটনায় রাশিয়ার সম্পৃক্ততা রয়েছে। রাশিয়ার সরকারি সংস্থা যদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান একটি রাজনৈতিক দলের সার্ভার হ্যাক করে, সেটি গুরুতর অন্যায়। যুক্তরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বে আঘাত হানার সামিল এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় 'আগুন না নিভিয়ে তার মধ্য আলু পুড়ে' খাওয়ার পন্থা বেছে নেন ট্র্যাম্প। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন হিলারি ক্লিনটনের মুছে ফেলা ইমেইল উদ্ধার করতে রাশিয়ান হ্যাকরদের আহবান জানান।

কী সাংঘাতিক কথা! যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার সাপে-নেউলে সম্পর্ক। সেই রাশিয়ার গোয়েন্দাদের ওপর ট্রাম্পের এত আস্থা। রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য দেশের নিরাপত্তা নিয়ে খেলতেও বাধা নেই ট্রাম্পের! বলাবাহুল্য, প্রবল সমালোচনার মুখে ট্রাম্প তাঁর এই বক্তব্য অন্য খাতে প্রবাহের চেষ্টা করেন। তাঁর দাবি, তিনি সিরিয়াসলি এটা বলেননি।

যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্য অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন চূড়ান্ত করার অনুষ্ঠান 'পার্টি কনভেনশনে' ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান উভয় দলই বিভিন্ন বক্তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকে। ট্রাম্প যেমন প্রকাশ্যে মুসলিমদের বিরোধিতা করেন, তাঁর দলীয় কনভেনশনের বিভিন্ন বক্তাদের মধ্যেও ছিল 'উগ্রপন্থী' ইসলাম ও 'আইএস' জাতীয় শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে সব মুসলিমদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যা দেওয়ার চেষ্টা।

অন্যদিকে ডেমোক্র্যাট কনভেনশনে হিলারির দল এটাই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল যে, মুসলিমদের মধ্যেও অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রকে ভালোবাসে, দেশের জন্য অনেকেই অনেক স্যাক্রিফাইস করেছে। এ ধারণা প্রতিষ্ঠা করার জন্য তারা বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানায় ইরাকে নিয়োজিত অবস্থায় নিজ ইউনিটের সেনাদেরর জীবন বাঁচাতে গাড়িবোমা হামলায় শহীদ ক্যাপ্টেন হুমায়ুন খানের পিতা খিজির খানকে। তিনি তাঁর বক্তৃতায় ট্রাম্পকে যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধান পড়ার আহ্বান জানান। তিনি দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ট্রাম্পের কোনো ত্যাগ (sacrifice) নেই।

ট্রাম্প এর জেরে খিজির খানকে আক্রমণ করেন। তিনি পরোক্ষভাবে অভিযোগ করেন, খিজির তাঁর স্ত্রীকে কোনো বক্তব্য উপস্থাপন করার সুযোগ দেননি। এর মাধ্যমে ট্রাম্প বোঝাতে চেয়েছেন যে, খিজিরদের কালচারে নারীদের 'দাবিয়ে' রাখা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রে দলমত নির্বিশেষে সবাই যেখানে সামরিক পরিবারের সদস্যদের, বিশেষ করে শহীদ পরিবারের সদস্যদের (গোল্ড স্টার ফ্যামিলি) সম্মান করে, সেখানে একজন শহীদ-সেনার গর্বিত বাবা-মাকে আক্রমণ করার মাধ্যমে ট্রাম্প তাঁর সহমর্মিতাহীন মানসিকতারই প্রমাণ দিয়েছেন। তাঁর এই আক্রমণ শুধু মুসলিম আমেরিকানদের বা সামরিক সদস্যদের পরিবারগুলোকে আহত করেনি, আহত করেছে মুক্তমনা সবাইকে।

৯ আগস্ট এক জনসভায় ট্রাম্প বলেন, হিলারি নির্বাচিত হলে প্রত্যেক নাগরিকের আগ্নেয়াস্ত্র বহন করার অধিকার-সংবলিত সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী বাতিল করবেন। বক্তৃতার এক পর্যায়ে তিনি বলেন, হিলারি নির্বাচিত হয়ে তাঁর পছন্দের বিচারক নিয়োগ করলে তাঁকে ঠেকানোর উপায় থাকবে না। এরপর তিনি বলেন, দ্বিতীয় সংশোধনী অ্যাকটিভিস্টরা হিলারিকে হয়তো ঠেকাতে পারবেন।

ট্রাম্পের এ মন্তব্যে অনেকেই পরোক্ষভাবে হিলারিকে 'হত্যা প্ররোচণা' হিসেবে অভিহিত করেছেন। ট্রাম্পের পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হয়েছে, দ্বিতীয় সংশোধনী অ্যাকটিভিস্টদের ভোটের মাধ্যমে হিলারিকে পরাজিত করার আহবান জানানো হয়েছে।

ট্রাম্পের অমানবিক, অসহমর্মিতা ও সুযোগসন্ধানী আচরণের আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে, গত সপ্তাহে শিকাগোতে এনবিএ তারকা ডোয়েইন ওয়েইডের খালাতো বোন নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে রাজনীতি করা। নিজ এলাকায় শিশু সন্তানকে নিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় ২৬ আগস্ট সন্ত্রাসীদের ক্রসফায়ারে নিহত হন নিকিয়া অলরিজ। ঘটনার পরপরই ট্রাম্প টুইটারে বলেন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ে তিনি যা বলেছেন তা-ই ঘটছে, অতএব আফ্রিকান আমেরিকানরা ট্রাম্পকেই ভোট দেবে।

প্রসঙ্গত, ডোয়েইন ওয়েইড এবং নিকিয়া অলরিজ আফ্রিকান আমেরিকান। একজন নিহতের পরিবারকে সান্ত্বনা না দিয়ে, সেটি নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা নিয়ে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েন ট্রাম্প।

অধিকাংশ বিশ্লেষক মনে করেন, ধর্মান্ধ, অহংকারী ও বর্ণবাদী ট্রাম্পের উত্থানের পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে তাঁর মেক্সিকানবিরোধী, ইসলামবিরোধী এবং অভিবাসীবিরোধী সস্তা রাজনৈতিক বক্তব্য। বিভিন্ন সময়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত মেক্সিকান অভিবাসীদের 'সন্ত্রাসী' ও 'ধর্ষক'সহ নানা উপাধি দিয়ে আক্রমণ করেন। মেক্সিকোর সীমান্তে তাদেরই অর্থায়নে দেওয়াল তৈরি করার ঘোষণাও দিয়েছেন তিনি।

মেক্সিকান ব্যাকগ্রাউন্ড থাকার কারণে তিনি ফেডারেল জাজের বিচারকার্যে নিরপেক্ষতা রক্ষার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আইএস ও মুসলমানের তকমা লাগানো বিপথগামী সন্ত্রাসীদের সঙ্গে ধর্মপ্রাণ, শান্তিপ্রিয় মুসলিমদের এক করে, ইসলাম ধর্মের প্রতি ভীতি ও বিদ্বেষ সৃষ্টিতে ট্রাম্প নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সব মুসলিমকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার ঘোষণাও দিয়েছেন ট্রাম্প। পরবর্তীতে অবশ্য নির্দিষ্ট দেশের বা এলাকার মুসলিমদের ক্ষেত্রে এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে বলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

দেশের কম শিক্ষিত, কর্মজীবী শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ বা শ্রেষ্ঠত্ববোধ জাগিয়ে তুলতে ট্রাম্প অনেকখানি সফল হয়েছেন। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে তিনি জাগিয়ে তুলেছেন বর্ণবাদিতা, অসহনশীলতা ও ইসলামবিদ্বেষী মনোভাব। সম্প্রতি নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশি ইমামসহ আরেকজনকে প্রকাশ্য দিবালোকে খুনের ঘটনায় ট্রাম্পের ইসলামবিদ্বেষী মনোভাবের 'প্রভাব' কাজ করেছে বলেই অনেকের ধারণা।

ট্রাম্প এমন একজন ব্যক্তি যিনি নিজের স্বার্থের বাইরে কিছুই বুঝতে চান না। তাঁর বিভিন্ন বিতর্কিত মন্তব্যের সমালোচনাকারী রিপাবলিকান নেতাদের একহাত নিতেও তিনি দ্বিধা করেন না। হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভের স্পিকার, রিপাবলিকান নেতা পল রায়ান এবং অভিজ্ঞ রাজনীতিক ও সিনেটর জন ম্যাকেইনও ট্রাম্পের আক্রমণ থেকে বাদ যাননি।

ট্রাম্পের খামখেয়ালী ও দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তৃতা-বিতর্ক নিয়ে খোদ রিপাবলিকান পার্টিতেই দৃশ্যমান বিরোধ রয়েছে। এমনকি ওহাইয়োর ক্লিভল্যান্ডে অনুষ্ঠিত রিপাবলিকান পার্টি কনভেনশনে রিপাবলিকান দলীয় ওহাইয়োর গভর্নর অংশ নেননি।

সম্প্রতি রিপাবলিকান দলীয় বেশ কিছু প্রভাবশালী নেতাও ট্রাম্পের পক্ষ থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। কেউ কেউ বরং হিলারিকেই সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মেইন অঙ্গরাজ্য থেকে নির্বাচিত রিপাবলিকান সিনেটর সুসান কলিন্স কিংবা রিপাবলিকান দলের বর্তমান কংগেসম্যান রিচার্ড হান্নাসহ রিপাবলিকান বিভিন্ন ক্যাবিনেটের সাবেক সদস্যও রয়েছেন এই তালিকায়।

প্রতিপক্ষকে বিভিন্ন অসম্মানজনক নামে ডাকা, ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা, নির্বাচনে হেরে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে অগ্রিম কারচুপির অভিযোগ করা এবং যুক্তিতর্কের ধার না ধেরে মনগড়া সব বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে দেশের কম শিক্ষিত, কর্মজীবী মানুষদের বিভ্রান্ত করে নির্বাচনী ফায়দা লোটার চেষ্টা করা– এসবই ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণার 'হলমার্ক'এ পরিণত হয়েছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত অধিকাংশ নির্বাচনী জরিপ বলছে, ট্রাম্প হিলারির তুলনায় বেশ খানিকটা পিছিয়ে রয়েছেন। তাই ট্রাম্প আফ্রিকান আমেরিকান ও মেক্সিকান নাগরিকদের আকৃষ্ট করার জন্য তাঁর বক্তৃতায় কিছু পরিবর্তন এনেছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ গত ১৫ মাস ধরে যে ট্রাম্পকে দেখেছেন, তাতে কিছু রক্ষণশীল রিপাবলিকান পুলকিত হলেও অধিকাংশ আমেরিকানেরই আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ নেই।

হিলারিকে প্রার্থী হিসেবে পছন্দ না হলেও ট্রাম্পের মতো ধর্মান্ধ ও বর্ণবাদীকে যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা বেছে নেবে না বলেই বিশ্বাস করি।