আহ স্টাইনম্যান!

ফাহাম আব্দুস সালাম
Published : 19 Oct 2011, 03:06 PM
Updated : 19 Oct 2011, 03:06 PM

রালফ স্টাইনম্যান নোবেলটা পেলেন শেষ পর্যন্ত, কিন্তু বড্ড দেরী হয়ে গেলো। ঘোষণা হোল সোমবার (০৩/১০/১১), মারা গেলেন তার আগের শুক্রবার (৩০/০৯/১১), প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসারে। মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে হাসপাতালে মেয়েকে ঠাট্টা করে বলেছিলেন ক'টা দিন যে তাকে টিকে থাকতে হবেই; মরে গেলে ওরা পুরস্কারটা দেয় না (I know I have got to hold out for that. They don't give it to you if you have passed away. I got to hold out for that)। নোবেল পুরস্কারের একশ বছরের চেয়ে দীর্ঘ ইতিহাসে তিনিই একমাত্র বিজ্ঞানী যিনি মরণোত্তর নোবেল পুরস্কার পেলেন। অবশ্য সঠিক স্পিরিটে মরণোত্তর বলা যাবে না যেহেতু পুরস্কার ঘোষণার সময় নোবেল কমিটির জানা ছিলো না যে তিনি আর জীবিত নেই। যথাযথ কারণেই পুরস্কারটি বহাল রাখা হয়েছে। মাত্র দশ দিনের ব্যবধানে স্টাইনম্যানসহ স্টিভ জবস ও জাগজিত সিং মারা যাওয়ায় বাংলাদেশে তার কাজ আলোচিত হয় নি মোটেও (মরণোত্তর নোবেল পুরস্কারটা আলোচিত হয়েছে যদিও)। কিন্তু মহাকালের বিচারে তার কাজের প্রভাব হয়তো স্টিভ জবসের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

তো কী কারণে তিনি নোবেলটা পেলেন? তিনি দেহের অতি গুরুত্বপূর্ণ এক ধরনের কোষ "ডেনড্রিটিক সেল" সম্বন্ধে প্রথম রিপোর্ট করেন ১৯৭৩ সালে। শুধু তাই না, ডেনড্রিটিক সেলের প্রকার, কাজ ও রোগ প্রতিরোধে ব্যবহার বিষয়ে তিনি দীর্ঘ চার দশক ধরে গবেষণা করেছেন। এই বিশেষ ধরনের কোষটি প্রথম শনাক্ত হয়েছিলো উনবিংশ শতকে; তখন এটিকে বলা হতো ল্যাঙ্গারহ্যান্স সেল, আবিষ্কারক Paul Langerhans এর নামানুসারে। কিন্তু তখন আর কিছুই জানা ছিলো না। রালফ স্টাইনম্যান তার সুপারভাইজার জ্যানভিল কোনকে সাথে নিয়ে এর নামকরণ করেন ডেনড্রিটিক সেল।

Pubmed কে বলা যেতে পারে লাইফ সায়েন্টিস্টদের Google। Pubmed এ গিয়ে আপনি যদি Dendritic Cell লিখে খোঁজ করেন, আজ (১৯/১০/২০১১) অবধি ৭২২৫৬ টি সায়েন্টিফিক পেপারের সন্ধান পাওয়া যাবে। এর প্রত্যেকটিই কোনো না কোনো ভাবে স্টাইনম্যানের কাছে ঋণী। সে কথা মাথায় রেখে প্রতি বছরই ডেনড্রিটিক সেল বায়োলজিস্টরা অক্টোবার মাসের প্রথম সপ্তাহে নিজেদের মাঝে আলোচনা করতেন স্টাইনম্যান যে কবে নোবেলটা পাবেন। যে পুরস্কারটি পাওয়া উচিত ছিলো অন্তত বিশ বছর আগে, সেইটে তিনি পেলেন মূল আবিষ্কারের ৩৮ বছর পরে; তাও নিজে দেখে যেতে পারলেন না, সত্যিই দুঃখজনক।

আমাদের জানা আছে যে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (Immune System) জীবাণু কিংবা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা চেনে না এমন কোনো বস্তুর উপস্থিতি টের পেলেই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। যেমন ধরুন আপনার কিডনি নষ্ট হয়ে গেলো, আরেকটি কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হোল। যেহেতু এই নতুন কিডনিটিকে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা চেনে না সেহেতু জীবাণু না হওয়া এবং মানব দেহের জন্য প্রয়োজনীয় হওয়া সত্ত্বেও সে বহিরাগত হিসাবে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। যেজন্য ট্রান্সপ্ল্যান্ট রোগীদের এই প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দমিয়ে রাখার জন্য প্রচুর ওষুধ খেতে হয়।

আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার দুটো অঙ্গ আছে। প্রথমটি Innate Immunity যেটাকে বলা যেতে পারে প্রথম প্রতিরোধ। যেমন ধরুন আপনার ত্বক জীবাণুদের শরীরের ভেতরে প্রবেশ করতে বাধা দেয় (ত্বকের অনেকটা অংশ একসাথে পুড়ে গেলে এই প্রতিরোধ ভেঙ্গে যায় এবং রোগী প্রায় সময় ইনফেকশানে মারা যায়) কিংবা আপনার পাকস্থলীর Acidic Environment বা অম্লীয় পরিবেশ যা বহু জীবাণুকে মেরে ফেলে। লক্ষ্য করুন, এই প্রথম প্রতিরোধ ব্যবস্থাটি কিন্তু স্পেসিফিক না, সব জীবাণুকেই একইভাবে প্রতিহত করে। কোনো জীবাণু এই প্রথম প্রতিরোধ ভেদ করলে (যেমন ক্ষত থেকে) বা আপনার নিজের শরীরেই যদি ক্ষতিকর কোনো কোষ তৈরি হয় (যেমন ক্যানসার সেল) তখন কী হবে? আমাদের দ্বিতীয় প্রতিরোধ বা Adaptive Immunity যুদ্ধ শুরু করে। এই প্রতিরোধটি খুব জটিল এবং স্পেসিফিক অর্থাৎ একেকটি জীবাণুর জন্যে একেক ধরনের যুদ্ধ শুরু হয়। কোনো কোনো জীবাণুর জন্যে এন্টিবডি তৈরি হয় তো কোনো কোনো শত্রুকে শরীরের T cell সরাসরি আক্রমণ করে। যেমন ধরুন ভাইরাস আক্রান্ত কোনো কোষের ভেতরের ভাইরাসটিকে আলাদাভাবে মারা যাচ্ছে না, তাই Adaptive Immunity ভাইরাস-শুদ্ধ গোটা কোষটাকেই মেরে ফেলবে। আবার ধরুন ভাইরাস নেই কিন্তু কোষটি ক্যানসারাস অর্থাৎ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে চলেছে, এই ধরনের কোষকেও Adaptive Immunity মেরে ফেলার চেষ্টা করবে (সব সময় পারে না, পারে না বলেই ক্যানসার হয়, কেন পারে না সে নিয়ে লিখতে বসলে সাত খণ্ডে রামায়ন হয়ে যাবে)।

প্রশ্ন হোলো কোন কোষকে মারবে আর কোনটাকে মারবে না এই তথ্যটি রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা পায় কোথা থেকে? আবার অন্যভাবে বলা যেতে পারে যে স্টাইনম্যানের কাজের আগেও কিন্তু জানা ছিলো Innate ও Adaptive Immunity র কার্যকারিতার কথা; জানা ছিলো না কোন কোষ দুটি প্রতিরোধের মাঝখানে থাকে, অর্থাৎ শরীরকে কে বলে দেয় যে Innate Immunity তে আর কাজ হবে না, এবার প্রয়োজন Adaptive Immunity। এখানেই ডেনড্রিটিক সেলের কাজ শুরু। আমাদের শরীরে এদের সংখ্যা খু-ব-ই কম কিন্তু এরা ভীষণ কাজের। পাওয়া যায় মূলত সে সমস্ত জায়গায় যেখানে জীবাণুদের থাকার কিংবা আক্রমণের সম্ভাবনা বেশি, যেমন ত্বকের একটু নীচে। মূল কাজটা পাহারাদারের; এরা সর্বক্ষণ শরীরের বিভিন্ন অংশে চষে বেড়ায় এবং চারপাশে যা পায় তাই ঢুকিয়ে ফেলে নিজের ভেতরে। এর মধ্যে যদি থাকে বহিরাগত কোনো জীবাণু (Antigen) তাহলে এরা সেটাকে শুধু মারবেই না, মেরে ধ্বংস করে ছোট্ট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশকে (Antigenic epitope) কোষের বাইরে পরিবেশন করবে। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার অন্যান্য যোদ্ধা কোষ B cell, T cell বা NK cell এই ছোট্ট অংশকে শনাক্ত করে নেবে বহিরাগত হিসাবে এবং এর পর যেখানেই এই অংশগুলোকে দেখবে সেখানেই যুদ্ধ শুরু করে। উল্লেখ্য, যোদ্ধা কোষরা একবার চিনে ফেললে প্রায় যে কোনো শত্রুকে পরাস্ত করতে সক্ষম এবং ডেনড্রিটিক সেল ছাড়াও অন্যান্য অনেক কোষ চিনিয়ে দেয়ার কাজটা অল্পবিস্তর করতে পারে; কিন্তু প্রথম পরিচয়টি করিয়ে দেয়ার জন্য (Priming of T cell) ডেনড্রিটিক সেল অপরিহার্য। আমরা ছোটোবেলায় যে টীকা নিই সেখানেও রয়েছে এই মূল সুর। যে জীবাণু পোলিয়ো রোগ সৃষ্টি করে তাকে অকার্যকর করে ঢুকিয়ে দেয়া হয় শরীরের ভেতরে যেন রোগ তৈরি করতে না পারে। কিন্তু ডেনড্রিটিক সেল জীবাণুটিকে চিনে B cell কে সহায়তা করবে এন্টিবডি তৈরি করার জন্যে। ভবিষ্যতে যখনই রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা পোলিয়ো রোগের জীবাণুর উপস্থিতি টের পাবে সাথে সাথে শুরু হবে যুদ্ধ। রোগ প্রতিরোধের এই দ্বিতীয় ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে সে প্রসঙ্গেও স্টাইনম্যান গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন।

অনেকেই জানতে চাইবেন টীকা তো দেয়া হয় অন্তত দুশ বছর ধরে (জলবসন্তের জন্য ১৭৯৬ সালে এডওয়ার্ড জেনারের টীকা দেয়ার আগেও এ ধরনের ব্যবস্থার সাথে মানুষ পরিচিত ছিলো), আর ডেনড্রিটিক সেল আবিষ্কৃত হোল সেদিন। ডেনড্রিটিক সেলের কাজ না জেনেই যদি এতোসব টীকা এতদিন ব্যাবহার হয়ে থাকে তাহলে এর গুরুত্বটা কোথায়? মোক্ষম প্রশ্ন। উত্তর হোল বিজ্ঞানীরা এখন এমন সব রোগের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টা করছেন যেটা ডেনড্রিটিক সেলের কাজ জানা না থাকলে কল্পনাও করা যেত না। যেমন ধরা যাক একটি বিশেষ ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত কোষগুলো একটি বিশেষ প্রোটিন "X" প্রকাশ করে কোষের পরিধিতে। কোনোভাবে যদি ডেনড্রিটিক সেলদের চিনিয়ে দেয়া যায় যে প্রোটিন "X" শরীরের জন্য বহিরাগত তাহলে সে এই প্রোটিনটিকে চিনিয়ে দেবে শরীরের T cell দের। যেহেতু আমাদের দেহে প্রচুর T cell রয়েছে এবং এরা বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করতে সক্ষম সেহেতু T cell ধ্বংস করবে প্রোটিন "X" প্রকাশকারী ক্যানসার সেলদের। কৃত্রিম উপায়ে ডেনড্রিটিক সেলকে Antigen দের বহিরাগত হিসেবে চিনিয়ে দেয়ার কাজটি কিন্তু সহজ না। একটি উপায় হোল শরীরের বোন ম্যারো থেকে Stem Cell (যে আদি কোষগুলো এখনও পরিপূর্ণতা পায় নি, বিভিন্ন রাসায়নিক ও ইমিউন সিগনালে বিভিন্ন ধরনের কোষে পরিণত হবে। অনেক সায়েন্স ফিকশান সিনেমায় হয়তো দেখেছেন যে Stem Cell এর বিস্তারকে নিয়ন্ত্রণ করে হার্ট, কিডনি প্রভৃতি অঙ্গ তৈরি করা হচ্ছে) বের করে ল্যাবে এমন পরিবেশে কোষগুলোকে বাড়তে দেয়া, যেন সেগুলো ডেনড্রিটিক সেলে পরিণত হয় (এর কারণ হোলো অধিক সংখ্যক ডেনড্রিটিক সেলকে এক সাথে একই কাজে লাগানো )। তারপর সেগুলোকে নির্দিষ্ট একটি কিংবা কয়েকটি Antigen চিনিয়ে দিয়ে পুনরায় শরীরে প্রবেশ করানো। আমাদের শরীরে যেহেতু ডেনড্রিটিক সেলের সংখ্যা খুবই কম সেহেতু এই পদ্ধতিতে একসাথে অনেক ডেনড্রিটিক সেল শরীরে ঢুকিয়ে অনেক সংখ্যক T cell কে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা সম্ভব। এতে নির্দিষ্ট একটি Antigen কিংবা এক ধরনের ক্যানসারের বিরুদ্ধে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশী মাত্রার Immune Response সৃষ্টি করা সম্ভব।

যেহেতু শরীর থেকে কোষ বের করে পুনরায় প্রবেশ করানোর মাধ্যমে এই চিকিৎসা সেহেতু এই পদ্ধতিতে ঝুঁকি আছে। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন শরীর থেকে কোষ না বের করে শরীরে যতো ডেনড্রিটিক সেল আছে সেগুলোকেই বেশি কার্যকর করে তুলে ক্যানসারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রস্তুত করা (বর্তমান লেখক এমন প্রচেষ্টায় বহু ইঁদুর নিধন করেছেন)। বিভিন্ন ন্যানোপার্টিকেলের মধ্যে Cancer Antigen ঢুকিয়ে যদি সেগুলোকে ডেনড্রিটিক সেলের উদ্দেশে টার্গেট করে পাঠিয়ে দেয়া যায় তাহলেও তো ক্যানসারের বিরুদ্ধে Immune Response বৃদ্ধি করা সম্ভব।

এই দু-ধরনের স্ট্র্যাটেজি নিয়ে স্টাইনম্যান বিস্তর গবেষণা করেছেন। তার কাজের উপর ভিত্তি করে বেশ কয়েকটি ক্যানসার ভ্যাকসিন ক্লিনিকাল ট্রায়াল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো রক্ষা পাবে বহু প্রাণ, তার কাজের কারণে।

স্টাইনম্যানের আরো একটি প্রতিভার কথা না বললেই না, সেটি তার লেখনী শক্তি। পৃথিবীতে যোগাযোগের ক্ষেত্রে যতো ধরনের কঠিন কাজ রয়েছে তার মধ্যে দ্বিতীয় কঠিনতম সম্ভবত লিগ্যাল ইংলিশ রফত করা। কিন্তু প্রথমটি, নিঃসন্দেহে, ভালো সায়েন্টিফিক ইংলিশ লেখা (এটি নিতান্তই আমার মত। চোস্ত ইংরেজি গদ্য লেখে এমন বহু লেখকের সন্ধান আমি জীবনে পেয়েছি কিন্তু মধুর সায়েন্টিফিক ইংলিশ লেখে এমন লেখক পেয়েছি দু-চার জন)। প্রত্যেক দ্বিতীয় বাক্যে অন্য কারো কাজ উদ্ধৃত করছেন, কিন্তু করতে হবে নিজের ভাষায়। আবার বেখাপ্পাভাবে করলে হবে না, এমন ভাবে করতে হবে যেন গল্পটা সুন্দর মতো দাড়িয়ে যায়। সাহিত্যে শব্দের ছাড় আছে, একটু এদিক-সেদিক হতেই পারে। In এর জায়গায় On লিখলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না সব জায়গায়। একজন সাহিত্যিক ক্ষেত্র বিশেষে ইচ্ছা করেই দ্ব্যর্থবোধক শব্দ ব্যাবহার করবেন। কিন্তু সায়েন্টিফিক ইংলিশে Loosely Speaking বলে কোনও কথা নেই। আপনি যা বলছেন ঠিক সেটাই Mean করছেন, ওজনদার শব্দ চলবে কিন্তু Ambiguity চলবে না। আবার বিষয়ের উপর নিজের দখলও প্রকাশ করতে হবে। এতো সব সাত-পাঁচ ভেবে, কঠিন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করে লেখালেখি করাটা তাও হয়তো সয়ে যেতো কিন্তু সেটাকে সুখপাঠ্য করে তোলা রীতিমতো দুঃসাধ্য। যারা পেশার কারণে সায়েন্টিফিক পেপার পড়েন তারাও বিরক্ত হন লেখাগুলো বোরিং বলে। কিন্তু মানুষ কীভাবে রালফ স্টাইনম্যান কিংবা রলফ জিঙ্কারনেগেলের (যার প্রথম ভাষা ইংরেজি না, ভাষাটা নাকি তিনি রফত করেছিলেন ক্যানবেরায় এসে পিএইচডি করার সময়; আর হ্যাঁ ঐ পিএইচডিটার জন্যে তিনি বেশ কয়েকটা পুরস্কারও পেয়েছিলেন; '৯৬ সালের নোবেল যার একটি ) মতো সুখপাঠ্য সায়েন্টিফিক ইংলিশ লেখে সেটা কল্পনা করাটাও কঠিন। আপনি পরিকল্পনা করে মোড় ঘুরিয়ে দেয়া বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হয়তো করতে পারবেন না (এ বছরের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল য়ুনিভার্সিটির ফিজিসিস্ট ব্রায়ান শ্মীড তার সংবর্ধনায় বলেছেন আপনি নোবেল পান না, নোবেল আপনাকে খুঁজে পায়) কিন্তু সব বিজ্ঞানীই চেষ্টা করেন তার কাজটা যেন ভালোভাবে লিখিত হয়। এতো সব ব্রাইট মাইন্ড একই চেষ্টা করছেন কিন্তু উৎকর্ষের শিখরে পৌঁছচ্ছেন মাত্র ক'জন। বুঝতেই হবে কাজটা কঠিন।

লেখার প্রথম অংশে দাবী করেছি যে স্টাইনম্যানের কাজের গুরুত্ব কোনোদিন হয়তো স্টিভ জবসকেও ছাড়িয়ে যাবে। খুব বড় দাবী মনে হতে পারে কিন্তু অসম্ভব না। আমরা এতটুকু জেনে ফেলেছি যে কোনো একটি ড্রাগ কোনোদিনও হয়তো সব ধরনের ক্যানসার সারাবে না। একেক ক্যানসারের জন্য একেক ড্রাগ। কিমোথেরাপির সমস্যা হোল সাইড-এফেক্ট, এই পদ্ধতিতে ভালো সেল আর ক্যানসার সেলের তফাৎ করা যায় না। পক্ষান্তরে ইমিউন থেরাপিতে শরীরের নিজের প্রতিরোধ ব্যবস্থাই ক্যানসার সেলের বিরুদ্ধে লড়বে, তাই এটি নিরাপদ। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন যে ভবিষ্যতে ইমিউন থেরাপিই হয়তো হয়ে উঠবে ক্যানসারের মূল চিকিৎসা। সে পথে এমন স্ট্র্যাটেজি হয়তো কমই পাওয়া যাবে যেখানে ডেনড্রিটিক সেলের কোনো অংশগ্রহণ থাকবে না।

স্টাইনম্যান এর গুরুত্ব বুঝতে পেরে নিজের প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসারের চিকিৎসা নিজেই ডিজাইন করেছিলেন। তিনি তার ডেনড্রিটিক সেলকে চিনিয়েছিলেন নিজের ক্যানসার আক্রান্ত কোষগুলো, ল্যাবরেটরিতে। আমি ঠিক জানি না কোন পর্যায়ে তিনি চিকিৎসা শুরু করেছিলেন কিংবা তার ক্যানসারটি ঠিক কোন ধরনের ছিলো কিন্তু প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসার সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ক্যানসারগুলোর একটি। সাধারণ রোগীরা যেখানে শনাক্তকরণের এক বছরের মাঝেই মারা যায় সেখানে স্টাইনম্যান বেঁচে ছিলেন সাড়ে চার বছর। একটি মাত্র কেস থেকে এই চিকিৎসার কার্যকারিতা নিরূপণ করা অসম্ভব কিন্তু তার সাহস আর নিজের আবিষ্কারের ওপর আস্থার কথাটা একবার চিন্তা করুন। মৃত্যুর দুয়ারে এসে নিজেকে গিনিপিগ বানিয়ে আনকোরা চিকিৎসার ব্যবস্থা ক'জন করবে, বলুন?

ব্রিটিশ কমেডিয়ান স্টিভেন ফ্রাই বড় বড় মানুষদের অতিমূল্যায়ন আর অবমূল্যায়ন হওয়া নিয়ে যারা নালিশ করেন তাদের উদ্দেশে সম্প্রতি চমৎকার একটা মন্তব্য করেছেনঃ আমার জানা নেই যে আদৌ কেউ তার কাজের জন্য "সঠিক" ভাবে মূল্যায়িত হতে পারেন কি না। সত্যিই তো; কাজের গুরুত্ব মাপার তো কোনো যন্ত্র হয় না। কিন্তু কাজের স্বীকৃতি দেয়া যায়। কেউ কেউ স্বীকৃতি পান আর কেউ কেউ পান না দেখে আমরা ব্যথিত হই (যেমন ধরুন নিকোলা টেসলার কথা। বিংশ শতাব্দীটা ছিলো না আইনস্টাইন কিংবা আলেকজান্ডার ফ্লেমিং এর শতক, ছিলো না গান্ধী, হিটলার কিংবা ট্রুম্যানের শতক; ছিলো টেসলার শতক। তিনি উদ্ভাবন করেছিলেন এসি কারেন্ট যা ছাড়া আধুনিক পৃথিবী বানান করতেও লজ্জা লাগে; ক'জন তার নাম জানে বলুন?)। রালফ স্টাইনম্যানের ঘটনাটি একটু বিচিত্র; কাজের স্বীকৃতি তিনি যে পাবেন সেটা জানা ছিলো, পেলেনও; কিন্তু বড্ড দেরী করে।

পুনশ্চঃ পরিভাষা না থাকার কারণে ইমিউনোলজির বহু বিষয়ের বাংলা অনুবাদ সম্ভবপর না। যে সমস্ত ক্ষেত্রে ধারণাগুলোর প্রকাশ নিখুঁত হোলো না তার দায়ভার এই লেখকের, বাংলা ভাষার ও আমাদের পূর্বপুরুষের যারা বিজ্ঞান চর্চা না করেও দেশের উন্নতি হবে – এই জাতীয় দিবাস্বপ্ন দেখেছিলেন।

সূত্র: Schuster, M., Nechansky, A., and Kircheis, R. (2006). Cancer immunotherapy. Biotechnol J 1, 138-147

ফাহাম আব্দুস সালাম : লেখক তার পিএইচডি গবেষণায় ক্যানসার ভ্যাকসিন ডিজাইন করেছেন।