অভিন্ন পারিবারিক আইন: এক সম্পূর্ণ জীবন বিধান

দিল মনোয়ারা মনু
Published : 18 August 2016, 04:52 AM
Updated : 18 August 2016, 04:52 AM

আমার দীর্ঘদিনের সাংবাদিকতা জীবনের অনেক ঘটনার মধ্য থেকে এখানে প্রাসঙ্গিক একটি ঘটনা উল্লেখ করে আলোচনার সূত্রপাত করতে চাই। আমি জেনেছিলাম, ঢাকার মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতালের নার্স সুমিতা গোমেজ একসময় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কার্যালয়ে এসেছিলেন একটি দাবি নিয়ে। তিনি স্বামীর কাছ থেকে কিছুই চান না, শুধু তালাক চান।

সুমিতার স্বামী তিন সন্তানসহ তাঁর ভরণ-পোষণ তো করেনই না, উপরন্তু মাসের প্রথমেই তাঁর বেতনের টাকা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন প্রায় প্রতিদিনই।

এর থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় বিবাহবিচ্ছেদ।

কিন্তু একজন খ্রিস্টান নারী যতই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন না কেন বিচ্ছেদ পাওয়াটা বেশ দুরূহ। সুমিতা চার্চের কাছে গিয়েছিলেন, কিন্তু চার্চ তাঁর বিচ্ছেদের আবেদন মঞ্জুর করেনি।

এ ক্ষেত্রে একাধিক সাক্ষীর প্রয়োজন। একজন নারীর পক্ষে একাধিক সাক্ষী জোগাড় করানোর কাজটা খুব সহজ নয়। আমি জেনেছিলাম, মহিলা পরিষদ সুমিতার পাশে সেভাবে দাঁড়াতে পারেনি। কারণ, 'পার্সোনাল ল' প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।

অথচ খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের একজন পুরুষ (স্বামী) একজন সাক্ষী চার্চে উপস্থিত করে খুব সহজেই তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিতে পারেন।

তেমনি মল্লিকা নামের এক হিন্দু নারীর কথা আমি জেনেছি। ময়মনসিংহের মল্লিকা বিয়ের পর স্বামীর মনের নাগাল কখনও পাননি। অর্থহীন পারিবারিক জীবন টেনে বেড়াতে হয়েছে বছরের পর বছর, কিন্তু স্বামীকে ছাড়তে পারেননি। কারণ, হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী 'সাত পাকে বাঁধা'– জন্ম-জন্মান্তরের এই বাঁধন থেকে বিচ্ছেদ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

অথচ মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সচেতনতার অভাবে 'এক তালাক', 'দুই তালাক', বা 'তিন তালাক' শব্দগুলো একজন সাক্ষীর সামনে উচ্চারিত হওয়ায় কত নারীর জীবন যে তছনছ হচ্ছে তার ইয়াত্তা নেই।

যদিও আইন এই প্রথা অনুমোদন করে না। তবুও সচেতনতার অভাবে এই ঘটনা অহরহই ঘটে চলেছে। কারণ, এই প্রথার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারী, পুরুষ নয়। স্ত্রী ইচ্ছা করলেই স্বামীকে তালাক দিতে পারেন না, কিন্তু স্বামী সহজেই পারেন। স্ত্রী পারেন তখনই, যখন কাবিননামায় নারীর তালাক দেওয়ার অধিকার স্বীকৃত থাকে।

আমরা জানি, পারিবার ও সমাজের প্রচলিত প্রথা, রীতিনীতি কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে বহুবার। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে সাহসী নারীরা যেমন প্রতিবাদমুখর হয়েছেন, তেমনি তাঁদের পাশে এগিয়ে এসেছে এ দেশের বৃহৎ নারী আন্দোলন।

ইতিহাসের ক্রমবর্ধমান বিকাশের ক্ষেত্রে নারী তাঁর স্বাধীন সত্তা প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম নিরন্তর চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতিহাসের ধারাবাহিকতার সূত্র ধরে নারী তাঁর প্রতি বিরাজমান সব ধরনের বৈষম্য নিরসনের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। বিশেষ করে আশির দশক থেকে নারীর প্রতি বৈষম্য– যাকে 'নারী নির্যাতন' বলে অভিহিত করা হচ্ছে– সেই নির্যাতন বন্ধে ধারাবাহিক জোরদার কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।

শুধু আইনগত সহায়তা নয়, সামাজিকভাবে প্রতিরোধ আন্দোলন, প্রচলিত আইন যা নারী উন্নয়নে বাধার সৃষ্টি করে তার সংশোধনের জন্য মহিলা পরিষদ ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি অন্যরাও কাজ করছে। এ আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট অর্জন সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।

সাম্য প্রতিষ্ঠার এ আন্দোলনের মূলধারা হচ্ছে সমাজ, রাষ্ট্র ও দেশবাসীর দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনসহ সচেতনতা বৃদ্ধি করে জনমত তৈরি করা। লক্ষ্য: এর মাধ্যমে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব নাগরিকের জন্য এক স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক মানবিক ও বৈষম্যহীন সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনবোধ তৈরি করা।

নারীর অধিকার মানবাধিকার– এই লক্ষ্যে নারীর ক্ষমতায়ন, রাষ্ট্র পরিচালনায় নারীর সম-অংশীদারিত্বের ভাবনাটি কোনো বিচ্ছিন্ন চিন্তা বা সিদ্ধান্তের বিষয় নয়। নারী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সামগ্রিকভাবে নারীর উন্নয়ন এবং ক্ষমতায়ন।

দুঃখজনক হলেও সত্য এই সুদীর্ঘ নারী আন্দোলনের অর্জন নারীর ভাগ্য উন্নয়নে তেমন ভূমিকা রাখতে পারছে না। কারণ, এই গৃহীত কর্মসূচিগুলোর ব্যবস্থাপনা ও নীতি নির্ধারণে রয়েছে পুরুষতন্ত্রের ধারক সেই ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো। যার ফলে দীর্ঘ আন্দোলন ও বাস্তবমুখী কর্মসূচি পরিচালনার পরও নারীর মানবাধিকার অর্জন এখনও নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রের ১০, ১৬, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯ ও ৩০ ধারা বা উপধারায় নারীর সমানাধিকারের ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও প্রচলিত ও পারিবারিক আইনে বৈষম্য থাকার কারণে ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের মধ্যে সমতা আনা যাচ্ছে না। নারীর মৌলিক অধিকার রক্ষার কথা শাসনতন্ত্র বা সাংবিধানিক বিধান হিসেবে ঘোষণা করা হলেও সমাজে প্রচলিত অসম বিধানকে অবৈধ ও বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়নি। ফলে বাংলাদেশের নারীরা সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।

বাংলাদেশের প্রগতি অব্যাহত রাখতে প্রচলিত আইনের সংস্কার অপরিহার্য।

কিন্তু সরকার একটি ক্ষেত্রে প্রচলিত আইনের সংস্কার করতে ব্যর্থ হয়েছে। যার ফলে এ দেশের নারীরা সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পারিবারিক আইনের আমূল সংস্কার প্রয়োজন। এর ফলে বাংলাদেশের মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান– সব ধর্মের নারীরা তাঁদের জীবনের সমস্যার একই ধরনের সমাধান পাবেন।

অগ্রসরমান সমাজজীবনের বৈষম্য দূর হবে; প্রত্যেক নারী আত্মপ্রত্যয়ের ভিত্তিতে নিজের জীবন পরিচালিত করতে সক্ষম হবেন।

বাংলাদেশের প্রতিটি ধর্মের লোকের জন্য ধর্মভিত্তিক 'পারসোনাল ল' প্রচলিত আছে, যাকে কেন্দ্র করে ধর্মের ভিত্তিতে বিয়ে, বিচ্ছেদ এবং উত্তরাধিকার সম্পর্কিত আইন কার্যকর হয়। এতে নাগরিকদের মধ্যে অধিকারের প্রশ্নে বিভেদের সৃষ্টি হচ্ছে, যা অসাংবিধানিক এবং মৌলিক অধিকারবিরোধী।

এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সব ধর্মের সাধারণ নারীরা এবং দেশের অগ্রগতি ব্যহত হচ্ছে।

জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত সিডও সনদে নারীর প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যেসব বৈষম্য রয়েছে তা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে এবং এসব বৈষম্য দূর করার জন্য সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করার জন্য নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আইন পরিবর্তন, সংশোধন ও নারীবান্ধব নতুন নতুন আইন তৈরি করা বিশেষভাবে জরুরি। আমাদের দেশে সরকার যে কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি সই করার জন্য অগ্রগামী হয়ে থাকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, চুক্তিগুলোর যথাযথ বাস্তবায়নে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ বা তা আইনে পরিণত করার বিষয়টি প্রতিফলিত হয় না।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে নারীর প্রতি সংবেদনশীল যে কয়টি আইন প্রণীত হয়েছে তাতে মহিলা পরিষদসহ সমমনা বিভিন্ন সংস্থার উল্লেখযোগ্য ও সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে।

১৯৯৩ সালে ভিয়েনা মানবাধিকার সম্মেলনে আন্তর্জাতিকভাবে উচ্চারিত হয়– নারীর অধিকার মানবাধিকার।

কিন্তু প্রণিধানযোগ্য সত্য হল এর পূর্বে আশির দশকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি সুফিয়া কামাল উচ্চারণ করেন, নারীর অধিকার মানবাধিকার।

মহিলা পরিষদ আইন সংস্কার ও প্রণয়নের লক্ষ্যে অ্যাডভোকেসি লবি শুরু করে। ১৯৮৯ সালে 'অভিন্ন পারিবারিক আইন'-এর ধারণাটি উপস্থাপন করা হয়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময় মতবিনিময় সভা, কর্মশালা ও দেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞদের পরামর্শ ও সহায়তায় 'অভিন্ন পারিবারিক আইন'-এর প্রস্তাবনা তৈরি করে ১৯৯২ সালে সরকারের কাছে পেশ করা হয়।

সেই সময় এ দাবি সময়ের চেয়ে অগ্রসর মনে হয়েছিল। ১৯৯৩ সাল থেকে জাতিসংঘ সিডও কমিটি বাংলাদেশ সরকারের কাছে তা প্রণয়নের আহ্বান জানাচ্ছে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ দীর্ঘদিন থেকে নিরন্তর সংগ্রাম করে যাচ্ছে প্রচলিত আইনগুলোর সংস্কার ও যথাযথ পরিবর্তনের জন্য। তারা দেশের চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গ, আইনজ্ঞ সমাজ ও উন্নয়নকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা-পর্যালোচনা করে যে সর্বজনীন পারিবারিক আইনের প্রস্তাবনা তৈরি করেছে তা আমাদের মতে যুক্তিযুক্ত এবং আধুনিক।

সরকার ও জনপ্রতিনিধিরা নারীর সম-অধিকারের বিষয়ে আন্তরিক হলে, এই খসড়াটি বিবেচনায় নিয়ে নারী সমাজসহ সব প্রগতিশীল, নারীবান্ধব মহল ও আইনজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি সর্বজনীন 'ফ্যামিলি কোড' প্রণয়নের পদক্ষেপ নিতে পারেন।