জহির রায়হান: নিখোঁজ ও অপেক্ষার হাজার বছর

সহুল আহমদ
Published : 20 August 2016, 12:59 PM
Updated : 20 August 2016, 12:59 PM

জহির রায়হান একদিন আমজাদ হোসেনকে ডেকে একটা সিনেমার চিত্রনাট্য লিখতে বললেন। গল্পটা হবে এমন যেখানে এক বোন আরেক বোনকে বিষ খাওয়াবে। আমজাদ হোসেন লেখাও শুরু করে দিলেন। তবে প্রথম দৃশ্যটা ছিল এ রকম– এক বোন আরেক বোনকে দুধভাত খাওয়াচ্ছে। জহির রায়হান জিজ্ঞেস বললেন, "খাওয়াতে বললাম বিষ, আর খাওয়াচ্ছেন দুধ।"

আমজাদ হোসেন বলেন, "আরে, দুধ না খাওয়ালে বিষ খাওয়াব কীভাবে?"

সময়টা তখন ১৯৬৯-৭০ সাল।

সিনেমার কাহিনি একটা পরিবার নিয়ে। ভাইবোন, ভাইয়ের বউ, বোন-জামাই আর একটা চাবির গোছা-– এই নিয়েই সে পরিবার। কিছুক্ষণ পর সেই পরিবারই হয়ে ওঠে 'একটি দেশ, একটি সংসার, একটি চাবির গোছা, একটি আন্দোলন, একটি চলচ্চিত্র।' সিনেমার নাম প্রথমে 'তিনজন মেয়ে ও এক পেয়ালা বিষ' রাখার কথা ছিল। মাঝপথেই জহির রায়হান নাম পাল্টে দিলেন 'জীবন থেকে নেয়া'

জহির রায়হান তখন 'কখনো আসেনি' এবং 'কাঁচের দেয়াল' এর মত ব্যতিক্রমধর্মী সিনেমার পরিচালক। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসবে 'কাঁচের দেয়াল' শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র এবং তিনি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকার হিসেবে পুরস্কার পান। সে উৎসবে সর্বোচ্চ সংখ্যক পুরস্কারও তিনি পেয়েছিলেন। বিভিন্ন কারণেই একসময় তিনি বাণিজ্যিক ধারার সিনেমা তৈরি শুরু করেছিলেন। কিন্তু সত্তরের জানুয়ারিতে তিনি নিজেই বলেন:

"এ বছরের মধ্যে নতুন ধরনের চলচ্চিত্র তৈরি করতে না পারলে আপন বিবেকের কাছে প্রতারক সাব্যস্ত হব। এই সময় আমার আর্থিক সংকট ছিল বলে সৃজনশীল ছবির বদলে বাণিজ্যিক ছবির ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম। এখন সে সামর্থ্য এসেছে। তাই আমার স্বপ্ন–সাধ নিয়ে ছবি তুলবার সময় উপস্থিত।"

'জীবন থেকে নেয়া' তাঁর এই স্বপ্ন-সাধের একটি।

ছবি নির্মাণকালে পাকিস্তানিদের নজরে পড়েন কলাকুশলীরা। জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জহির রায়হানকে। ছবি মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল ১৯৭০ সালের ১০ এপ্রিল। সেন্সর জটিলতার দরুণ ওই দিন মুক্তি না পেয়ে পায় পরদিন– ১১ এপ্রিল। নির্দিষ্ট সময়ে মুক্তি না দেওয়াতে জনগণ আন্দোলনে নেমে পড়েছিল। 'জীবন থেকে নেয়া' খুব সম্ভবত একমাত্র চলচ্চিত্র যার মুক্তির জন্য হাজার হাজার মানুষ মিছিল করেছে, স্লোগান দিয়েছে।

নিজে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলেই তাঁর সাহিত্যকর্মে ভাষা আন্দোলন এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন:

"জহির রায়হান সম্ভবত বাংলাদেশের একমাত্র কথাসাহিত্যিক যাঁর উদ্ভবের পেছনে আছে ভাষা আন্দোলন…। যদি বায়ান্নর একুশ না ঘটত তবে জহির রায়হান হয়ত কথাশিল্পী হতেন না।"

'আরেক ফাল্গুন', 'একুশে ফেব্রুয়ারী', 'মহামৃত্যু' এবং 'একুশের গল্প' সেই সত্যতার প্রমাণ দেয়। এ জন্যেই বোধহয় ছবির শুরুতেই প্রভাত ফেরীর বাস্তব দৃশ্যেটা এতটা অতুলনীয়। খান আতাউর রহমানের সঙ্গিতায়োজনে করা "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি…" এখনও আমাদের প্রভাত ফেরীর অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে, থাকবেও।

ছবিটি শেষ হয়েছিল এক নবজাতককে দিয়ে, নাম 'মুক্তি'; এ যেন আমাদের মুক্তির আগাম বার্তা!

২.

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ১৮ এপ্রিলের দিকে জহির রায়হান দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান। ফেরেন ১৮ ডিসেম্বর। আসার পথে বাঙালির বিজয়োল্লাস রুপালি ফিতার মধ্যে বন্দি করছিলেন। ঢাকাতে নেমেই চলে যান ক্যান্টনমেন্টে; পাকিস্তানিদের আত্নসমর্পনের দৃশ্য ক্যামেরায় তুলে রাখতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন। হঠাৎ তখন কে একজন তাঁকে জানাল– "বাড়ির খবর কিছু জানেন, আপনার বড়দা ১৪ তারিখ থেকে নিখোঁজ। রাজাকার আলবদররা ওঁকে ধরে নিয়ে গেছে।"

ক্যামেরাটা সহকারীর হাতে দিয়ে তখনই রওয়ানা দেন বাড়ির দিকে।

পরাজয় আসন্ন দেখে পাকিস্তানিরা বাঙালিকে মেধাশূন্য করার নীলনকশা তৈরি করে। সেই নকশা অনুযায়ীই শহীদুল্লাহ কায়সার, ডা. আলীম চৌধুরীর মতো আরও বহু বুদ্ধিজীবীকে আলবদরেরা ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে পরবর্তীতে অনেকেরই লাশ পাওয়া গেলেও শহীদুল্লাহ কায়সারের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। যে বড়দা তাঁর 'প্রেরণার মূল শক্তি' সেই বড়দার জন্য পাগলপ্রায় হয়ে গেলেন।

এসেই তিনি বুদ্ধিজীবী হত্যা ও গণহত্যার তথ্য অনুসন্ধান ও ঘাতকদের ধরার জন্যে 'বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটি' নামে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেন। এশতেহাম হায়দার চৌধুরী, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার মওদুদ, ড. সিরাজুল ইসলামসহ আরও অনেক বুদ্ধিজীবী এর সদস্য ছিলেন। এই কমিটিতে কাজ করতে গিয়ে জহির রায়হান আলবদর ও রাজাকারদের অনেক গোপন তথ্যও উদ্ধার করেছিলেন। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পেছনে কারা জড়িত ছিলেন এবং হত্যাকারীদের অনেকেরই গোপন আড্ডাখানা সম্পর্কেও তথ্য উদ্‌ঘাটন করেছিলেন জহির রায়হান। শহীদুল্লাহ কায়সারকে যে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, সেই খালেক মজুমদারকে ধরিয়েও দিয়েছিলেন।

বড়দাকে খুঁজতে একজন জাপানি রেডক্রস কর্মীর সাহায্যে মিরপুরের কয়জন বিহারি ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করেন। রেডক্রস কর্মীর ভাষ্য অনুযায়ী, এই ডাক্তাররা ছিলেন নিরপেক্ষ এবং ভালো। তারা আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ব্যাপারটা দেখবেন এবং ১৬ ডিসেম্বরের পরে এ রকম আরও অনেক অনুরোধ তাদের কাছে আসছে।

এখানে উল্লেখ্য, জহির রায়হান পীর-ফকির-মাজার এ ধরনের কুসংস্কারে কখনও বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু শুধুমাত্র তাঁর প্রিয় বড়দার জন্য পীর–ফকিরদের কাছে যাতায়াতও শুরু করেছিলেন। এমনকি আজমীর শরীফেও গিয়েছিলেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। রফিকউদ্দীন নামক এক লোকের দ্বারা তখন বেশ প্রভাবিত হয়েছিলেন। সে হয়ে উঠেছিল তাঁর নিত্যদিনের সহচর।

১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি সকালে টেলিফোনে তিনি খবর পান যে মিরপুরের ১২ নম্বরে শহীদুল্লাহ কায়সারসহ আরও অনেক বুদ্ধিজীবীকে বন্দি করে রাখা হয়েছে।

এই পর্যায়ে মিরপুরের তখনকার অবস্থা সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন। মিরপুর এবং মোহাম্মদপুর ছিল মূলত বিহারি অধ্যুষিত এলাকা। এদের মধ্যে শিক্ষিত ও বড় ব্যবসায়ীয়রা থাকত মোহাম্মদপুরের দিকে এবং মূলত শ্রমিক শ্রেণিরাই থাকত মিরপুরে। ১৯৬৯ সালের দিকে এখানে বিহারি-বাঙালি দাঙ্গাও হয়। ২৫শে মার্চে রাতের পর বিহারিরা নির্মম ও নৃশংসভাবে সে এলাকার অনেক বাঙালিকে হত্যা করে। পরবর্তীতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রায় ২০ হাজার বিহারিকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে 'সিভিল আর্মড ফোর্সেস' (সিএএফ) নামে নতুন আরেকটা বাহিনী গড়ে তোলে। কেউ কেউ রাজাকার আলবদর বাহিনীতে যোগদান করে। ১৬ই ডিসেম্বরে পাকিস্তানিরা আত্নসমর্পন করলেও এই সিএএফের সদস্যরা আত্নসমর্পণ করেনি। বরং এসব বিহারি, আলবদর অস্ত্রশস্ত্রসহ আশ্রয় নিয়েছিল মিরপুরে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ১৬ই ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হলেও মিরপুর তখনও অবাঙালি, আলবদর ও রাজাকারদের দখলে ছিল।

এখানে একটা প্রশ্ন আসে, কে তাঁকে সেদিন ফোন দিয়েছিল। বিহারিদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে সিনেমার সঙ্গে জড়িত ছিল, যার ফলে জহির রায়হানের সঙ্গে টুকটাক পরিচিতি থাকার কথা। এরাই যুদ্ধকালীন নির্বিচারে বাঙালি হত্যা করেছে। এই পূর্বপরিচিত বিহারিদের কেউ কি তাঁকে সেদিন ফোন দিয়েছিলেন?

অনেকেরই ধারণা, ষাটের দশকের ঢাকার ছবির এক বিহারি নৃত্যপরিচালক মাস্তানাই তাঁকে সেদিন ফোন দিয়েছিল। মিরপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান সহযোগীদের একজন ছিল এই মাস্তানা; মিরপুর মুক্ত হওয়ার সময় মারা যায় সে। আবার, অনল রায়হানের 'পিতার অস্থির সন্ধানে' প্রতিবেদনে উপরোল্লিখিত আধ্যাত্মিক রফিক সম্পর্কেও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এই প্রশ্নের উত্তর বোধহয় কখনও পাওয়া যাবে না!

টেলিফোনে খবর পাওয়ার পরই জহির রায়হান পরিচিত কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে করে মিরপুরের দিকে রওয়ানা দেন। পরনে ছিল ছাই রঙয়ের প্যান্ট আর গাঢ় ঘিয়ে রঙের কার্ডিগান। সাদা রঙের শার্টের সঙ্গে পায়ে ছিল স্যান্ডেল। শাহরিয়ার কবিরও সেদিন সঙ্গে ছিলেন। তাঁর ভাষায়:

"সেদিন আমরা যখন টেকনিক্যালের মোড় ঘুরে বাংলা কলেজের কাছে গিয়েছি তখনই উত্তর দিক থেকে আমাদের গাড়ি লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি বর্ষিত হয়েছিল। জহির রায়হান প্রচণ্ড বেগে গাড়ি চালিয়ে ছয় নম্বর সেকশনে এসেছিলেন। মিরপুরে তখন কারফিউ। টেকনিক্যালের মোড়ে গাড়ি আটকানো হয়েছিল। গাড়িভর্তি মুক্তিযোদ্ধা দেখেই হোক কিংবা জহির রায়হানের কথা শুনেই হোক পুলিশ আমাদের গাড়ি আটকায়নি। আটকেছিলেন ছয় নম্বর সেকশনের পুলিশ ক্যাম্পে অবস্থানরত সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা।"

উল্লেখ্য, সেনাবাহিনি তখন ১২ নম্বর সেকশনের রেইড করার জন্যে যাচ্ছিল, তারা কোনো সিভিলিয়ান সঙ্গে রাখতে চায়নি। অনেক অনুরোধের পর জহির রায়হানকে নিতে রাজি হয়েছিল।

আনুমানিক সাড়ে ১১টার দিকে বিহারিরা আশেপাশের বাড়িঘর থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্রসহ হ্যান্ড গ্রেনেড নিয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। কেউ এই হামলার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, তাই পাল্টা আক্রমণের কোনো সুযোগ পাননি তাঁরা। ওই দিন বিকালে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেনাবাহিনী মিরপুরে ১২ নং সেকশনের ওপর আবারও আক্রমণ চালায়। পরদিন সকালে পুরো একটা ব্যাটালিয়ন ১২ নং সেকশনে প্রবেশ করে, কিন্তু কোনো পুরুষ মানুষকে খুঁজে পায়নি। রাতেই সবাই পালিয়ে গিয়েছিল।

অন্যদিকে, সেদিন সকালের বিহারিদের অতর্কিত হামলায় ৪২ জন সেনাসদস্য নিহত হন। ক্যাপ্টেন মোর্শেদ ও নায়েক আমিরসহ কয়েকজন আহত হন। নিহতদের মাত্র ৩-৪ জন ব্যতীত আর কারও লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকি মিরপুর পুরো জনশূন্য করার পরও। খুব সম্ভব ৩০ জানুয়ারি রাতেই সেগুলো সরিয়ে ফেলা হয়। রাতের অন্ধকারে বিহারিদের সরিয়ে ফেলা সেই লাশগুলোর সঙ্গে বড়দাকে খুঁজতে গিয়ে হারিয়ে যান আমাদের জহির রায়হান।

তাঁর আর সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাঁর বাসায় পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট আবু সাইদ চৌধুরী বলেছিলেন, "স্বাধীন দেশে এমন একজন ব্যক্তিকে হারালাম, যাঁকে এখন আমাদের বেশি করে প্রয়োজন। যা ঘটল– এ আমাদের সকলের ব্যর্থতা।"

পত্রপত্রিকায় জহির রায়হানের হারিয়ে যাওয়ার খবর বেরোতে লাগল। অনেকগুলো নতুন সিনেমা বানানোর কথা ছিল তাঁর। ভাষা আন্দোলন নিয়েও একটা সিনেমা বানানোর কথা ছিল। নামও দিয়েছিলেন, 'একুশে ফেব্রুয়ারি' ।

কিছুই করা হল না। হারিয়ে গেলেন তিনি।

৩.

১৯৯৯ সালের জুলাই মাস। জহির রায়হান হারিয়ে যাওয়ার প্রায় ৩০ বছর হয়ে গিয়েছে। বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করার কথা ছিল জহির রায়হানের। এই ৩০ বছরের মধ্যে অনেকেই রটালেন যে, নেতাদের গোপন ডকুমেন্ট প্রকাশ হওয়ার ভয়ে খুন হয়েছিলেন জহির রায়হান। আলবদর নেতা নিজামী জহির রায়হান প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে পুরো বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায়ভারই তখনকার আওয়ামী লীগের ওপর চাপিয়ে দেন। শাহরিয়ার কবীরের এক ডকুমেন্টারিতে নিজামী বলেন:

"একটি তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছিল জহির রায়হানের নেতৃত্বে; সেই তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান জহির রায়হানকে কারা উধাও করল? কেন উধাও করল? সেই তদন্তটাও কেন হল না? এই প্রশ্নের উত্তর যদি আপনারা বের করতে পারেন, তাহলে আসল রহস্য আমাদের সামনে বের হবে!"

তাহলে কারা খুন করেছিল জহির রায়হানকে?

১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে মিরপুর ১২ নং সেকশনের মুসলিম বাজারের নূরী মসজিদের নির্মাণকাজের জন্য খননকালে বের হয়ে আসে মানুষের দেহাবশেষ, গুলিবিদ্ধ হাড়, করোটি; আবিষ্কৃত হয় বাংলার আনাচেকানাচে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য বধ্যভূমির একটি। ১২ নং সেকশনের এই বধ্যভূমি আবারও ৩০ জানুয়ারির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, আবারও সামনে চলে আসেন হারিয়ে যাওয়া জহির রায়হান।

যুদ্ধের ২৮ বছর পর সেদিনের আহত নায়েক আমির হোসেনের সন্ধান পাওয়া যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, যিনি বেঁচে এসেছিলেন বিহারিদের আক্রমণের হাত থেকে। তাঁর মুখ থেকেই বেরিয়ে পড়ে ঘটনা। তিনি জহির রায়হানকে গুলিবিদ্ধ দেখেছিলেন। আমির হোসেন জহির রায়হানকে চিনতেন না। উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন 'সাংবাদিক' হিসেবে। তার প্রতি নির্দেশ ছিল ওই সাংবাদিকসহ অন্যদের পাহারায় থাকা। যেহেতু সবাই সামরিক বাহিনীর লোক ছিলেন, তাই একমাত্র সেই সাংবাদিকই ছিলেন সিভিল পোশাকে। তিনি বলেন,

''বেলা ১১টার দিকে ঢং ঢং পাগলা ঘণ্টা শুনতে পাই। গুলি ছুটে আসতে থাকে দক্ষিণ দিক থেকে। সঙ্গে সঙ্গে বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই অনেক পুলিশ সদস্য মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে এবং সেখানেই একটি ইটের স্তূপের পিছনে আমি অবস্থান নিই। তখন তাকিয়ে দেখি, পুলিশের পাশাপাশি সাংবাদিক সাহেবও যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন, তাঁর পাশেই পানির ট্যাংকের দেয়ালের পাশে তাঁর দেহ পড়ে আছে।''

আমির হোসেনের কথা থেকেই আরও জানা যায়, পুলিশের সদস্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার পর দক্ষিণ দিক থেকে গোলাগুলি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তখনই 'সিভিল পোশাকে' একশ জনের মতো বিহারি দা-ছুরিসহ নানা ধরনের অস্ত্রপাতি নিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে ছুটে আসতে থাকে। তারা উর্দুতে গালিগালাজ করাসহ 'কাউকেই ছাড়া হবে না' বলে চিৎকার করছিল। অবাঙালিরা দক্ষিণ দিক থেকে এদিয়ে এসে মাটিতে লুটিয়ে পড়া পুলিশ সদস্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা তাদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো শুরু করে এবং টেনেহিঁচড়ে পানির ট্যাংকের পশ্চিম দিকে নিয়ে যেতে থাকে। এ সময় পড়ে থাকা সাংবাদিককেও (জহির রায়হান) ৬-৭ জন অবাঙালি হাত-ঘাড়-কোমর ধরে টেনে নিয়ে যায় পানির ট্যাংকের পশ্চিম দিকে।

আমির হোসেনের জবানবন্দি নিয়ে দৈনিক ভোরের কাগজ ১৯৯৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর 'নিখোঁজ নন, গুলিতে নিহত হয়েছিলেন জহির রায়হান' শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

এই প্রতিবেদনের মাধ্যমেই জহির রায়হানকে নিয়ে নিজামীদের তৈরি করা দীর্ঘদিনের ধোঁয়াশার চাদর পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। তাই এটা স্বীকার করতেই হয় যে, জহির রায়হানের এই মৃত্যু পাকিস্তানি ও তাদের সহযোগীদের দ্বারা পরিচালিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডেরই একটা অংশ।

৪.

বাহাত্তরে জহির রায়হান যখন ঘাতকের হাতে নিহত হন তখন তাঁর বয়স সবে ৩৭ বছর। এই মৃত্যুর ফলে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বও অকালে হারাল তার এক প্রতিভাবান সৃষ্টিশীল সন্তান।

'Stop Genocide' এর কথাই ধরেন, এটা কি শুধুই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল কিংবা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র! শুরুতেই লেনিনের স্কেচ ও বক্তব্য, ভিয়েতনামে মার্কিন বোমাবাজির দৃশ্য, ভিয়েতনামি শিশুর লাশ ও নাৎসি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের দৃশ্য প্রমাণ করে এটা শুধুই আমাদেরই না, পৃথিবীব্যাপী সব মুক্তিকামী মানুষের চেতনার প্রতীক। আমাদের এই মুক্তিসংগ্রামকে তিনি দেখেছিলেন দুনিয়াজুড়ে সব মুক্তিসংগ্রামের অংশ হিসেবে।

'আর কতদিন' – এক অদ্ভুত সৃষ্টি জহির রায়হানের। এখানেও দুনিয়াজুড়ে চলতে থাকা ধর্ম, জাত, বর্ণ নিয়ে হানাহানি সংঘাতের চিত্র পাওয়া যায়। ধর্ম-বর্ণের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া বিপন্ন মানবতার ছবি পাওয়া যায়। জহির রায়হানের চলে যাওয়ার প্রায় অর্ধশতাব্দী পরও 'আর কতদিন' এর শেষ বক্তব্যটুকুর অস্তিত্ব এখনও পৃথিবীব্যাপী বিরাজমান:

আমরা কোথায়?
ভিয়েতনামে না ইন্দোনেশিয়ায়।
জেরুজালেমে না সাইপ্রাসে।
ভারতে না পাকিস্তানে।
কোথায় আমরা?
জানো ওরা আমার ছেলেটাকে হত্যা করেছে হিরোশিমায়।
ওরা আমার মাকে খুন করেছে জেরুজালেমের রাস্তায়।
আমার বাবাকে মেরেছে বুখেনওয়াল্ডে গুলি করে।
আর আমার ভাই। তাঁকে ওরা ফাঁসে ঝুলিয়ে হত্যা করেছে। কারণ সে মানুষকে ভীষণ ভালোবাসতো।

একজন জহির রায়হানের শূন্যতা কোনোভাবেই পূরণীয় নয়। এখনও অপেক্ষা করি তাঁর জন্য। রাত বাড়ছে, হাজার বছরের সে রাত!

তথ্যসূত্র:

১.    'জহির রায়হানের চলচ্চিত্র পটভূমি বিষয় ও বৈশিষ্ট্য', অনুপম হায়াৎ

২.    'স্টপ জেনোসাইডএর চিত্রনাট্য; ভূমিকা ও সম্পাদনা', মানজারে হাসীন

৩.    'নিখোঁজ নন, গুলিতে নিহত হয়েছিলেন জহির রায়হান', ভোরের কাগজ

৪.    'পিতার অস্থির সন্ধানে', অনল রায়হান

৫.    'মিরপুরের সদ্য আবিষ্কৃত বধ্যভূমি ও জহির রায়হানের অন্তর্ধান প্রসঙ্গ', শাহরিয়ার কবির

৬.    'রক্ত ও কাঁদা ১৯৭১', তাদামাসা হুকিউরা

৭.     'মুক্তিযুদ্ধ – আগে ও পরে', পান্না কায়সার

৮.    'এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য', জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী

৯.    'যুদ্ধাপরাধ ৭১ শাহরিয়ার কবির' (ডকুমেন্টারি)

১০.   'একুশে ফেব্রুয়ারি', শাহরিয়ার কবিরের ভূমিকায়

১১.   বিভিন্ন ব্লগ ও ওয়েবসাইট।