রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ

মোজাম্মেল খানমোজাম্মেল খান
Published : 22 August 2016, 03:45 PM
Updated : 22 August 2016, 03:45 PM

আগস্ট মাস বাঙালি জাতির জন্য সুখের মাস নয়, শোকের মাস; আগমনের মাস নয়, তিরোধানের মাস। এ মাসেই মহাপ্রয়াণ ঘটেছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দুই বাঙালির– রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধুর।

শোকের মাসে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের এ স্বল্পপরিসরে আমি তুলে ধরব বিশ্বসভায় সব বাঙালির গৌরব, ভারতবর্ষ তথা এশিয়ার গর্ব, প্রথম অশ্বেতাঙ্গ নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথের ভাবনা, চেতনা ও গান মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু তথা বাঙালিরা কীভাবে ব্যবহার করেছেন; বাঙালির মহাজাগরণ সৃষ্টিতে যার সফল পরিণতি মহান মুক্তিযুদ্ধ।

রবীন্দ্রনাথ এমন একজন মানুষ ছিলেন যাঁকে নিয়ে কোনো কিছু লেখা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। তিনি ছিলেন এক মহাসমুদ্রের মতো; যে কোনো দিকে তাকালেই যাঁর বিবিধ রূপ সহজেই ধরা পড়ে। তাঁর মহাপ্রয়াণের ঠিক ত্রিশ বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশে জন্ম হয় এমন আর এক বাঙালির, কালের বিবর্তনে তাঁকে মনে করা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি; এমনকি রবীন্দ্রনাথের মতো বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানুষটিকে ডিঙিয়ে। ঠিক যেমনটা ইংরেজরা উইনস্টন চার্চিলের গলায় শ্রেষ্ঠ ইংরেজের বরমাল্য পরিয়ে দিয়েছেন শেক্সপিয়ারের মতো আরেক কালজয়ী মানুষকে ডিঙিয়ে।

বঙ্গবন্ধুকে এক কথায় অভিহিত করা যায় দেশপ্রেমের অবতার হিসেবে। দেশের মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা কিংবদন্তীতুল্য। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের কত শত সংগ্রামের শীর্ষ যিনি রচনা করেছিলেন, বাংলাকে তাঁর মতো আর কে ভালোবেসেছে?

সাংবাদিক যখন তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন– 'হে মহানায়ক, আপনার শক্তি কোথায়'– তিনি উত্তর দিয়েছিলেন– "বাংলার মানুষকে আমি ভালোবাসি, সে-ই আমার শক্তি।"

সাংবাদিকের আবার প্রশ্ন– 'আর আপনার দুর্বলতা'– তাঁর উত্তর– "বাংলার মানুষকে আমি বড় বেশি ভালোবাসি, সেই আমার দুর্বলতা।"

১৯৭১ সালে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক সে ভাষণের কথা বলতে গিয়ে ওই সালের ৫ এপ্রিল সংখ্যায় মার্কিন সাপ্তাহিক 'নিউজ উইক' লিখেছিল:

"রাজনীতির প্রকৌশলী নন মুজিব, মুজিব হচ্ছেন রাজনীতির কবি; বাঙালির স্বাভাবিক প্রবণতা প্রায়োগিক নয়, শৈল্পিক; তাই মনে হয়, বাংলাদেশের সব মানুষ, শ্রেণি ও মতাদর্শকে এক সূত্রে গাঁথা হয়তো কেবল মুজিবের মতো রাজনৈতিক কবির পক্ষেই সম্ভব।"

বস্তুত বঙ্গবন্ধু এমন এক জাতীয়তাবাদী, সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করেন, যার সন্ধানে গেলে নেতাজি সুভাষ বসুর কাছে গিয়ে পৌঁছুতে হয়। অনেকটা অসচেতনভাবেই তিনি ওই মহান বাঙালির জাতীয়তাবাদী মতবাদ প্রচার করতে শুরু করেন। আমেরিকান লেখক জেমস জে নোভাকের ভাষায়–

"দুজনের মধ্যে পার্থক্য ছিল কেবল এক জয়গায়, বসু সব সময় ছিলেন অভিজাত, আর মুজিব কথা বলতেন সাধারণ মানুষের ভাষায়। তা সত্ত্বেও দুজনই বাঙালি জাতীয়তাবাদের গভীরতম প্রদেশে নাড়া দেন এবং সাম্প্রদায়িকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে বর্ণ, গোত্র ও ভাষাভিত্তিক ভ্রাতৃত্ববোধের দিকে এগিয়ে যান। তিনি ছিলেন এক সঞ্জাত শক্তি, যাঁর ব্যক্তিত্ব এবং কর্মকাণ্ড বাঙালি মানসের গভীরতম প্রদেশ অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি ছিলেন এক নৌকা যাতে চেপে জনগণের আকাঙ্ক্ষা বয়ে যেতে পারত।"

বাংলাদশের জন্য বাঙালিদের ভালোবাসা অফুরন্ত, বাংলাদেশ তাঁর স্বপ্ন এবং স্বর্গ। ইতিহাস খুললেই চোখে পড়ে বাঙালির দেশপ্রেম। নোভাকের জবানিতে তা এ রকম–

"এই ভালোবাসার নজির: গাঙ্গেয় লোকদের হাতে আলেকজান্ডার দি গ্রেটের পরাজয়, ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াকু বাঙালির মরণপণ সংগ্রাম ও ট্রাজিক পরাভব, ১৯১৭ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বাঙালি জাতির ব্রিটিশবিরোধী সক্রিয়তা, দ্রোহ ও আন্দোলন এবং সর্বশেষে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতায়। বাঙালিরা সব সময় লড়েছে এই স্বপ্নঘেরা ভূখণ্ডটির জন্য; কখনও জয় হয়েছে, কখনও পরাজয়, কিন্তু দেশটা ছেড়ে দেয়নি। সেই ভালোবাসাই তাদের গানে-কবিতায়-চিত্রে-কথকতায় ব্যক্ত। বাংলা ভাষায় যত দেশাত্মবোধক গান রচিত হয়েছে অন্য কোনো ভাষায় তা হয়েছে কি না সন্দেহ।"

বাঙালিরা যেমন ভালোবাসে তাদের দেশ তেমনি ভাষাও। বাঙালি পৃথিবীতে একমাত্র জাতি যার সন্তানেরা রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে নিজের ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। ভাষার জন্য সেই আত্মদানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আজকে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হয়েছে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস'। নতুন করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বীজ ওই রক্ত দেওয়ার মধ্যে রোপিত হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথকে সরাসরি পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে টেনে আনে পাকিস্তান সরকার ১৯৬১ সালে। ওই সময় পাকিস্তান সরকার রেডিও ও টিভিতে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আর গান নিষিদ্ধ করে দেয়; কিন্তু বাঙালিরা সেসব প্রচার করতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন বাংলার এক অভ্রান্ত প্রতীক, রবীন্দ্রনাথকে আশ্রয় করে অভিব্যক্তি পায় বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য; পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্ব এভাবে আকরিত হয়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে কাব্য ও গানের যে প্রভাব, রবীন্দ্রনাথ সে প্রভাব সৃষ্টিতে প্রধান ভূমিকা রাখেন। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রকাব্য আর রবীন্দ্রসংগীত হয়ে ওঠে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বাঙালিদের বিদ্রোহ ঘোষণা করার এক মহান উজ্জীবনী শক্তি। রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতার মধ্যে বাঙালির আত্ম-আবিষ্কার সূচিত হল যেন; ভিত্তি হয়ে উঠল এক রাজনৈতিক আন্দোলনের। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিসংগ্রামে এই দেশাত্ববোধক গান ও কবিতা স্থান পায় মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠে কণ্ঠে।

বহু বছরের কারাকক্ষের নির্জনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গী ছিল– তাঁর নিজের ভাষায়– "পবিত্র কোরান এবং গীতবিতান আমার জেলের স্যুটকেসে রাখা থাকত সব সময়, যা ছিল আমার কারাজীবনের নিত্য সময়ের সঙ্গী।"

১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি তদানীন্তন পূর্ব বাংলার শিল্পীগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তাঁকে দেওয়া এক সংবর্ধনায় (আমি সে সভায় উপস্থিত ছিলাম) প্রদত্ত ভাষণের মাঝখানে রবীন্দনাথের কথা বলতে গিয়েক বঙ্গবন্ধু ইংরেজিতে বললেন:

"Go to anywhere in the world and tell them that you have come from the country of Tagore, they will respect you."

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই বাংলার সম্পর্ক এবং এই পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশের মানুষকে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ করে রাখে। সে জন্য সোনার বাংলার বুকে মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করেন বারবার এবং স্বাধীনতা-উত্তর বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করেন দেশপ্রেমে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা সংগ্রামে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা খুব প্রত্যক্ষ; সেই রকম প্রভাব আর কোনো প্রভাবের সঙ্গেই তুলনীয় নয়। কলকাতার কবি এরা দে তাই আক্ষেপ করে বলেন:

"রবীন্দ্রনাথের প্রভাব যা কিছু আছে তা মুসলিম বাংলাদেশে, যদিও তিনি জীবনের বিরাট অংশ কাটিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে; তবু রবীন্দ্রনাথের ভাষাপ্রেম বাংলাদেশের মানুষকে ভাষা সংরক্ষণের সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব স্বাধীনতা লাভে অনুপ্রাণিত করেছে এবং তাঁর রোমান্টিকতা ও দেশপ্রেম এখনও এ দেশের মনোলোকে স্থায়ী ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।"

লেখক জেমস জে নোভাক কীভাবে বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথে অনুপ্রাণিত হয়েছেন সে সস্পর্কে বলেন:

"আরেকটি বিষয় মুজিব উসকে দিয়েছিলেন, তা হচ্ছে সামরিক ও যুদ্ধপ্রিয় পাকিস্তানি পাঞ্জাবিদের চেয়ে বাঙালি সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্বের বোধ। অকৃত্রিম বাঙালি মনের সুক্ষ্ম ও শৈল্পিক গুণাবলী এবং সে মনের নৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে কবিতার ভূমিকা কী তা মুজিব বুঝেছিলেন। বহুদিন আগে সক্রেটিস যেমনটা বুঝেছিলেন। তাই তিনি বাঙালির সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে যেয়ে বাঙালি রবীন্দ্রনাথকে পাকিস্তানের মহান কবি ইকবালের বিপরীতে প্রতিস্থাপন করেছেন।"

পরবর্তীতে সেই একই ধারায় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে লিখিত কবিগুরুর সেই বিখ্যাত গান স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করে আমরা ধন্য হয়েছি।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সম্ভবত বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ দিনে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে রেসকোর্সের ময়দানে লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে কবিগুরুর সেই বিখ্যাত কবিতা পংক্তির– 'সাত কোটি বাঙালিকে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি"– বিপরীতে অশ্রুভেজা কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বললেন, 'কবিগুরু, তোমার উক্তি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দেখে যাও তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।'

এর থেকে বড় শ্রদ্ধার্ঘ কবিগুরুর প্রতি মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কের আর কী হতে পারে?

ব্যক্তিগত পাদটীকা:

সত্তর দশকের প্রথম দিকে দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছু পরেই আমি যখন যুক্তরাষ্ট্রের University of Illinois at Urbana-Champaignএ পড়তে আসি তখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসপেকটাসের কভারে কবিগুরুর উক্তি দেখে একজন বাঙালি হিসেবে গর্বে আমার বুক ভরে উঠেছিল। পরবর্তীতে জানতে পারি, কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ এ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছিলেন ১৯২৮-১৯৩২ সালে। কবিগুরু এখানে ১৯২৯ সালে এসে প্রায় এক বছর বাস করেন।

তথ্যগুলো জানার পর কবিগুরু ওই শহরে তাঁর পুত্রের সঙ্গে যে বাড়িতে বাস করেছিলেন সেটা খুঁজে বের করি। ওই বাড়ির ছবিসহ সে সময়ের সাপ্তাহিক বিচিত্রাতে একটা নিবন্ধও লিখেছিলাম। রবীন্দ্রনাথ ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের সাহায্যের জন্য 'কসমোপলিটান ক্লাব' নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। আমি যখন ওখানে যাই তখন প্রচণ্ড শীতের সময় ওরা আমাকে একটা সুন্দর শীতের কোট উপহার দিয়েছিল। পরবর্তীতে ওই কসমোপলিটান ক্লাবটি 'Tagore Center'এ রুপান্তরিত হয়।

কবিগুরুর সার্ধশতবার্ষিকীতে এ সেন্টারের উদ্যোগে মাসব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয় এবং একজন এলুমনাই হিসেবে আমিও আমন্ত্রিত ছিলাম সেখানে।