তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্য ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই

জিয়াউল হক মুক্তা
Published : 25 August 2016, 02:25 PM
Updated : 25 August 2016, 02:25 PM

২৪ জুলাই ঢাকায় 'টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা' বিষয়ক একটি আলোচনা সভায় জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, উৎপাদনের কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে; তা না করে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে যতই বরাদ্দ দেওয়া হোক না কেন, তা কোনো কাজে আসবে না। তাঁর এ বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশটি জোরালো করতে তিনি বাংলাদেশের টেস্ট রিলিফ (টিআর) কর্মসূচি পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট সংসদ-সদস্য (এমপি) ও অন্যদের দুর্নীতির প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেন। পাশাপাশি তিনি এ-ও বলেন যে, সব এমপি চুরি করেন না; তবে এমপিরা চুরি করেন।

তাঁর এ বক্তব্যটি সঙ্গে সঙ্গেই অনলাইন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এ নির্মম বাস্তবতা তুলে ধরার জন্য তিনি ব্যাপকভাবে জননন্দিত হন। আর তা এমপি ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদেরও মনোযোগ আকর্ষণ করেও অতি দ্রুত। সেদিন সন্ধ্যায় সংসদে ও পরদিন মন্ত্রিপরিষদের সভায় তিনি তাঁর সহকর্মীদের দ্বারা প্রশ্নবিদ্ধ হন।

হাসানুল হক ইনু তাঁদের জানান, তিনি ঢালাওভাবে এমপিদের অভিযুক্ত করেননি। তিনি বলেন যে নিজে একজন এমপি হিসেবে সব এমপি ও জনপ্রতিনিধিদের তিনি আন্তরিকভাবে সম্মান করেন এবং সে সম্মান অক্ষুণ্ন রয়েছে। এরপরও কেউ যদি তাঁর বক্তব্যে অনভিপ্রেতভাবে দুঃখ পেয়ে থাকেন সে জন্য তিনি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। তিনি আশা প্রকাশ করেন, সামাজিক নিরাপত্তা খাতের প্রকল্পের অব্যবস্থাপনার অবসানে সব এমপি ও জনপ্রতিনিধি ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাবেন।

মন্ত্রিপরিষদে ও সংসদে হাসানুল হক ইনুর এ দুঃখ প্রকাশের ঘটনা অনেককে আশাহত করেছে। বিশেষত, যারা তাঁর আগের বক্তব্যটিকে সমর্থন করেছিল। বিপরীতে এ ঘটনা কাউকে কাউকে উচ্ছ্বসিত করেছে, বিশেষত যারা তাঁকে অপছন্দ করে।

২৮ জুলাই হাসানুল হক ইনু অন্য একটি সভায় বলেন–

"মুরুব্বিরা বলেছেন, একটু কৌশল করে কথাবার্তা বলতে। ক্ষমতায় থাকলে সব কথা বলা যায় না। জানি না কতটা কৌশলী হতে পারব। তবে আমি সবসময় চোরকে চোরই বলব। আমি রাজাকারকে রাজাকার, জঙ্গিকে জঙ্গিই বলব।"

এর অর্থ হাসানুল হক ইনু তাঁর বক্তব্য প্রত্যাহার করেননি।

প্রদত্ত বক্তব্যের কারণে হাসানুল হক ইনু কতটা নন্দিত এবং কতটা নিন্দিত হলেন বা তাঁর দুঃখ প্রকাশ নিয়ে কে কতটা আশাহত বা কে কতটা উচ্ছ্বসিত হলেন– সেটা নিতান্তই একটি সাবজেকটিভ বিষয়। মূল কথা হল: তিনি যে বক্তব্যটির অবতারণা করেছেন তা কতটুকু বাস্তবানুগ, কতটা বস্তুনিষ্ঠ বা অবজেকটিভ। তাঁর নিন্দিত-নন্দিত হওয়া বা অন্যদের আশাহত-উচ্ছ্বসিত হওয়ায় সে অবজেকটিভিটির বা বস্তুনিষ্ঠতা বদলে যায় না।

তিনি যদি এমপিদের দুর্নীতির বিষয়টি না বলতেন, তার মানে এ হত না যে তাঁরা দুর্নীতি করেন না। আর তিনি তাঁর সহকর্মীদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করলেও এটা প্রমাণ হয় না যে তাঁরা সবাই দুর্নীতিমুক্ত।

হাসানুল হক ইনু একটি রূঢ় বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। সরকারের আলোচনা ও অনেক দলিলেও এ বাস্তবতার প্রতিফলন রয়েছে, যদিও এমপিদের দুর্নীতির কথা সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয় না। সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের ওয়েব সাইটে বলা হয়েছে–

"There is considerable leakage of allocated fund and a significant percentage of households are non-poor."

মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) ২.২ শতাংশ এবং বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের প্রায় ১৩ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে। বাংলাদেশের ২৪.৫ শতাংশ পরিবার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতাভুক্ত; কিন্তু অতিগরিব (হতদরিদ্র) পরিবারের ৫৭ শতাংশ এবং গরিব (দরিদ্র) পরিবারের ৬৬ শতাংশ এখনও এ কর্মসূচির আওতার বাইরে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি-নির্ভর উন্নয়ন চিন্তা যতদিন বহাল থাকবে ততদিন জনগণ দরিদ্র ও অতিদরিদ্র পর্যায়ে নিপতিত হতেই থাকবে; উপরন্তু অর্থনৈতিক-সামাজিক-প্রাকৃতিক ঝুঁকির কারণেও আরও বিপুলসংখ্যক মানুষ দরিদ্র ও হতদরিদ্র হবে।

আরও মনে রাখা দরকার, অর্থনৈতিক দারিদ্র্য একটি আপেক্ষিক প্রপক্ষ; ধনী-গরিব বৈষম্য যত বাড়তে থাকবে, দারিদ্র্য তত সম্প্রসারিত হবে। দিনে এক পিপিপি ডলার আয় দিয়ে হতদরিদ্র মাপার মাপকাঠি ধ্রুবক নয়।

সুতরাং বাংলাদেশে আগামী দিনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ঢেলে সাজাতে হবে। বর্তমানে দেশের ৩৫টি মন্ত্রণালয়-বিভাগ-সংস্থার অধীনে ১৪৫ ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু আছে। সুখের বিষয় এগুলোর দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা দূর করতে মন্ত্রিপরিষদের নির্দেশে দেশের পরিকল্পনা কমিশনের 'সাধারণ অর্থনৈতিক বিভাগ' একটি 'জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র' প্রণয়ন করেছে। সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত একটি 'কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটি' গঠনও করা হয়েছে।

গঠিত কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটি জাতীয় কৌশলপত্রের আলোকে–

১. একক ও সমন্বিত তথ্য ব্যবস্থাপনা;
২. ডিজিটাল ও মোবাইল-মাধ্যমে সরকার থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে অর্থ হস্তান্তর ব্যবস্থা সম্প্রসারণ;
৩. সমন্বিত পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা উন্নয়ন এবং
৪. কার্যকর অভিযোগ নিরসন ব্যবস্থা প্রণয়ন করবে।

অতএব বলা যায়, হাসানুল হক ইনু যে বক্তব্য প্রদান করেছেন তা বাস্তব। আর এ বাস্তবতা থেকে উত্তরণে সরকার কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছে এবং তার প্রয়োগের জন্য কাজ করছে। এ কৌশলপত্র প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক জনসচেতনতা ও জনসমর্থন প্রয়োজন; তা না হলে যারা এগুলো চুরি করেন তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এর প্রয়োগ বানচাল করে দিতে পারেন।

শুধু তাই নয়। আগেই বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিনির্ভর উন্নয়ন কৌশলের মাধ্যমে দরিদ্র, হতদরিদ্র ও বৈষম্যের শিকার জনগণের সংখ্যা কমানো সম্ভব নয়; দরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির।

এখানে মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই হাসানুল হক ইনুর বক্তব্যের প্রথম অংশের প্রতি; যে অংশে তিনি বলেছেন, উৎপাদনের কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষকে সক্ষম হতে হবে।

আর সে প্রসঙ্গে রাংলাদেশে কোনো উন্নয়ন কৌশল অনুসরণ করতে হবে তার পরিষ্কার নির্দেশনা রয়েছে বাংলাদেশের সংবিধানের ১০ অনুচ্ছেদে–

'মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।'

দুঃখজনক হলেও সত্য যে অনেক বাগাড়ম্বর করে সংবিধান সংশোধন করে আমরা বাহাত্তরের সংবিধানের মৌল নীতিমালায় ফেরত গিয়েছি, কিন্তু অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় আমরা তার কোনো প্রতিফলন দেখতে পাই না কখনও।

আশা করা যায়, হাসানুল হক ইনু যে বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা তুলে ধরেছেন তা বিবেচনায় নিয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবাই দেশের সংবিধানের নির্দেশ মেনে চলবে।