‘হামার মাই ত সাইকেলত চড়েহ স্কুলত যাছেহ’

আইরিন সুলতানাআইরিন সুলতানা
Published : 28 August 2016, 04:49 PM
Updated : 28 August 2016, 04:49 PM

মালয় মেয়েটি কণ্ঠে বিস্ময় নিয়ে বলছিল, "তাহলে তোমরা (বাংলাদেশি মেয়েরা) বাইকে কীভাবে বস?"

মোটামুটিভাবে বোঝাতে সক্ষম হলাম, মোটরসাইকেলে চালকটি (অবশ্যই পুরুষ) দুপাশে দুপা দিয়ে বসে আর নারীযাত্রী চালকের আসনের পিছনের অংশে পশ্চাদ্দেশটুকু রেখে দুপা একত্রে বামে ঘুরিয়ে রাখে এবং পতন রোধে সম্পর্কের ধরন অনুযায়ী চালক-পুরুষটিকে ধরে রাখে।

মালয় মেয়েটি বলল, "ইটস নট সেইফ!"

বস্তুত মালয়শিয়াতে ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া থেকে সদ্য চাকরিতে ঢোকা মেয়েদের 'নিজে চালিত' একটি 'প্রোটোন' গাড়ি যদি না-ও থাকে, একটি মোটরসাইকেল থাকবেই। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে 'হিজাব' পরিধানের যে চল শুরু হয়েছে, তার পেছনে আমাদের মালয়শিয়া ভ্রমণের সহজলভ্যতা কাজ করেছে। ওদের মেয়েদের 'হিজাব'টুকু আমাদের মেয়েরা দ্রুত অনুসরণ করতে পেরেছে।

আফসোস হল, মালয়শিয়ায় হিজাব-পরিহিত মেয়েরা নিজেরাই ড্রাইভ করে গাড়ি নিয়ে অফিস যাচ্ছে, ফিরছে– এই আত্মনির্ভরশীল চর্চাটা আমাদের মেয়েরা ধারণ করতে পারেনি।

মালয়শিয়ায় হিজাব ও সঙ্গে লম্বা ঝুলের 'বাজু কুরুং' (প্রধানত মালয় মুসলিম মেয়েদের পরিধেয় লম্বা কামিজ ও লম্বা স্কার্টের মতো পোশাক) পরিহিত মেয়েরাও মোটর সাইকেলে চালকের আসনে বসে দুপা দুপাশে দিয়ে; একেবারে পুরুষের মতো করেই। সঙ্গে নারী সহযাত্রীটিও বসে একইভাবে। একসঙ্গে তিন নারী (চালকসহ) মোটরসাইকেলে চেপে যাচ্ছে, এমনটা বিরল দৃশ্য নয় ওখানে।

লম্বা স্কার্ট অথবা 'বাজু কুরুং' পরে মোটরসাইকেলে চড়ে বসলে, পরিধেয় কাপড় কোণাকুনিভাবে অনেকটা উপরে উঠে যায়; যেমনটা লুঙ্গি-পরা পুরুষ-চালকের ক্ষেত্রে ঘটে। নারীদের এভাবে মোটর সাইকেলে বসা সামাজিক-ধর্মীয় ভ্রুকুটি তৈরি করে না ওখানে। ফলে ওরা হিজাব-বাজু কুরুং পরেও মোটরসাইকেল দাপিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে, শপিংয়ে আসে; বাড়ি ফেরে।

মোটরসাইকেল ছাড়াও মেয়েদের মধ্যে স্কুটি বেশ জনপ্রিয় মালয়শিয়াতে। ভারতেও আত্মনির্ভরশীল নারীদের স্কুটি বেছে নিতে দেখা যায়। ভারতে বাসে গণধর্ষণ ঘটনার পর স্কুটি বিক্রি বেড়ে গিয়েছিল ‍উল্লেখযোগ্য হারে। নামি মোটর সাইকেল ব্র্যান্ডগুলো বিশেষত নারীদের কথা ভেবে এই দ্বিচক্রযানটির নতুন নতুন নকশা করা শুরু করে। মোটরসাইকেল ও স্কুটি চালাতে নারীদের উদ্বুদ্ধ করতে বিজ্ঞাপনও হতে থাকে। এমনকি মোটরসাইকেল প্লান্টে বিনিয়োগও বাড়তে থাকে ভারতে, কেবল নারী-চালকদের চাহিদা মেটাতে।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে স্বাবলম্বী, কর্মমুখী নারীদের সচ্ছন্দ চলাফেরায় মোটরসাইকেল-স্কুটি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। আমাদের দেশে যতই নারীবাদ চর্চিত হোক, বিশেষ দিবসে যতই নারীঅধিকার প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক জয়জয়কার হোক, বাস্তবিক জীবনে সামাজিক এবং ধর্মীয় ভ্রুকুটিতে নারীর জীবনযাপন এখনও 'স্বাভাবিক' সুযোগ-সুবিধাহীন। এখানে উচ্চ পদমর্যাদায় কর্মরত নারীটিকেও নিজে গাড়ি চালনা করতে দেখা যায় না। মধ্যবিত্ত পরিবারের বিশ্ববিদ্যালয় গমনরত কন্যাটিকে স্কুটি চালনায় দেখা যাওয়ার চিন্তা অবান্তর। প্রতিদিনের যাতাযাত-যুদ্ধে অবতীর্ণ উপার্জনক্ষম নারীটি একটি মোটরসাইকেল কিনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচবেন এমন ভাবনাও অলীক।

এখানে দুপা একত্র করে বামে ঘুরিয়ে রেখে চালকের পেছনের আসনে বসে নির্বিকার চেহারায় ভারসাম্য রক্ষা করতে করতে হোন্ডা-চালক বয়ফ্রেন্ড কিংবা স্বামীকে আঁকড়ে ধরে থাকা ব্যতীত নারীর কিছুই করণীয় নেই!

এতটা নেতিবাচকতার মাঝেও সম্ভাবনা-জাগানিয়া খবর হল, এই শহরেই নারী ট্রাফিক সার্জেন্টদের পুরুষ সহকর্মীদের মতো নির্বিঘ্নে রাজপথে যাতায়াতে স্কুটি দেওয়া হয়েছে। শুরুটা বাইশটা স্কুটি দিয়ে হলেও নারী ট্রাফিক সার্জেন্টদের সংখ্যা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে স্কুটির সংখ্যাও বাড়বে আগামীতে, এমনটা আশা করাই যায়।

তবে কেবল ট্রাফিক সার্জেন্টদের মধ্যে সীমিত না রেখে, নারী-শিক্ষার্থী ও কর্মজীবীদের মোটর সাইকেল ও স্কুটি চালনায় সরকারি-বেসরকারিভাবে প্রচারণা চালাতে হবে। নারীকে পুরুষ-চালিত মোটর সাইকেলের বিজ্ঞাপনে স্রেফ মডেল হিসেবে নয়, খোদ নারীর বাহন হিসেবে মোটরসাইকেল ও স্কুটির বিজ্ঞাপনে উপস্থিত হতে হবে।

একদম যে মোটরসাইকেল বা স্কুটি চালাতে নারীদের দেখা যায় না তা নয়। গ্রামে এনজিওগুলোর সঙ্গে জড়িত নারী-কর্মীদের স্কুটি চালনায় দেখা গেছে। সম্ভবত পেশাগত কারণে, ঢাকাতেও কালেভাদ্রে নারীকে স্কুটিতে, মোটরসাইকেলে চালকের আসনে দেখা যায়। দৃশ্যটা সচরাচর নয় বিধায় যতক্ষণ-না নারী ও তার স্কুটি চোখের আড়ালে যাচ্ছে, ততক্ষণ 'হা' মুখে, ঘাড় ঘুরিয়ে লোকে তাকিয়েই থাকে।

একই আচরণ আমিও করেছিলাম সম্প্রতি উত্তরবঙ্গ ভ্রমণে যেয়ে। গ্রামের নাম হরিন্দা হোক অথবা ছিট চিলারং, উপজেলা পীরগঞ্জ হোক কী বীরগঞ্জ, জেলা ঠাঁকুরগাঁও হোক আর দিনাজপুর, আমি চকচকে চোখে, হা-করা মুখে, বিস্ময়ানন্দে স্কুলড্রেস-পরা মেয়ে-শিক্ষার্থীদের বাইসাইকেল চালিয়ে যাতায়াত করতে দেখেছি মেঠো পথ দিয়ে, পাকা রাস্তা দিয়ে। দেখেছি বিভিন্ন বয়সী নারীদেরও বাইসাইকেলে। এসব নিয়ে কোনো কানাঘুষা কানে আসেনি। কানে আসেনি কোনো নেতিবাচক মন্তব্যও।

বরং একজন পিতা পান চিবুতে চিবুতে গালভরা হাসি দিয়ে বললেন, "হামার মাই ত সাইকেলত চড়েহ স্কুলত যাছেহ।"

তাঁর এই কথায় ছিল কন্যাকে শিক্ষাদানের গৌরব– কন্যার আত্মনির্ভরশীলভাবে এগিয়ে চলার আনন্দ।

গ্রামীণ জনপদে স্কুলপড়ুয়া ছাত্রীদের সাইকেল চালানো নিয়ে প্রতিবেদন পড়া হয়েছে, দেখা হয়েছে আলোকচিত্র– তবে নিজ চোখে তাদের এই পরিশ্রম, নিষ্ঠা, দৃঢ়তা, সাবলীলতা দেখার অভিজ্ঞতা অভূতপূর্ব। অবশ্য সরকারকেও সাধুবাদ জানাতে হয়; কারণ বাংলাদেশে ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন রয়েছে বিনামূল্যে নারী-শিক্ষার্থীদের সাইকেল প্রদানে। প্রতিষ্ঠানগুলোর 'সিএসআর' নীতিমালা মানতে এমনকি 'শরিয়া নিয়মে পরিচালিত ইসলামি ব্যাংকও' উত্তরাঞ্চলে বিনামূল্যে সাইকেল বিতরণ করেছে!

বাস্তবিক প্রয়োজন আর জ্ঞান মানুষকে ক্রমাগত কুসংস্কারমুক্ত করে। আধুনিক সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত গ্রামের অনেক মানুষ কুসংস্কারমুক্ত হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সে তুলনায় বরং শহরের পোশাকি আধুনিক সমাজ আটকে আছে ট্যাবুতে। এখানে ফেসবুকেই কেবল ‍অধিকারের কথা, উদারতার কথা; বাস্তবে প্রয়োগ নেই।

অবশ্য ঢাকায় অনেক স্কুল-শিক্ষার্থী মেয়েকে বাবার সঙ্গে মোটরসাইকেলে দুপাশে পা দিয়ে বসতে দেখা যাচ্ছে। সমাজের অযৌক্তিক ভ্রুকুটির চেয়ে কন্যার স্বাভাবিকভাবে বসার স্বাধীনতা ও কন্যাকে 'অদ্ভুতভাবে' বসে ভারসাম্য রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করতে দেওয়ার চেয়ে নিরাপদ ভঙ্গিমায় বসা নিশ্চিত করার চিন্তা যে অভিভাবকেরা করতে পারছেন, তারা দৃষ্টান্ত গড়ছেন। তাদের সাধুবাদ।

'বিডি সাইক্লিস্টস' নামের জনপ্রিয় একটি সংগঠনে বিভিন্ন বয়সী সাইকেল-চালনাকারীর মধ্যে নারীরাও রয়েছেন। বছর কয়েক আগে রেডিওতে শুনছিলাম, একটি স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন গার্মেন্টসের নারীশ্রমিকদের জন্য সাইকেল চালনা উদ্বুদ্ধ করতে কাজ করছে। যেখানে বাংলাদেশ বাইসাইকেল রপ্তানিতে শীর্ষ পাঁচটি দেশের মধ্যে রয়েছে, সেখানে দেশের অভ্যন্তরে বাইসাইকেল সকলের বাহন হবে না, এমনটা মানা যায় না। তাই উত্তরাঞ্চলের পাশাপাশি বস্তুত পুরো দেশেই নারীর সাইকেল চালানোর বিষযটিতে স্বাভাবিকতা দিতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ভূমিকা নিতে হবে।

সম্প্রতি ঢাকায় আয়োজিত হল নারীদের প্রথম ম্যারাথন দৌড়। বিদেশে নারী-পুরুষের ম্যারাথন দৌড়ের ক্রীড়াচর্চা নিয়মিত। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সুনির্দিষ্ট দিবসে, বিশেষ বার্তা নিয়েও ম্যারাথন দৌড়ের আয়োজন করে। একইভাবে বাইসাইকেল চালনাও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হিসেবে জনপ্রিয়।

ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে, বিশেষত ঢাকায়, শিশু-কিশোরদের বাড়ির সামনে, এলাকার গলিতে খেলাধুলা করা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন খেলাধুলা সম্পূর্ণ 'অনলাইন'! এতে গড়ে উঠছে শরীরচর্চাহীন একটি প্রজন্ম। সাইকেল-চালনা একটি উপযুক্ত শরীরচর্চা। সাইকেল একটি পরিবেশবান্ধব বাহন। নারীকে সাইকেল চালনায় উৎসাহ দিলে পারিবারিক-সামাজিক-ধর্মীয় দোহাইয়ে নারী আর যোগাযোগে পিছিয়ে পড়বে না। একই সঙ্গে সুগঠিত শারীরিক ও মানসিক বিকাশ হবে। এমন বুদ্ধিদীপ্ত প্রজন্মই তো জাতির আর্থ-সামাজিক কাঠামো গড়ে তুলবে। জাতিকে দেবে নেতৃত্ব।

সাইকেল চালনার জন্য প্রধান সড়কে বিশেষ লেন করার একটি দাবি রয়েছে সাইক্লিস্টসদের পক্ষ থেকে। ঢাকার দুই নগরপিতা এদিকে নজর দিতে পারেন। অন্যদিকে প্রজন্মের বেপথু হওয়া রুখতে কিছু প্রাণবন্ত ক্রীড়া প্রতিযোগিতার নিয়মিত আয়োজন জরুরি। সাইকেল-চালনা প্রতিযোগিতা হতে পারে 'স্পোর্টিং স্পিরিট' গড়ার অনন্য ধাপ। এমন উৎসবমুখর আয়োজন পর্যটকদেরও দৃষ্টি কাড়বে।

সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নিয়মিতভাবে আন্তঃবিদ্যালয় সাইকেল-চালনা প্রতিযোগিতা আয়োজিত হলে, সাইকেল-চালনা জনপ্রিয় হবে সকলের মাঝে। একই সঙ্গে নারীদের জন্য ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সাইকেল-চালনা প্রতিযোগিতা হলে সমাজে নারীর সাইকেল-চালনার বিষয়টি সাবলীল চাহনিতে দেখা হবে।

সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, টেলিকম প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে নারীদের সাইকেল বিতরণ কার্যক্রমে এগিয়ে এসে সবা্ইকে সচেতন করতে পারে। প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞাপনে উঠে আসতে পারে সাইকেল-চালক নারীর চিত্র। দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ড সাইকেলের টিভি কমার্শিয়াল, পত্রিকার বিজ্ঞাপন সাইকেল কিনতে আগ্রহী করবে সকলকে।

পরিবারের ছেলে সন্তানটি কেবল সাইকেল কিনতে আবদার করবে, এই পারিবারিক-সামাজিক দৃশ্যটি আরও বড় পরিসরে চিত্রায়িত হোক। পরিবারের কন্যাসন্তানটিও একটি সাইকেলের জন্য বায়না করুক।

তারপর কাঙ্ক্ষিত সাইকেল পেয়ে চকচকে চোখে সরল আনন্দে দুপাশে দুপা দিয়ে আসনে বসে প্যাডেল মেরে এগিয়ে যাক আজকের কন্যাশিশু, কালকের তরুণী, পরশুর নারী।