গণতান্ত্রিক রূপবিন্যাস: নির্বাচন, সুবিধাভোগী শ্রেণি ও জনগণের কল্যাণ

গোলাম কিবরিয়া পিনুগোলাম কিবরিয়া পিনু
Published : 20 August 2016, 05:50 AM
Updated : 20 August 2016, 05:50 AM

যে শাসনব্যবস্থাই প্রবর্তন করা হোক না কেন, তাতে জনগণের কল্যাণ কতটুকু রক্ষা করা হয়, তা জনগণ দ্বারা কতটুকু সমর্থিত হয়– বিষয়টি বিবেচনায় আনা একটি দৃষ্টিভঙ্গি। বাংলাদেশে কোন কালপর্বে গণতন্ত্রের চেহারায় কেমন রূপ দেখা দিয়েছে– তা আমরা বিশ্লেষণ করতে পারি, দেখতেও পারি। বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের ভিন্ন ভিন্ন চেহারায় বিভিন্ন দিকও খুঁজে পাই।

আথেনীয় আমলে গণতন্ত্রের স্বর্ণযুগ ছিল, সেটি প্রতিষ্ঠার পরবর্তী সময়ে একশত বছর পর্যন্ত। বলা হয়ে থাকে, সেই যুগে আথেনসের সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমতা জনগণের হাতেই ছিল, কিন্তু বাস্তবে তা ছিল অভিজাতবর্গের হাতেই!

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম অধ্যায়ে গণতন্ত্রের বিকাশ হয়েছিল সেই অভিজাত শ্রেণির হাতেই। তাই গণতন্ত্র নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন থেকেই যায়, তাতে জনগণের স্বার্থ ও অবস্থান কতটুকু ছিল– তা ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করা যেতে পারে। ঐতিহাসিক থুকিডিডিস এবং দার্শনিক প্লেটো আথেনীয় গণতন্ত্রকে একটি অপকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা হিসেবে নিন্দা করেছেন। আবার অনেক দার্শনিক এ বিষয়ে ভিন্নমতও প্রকাশ করেছেন।

গণতন্ত্রের চর্চায় পশ্চিম ইউরোপ সেই উনিশ শতক থেকে এক ধরনের শাসনব্যবস্থা চালিয়ে এসেছে। এই শাসনব্যবস্থায় উচ্চশ্রেণি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির সমঝোতায় এক ধরনের সামাজিক ও মানবিকবোধের ঐক্য গড়ে তুলতে পেরেছে। এর ফলে তাদের মধ্যে রাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে ওঠার জন্য দায়িত্ব ও কর্তব্যের পাশাপাশি অধিকার চেতনা কাজ করেছে। মনস্তাত্ত্বিকভাবে নিজেদের মধ্যে একধরনের বন্ধন তৈরি করে কালের চাহিদা ও পরিবর্তনকে স্বাগত জানানোর মত সহনশীল পরিবেশ বজায় রাখার চেষ্টা দীর্ঘকাল ধরে করে যেতে পারছে। এসব দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও নিয়মনীতিও স্থায়ীভাবে জনগণের আচরণের সঙ্গে সমন্বিত হয়ে কার্যকর হয়েছে।

অন্যদিকে আধুনিক যুগের পরিবর্তিত শিক্ষা, প্রযুক্তি, অর্থনীতি, আবিষ্কার ও অন্যান্য দিকও সফলভাবে উন্নত স্তরে নিয়ে নিজেদের জীবন বিকশিত করতে পারছে।

বাংলাদেশে এই পরিস্থিতি এখনও সেভাবে বিকশিত হতে পারেনি বলেই গণতন্ত্রের বিভিন্ন দিক নিয়ে মানুষ সন্তুষ্ট নয়, মানুষের কল্যাণও গণতান্ত্রিকভাবে সেভাবে বিকশিত হচ্ছে না।

সাম্প্রতিককালে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন এবং এর আগে তিনটি সিটি কর্পোরেশনের যে নির্বাচন হল, এতে প্রায় সব উল্লেখযোগ্য দলেরই প্রার্থী অংশ নিয়েছে। নির্বাচন হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রচারণায় প্রার্থীরা বেশ সহনশীল আচরণ করাসহ এক অপরের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছে। জনগণের কাছে তাদের বক্তব্য নিয়ে গেছে। শান্তিপূর্ণ প্রচারণা ও নির্বাচন অনুষ্ঠানে সীমিত পর্যায় হলেও একধরনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছিল। জনগণও ভোট দেওয়ার মত পরিস্থিতি সীমিত পর্যায়ে অনুকূলে আছে বলে মনে করতে শুরু করেছিল। কিন্তু ভোটের দিন সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনায় নির্বাচন অনেক ক্ষেত্রেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি বলে অভিযোগ ওঠে।

ইউনিয়ন পরিষদের এবারের নির্বাচনে অনেক মানুষ নিহত হয়েছে। খারাপ উপায় অবলম্বন করে ভালো লক্ষ্যে পৌঁছানোর মধ্যে এক ধরনের ভ্রান্তি ও সংকট থেকে যায়। এর ফলে গণতন্ত্র স্থায়ী হতে পারে না। নির্বাচনের এসব উদাহরণই বলে দেয় আমাদের দেশে বিভিন্ন কারণে এখনও গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি সুদৃঢ় হয়নি। নির্বাচন পদ্ধতি ও নির্বাচন ঘিরে মনমানসিকতা এখনও কলুষমুক্ত হয়নি। দুঃখের বিষয় ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিভিন্ন দ্বন্দ্বের কারণে এ দেশে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির বিকাশ বারবার হোঁচট খেয়েছে।

আমাদের নিকট অতীতকালের সংক্ষিপ্ত চালচিত্রে লক্ষ করা যায়, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার পরও ক্ষমতায় আসতে পারেনি। মানুষের মতামত ও আকাঙ্ক্ষা ভূলুণ্ঠিত করার ফলে এবং অন্যান্য কারণে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হল।

বিভিন্ন দিক থেকে ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশটিতে নতুন উদ্দীপনা নিয়ে গণতান্ত্রিক চেতনায় মাত্র নয় মাসে সংবিধান রচনা, নতুন সংবিধান অনুয়ায়ী ছয় মাসের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান, দেড় বছরের মধ্যে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন, দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন– এসব উদ্যোগ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অবকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

১৯৭৫ সালে বাকশালের ১১৫ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয় এবং ২১ জুন ১৯ জেলাকে ৬১ জেলায় রূপান্তরিত করে প্রত্যেক জেলায় গভর্নর নিয়োগ করে এক নতুন ধরনের শাসনপদ্ধতির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই পদ্ধতি সে সময়ের বহু দেশের মডেলের ছায়া-প্রচ্ছায়া ও বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে নেওয়া হয়েছিল; যখন বিভিন্ন সংকট উজিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মানুষের মধ্যে এক ধরনের প্রণোদনাও ছিল।

বিভিন্ন সময়ের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দেশের কালগত সংকট ও সমস্যা উপলব্ধি করে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে মহান নেতারা এগিয়ে আসেন। সেই ধরনের সামর্থ্য ও মানুষের আস্থাবান নেতা বঙ্গবন্ধু কালের সংকট মোকাবিলায় 'বাকশাল'-এর মত একধরনের শাসনপদ্ধতির প্রবর্তন করার উদ্যোগ নেন। সাধারণ মানুষের আস্থাভাজন ও পরীক্ষিত নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর এই উদ্যোগ মানুষ ও দেশ বাঁচানোর পথ-পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হত কি না, তা প্রমাণে বঙ্গবন্ধু হাতে সময় পাননি। তবে, আমার মনে হয়, বঙ্গবন্ধু জনগণের স্বার্থ থেকে দূরবর্তী অবস্থানে থাকেননি, বেঁচে থাকলে সেই সময়ে বরং জনগণের ত্রাণকর্তা হিসেবেই ভূমিকা রাখতেন। বঙ্গবন্ধুর মধ্যে সেই কালপোযোগী যোগ্যতা ও স্বপ্ন ছিল বলেই মনে হয়।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এক কালো অধ্যায়। তাঁকেসহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হয়, পরবর্তী সময়ে তাঁর বিশ্বস্ত অনুসারী জাতীয় নেতাদের হত্যা করা হয়। যে কোনো দেশের গণতন্ত্র তার নিজস্ব মূলভূমির আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী বিকশিত হয়। সে ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাংলাদেশের মানুষের চেতনার মূল ভিত্তি। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে জাতীয় চরিত্র গঠনের সম্ভাবনা ও প্রণোদনা মানুষের কণ্ঠলগ্ন ছিল; এক ধরনের অর্থনৈতিক সাম্য জনগণের জীবনকে বিকশিত করবে– এমন আকাঙ্ক্ষাও ছিল। আর এসবের মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু।

তাঁকে হত্যার পর গণতন্ত্রের বিভিন্ন দিক বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে যে শূন্যতা তৈরি হল– সেই শূন্যতার কারণে আমাদের বহু ধরনের অগণতান্ত্রিক ও রক্তাক্ত অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছে। গণতন্ত্র বিকাশে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিষয়টি এখনও সংকট হিসেবেই বারবার ফিরে আসে। যারা হত্যাকারী ছিল তারা মুক্তিযুদ্ধের মূল ভূমি থেকে উৎসারিত গণতান্ত্রিক বিকাশ রুদ্ধ করেছিল– সেই ধারা কখনও শক্তিশালী হয়েছে, কখনও ক্ষীণ হয়েও চোরাপথে আঘাত হেনেছে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর মোশতাক চক্র থেকে শুরু করে জিয়ার আমলে সামরিক শাসন, 'হ্যাঁ'-'না' ভোট ও নিয়ন্ত্রিত ভোটের মাধ্যমে শাসন চলেছে। এই সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উৎসভূমি থেকে উৎসারিত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে যে চেতনার বিকাশ হওয়ার কথা ছিল, তার বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি এবং ১৯৭৫ সালের হত্যাকারীদের পুনর্বাসন করা হয়।

১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়ার যে ২৪ জন উপদেষ্টা ছিলেন, তাদের অনেকেই অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকতা। ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদের নির্বাচনে খানিকটা ভোটের অধিকার নিয়ে জনগণকে ভোট দিতে দেখা যায়। যদিও সংসদ হল, তবু সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের দখলেই ছিল পুরো প্রশাসন। জিয়ার আমলে ঘরোয়া রাজনীতি, সীমাবদ্ধ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, কারফিউ-শাসিত শাসন, ক্যু ও পালটা ক্যু, সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বিচারের নামে হত্যা, রাজনৈতিক নেতাদের জেলে পাঠানো– এসব ছিল নিত্য-সহচর।

এরশাদের আমলেও সামরিক সদস্যদের বিচারের নামে হত্যা, সীমিত পর্যায়ে গণতান্ত্রিক সুযোগসুবিধা, পরবর্তী সময়ে কারচুপির নির্বাচনের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তার আমলে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ছিল সামরিক, বেসামরিক কর্মকর্তা ও দলছুট নেতাদের হাতে। দীর্ঘ দশ বছর এরশাদের আমলে একনায়ক শাসন চলেছে ধর্মের লেবাসে ও মিথ্যার বেসাতি দিয়ে।

স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়, অনেকে শহীদ হন। এই আন্দোলনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, সিপিবিসহ বিভিন্ন সংগঠন জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করে বিজয়ী হয়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে কবি-সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা অগ্রগামী ভূমিকা পালন করে। এঁদের কারণে এই আন্দোলন আরও বেগবান হয়।

এরশাদের পতনের পর অনেক আশা নিয়ে গণতান্ত্রিক চেতনানির্ভর রাজনৈতিক পরিবেশ উজ্জ্বল হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এরশাদ-পরবর্তী সময়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতায় এসে গণতান্ত্রিক আবহাওয়া বজায় রেখে পাঁচ বছর সরকার পরিচালনা করে। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগও পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে গণতান্ত্রিক পরিবেশ অনেকটা অনুকূলে রেখে দেশ শাসন করে।

ওই দশ বছর দুদলের নেতৃত্বে এ দেশের পরিপ্রেক্ষিতে মোটামুটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রেখে গণতন্ত্রকে সংহত করার সুযোগ ছিল। এই সম্ভাবনা ও মনস্তাত্ত্বিক শক্তি অর্জন হয়েছিল নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। অনেকটা সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর বা সরকার বদল হলেও যে শ্রেণির হাতে ক্ষমতা ছিল, তারা তাদের যোগ্যতা, উদারতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ দিয়ে নিজেদের দল, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনিকব্যবস্থা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে গড়ে তুলতে পারেনি। এর ফলে এই দুদলের শাসনামলে ক্ষমতায় থাকা নেতৃত্ব ও সুবিধাভোগী শ্রেণি গণতন্ত্রের জমিতে স্বৈরতন্ত্রের বীজ অঙ্কুরিত করতে থাকে এবং পরবর্তী সময়ে তা পল্লবিত হতে থাকে।

খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দ্বিতীয় পর্যায়ের আরও পাঁচ বছরের শাসনামল ছিল আগের চেয়ে তুলনামূলকভাবে অগণতান্ত্রিক, ছিল ক্ষমতালোভী হয়ে ওঠার জন্য কর্তৃত্বপরায়ণ বিভিন্নমুখী ভূমিকা আর উন্নাসিক আচরণ। এই সুযোগে ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তি অবাধ বিচরণের জায়গা পেয়ে যায়। সিপিবির পল্টনের জনসভায় বোমা মেরে সিপিবির কর্মীদের হত্যা, পয়লা বৈশাখে রমনার ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা মেরে সাংস্কৃতিক সচেতন মানুষকে হত্যা, যশোরে উদীচীর সম্মেলনে সাংস্কৃতিক কর্মীদের হত্যাসহ আরও হত্যা চলতে থাকে।

এরপর ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় শেখ হাসিনাকে হত্যা করার লক্ষ্যে গ্রেনেড হামলা; এতে বহুজন হতাহত হওয়ার পরও শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে যান। এসব ঘটনার মধ্যে দিয়ে বিএনপি ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য মরিয়া হয়ে ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য নিয়ে ভয়ংকর হয়ে ওঠে। ক্ষমতাভোগী বিএনপির ছোট গোষ্ঠীটি বিএনপির গণতান্ত্রিক অংশকেও গ্রাস করে ফেলে, পরবর্তীতে দেশের গণতন্ত্রকেও।

নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে গণতন্ত্রের অভিমুখে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা পুরোপুরি বিধস্ত হয়ে যায়। এরপর সমরিক হস্তক্ষেপ– 'এক-এগারো'। তবে, একটি গ্রহণযোগ্য এবং অনেক দিক থেকে তুলনামূলক ভালো জাতীয় সংসদের একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।

কিন্তু ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ফলে এবং অন্যান্য বাস্তবিক কারণেই বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের যে আস্থাহীনতার সংকট সৃষ্টি হয়, তা দিন দিন প্রকট হয়ে ওঠে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ ধরে রাখার জন্য বিশ্বাস ও সহনশীলতার প্রয়োজন, তা এমন পরিস্থিতিতে ক্ষীণ হতে থাকে। এর ফলে প্রকটভাবে মনস্তাত্বিক সংকট তৈরি হয়।

এ ছাড়া রয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির সঙ্গে বিএনপির গাঁটছড়া, তাদের ব্যবহার করে আওয়ামী লীগকে আঘাত হানার কৌশল, যেনতেন প্রকারে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার চেষ্টা। এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগও বিভিন্ন কৌশলে বিএনপিকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ নিচ্ছে। এমন পরিস্থিতি গণতন্ত্রকে গভীর সংকটে ফেলে দিচ্ছে।

নৈরাজ্যের মধ্যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। আওয়ামী লীগ পুনর্বার ক্ষমতায় থাকল এ ধরনের 'নির্বাচন'-এর মধ্যে দিয়ে, কিন্তু তা গণতন্ত্রের জন্য কম ক্ষতিকর হল না। এর পর বিএনপির হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড ও নৃশংসভাবে মানুষ হত্যা করার রাজনীতি এ দেশের গণতান্ত্রিক পথচলা আরও বিপদগ্রস্ত করে তোলে।

এ রকম পরিস্থিতিতে জনগণ তাদের জীবন-জীবিকার কারণে রাজনীতি থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে অনেক সময়ে নিস্পৃহ হয়ে ওঠে। রাজনীতিকেও উপেক্ষা করতে শুরু করে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ কমে যায়। নাগরিকরা রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক কর্মকাণ্ডে তখনই উৎসাহিত হয়, যখন দেখে তাদের ভূমিকা বাস্তবে কার্যকর হচ্ছে।

বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে জনগণের ব্যাপক মোহমুক্তি ঘটছে। এই অবস্থার পরিবর্তন না করতে পারলে গণতন্ত্র আরও বিপন্ন হয়ে উঠবে। এমন পরিস্থিতিতে গণতন্ত্রের চেহারায় একনায়কতন্ত্রের ছাপ দৃঢ় হতে থাকে, তা একধরনের বিপর্যয় তৈরিতে অনেক সময় সাহায্য করে।

এমনিতে এ দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের সীমিত চর্চায় বারবার ভোটে অংশ নিয়ে বৃহত্তর জনগণ একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর কাছে বন্দী হয়ে পড়ে। এই গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে লুটপাট করার প্রবণতায় এমনভাবে উদগ্রীব থাকে যে জনগণ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এই গোষ্ঠী তাদের ব্যক্তি স্বার্থকে জাতীয় স্বার্থের উপরে স্থান দিয়ে থাকে। আর অন্যদিকে শাসকদলের মধ্যে যে গোষ্ঠী ক্ষমতার কেন্দ্রভূমিতে থাকে, তারা আদর্শ, নৈতিকতা ও জাতীয় স্বার্থ দ্বারা কতটুকু পরিচালিত হয় তার ওপরও গণতন্ত্রের অভিযাত্রা অনেকটা নির্ভর করে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দলে গণতন্ত্র, নির্বচন কমিশন ঢেলে সাজানো ও নির্বাচন-বিধি পরিবর্তন ছাড়াও নতুন রাজনৈতিক শক্তি ও নেতৃত্ব প্রয়োজন। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করার জন্য জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাও প্রয়োজন। শুধু অতীত-আশ্রয়ী না হয়ে ভবিষ্যৎমুখী উদ্যোগ গ্রহণে সক্রিয় হওয়ার মানসিকতা জরুরি হয়ে পড়েছে।

আজকের সময়ে জগতের রূপান্তর ঘটেছে, মানুষ এগিয়েছে। মানুষের মনোজগতের পরিবর্তন হয়েছে; আশা ও আকাঙ্ক্ষারও বদল ঘটছে। চাহিদা বেড়েছে প্রবহমান জীবনে। মানুষের দাবি মেটানোর জন্য এই রাষ্ট্র ও সরকার কতটুকু প্রস্তুত ও সামর্থ্য রাখে তা-ও বিবেচনায় এনে গণতান্ত্রিক রূপবিন্যাসে এর প্রতিফলন ঘটানো বড় একটা চ্যালেঞ্জ। তবে মানুষের মধ্যে একধরনের শক্তি রয়েছে তা দ্বারা একটি খারাপ ব্যবস্থা পরিহার করে ভিন্ন একটি ভালো ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হয়। মন্দ অবস্থা কাটানোর পর ভালো অবস্থাও তৈরি হয়, আবার তা নতুন করে মন্দ অবস্থা তৈরি করতে পারে।

এ এক দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া। একটি ব্যবস্থা বিচার করার মানদণ্ড হওয়া উচিত– সেই ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট দেশে জনগণের কল্যাণে কতটুকু সাহায্য করে এবং অধিকাংশ জনগণের কাছ থেকে তা সমর্থিত কি না। জনগণ যদি সেই ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ না করে, সমর্থন না করে, তবে তা হয়ে উঠবে অপশাসন ও অগণতান্ত্রিক।