শোষিত বেলুচ ও মোদীর বেলুচিস্তান নীতির নেপথ্যে

বিজন সরকার
Published : 28 August 2016, 05:55 AM
Updated : 28 August 2016, 05:55 AM

একসময়ের ব্রিটিশ-শাসিত কালাত, খারন, মারখান ও লাসবেলা নিয়েই মূলত গঠিত বেলুচিস্তান। পাকিস্তানের চার প্রদেশের একটি বেলুচিস্তানের আগ্নেয়গিরির আগুন সেই সাতচল্লিশ সাল থেকেই জ্বলছে!

কালাত চুক্তির মাধ্যমে বেলুচিস্তানের শাসকরা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। চুক্তিতে কেবল প্রতিরক্ষা, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি-ইসলামাবাদের হাতে থাকার কথা ছিল। বাকি বিষয়গুলি বেলুচিস্তানের শাসকদের উপর ন্যস্ত রাখা হয়। আটচল্লিশ সালে জিন্নাহর সঙ্গে বেলুচিস্তানের শাসকদের যে চুক্তি হয়, তা পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী মানেনি। পাকিস্তানি শাসকেরা সেনাবাহিনী পাঠিয়ে আরও অঞ্চল দখল করে বেলুচিস্তান নামক প্রদেশটি তৈরি করে। বেলুচিস্তান প্রদেশটি পাকিস্তানের ৪০ ভাগ জায়গাজুড়ে অবস্থিত। এর জনসংখ্যা প্রায় দশ লাখ।

বেলুচরা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার হারিয়ে ভুলের খেসারত দিচ্ছে। তবে পাকিস্তানি শাসকদের বিশ্বাসঘাতকতা বেলুচরা মানতে পারেনি। স্বাধীনচেতা বেলুচরা আটচল্লিশ সালেই পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সংগ্রামে লিপ্ত হয়। পরবর্তীতে বহুবার বেলুচদের স্বাধীনতার সংগ্রাম দাবানলের মতো জ্বলে ওঠে। তাতেও কোনো ফল আসেনি। বিশেষ করে, একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে যাওযায় বেলুচদের স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৭৩-এ তেজময় হয়ে ওঠে। বেলুচদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে অভীষ্ট লক্ষ্যে নেওয়ার জন্য বেলুচদের একজন 'বঙ্গবন্ধু' খুবই অপরিহার্য। এখনও বেলুচদের মধ্যে কেউ বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেননি।

যতবারই স্বাধীনতার জন্য মরিয়া হয়েছে ততবারই পাকিস্তানি সেনারা বেলুচদের নির্বিচারে হত্যা করেছে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী একাত্তরের শিক্ষাকে উচ্চতার চিহ্ন হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে বেলুচদের দমিয়ে রাখছে। বেলুচরা প্রায় দশবার পাকিস্তানের শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রতিবারই বেলুচ স্বাধীনতাকামী জনগণের উপর নির্মম দমননীতি প্রয়োগ করেছে।

খোদ পাকিস্তানের সেনা গোয়েন্দা সংস্থার হিসাবে, এখন পর্যন্ত প্রায় ১৮ হাজার বেলুচিস্তানের মানুষ হারিয়ে গেছে। বিভিন্ন সংস্থার জরিপে দেখা যায়, গড়ে প্রায় প্রতিটি বেলুচ পরিবারের একজন করে মানুষ গুম হয়েছে। কেবল গ্রাউন্ডে সেনা পাঠিয়ে নয়, আকাশ থেকেও বেলুচ স্বাধীনতাকামী জনগণের উপর হামলা করা হচ্ছে।

২০০৩ সালে থেকে কয়েক বছর ধরে বেলুচরা আবারও স্বাধীনতার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। আত্মনিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার জন্য বেলুচদের ন্যায্য সংগ্রাম তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। সেই সময়ে সামরিক শাসক পারভেজ মুশাররফ বেলুচদের স্বাধীনতার চেতনাকে নির্মূল করতে চেয়েছিলেন। বেলুচদের ওপর নেমে আসে মধ্যযুগীয় বর্বরতা। গুহার ভেতর থেকে ধরে বেলুচদের অবিসংবাদিত জাতীয় নেতা নবাব আকবর বুগতিকে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। বুগতিকে হত্যার পর বেলুচদের স্বাধীনতার সংগ্রাম স্ফুলিঙ্গের মতো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে।

গত সাত দশক ধরে বেলুচেরা পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী দ্বারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মতো শোষিত হচ্ছে। সময়ের পরিক্রমায় বেলুচদের শোষণ করার জন্য নতুন নতুন ভূ-রাজনৈতিক হাতিয়ার পাকিস্তানি শাসকেরা ব্যবহার করছে।

পাকিস্তানের জাতীয় গ্যাস উৎপাদনের ১৭ শতাংশ আসে বেলুচিস্তান থেকে। বেলুচরা ব্যবহার করে মাত্র সাত শতাংশ। অপর দিকে পাঞ্জাব মাত্র জাতীয় গ্যাস উৎপাদনে চার শতাংশ অবদান রাখে; অথচ পাঞ্জাবিরা ব্যবহার করছে ৪৩ শতাংশ। বেলুচিস্তানের ৪০ শতাংশ মানুষ গ্যাস ব্যবহারের সুযোগ পায়। অন্যদিকে পাঞ্জাবের ৯৭ শতাংশ মানুষ গ্যাস ব্যবহার করে।

অনুরূপভাবে, প্রতিটি খাতে বেলুচদের শোষণ করা হচ্ছে। সারা দিনে বেলুচদের ঘণ্টা দুয়েক পানি দেওয়া হয়। বেলুচদের পানি দেওয়া হয় সিন্ধু প্রদেশে। বেলুচিস্তানের সেচ প্রকল্পগুলিরও একই রকম অবস্থা। অথচ পাকিস্তানের জাতীয় খাদ্যভাণ্ডারে বেলুচিস্তানের ভূমিকা অনেক। কয়েক দিন আগেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর 'হাতের পুতুল' খোদ বেলুচিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নবাব সানাউল্লাহ খান জাহেরি বেলুচিস্তানের কৃষকদের সরকারি ঋণ না দেওয়ার অভিযোগ আনেন।

প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ থাকার পরও বেলুচিস্তানেই সবচেয়ে বেশি বেকারত্ব, দরিদ্রতা। প্রশাসনের উপরের স্তরে বেলুচদের সংখ্যা হাতেগোনা। এমনকী বেলুচিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভরশীল প্রকল্পগুলিতেও অন্যান্য প্রদেশ ও চীন থেকে লোক নিয়োগ করা হয়। শোষণ করার তারতম্যের প্যারামিটারের পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে বেলুচিস্তানের অবস্থা খুব খারাপ। এর পেছনে মূল কারণ বেলুচিস্তানের প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ সম্পদ।

বেলুচদের ভূমির প্রাকৃতিক সম্পদ দেশি-বিদেশিরা লুটে খাচ্ছে। বেলুচিস্তানের ভৌগোলিক সুবিধাজনক অবস্থানের ফসলও অন্যের ঘরে। বেলুচদের ভবিষ্যৎ একে-৪৭ ও এফ-১৬-এর নিচে! বেলুচিস্তানে বেলুচদের সার্বিক সয়সম্পত্তি কমছে; বাড়ছে কেবল বিভিন্ন বাহিনীর স্থাপনা ও বাহিনীর বুটের আওয়াজ।

এমতাবস্থায় এটি বলা যায় যে শোষণ ও বঞ্চনা দিক দিয়ে বেলুচিস্তান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চেয়েও সব প্যারামিটারেই খারাপ। বেলুচদের জাতীয় সম্পদের হরিলুটে কেবল পাকিস্তানের এলিট সম্প্রদায় জড়িত হয়, চীনের নব্য পুঁজিবাদীরাও এ দলে আছে। চীনের অর্থায়নে গুয়াদার সমুদ্রবন্দর বেলুচদের ভূমিতে নির্মাণ হলেও বেলুচদের এই বন্দরের শত্রু হিসেবে দেখা হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, আমেরিকা ও ভারত গুয়াদার সমুদ্রবন্দরে চীনের অর্থায়নের পেছনে চীনের নৌঘাঁটি নির্মাণের পরিকল্পনার অভিযোগ করে আসছে। পাকিস্তানের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও আমেরিকা বেলুচিস্তানের কোয়েটাতে একটি অফিস খোলার চেষ্টা করছে। চীন নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে এমন ধারণা সাধারণ বেলুচদেরও।

বেলুচিস্তানের স্বর্ণের খনিগুলিও অব্যবস্থাপনার মতো নানা অজুহাতে প্রাদেশিক সরকারকে নিষ্ক্রিয় করে পাকিস্তানের এলিট সম্প্রদায় হাতে নিয়েছে। চীনের কোম্পানিগুলি স্বর্ণ উত্তোলনের বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে।

এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, বেলুচিস্তানের চাগাই জেলার রিকু ডিকের মতো ছোট শহরটিতেই প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলারের দামের স্বর্ণ ও তামা জাতীয় সম্পদ রয়েছে। একই জেলায় আরেকটি ছোট শহর সেইনডাকেও স্বর্ণ ও তামার মজুতের পরিমাণ শত বিলিয়ন ডলার মূল্যেরও বেশি। বেলুচের এই মূল্যবান সম্পদ আরোহণের দায়িত্বে রয়েছে চীনা ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিগুলি।

বেলুচিস্তানের উপর পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর ভয়াবহ নির্যাতন, নিপীড়ন ও শোষণের চিত্র বহির্বিশ্বের কাছে অনেকটাই অজানা। বহির্বিশ্বের দেশগুলি, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী সমাজ বেলুচদের শোষিত হওয়ার খবর জানলেও কেউ দীর্ঘদিন তেমন মাথা ঘামায়নি।

বিভিন্ন সামরিক সূত্রগুলির মতে, পাকিস্তানের বিমানবাহিনী যখন বেলুচ স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের উপর বিমান থেকে হামলা চালায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন গোপনে দূত পাঠিয়ে কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে পাকিস্তানকে শাসিয়ে দেয়।

বহির্বিশ্বের সাধারণ জনগণের কাছে বেলুচদের শোষিত হওয়ার নিত্যদিনের খবর তেমন ছিল না। বেলুচ স্বাধীনতাকামী জনগণ গত সাত দশক চেষ্টা করেও তাদের শোষণের খবর বিশ্ববাসীকে জানাতে পারেনি। কোনো দেশের সমর্থন বেলুচরা পায়নি। ভারতও নানান ভূ-রাজনৈতিক ও শক্তিশালী অর্থনীতি অর্জনের লক্ষ্যের কারণে বেলুচিস্তানের অমানবিক চিত্র নিয়ে কথা বলেনি। দেশটির উদ্দেশ্য ছিল এই অঞ্চলে শান্তি বজায় রেখে নিজের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা।

নরেন্দ্র মোদী ভারতের ক্ষমতায় আসার পরপরই বেলুচরা কিছুটা আশান্বিত হয়েছিল। কিন্তু গত দুবছর মোদী বেলুচিস্তানের বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট অবস্থান নেননি। বরং মোদী আঞ্চলিক শান্তির স্বার্থে জম্মু-কাশ্মীরের সমস্যাটিকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি পর্যায়ে নিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। গত দুবছরে মোদী তিনবার জম্মু-কাশ্মীর সফর করলেন। ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রীরই পুরো এক টার্মে তিনবার কাশ্মীর সফরের রেকর্ড নেই।

এমতাবস্থায় বোঝা যায়, মোদী সরকার জম্মু-কাশ্মীর ইস্যুটিকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে। ভারত সরকার জম্মু-কাশ্মীরে উন্নয়ন করে সেখানকার জনগণকে আরও ভারতের বহুত্ববাদ রাজনৈতিক দর্শনে দীক্ষিত করতে চাইছে। বর্তমানে জম্মু-কাশ্মীর পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) কোয়ালিশন করে জম্মু-কাশ্মীর শাসন করছে। বিরোধী দলে রয়েছে ন্যাশনাল কনফারেন্স।

জম্মু-কাশ্মীরে ভেতরে পাকিস্তানের সহযোগিতায় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা কয়েক মাস ধরেই তৎপর। পাকিস্তানের সেনা গোয়েন্দা সংস্থায় সহযোগিতায় এই বিচ্ছিন্নতাবাদীরা জম্মু-কাশ্মীরের ২০১৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়েছিল। জম্মু-কাশ্মীরের জনগণ তা প্রত্যাখ্যান করে। গত ২৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৬৫ শতাংশ ভোট পড়ে।

মোদী সরকার যে বহুমাত্রিক পদ্ধতিতে জম্মু-কাশ্মীরের সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে তৎপর তা পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বুঝে গেছে। মোদীর সেই বহুমাত্রিক পন্থায় একটি ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করা। বিশেষ করে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে গুরুত্ব দিয়ে সামনে নিয়ে এসে এই অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখা। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের খুব একটা আপত্তি ছিল বলে মনে হয় না। এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।

পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর আপত্তিকে এড়িয়ে নওয়াজ শরীফ মোদীর অভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এমনকী জম্মু-কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের সঙ্গেও নওয়াজ শরীফ দিল্লি সফরের প্রাক্কালে দেখা করেননি। নওয়াজ শরীফের এ সিদ্ধান্ত শান্তির বার্তারই ইঙ্গিত দেয়।

কিন্তু দিল্লি থেকে দেশে ফিরতে না ফিরতেই সেনাবাহিনীর সমর্থনে 'জঙ্গিবান্ধব' ইমরান খানের কথিত সরকারবিরোধী আন্দোলনের মুখে পড়তে হয় নওয়াজ শরীফকে। নওয়াজ শরীফ নিজের ক্ষমতা ও রাজনীতির অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য জম্মু-কাশ্মীরের প্রতি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর চাপিয়ে দেওয়া নীতিতে ডুব দিতে বাধ্য হন।

নরেন্দ্র মোদী তবু হাল ছাড়েননি। মোদী সরকার দুটি বছর নানা ফোরামে জম্মু-কাশ্মীরে পাকিস্তানের মদদে সন্ত্রাসের বিষয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যান। সেইসব আলোচনায় ভারত পাকিস্তানের কাছ থেকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সমর্থিত কোনো ধরনের জঙ্গি কর্মকাণ্ড যেন ভারতে না ঘটে সেই নিশ্চয়তা চেয়েছিল। তবে পাকিস্তান কেবল জম্মু-কাশ্মীর ছাড়া ভারতের অন্যান্য প্রদেশের নিশ্চয়তা দিয়েছিল। জম্মু-কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও জঙ্গিদের পাকিস্তান অনেকটা প্রকাশেই সমর্থন দিচ্ছে। পাকিস্তানের এখনও মনে করে জম্মু-কাশ্মীর একটি অমীমাংসিত বিষয়।

এমতাবস্থায় মোদী সরকার নিজ দলে ও সংঘ পরিবারের চাপে পড়েন। বেলুচিস্তানের স্বাধীনতাকামী জনগণকে সমর্থন দেওয়ার চাপটি ক্ষমতায় আসার পরপরই মোদীর উপর ছিল। কিন্তু মোদী আমলে নেননি। মোদী পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে এড়িয়ে দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের সব চেষ্টাই করেন। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির ক্ষমতার কেন্দ্রে যে কুর্দি পরিহিত মানুষেরা, সেটি জানার পরও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সামনে নিয়ে আসার উৎসাহ দিয়ে যান মোদী।

কিন্তু মোদীর গৃহীত কোনো পদক্ষেপই কাজে আসেনি। নওয়াজ শরীফ পাকিস্তানের এবারের স্বাধীনতা দিবসকে জম্মু-কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উৎসর্গ করেন। ফলে বাধ্য হয়েই মোদী ভারতের স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে বেলুচিস্তান, পাকিস্তান-দখলকৃত কাশ্মীর ও গিলকিটে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর নির্মমনীতির সমালোচনা পথ বেছে নেন। একই সঙ্গে দেশটির পররাষ্ট্র

মন্ত্রণালয়কে বেলুচিস্তানের স্বাধীনতাকামী জনগণের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেন। বলা যায়, ভারত এখন বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার জন্য কাজ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

পুরো বিষয়টি দ্রুত পাল্টে যায় দুটি ঘটনার পর। আফগানিস্তানে মার্কিন নতুন কমান্ডার জেনারেল জন নিকোলসন নিয়োগ পান তিন মাস হতে চলল। এই তিন মাসে তিনি দুবার ভারত সফর করেন। চলতি মাসের ১০ তারিখে ভারত সফরে গিয়ে আফগানিস্তানে ভারতের সামরিক অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য অনুরোধ করেন। আফগানিস্তানে ভারতের কেবল সামরিক খাতে নয়, বেসামরিক খাতেও সহযোগিতা বাড়ানোর তাগিদ দিচ্ছে মার্কিন প্রশাসন। আফগানিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও ভারত সফরে এসে ভারতের বিনিয়োগকারীদের আফগানিস্তানের বিনিয়োগ করার আহ্বান জানান। ভারত ইতোমধ্যে আফগানিস্তানে ২২০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছে।

অন্যদিকে, পাকিস্তানকে তাদের ভূমি থেকে জঙ্গিদের স্বর্গরাজ্য নিশ্চিহ্ন করার তাগিদ দিলেন জেনারেল জন, বিশেষ করে হাক্কানি নেটওয়ার্ককে নির্মূল করার। আফগানিস্তানের প্রধানমন্ত্রী আশরাফ ঘানিও পাকিস্তানে সফর গিয়ে কীভাবে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলিকে নির্মূল করা যায় তা ভাবার জন্য পাকিস্তানের সরকারকে অনুরোধ করলেন। আফগানিস্তানের অভিযোগ, আফগানিস্তানের বিগত কয়েক বছরের হামলায় পাকিস্তানের গোয়েন্দাদের হাত রয়েছে। উল্লেখ্য, আফগানিস্তানে ভারতের প্রাধান্যতা বৃদ্ধির কারণে আফগানিস্তানের প্রতি পাকিস্তান নাখোশ।

দ্বিতীয়ত, মার্কিন প্রশাসন পাকিস্তানকে ৩০০ মিলিয়ন ডলার সামরিক সাহায্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিলের ঘোষণাটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেবল সামরিক সহযোগিতাই বাতিল করেনি, পাকিস্তানকে শাসিয়ে দিয়েছে। জঙ্গিদের মদদ দেওয়া বন্ধ না করলে পাকিস্তানের উপর বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে এবং উত্তর কোরিয়ার মতো পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হবে– এটি স্পষ্ট করেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ভারতের ভূ-রাজনৈতিক সচেতন কূটনৈতিক সমাজ একটি বিষয় ভালো করেই বুঝতে পেরেছে: পাকিস্তান ইচ্ছে করলেই ভারত-বিদ্বেষমূলক পররাষ্ট্রনীতি বাদ দিতে পারবে না। আর সেই বিদ্বেষপূর্ণ নীতিতে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলি পাকিস্তানের সামরিক শক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। যে সমাজে হাফিজ সাইদের মতো একজন জঙ্গি ও সন্ত্রাসীকে 'জাতীয় বীর' ঘোষণা করা হয়, সেই সমাজকে 'উত্তর কোরিয়া' হওয়া থেকে কেউ ফেরাতে পারে না। যে সমাজে অ্যাকটিভ ট্যাঙ্ক থিংকিং ট্যাঙ্কের ভূমিকা পালন করে, সেই সমাজের উত্তর কোরিয়া হওয়ার স্বাভাবিক পদ্ধতি রোধ করা যাবে না।

ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তান ও ইরানের গভীর সম্পর্কটিও বেলুচিস্তানের স্বাধীনতাকামী জনগণের পক্ষ নেওয়া মোদীর সিদ্ধান্তে ভূমিকা রাখে। আফগানিস্তান দেশটির নিরাপত্তাকে স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরিয়ে আনতে হিমশিম খাচ্ছে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক দর্শন যে জঙ্গিপন্থী, সেটি আফগানিস্তানের প্রতিটি নাগরিক (জঙ্গিরা ছাড়া) ভালো করেই বোঝে। পাকিস্তান যদি ক্রমশ আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি যদি একেবারেই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পরে, আফগানিস্তানের ভারত নির্ভরশীলতা বাড়বে বই কমবে না।

অন্যদিকে, ভারত যদি মোদীর বেলুচিস্তান নীতি বাস্তবায়নের দিকে অগ্রসর হয় তাতে ইরানেরও সুবিধা হবে। তবে এ ক্ষেত্রে ইরান নিজের দখলকৃত বেলুচিস্তানের অংশের নিশ্চয়তা নিয়ে চিন্তা করবে। তাছাড়া পাকিস্তান থেকে বেলুচিস্তান সরে গেলে ইরান খুশিই হবে। ইরানের চিরশত্রু সৌদির ওহাবিজম আদর্শের রাজনৈতিক গবেষণার 'হ্যাচারি' পাকিস্তান দুর্বল হয়ে পড়লে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদির ক্ষমতা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

মোদী বেলুচিস্তান নীতি কেবল নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ ফ্যাক্টরগুলির উপর নির্ভর করে নেননি। পরিবর্তনশীল বিশ্বের ভারতবান্ধব ভূ-রাজনৈতিক নতুন নতুন প্রেক্ষাপট মোদীকে অনুপ্রাণিত করেছে। যে পরিবর্তনশীল বিশ্বে পাকিস্তানের জন্য স্থান ক্রমশই সংকোচনশীল হয়ে পড়ছে।

এমতাবস্থায় মোদীর বেলুচিস্তান নীতির ভবিষ্যৎ একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় কি?