আমাদের এই নির্লিপ্ততা

পারভীন সুলতানা ঝুমা
Published : 31 August 2016, 01:49 PM
Updated : 31 August 2016, 01:49 PM

২৪ অাগস্ট রিশা নামের চৌদ্দ বছরের এক কিশোরীকে ওবায়দুর নামের ঊনত্রিশ বছরের এক যুবক ছুরিকাঘাত করে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৮ আগস্ট মৃত্যু হয় রিশার। এরপর থেকে আমি রিশার 'সাত ভাই চম্পা'কে খুঁজছি; যে ভাইয়েরা রিশা হত্যার প্রতিবাদ জানাতে নিজের প্রাণ দিতেও দ্বিধা করবে না! যেমন করেনি ১৯৯৫ সালে দিনাজপুরের ইয়াসমিনের সাত ভাই।

কতিপয় পুলিশ সদস্য কিশোরী ইয়াসমিনকে ধর্ষণ করে হত্যা করার পর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিল সমগ্র বাংলাদেশ। পুলিশের গুলিতে নিহত হয় সাত দিনাজপুরবাসী। অনেকে আদর করে তখন তাদের ডেকেছে ইয়াসমিনের 'সাত ভাই চম্পা' বলে। বোন রিশার জন্য চম্পা ভাইদের খুঁজে পাওয়া এখন কঠিন! কিন্তু কেন?

১৯৯৫ থেকে ২০১৬ সালের দূরত্ব কতটুকু? একুশ বছর। এই সময়কালে মানুষের মানসিকতার কতটা পরিবর্তন হয়েছে? আমরা অবলোকন করছি, বিবেক-সহানুভূতি-মানবতাবোধ কীভাবে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে!

রিশার হন্তারকের হাতে ছিল না কোনো পিস্তল বা বোমা। সেই মুহূর্তে হয়তো দু-চারজন পথচারী তাকে জাপটে ধরে সেই ভয়ঙ্কর কাজ থেকে নিবৃত্ত করতে পারত! অনেকে এই আফসোস জানিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আমরা যারা প্রত্যক্ষদর্শী নই, তারা জানি না আসলে সেখানে কী ঘটেছিল তখন– সেই দুর্বত্তকে ধরা আসলেই সহজ ছিল কি না।

তবে একজন ব্লগার আক্রমণের ঘটনায় দেখেছি তৃতীয় লিঙ্গের একজন কীভাবে জীবনের ঝুঁকি অগ্রাহ্য করেও ঘাতককে জাপটে ধরেন। বছর দুযেক আগে বিরোধী দলের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের সময় একজন অতিসাধারণ নারীকে দেখেছি জীবনের মায়া উপেক্ষা করে এক পুলিশ সদস্যকে বাঁচাতে ছুটে যেতে। কিন্তু রিশাকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে এল না! অকালে ঝরে গেল মায়াবতী মেয়েটি।

রিশা, তনু, মিতু, আফসানার মতো কিশোরী-তরুণী সমাজের পুরুষতান্ত্রিকতা এবং এর সঙ্গে বিশেষ ক্ষমতাবানদের অহমিকা ও ক্ষমতার দাপটের বলি। এসব নৃশংস ঘটনা এবং দলবদ্ধ হয়ে পয়লা বৈশাখের মতো সর্বজনীন উৎসবে উদ্ভটভাবে মেয়েদের লাঞ্ছিত করার ঘটনাগুলো প্রশাসনের উদাসীনতায় হারিয়ে যাওয়ার কথা ছিল না, যদি ইয়াসমিন হত্যা-ঘটনার পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার মতো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা যেত।

কয়েকটি মানব বন্ধন, স্মারকলিপি প্রদান ও বিবৃতি-সংবলিত প্রতিবাদে আর যা-ই হোক আন্দোলন তৈরি করা যায় না। রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের যতই গালমন্দ করি, একটি আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদানকালে তাদের প্রয়োজনীয়তা যে কতটা জরুরি তা উপলদ্ধি করা যাচ্ছে।

ইয়াসমিনের ঘটনাটি দেশব্যাপী আন্দোলনে রূপান্তরিত করার পেছনে কিছুটা হলেও কৃতিত্ব ছিল সে সময়কার বিরোধী দলের। টলে গিয়েছিল তখনকার ক্ষমতাসীনদের মসনদ। ঘটনাটির প্রভাব এমনই পড়েছিল যে, এখন ইয়াসমিন হত্যার দিনটি অর্থাৎ ২8 আগস্ট 'জাতীয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস' হিসেবে পালন করা হচ্ছে। আর কী প্রহসন, এই একই দিনে হামলার শিকার হল রিশা!

এখন ইয়াসমিনের ঘটনার চেয়েও সংখ্যায় এবং ভয়াবহতায় আরও বেশি ঘটনা ঘটছে, তার প্রতিবাদ কেন যেন সব পর্যায়ে যাচ্ছে না। রাজনীতির বন্ধ্যাত্ব একটা রাষ্ট্রের জন্য কতটা ক্ষতিকর হতে পারে তার উদাহরণ হচ্ছে একটার পর একটা এ ধরনের বর্বর ঘটনা এবং অপরাধীদের পার পেয়ে যাওয়া ও প্রতিবাদের জোর কমে আসা।

রিশার খুনি কোনো সুরক্ষিত এলাকার বাসিন্দা নয়। সামাজিক অবস্থানের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত সাধারণ এক ব্যক্তি, বিশেষ করে রিশার পারিবারিক মর্যদা বা স্ট্যাটাস বিবেচনা করলে।

একটা মেয়ে পোশাক বানাতে গেছে মায়ের সঙ্গে, তাকে ভালো লেগেছে। প্রেম নিবেদনে প্রত্যাখ্যাত হওয়া, এরপর মায়ের ফোনে বিরক্ত করা, মায়ের অভিযোগের প্রেক্ষিতে মালিক কর্তৃক চাকরিচ্যুত হওয়া আর এ জন্য এতটা হিংস্র হয়ে 'ভালোলাগার' মেয়েটিকে ছুরিকাহত করা– পুরো ঘটনায় বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই, বিশেষ করে বাংলাদেশে! প্রেমে সাড়া না দেওয়ায় প্রেমিকাকে অ্যাসিড নিক্ষেপ একসময় মহামারী আকার ধারণ করেছিল। এ অপরাধের কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা এবং দু-একটি ক্ষেত্রে শাস্তি কার্যকর করার ফলে সেই মহামারীর প্রকোপ কিছুটা কমে আসে।

সেই মহামারী আবার দেখা দিয়েছে– অন্যরূপে। অ্যাসিড নিক্ষেপ হয়তো কিছুটা হ্রাস পেয়েছে, কিন্তু মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার ঘটনা দিন দিন বাড়ছেই। মেয়েরা যত ঘর থেকে বের হচ্ছে, এর হারও তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ তা কমে আসার কথা ছিল।

পাশ্চাত্যেও একসময় পথেঘাটে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার বাজে সাংস্কৃতি ছিল। কিন্তু ক্রমশ যখন রাস্তাঘাটে মেয়েদের চলাচল বাড়তে থাকে– জীবনের সর্বক্ষেত্রে যখন দেখা যায় নারীদের আনাগোনা– দোকানে, অফিসে, শিক্ষালয়ে যখন ছেলেমেয়ের সংখ্যা সমান সমান হতে শুরু করে, তখন 'ইভ টিজিং' কমতে থাকে। এটি স্বাভাবিক। (যদিও 'ইভ টিজিং' শব্দবন্ধ এখন অচল; ইংরেজিতে এখন একে 'স্টকিং' বলা হচ্ছে।)

মানুষ মাত্রই অদেখা-অজানার প্রতি কৌতুহল থাকে। আর উত্ত্যক্ত বা বিরক্ত করার প্রবণতা থাকে অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের প্রতি। যে সমাজে নারীরা যত পিছিয়ে থাকে সে সমাজে নারীর প্রতি নির্যাতন, নারীকে হেয় করার সংস্কৃতি তত বেশি। বিষয়টি খালি চোখে দেখা যায়; গবেষণা করার প্রয়োজন হয় না।

নারীকে ঢেকে রেখে যারা নারীর মর্যাদার কথা বলে তারাই রাস্তাঘাটে নারীদের দেখলে 'উত্তেজিত' হয়ে পড়ে এবং সম্ভবত তাদের দুর্বলতা ঢাকতেই নারীর 'পর্দা' নিয়ে তাদের এত হইচই! তাদের নিজদের কারণে নারীদের অবরোধবাসিনী করে রাখার প্রয়াস। 'হীরের খণ্ড' বা 'মাংসের দঙ্গল' যা-ই বলুক– যেভাবেই তারা নারীদের ঢেকে রাখার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করুক না কেন, আসল কারণ তাদের নিজস্ব রিপুর সমস্যা।

সবচেয়ে বড় কথা, নারীরা বাইরে বের হবে কী হবে না, নিজেদের কতটা অবগুণ্ঠিত করে রাখবে, তার সিদ্ধান্ত তাদের নিজেদের। নারীরা তো পুরুষের পোশাক বা চলাচলের উপর কোনো নিষেধাজ্ঞা বা বয়ান দেয় না। এর কারণ অবশ্যই আমাদের সমাজ, ধর্ম সব কিছুই পুরুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া। কিন্তু এ নিয়ন্ত্রণ ভাঙার সময় হয়েছে; ভাঙাও হচ্ছে ধীরে ধীরে।

পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, একদিকে নিয়ন্ত্রণ ভাঙছে, অন্যদিকে নিয়ন্ত্রণ আরও জোরালোভাবে চেপে বসছে। আরও দুঃখের বিষয় হচ্ছে, কোনো কোনো নারী, তথাকথিত শিক্ষিত নারীরাও এ নিয়ন্ত্রণ শুধু মানছে না, এর পক্ষে মনপ্রাণও সঁপে দিচ্ছে! তারা আসলে পুরুষতান্ত্রিক-রোগে আক্রান্ত।

রিশার ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে ফরিদপুরের চাঁপা রানী ভৌমিক, যাঁকে বখাটেরা মোটর সাইকেল চাপা দিয়ে মেরে ফেলে। গাইবান্ধার সেই ফুটফুটে মেয়ে তৃষা যে বখাটেদের হাত থেকে রক্ষা পেতে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে মারা যায়। বখাটেদের কারণে একের পর এক মেয়ের আত্মহত্যা করার নজির বাংলাদেশে যেমন আছে, পৃথিবীর আর কোনো দেশে তেমন আছে কি না সন্দেহ।

নারীদের উত্ত্যক্ত করার হার ও পদ্ধতি যে ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে তাতে 'ইভ টিজিং' শব্দ দিয়ে তা সঠিকভাবে প্রকাশিত না হওয়ায় এখন 'যৌন হয়রানি' বলা সমীচীন মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি 'যৌন হয়রানি বিরোধী আইন' পাস হয়েছে। কিন্তু এ আইন সম্পর্কে যেমন মানুষের অজ্ঞতা রয়েছে, তেমনি আইন 'থোড়াই কেয়ার' করার চিরাচরিত প্রবণতাও কাজ করছে। পাশ্চাত্যে এ আইনের কঠোর প্রয়োগের কারণে সেখানে যৌন হয়রানির হার অনেক কম।

সমাজে মেয়েদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ওবায়দুলের মতো দর্জি দোকানের এক কর্মী রিশার মতো মেয়েকে উত্ত্যক্ত করার সাহস পায়– তাকে হত্যা করার মতো দুঃসাহস দেখাতে পারে।

নারী মানেই আমার অধীনস্থ। নারী মানেই আমার করায়ত্ত। আমার অবাধ্য হওয়া, তা প্রেম-বিষয়ক হোক আর আমার নির্ধারিত নীতি-প্রথার বিরুদ্ধে হোক, তা বরদাশত করব কেন? অসুস্থ পুরুষ মানসিকতায় আবদ্ধ এ সমাজ। পুরষতান্ত্রিকতা মানেই তো অবিচার, অনৈক্য এবং বৈষম্য!

দিল্লিতে বাসে ধর্ষিত নির্ভয়ার হত্যা মামলার আসামীর উকিল এবং স্বয়ং আসামীর কথা শুনেছি একটি ডকুমেন্টারিতে। যারা অবলীলায় অনেকটা এ রকম কথা বলেছে, 'মেয়েরা কেন রাস্তায় বের হবে? বের হলেও সন্ধ্যায় কেন বের হবে? তারা তো ধর্ষিত হবেই।' এ ধরনের মানসিকতা কমবেশি এই উপমহাদেশের প্রায় সব পুরুষের।

সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে যে শরণার্থীরা উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিচ্ছে সেখানেও চলছে যৌন হয়রানি। তবে সত্যটা হল, তারা আশ্রিত দেশের পুরুষদের দ্বারা উৎপীড়িত হচ্ছে না, তারা নিজে নিজে দেশের পুরুষ শরণার্থীদের দ্বারাই হয়রানি ও নির্যাতিত হচ্ছে। এসব পুরুষ যে সাংস্কৃতিতে বড় হয়েছে তার বলয় থেকে বের হতে পারছে না; এমনকি নিজেদের এই চরম দুর্দিনেও!

যে ধর্ম ও সমাজ যত নারীদের বিরুদ্ধে, সে ধর্ম ও সমাজের পুরুষরা তত বেশি নারী নির্যাতনকারী হবে– এটাই স্বাভাবিক।

পুরষতান্ত্রিকতা ছাড়াও দায় এড়ানোর মানসিকতাও আমাদের এ ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অভিযোগ আছে, রিশার স্কুল কর্তৃপক্ষর বিরুদ্ধে। তারা নিজেদের গাড়িতে সঠিক সময়ে রিশাকে হাসপাতালে পাঠায়নি পুলিশি মামলার ভয়ে। যে বিপদে আমাদের পুলিশের শরণাপন্ন হওয়ার কথা সে বিপদেই আমরা পুলিশকে ভয় পাচ্ছি। আমাদের অভিজ্ঞতা এতই নগ্ন!

জনতাকে জাগতে হবে, জাগতে হবে পুরো বাংলাদেশকে।

আমাদের নির্লিপ্ততা গ্রাস করে নিচ্ছে সমাজের সব শুভবোধ; ন্যায়-নীতি-নৈতিকতা চলে যাচ্ছে নির্বাসনে!