নারী, ছিঁড়ে ফেল সব মোহন শিকল

Published : 16 August 2016, 03:44 AM
Updated : 16 August 2016, 03:44 AM

প্রাচীন যুগে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হত ক্রীতদাসকে। দাসের সর্বদাই চেষ্টা থাকত কীভাবে শিকল ভাঙা যায়। কারণ, শিকলটা প্রতি পদক্ষেপে তাকে মনে পড়িয়ে দেয় যে সে ক্রীতদাস। তার স্বাধীনভাবে বাঁচা বা চলার অধিকার নেই। আবার সে যুগে ধনীর গৃহে কিংবা সম্রাটের প্রাসাদে এমন অনেক দাস ছিল যাদের পায়ে শিকল পরানো হত না। তারা ছিল 'বিশ্বাসী'। তারা কখনও প্রভুকে ছেড়ে যেতে চাইত না। কারণ, সেসব দাসের খাওয়া-পরার কোনো অভাব রাখা হত না। প্রভু তাকে বিশ্বাস করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার দিত। দাসও বেশ গৌরব অনুভব করত যে প্রভু তাকে ভালোবাসেন, তাকে বিশ্বাস করেন, তাকে বেশ যত্নআত্তিও করেন। সম্রাটের খাস দাসদাসীরা তো রীতিমতো রাজকীয় জীবন যাপন করত। বাহ্যিকভাবে অর্থাৎ পোশাক-পরিচ্ছদ, খাবারদাবারের দিক থেকে তারা অনেক স্বাধীন নাগরিকের তুলনায় ভালো মানের জীবন যাপন করত।

তবু, হ্যাঁ তবু, তারা কিন্তু দাসই ছিল। স্বাধীনতার দায়িত্ব, স্বাধীনতার ব্যথা এবং স্বাধীনতার আনন্দ– কোনোটাই তারা অনুভব করতে পারেনি। স্বাধীনতার চেহারা না দেখেই তারা ভাবত তারা খুব সুখে আছে।

এ কালে স্বামীর আাদরযত্নে পালিত, সুখী সুখী চেহারার নিষ্কর্মা পুতুল বউদের দেখে আমার চোখে কেন যেন সেই দাসদের চেহারা ভেসে ওঠে। পুরুষতন্ত্র কত কৌশলেই না নারীর পায়ে শিকল পরায়। কখনও সেই শিকলের নাম 'গহনা', কখনও 'প্রেম', কখনও 'মানসম্মান', কখনও 'সন্তান', কখনও 'সংসার'। নারী সেসব শিকল পরে দিব্যি আনন্দে ঘোরে-ফেরে; ভাবে 'বাহ্‌! আমি কত সুখে আছি।'

এসব অদৃশ্য শিকলের মধ্যে একটি মোহন শিকল হল 'প্রেম'। কোনো মানুষ যদি অন্য কোনো মানুষকে সত্যিকারভাবে ভালোবাসে তাহলে সে ভালোবাসার মানুষটির উন্নতি চাইবে, চাইবে তার প্রতিভার বিকাশ হোক, সর্বোপরি চাইবে তার স্বাধীনতা। কারণ, রাজা দ্রুপদ যেমন দ্রোণাচার্যকে বলেছিলেন– 'রথীর সঙ্গে অরথীর, ধনীর সঙ্গে দরিদ্রের, বীরের সঙ্গে কাপুরুষের কখনও বন্ধুত্ব হয় না, বন্ধুত্ব হতে হয় সমানে-সমানে'– প্রেমও তা-ই।

একজন স্বাধীন মানুষের সঙ্গে অন্য স্বাধীন মানুষেরই প্রেম হতে পারে। প্রভু ও ক্রীতদাসীর মধ্যে প্রেম হয় না। প্রভু যদি কোনো ক্রীতদাসীর প্রেমে পড়ার পর তাকে স্বাধীন করে দেয় তবেই সেটা প্রেম হয়। আর প্রেমের নাম দিয়ে তাকে যদি দাসী করেই রাখে তবে সেটা হয় শোষণ; সেটা হয় নিজের স্বার্থের জন্য তাকে 'ব্যবহার' করা। সত্যিকারের প্রেম কখনও ভালোবাসার মানুষের স্বাধীনতা হরণ করতে পারে না, বাধা হয়ে দাঁড়াতেও পারে না তার বিকাশের পথে। আর যে প্রেম শুধু বাঁধতে চায়, মুঠোয় পুরে রাখতে চায়, সেটা প্রেম নয়। সেটা নিয়ন্ত্রণকামিতার প্রকাশ মাত্র। সেটা হল নারীকে মুঠোয় পুরে রাখার এক মোহন কৌশল। সেটা হল নারীকে খাঁচায় ভরা। আর খাঁচা যদি সোনার তৈরি হয়, তবু তা খাঁচাই থাকে।

হুমায়ূন আহমেদের আবেগঘন চিঠি পেয়ে গুলতেকিন পরীক্ষা ফেলে ছুটে গিয়েছিলেন আমেরিকায়। তিনি তখন বুঝতে পারেননি এই 'চিঠি', এই 'আবেগ' এবং এই 'প্রেম' প্রকৃত প্রস্তাবে ছিল পুরুষতন্ত্রের পুরনো সেই মোহন কৌশল। গুলতেকিনের প্রতি যদি হুমায়ূন আহমেদের 'নিয়ন্ত্রণকামিতার খাদ-মেশানো প্রেম' না থেকে 'নিখাদ প্রেম' থাকত তাহলে তিনি বরং স্ত্রীকে পরীক্ষা দিতে উৎসাহ দিতেন। উৎসাহ দিতেন যেন সে নিজেকে বিকশিত করতে পারে। গুলতেকিন অবশ্য পরবর্তীতে বিদ্রোহ করেছিলেন।

কিন্তু এই বিদ্রোহ সবাই পারে না। পুরুষতন্ত্রের মোহন কৌশলগুলো বুঝতে বুঝতেই অনেক নারীর জীবন পার হয়ে যায়।

প্রেমিক কিংবা স্বামীর প্রেমের জন্য প্রচুর ত্যাগ স্বীকার করে নারীরা। লেখাপড়া জলাঞ্জলি দেয়, ক্যারিয়ার ত্যাগ করে ইত্যাদি, ইত্যাদি। ত্যাগ স্বীকার করে আর মনে মনে ভাবে, এই তো লাইলি-মজনু মার্কা প্রেম আমি পেয়েছি। আহা কী আনন্দ, কী সৌভাগ্য, কী আহ্লাদ! (প্রকৃত প্রেমের কথা বলছি না)। আর সেসব নিয়ন্ত্রণকামী প্রেমের জন্য ত্যাগ স্বীকারের পর কী পায়? অশ্বডিম্ব! ক্রমে দেখা যায় সে প্রেমিক কিংবা প্রেমিক-স্বামীর হাতের পুতুল ছাড়া আর কিছুই নয়।

আরেকটি শিকলের নাম 'মানসম্মান'।

"তুমি একা চাকরি করতে যাবে অন্য শহরে?"

"তুমি সভা-সমিতিতে বক্তব্য রাখবে?"

"তুমি মঞ্চে নাচবে বিয়ের পরও?"

"তুমি রাত করে বাড়ি ফিরবে?"

"বিয়ের পরও তোমার ছেলেবন্ধু কিংবা অফিসের পুরুষ কলিগরা বাড়িতে আসবে?"

"হায়! হায়! পরিবারের মানসম্মান সব যে চলে যাবে!"

মানসম্মান নামক শিকলটির যে কী বিচিত্র রূপ! কোথায় কখন কোন নারীর জন্য যে মানসম্মান চলে যায় তা বোঝাই মুশকিল! ব্রিটেনের সংবিধানের মতো– এই অলিখিত মানসম্মানের কোনো শুরু নেই, শেষ নেই। আর এই মানসম্মান রক্ষার দায় একমাত্র নারীর ঘাড়ে।

নারীকে বেঁধে রাখার আরেকটি শিকলের নাম 'গয়না'।

একটা সত্যি ঘটনা শোনাই–

আমার এক বান্ধবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তুখোড় ছাত্রী ছিল। ফার্স্ট ক্লাস স্কোর নিয়ে প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষে উঠল সে। সেসময় এক বিয়ে বাড়িতে তাকে দেখে এক ধনীপুত্র ও তার মায়ের দারুণ পছন্দ হয়। বিয়ের প্রস্তাব, মেয়েটিরও সম্মতি দান এবং বিয়ে। বিয়েতে বউকে ৩০ ভরি সোনার গয়না দেয় ছেলেপক্ষ। মধ্যবিত্ত মেয়ের পরিবার আনন্দে আত্মহারা। অনার্স পরীক্ষার পরপরই প্রথম সন্তানের জন্ম। 'বংশের বাতি'র মুখ দেখে শাশুড়ি এবার হীরার নেকলেস দেয় পুত্রবধূকে। মেয়েটি মাস্টার্সও পাশ করেছিল। তারপর যখন চাকরির খোঁজ করছে, তখন শাশুড়ির মৃদু অনুরোধ, "ছোট বাচ্চা ফেলে বাইরে নাই-বা গেলে বউমা।"

স্বামীরও তা-ই মত। চাকরির কী দরকার, বিশেষ করে খাওয়া-পরার যখন অভাব নেই। এমন 'গহনাদাতা' শ্বশুরবাড়ির অনুরোধ কি পায়ে ঠেলা চলে? আমার বান্ধবী এখন সেজেগুজে স্বামীর সঙ্গে দেশবিদেশ ঘোরে। সোনার শিকল পায়ে গয়না গায়ে অবিকল পোষা ময়নার মতো বুলি ছাড়ে! ইকোনমিক্সের তত্ত্ব কোথায় মুখ লুকিয়েছে, কে জানে!

মনে পড়ছে, আমি তখন উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রী। পুরান ঢাকার এক বিত্তশালী পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব এল। মোতাশা (মহিলা ঘটক) আমার মাকে বলল, "আপনের মাইয়্যারে সোনায় মুইড়া লইয়া যাইব।"

আমার মা জবাব দিলেন,"তাহলে তো আমার মেয়ে দম বন্ধ হয়ে মরে যাবে। মানুষকে কি সোনায় মোড়ানো যায়? আমার মেয়ে এখন লেখাপড়া করছে, এখন বিয়ে দেওয়া যাবে না। বড় হয়ে মন চাইলে নিজের টাকায় অনেক গয়না কিনতে পারবে।"

আমার মায়ের মতো দেশের সব মা এবং মেয়ে যদি স্বর্ণশিকলকে এভাবে প্রত্যাখ্যান করতে পারত! যে গয়নার লোভে মেয়েরা নিজেদের স্বাধীনতা বিসর্জন দেয়, সেই গয়নাগুলোর মালিকও কি সত্যি তারা হয়? স্ত্রীকে কিনে দেওয়া স্বর্ণালংকারের মালিক আসলে কিন্তু স্বামীই থাকে। সে শুধু খেলার ছলে হার-দুল-চুড়িতে তার নিজস্ব 'বার্বিডল'কে সাজায়, প্রয়োজনে আবার খুলেও নেয়। কখনও পুরনো বার্বির কাছ থেকে নিয়ে নতুন বার্বিকে পরায়, আবার কখনও সেটা ব্যাংকের লকারে রাখে ভবিষ্যতের সঞ্চয় হিসেবে।

সত্যি কথা হল, নারী তার নিজের উপার্জনে যখন কোনো গয়না কেনে (হোক তা পিতল, সোনা, রুপা, হীরা কিংবা মাটির) সেটাই তার অলংকার, সেটাই তাকে শোভা দেয়। আর অপরের দয়াদাক্ষিণ্যে যা কেনা হয় সেটা 'শিকল' ছাড়া আর কিছুই নয়।

নারীকে মুঠোয় পুরে রাখার সবচেয়ে মজবুত শিকলের নাম 'সন্তান ও সংসার'। সন্তান জন্ম দেওয়ার পর থেকেই নারীকে পাখিপড়া করে শেখানো হয়– 'মা হওয়া মানেই নিজের সব আনন্দ, সব চাওয়া-পাওয়ার হিসাব ভুলে সন্তানের জন্য জীবনধারণ করা'। যেন মা রক্তমাংসের মানবী নয়, তার কোনো চাহিদা থাকতে পারবে না, পারবে না জীবনটা নিজের মতো করে যাপনের অধিকার।

'বাবা' হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তো একজন পুরুষকে চাকরি ছাড়তে হয় না, নিজের সব সুখ-সুবিধা-ইচ্ছা-অনিচ্ছা ছাড়তে হয় না। একজন বাবা তো নিজের ক্যারিয়ার, নিজের সৃজনশীল কাজ সবই বজায় রাখতে পারে। কোনো অভিনেতা তো বাবা হওয়ার পর অভিনয় ছেড়ে দেন না, কোনো ক্রীড়াবিদ ছাড়েন না তাঁর পেশা, কোনো বিজ্ঞানীও ত্যাগ করেন না তাঁর গবেষণা।

কিন্তু মাকে কেন ছাড়তে হয় সবকিছু? কিংবা যদি ধরেও রাখতে চান তাহলেও আমাদের সমাজ তাঁর দিকে এমন চোখে চায় যেন তাঁর মধ্যে মায়ের মমতার অভাব রয়েছে। আর সন্তান ও সংসারের সঙ্গে নিজের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা ধরে রাখতে গেলে কত যে মূল্য দিতে হয়, কত যে পথের কাঁটায় পায়ের রক্ত ঝরাতে হয় তা জানেন স্বাধীন নারী মাত্রই।

হ্যাঁ, মূল্য দিতে হয়। স্বাধীনতার জন্য অনেক, অনেক কিছুর মোহ ছাড়তে হয়। এসব শিকল ছিঁড়ে, ভেঙেই এগোতে হয় নারীকে। তার চলার পথটা তখন আর মসৃণ থাকে না বটে, তবু তো সে পথ তার জীবনটা কারাগারের বাইরে নিয়ে যায়।

যদি বাঁচতে হয় মানুষের মতো, নিজের মন বাঁচিয়ে রেখে, আত্মসম্মান সমুন্নত রেখে তাহলে পুরুষতন্ত্রের অদৃশ্য শিকলগুলো ভেঙেই এগোতে হবে। দাসনারীর মতো স্বাধীন নারীরা দৈহিক সুখ পায় না। তাদের কষ্ট করে নিজের ভাত নিজেকেই জোটাতে হয়। তাদের জীবনমান কিংবা সুখসম্ভোগও ধনীর গৃহের দাসনারীর চেয়ে অনেক কম হয়। কিন্তু তবু সে স্বাধীন। সে যা চায় তা করতে পারে। নিজের পথে চলতে পারে। সে বাার্বিডল হয়ে বাঁচে না, শিকলে বাঁধা পাখির মতো বুলি আওড়ায় না। সে হয়তো পুরুষ-প্রভুর প্রেম পায় না। কিন্তু তাকে কারও অধীন হয়ে বাঁচতে হয় না। সে নিজেই নিজের কর্ত্রী।

পুরুষতন্ত্রের আরও কিছু শক্তিশালী ও মোক্ষম শিকল অবশ্য রয়েছে। তবে সেগুলোর কথা আজ না-হয় থাক। সে কথা হবে অন্য কোনোদিন।