Published : 20 Oct 2011, 10:42 PM
দেশে দেশে একই শ্লোগান দিয়ে মানুষ উঠে আসছে রাস্তায়। শ্লোগানের মূল কথা দুটো; একটি, নিজের পরিচয় ঘোষণা: 'আমরা ৯৯%'। আরেকটি, আন্দোলনের লক্ষ্য ঘোষণা: 'দখল কর….'। কী দখল? দখল ক্ষমতার কেন্দ্র, দখল নিজের দেশ, দখল নিজের জীবন। প্রকৃত অর্থে নিজের জীবন, সম্পদ ও দেশ দখল করেছে শতকরা ১ ভাগ লুটেরা, দখলদার, যুদ্ধবাজ সন্ত্রাসী। লক্ষ্য এসব দখলমুক্ত করা। কেননা দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।
গত কয়েক মাস ধরে ইউরোপের বহু শহরে লক্ষ মানুষের বিক্ষোভ আমরা দেখেছি। যুক্তরাষ্ট্রে এর শুরু গত ১৭ সেপ্টেম্বর 'অকুপাই ওয়াল স্ট্রীট' বা 'ওযাল স্ট্রীট দখল কর' এই ডাক দিয়ে। প্রথম দিকে বড় বড় সংবাদ মাধ্যম এটাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে চেয়েছে। কিন্তু ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ায় তারা নীরবতা ভাঙতে বাধ্য হয়েছে। 'আমরা ৯৯%' এবং 'দখল কর…' এই দুটো শ্লোগান খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। দেশে দেশে মানুষ এই দুটো শ্লোগান ধরেই নিজেরাও সংগঠিত, সমবেত ও বিস্তৃত হচ্ছে। ওয়াল স্ট্রীটের পর নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, ভ্যনকুভার, টরন্টো, লন্ডন, রোম, প্যারিস, মাদ্রিদ, টোকিও কিংবা দেশ নাম ধরে দখল করবার আওয়াজ উঠছে। পাকিস্তানে সব বামপন্থীরা একত্রিত হয়ে ২২ অক্টোবর থেকে লাহোরে 'এন্টি ক্যাপিটালিস্ট ক্যাম্প' নামে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করছে, অন্যান্য শহরেও পরিকল্পনা আছে। ভারতেও বিভিন্ন শহরে প্রস্তুতি চলছে। বাংলাদেশেও শুরু হচ্ছে ২২ তারিখ।
যুক্তরাষ্ট্রের আন্দোলনকারীদের http://wearethe99percent.tumblr.com/ ওয়েবসাইটে, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে মিছিলে শ্লোগানে আসছে- নির্বাচন একটা প্রহসন, পুরো সরকার ব্যবস্থা শতকরা ১ ভাগ লুটেরার দখলে। প্রথমে এই রাষ্ট্রক্ষমতা সম্পর্কে মোহমুক্তি, পরে এই শতকরা ১ ভাগকে লক্ষ্য করে ঘৃণা ও প্রতিরোধের জমায়েত। ৯৯ ভাগ তাদের জীবন আর সম্পদে নিজেদের দখল প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এসব সমাবেশের অনেক স্থানে মাইক ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়নি। উপস্থিত মতো শক্তিশালী বিকল্প বের হয়েছে। খালি গলায় একজন বলে তো শতজন তা ছড়িয়ে দেয়, হাজারজন তার ধ্বনি প্রতিধ্বনিত করে। অংশগ্রহণকারীরা বলে, 'এই তো, আমরা ঈশ্বরের কন্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি।' এই প্রতিরোধ, মানুষের পক্ষে মানুষের লড়াইএর মতো সৃজনশীল কাজ আর কী? তাই হাজার শহরে এসব সমাবেশে শিল্পী লেখক কবিদের উপস্থিতিও অনেক। গান নাটক কবিতা তৈরি হচ্ছে পথেই। নিউইয়র্কের লিভিং থিয়েটারের জুডিথ মেলিনা ওয়াশিংটনে বিশাল উপস্থিতির সামনে বলেছেন, 'এটা দেখার জন্যই এতদিন বেঁচে আছি।' তাঁর বয়স এখন ৮৫।
ওয়াল স্ট্রীট-এর কাছের পার্কে যখন বিক্ষোভকারীরা দিনের পর দিন অবস্থান করছেন তখন এক পর্যায়ে নোটিশ এলো, পার্ক পরিষ্কার করা হবে, এর জন্য পার্ক ছাড়তে হবে সবাইকে। সাথে সাথে বিক্ষোভকারীরা নিজেরাই বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে পার্ক পরিস্কার করবার কাজে লেগে গেলেন। সকালের মধ্যে পার্ক এত পরিষ্কার হয়ে গেলো যে, ঐ বাহানা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলো। সাধারণ সভা বসে প্রতিদিন। বিভিন্ন কাজের জন্য বিভিন্ন দল। সবই শান্তিপূর্ণ, অহিংস। আবার আক্রমণ এলে তার মোকাবিলার প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণও চলছে।
ফেডারেল রিজার্ভ বা যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শতকরা ১ ভাগের ১ দশমাংশের স্বার্থরক্ষায় ৯৯ ভাগ মানুষের জীবন বিপন্ন করবার অভিযোগ উঠেছে এই আন্দোলনের বিভিন্ন প্রকাশনা, ভিডিও ও সমাবেশের পোস্টারে। এই সংস্থার দীর্ঘদিনের চেয়ারম্যান এলান গ্রীন্সপ্যানের গ্রন্থ এজ অব টারবুলেন্স পড়লে যে কেউ বুঝতে পারবেন ফেডারেল রিজার্ভ এবং ওয়াল স্ট্রীট একেবারেই অভিন্ন। হোয়াইট হাউস আসলে চালায় এরাই। অনেক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কার্যত বিভিন্ন কোম্পানির লবিষ্ট হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশেও এই লবিষ্টদের কাউকে কাউকে আমরা মাঝে মধ্যে আসতে দেখি। যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসগুলো তো চলে সেই দেশের জনগণের টাকাতেই, কিন্তু সেগুলোর কাজও থাকে বস্তুত বিভিন্ন বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করা। উইকিলিকস কেউ ভালভাবে খেয়াল করলে বাক্যে বাক্যে এর স্বাক্ষর পাবেন। যুক্তরাষ্ট্র তাই তার বিপুল সম্পদ, অন্য দেশ দখল করা সম্পদ কমই জনগণের কল্যাণে ব্যয় করে, করতে পারে। নিশ্চিত কাজ, বাঁচার মতো মজুরি, আশ্রয় ও চিকিৎসার নিশ্চয়তা এগুলোর কোনটাই যুক্তরাষ্ট্রে টেকসই হতে পারেনি। শ্রমিক বা পেশাজীবীদের কাজ মজুরির অধিকার সংগঠনের অধিকার শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে সবচাইতে কম। এমনকি যে মে দিবসের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে, যে দিবস পালিত হয় সারা বিশ্বে, সেই দিবসটিও রাষ্ট্রীয়ভাবে অস্বীকৃত, মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে ফেলার চেষ্টায়।
ঋণ করে আয়ের চাইতে ব্যয় বেশি করবার মধ্য দিয়ে একটি কৃত্রিম স্বচ্ছলতাতেই অভ্যস্ত করা হয়েছে মানুষকে। নিয়মিত যা আয় তা দিয়ে অনিয়ন্ত্রিত ভোগের উন্মাদনা তৈরি হয়না। আর এই উন্মাদনা ছাড়া পুঁজিবাদ টিকতেও পারে না। একদিকে দুর্বল দেশগুলো থেকে কম দামে খাদ্য থেকে শুরু করে সবধরনের পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে অন্যদিকে বিস্তার ঘটানো হয়েছে ঋণ বাজার। দুর্বল দেশগুলোকে এই খাপে মেলানোর জন্য সেখানে রফতানিমুখি উন্নয়নের দর্শন আরোপ করা হয়েছে। ভুলভাবে 'উন্নয়ন সংস্থা' বা 'দাতা সংস্থা' হিসেবে চিত্রিত বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ কার্যত ওয়াল স্ট্রীট ও ফেডারেল রিজার্ভের অধীনস্ত দুটো প্রতিষ্ঠান। এদের কাজ প্রধানত বিশ্বের বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজির কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষায় বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির 'সংস্কার' করতে জাল তৈরি করা। এসবের মধ্য দিয়ে কেন্দ্র দেশগুলোতে ভোগবাদিতা প্রসারিত হয়েছে। বিস্তৃত হয়েছে ঋণ ব্যবসা। প্রান্ত দেশগুলোতে উজাড় হয়েছে বন, দুষিত হয়েছে পানি, রফতানিমুখি ও আমদানিমুখি একগুঁয়ে যাত্রায় অর্থনীতি নাজুক অবস্থায় পড়েছে, জ্বালানী ও খাদ্য নিরাপত্তা বিপর্যস্ত হয়েছে। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে যেসব দেশ থেকে উজাড় করে তেল, গ্যাস, সোনা, হীরাসহ নানা খনিজ দ্রব্য, কাঠসহ নানা বনজ দ্রব্য, কোকো, কলাসহ নানা ফলজ দ্রব্য এসেছে সেসব দেশে দারিদ্র পশ্চাদপদতা কিছুই দূর হয়নি, বেড়েছে বৈষম্য, নির্যাতন আর অনিশ্চয়তা। আর এগুলোর দখল নিশ্চিত রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ খাতে ব্যয় বেড়েছে, মানুষের জন্য অর্থ সংকট বেড়েছে।
অধিক মুনাফার সন্ধানে ফটকাবাজারী ও জুয়ার বিস্তৃত জালও তৈরি হযেছে। ইন্টারনেট ব্যবহার শুরুর পর থেকে পুঁজির গতি বেড়ে যায় অসম্ভব হারে, জাতীয় সীমানা অর্থহীন হয়ে পড়ে। অর্থকরী খাতে, ফটকাবাজারীতে বিনিয়োগ লাফিযে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। তাদের স্বার্থে পুঁজির উপর সবরকম নিয়ন্ত্রণ ক্রমে শিথিল হওয়ায় পরিমাণ ও গতি দুটোরই বৃদ্ধি ঘটে অভূতপূর্ব মাত্রায়। খাদ্য ও তেল-এর উপর ফাটকা বিনিয়োগে আগে যে নিয়ন্ত্রণ ও বিধিনিষেধ ছিল সেটাও প্রায় অকার্যকর করা হয় বছরদশেক আগে। এর পরিণতি বোঝা যায় ২০০৮ সাল থেকে যখন তেল ও খাদ্যের দামের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে এবং অস্থিতিশীলতাই নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়। উৎপাদনের সাথে অসমানুপাতিক হারে অর্থকরী খাতের এই ফুলে ফেঁপে উঠার ঘটনাটিকে বাজার অর্থনীতির শক্তি, পুঁজিবাদের সংকট মোচনের উদ্ভাবনী ক্ষমতা, সকলের ধনী হবার উপায় বলে মহিমান্বিত করবার মতো তত্ত্ব ও অর্থনীতিবিদের সরবরাহও বাড়ে তখন।
কিন্তু ২০০৭ থেকে শুরু হয় এই ভারসাম্যহীনতা, কৃত্রিম জৌলুস ও প্রতারণা দিয়ে ফোলানো বেলুন ফোটা। ধ্বস নামে একের পর এক, তাসের ঘরের মতো একে একে ধ্বসে পড়ে বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির বিশাল বিশাল ব্যাংক বীমা এবং সাথে সাথে নানা সংস্থা। এগুলোর ঐশ্বর্য্যের পেছনে যে কত মিথ্যাচার, দুর্নীতি ও জালিয়াতি ছিল তা একে একে কিছু কিছু প্রকাশিত হয়। রাতারাতি দৌর্দন্ডপ্রতাপী ধনী সফল ব্যক্তিবর্গ প্রতারক হিসেবে চিহ্নিত হন। কিন্তু শেষপর্যন্ত সংকট তাদের কমই শায়েস্তা করতে পেরেছে। এসব কর্মকাণ্ডে সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে যে কর্মসংস্থানে সংকট, মুদ্রাস্ফীতি ও মন্দার ভার তৈরি হয় তার প্রায় পুরোটাই পড়ে কম আয়ের মানুষদের উপর, সারা বিশ্বের। এই ভার এখনও বাড়ছেই।
বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষুদ্র পরিচালকমন্ডলীর প্রভাবশালী সদস্য বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ হরদম বলে যাচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি গভীর সংকটের দিকে যাচ্ছে, কিন্তু এই কথাটা স্বীকার করা তাদের পক্ষে কী করে সম্ভব যে এই অবস্থা সৃষ্টিতে তাদের ভূমিকাই অন্যতম। আর ফেডারেল রিজার্ভের আজ্ঞাবহ হিসেবে তাদের নীতি ও দর্শন নিয়ন্ত্রণমুক্ত করেছে একচেটিয়া পুঁজি বা ওয়াল স্ট্রীটকে, শৃঙখলিত করেছে মানুষকে, ফটকা বাজার আর ডিরাইভেটিভের বায়বীয় অর্থনীতিকে দানবীয় আকার দিয়েছে, দেশে দেশে অর্থনীতির সকল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে চুরমার করেছে, শিক্ষা চিকিৎসা, পানিসহ সর্বজনের সম্পদকে বেসরকারিকরণের নামে মুনাফার বলি করেছে। এসব তৎপরতা সম্পদ ও সম্ভাবনাকে বাজারের হাতে ছেড়ে দিয়ে পুঁজিকে ঈশ্বরের অবস্থানে নিয়ে গেছে, যুদ্ধ, দখল আর লুন্ঠনকে অনিবার্য করে তুলেছে। এই নীতিকাঠামো অব্যাহত রেখে এই সংকট দূর করার আসলেই কোন রাস্তা নাই। পুরনো ওষুধ দিয়ে কাজ হবে– এই মোহবিস্তারের খেলা আর এখন চলবে না।
দ্বিদলীয় বিভাজনে বাজারের মোহ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষকে এতদিন মোহগ্রস্ত করে রাখা গেছে। ওবামার ব্যর্থতার পর খোলাসা হয়েছে অনেককিছু। ক্ষমতার কেন্দ্র হোয়াইট হাউস নয়, একচেটিয়া বহুজাতিক পুঁজি, তাদের কেন্দ্র ওয়াল স্ট্রীট এবং যুদ্ধকেন্দ্র পেন্টাগন। ক্ষমতার কেন্দ্র অটুট রেখে সরকারের বদলে কিছুই বদল হবে না। এটা যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা, এটা বাংলাদেশের শিক্ষা। মানুষ এখন তাই দখল করতে চাচ্ছে ক্ষমতার কেন্দ্র। বাংলাদেশেও মানুষকে বাঁচতে হলে, নতুন ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে হলে, দ্বিজোটীয় বিভাজনের ঘোরে লুটেরা, দখলদার সন্ত্রাসী শতকরা ১ ভাগের যে শৃঙ্খল, তা থেকে মুক্ত হতে গেলে এই মেরুকরণকেই নতুন রাজনীতির কেন্দ্রে আনতে হবে। বাংলাদেশে এই লড়াই নতুন নয়, জনগণের শতভাগ মালিকানায় দেশ ও তার সম্পদ প্রতিষ্ঠার চলমান লড়াইয়ের অন্তর্গত শ্লোগানই হল: আমরা ৯৯%, দখলমুক্ত কর বাংলাদেশ।
আনু মুহাম্মদ : শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, গবেষক এবং তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব ।