সম্পর্ক, বিয়ে; অতঃপর…

সীনা আক্তার
Published : 8 August 2016, 03:19 PM
Updated : 8 August 2016, 03:19 PM

টাইমস অব ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী ভারতের শহুরে দম্পতিদের অনেকেই মধুচন্দ্রিমা থেকে ফিরে এক মাসের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ওই প্রতিবেদনে ছাপা হওয়া বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদনকারী এক নারীর ভাষ্য এমন: "বিয়ের আগে আমরা তিন বছর মেলামেশা করেছি। কিন্তু আমাদের মধুচন্দ্রিমার (হানিমুন) সময় ওর মধ্যে অদ্ভুত রকমের পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। ওর প্রত্যাশা ছিল, ওর যাবতীয় কাজ আমি করে দেব। কিন্তু একটা সময়ের পর এটা আমার কাছে অসহ্য বলে মনে হল। ঠিক করলাম, এর চেয়ে দুজনে আলাদা হয়ে যাওয়াই শ্রেয়।"

বলাই বাহুল্য, আমাদের দেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় অধিকাংশ পুরুষ মনন-মতাদর্শে এক একজন 'ব্যাটা'। এই ব্যাটা স্বামীরা বিয়ের পর নিজেকে সংসারের প্রধানকর্তা হিসেবেই দেখে এবং স্ত্রীর ওপর কর্তৃত্ব করা নিজেদের অধিকার মনে করে।

বিয়েপূর্ব ভালোবাসার মানুষটির এ ধরনের পরিবর্তন অনেক স্ত্রীর পক্ষেই মেনে নেওয়া কষ্টকর। তাছাড়া, এই কর্তৃত্ব-নিয়ন্ত্রণ প্রায়ই নির্যাতন-নিপীড়নের সূত্রপাত ঘটায়। এসব কে-বা পছন্দ করে! বিয়েপূর্ব প্রত্যাশা এবং বাস্তবতার মধ্যে ব্যবধানের কারণে বিরোধ এবং অসুখী দম্পতির সংখ্যা আমাদের দেশেও কম নয়। তবে এমন পরিস্থিতিতে নারীরাই অধিক ভুক্তভোগী।

দুজন মানুষের মধ্যে অনেক বিষয়ে মতবিরোধ ও অসন্তুষ্টি সৃষ্টি হতে পারে। যেমন: অসংবেদনশীলতা, কর্তৃত্ববাদী আচরণ, কৃপণতা, প্রতারণা, শিষ্টাচার, ক্রোধ, মিথ্যা বলা ইত্যাদি। আমাদের দেশে বিয়ে মানে দুই পরিবারের সম্পর্ক এবং সে ক্ষেত্রে পরিবারের অন্য সদস্যদের মানসিকতা, মূল্যবোধ, আচার-আচরণ বিবাহিত দম্পতির সম্পর্ক প্রভাবিত করে; নেতিবাচক ও ইতিবাচক দুভাবেই।

অনেক স্বপ্ন নিয়ে একজন নারী নতুন জীবন শুরু করে। কিন্তু অনেকেই বিয়ে-পরবর্তী স্বামী-শ্বশুরকুলের অযাচিত কর্তৃত্ব, আবদারের সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খায়। পরিণামে সংঘাত ও স্বপ্নভঙ্গ; পরবর্তীতে বিচ্ছেদ অথবা অসুখী দাম্পত্যের ঘানি টানা। এমনকি জানাশোনা এবং প্রেমের বিয়েতেও এমনটা ঘটে।

দম্পতি-বিষয়ক মনস্তাত্ত্বিক পিটার পিয়ার্সনের (Peter Pearson) মতে, "একই 'মূল্যবোধ' ধারণ করে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া হচ্ছে সম্পর্কের 'পবিত্র ঈপ্সিত বস্তু' এবং এটাই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে।"

[Finding someone who shares the same core values as you is the holy grail of relationships and will make a partnership sustainable.]

অথচ আমাদের দেশে বিয়ের ক্ষেত্রে সাধারণত ছেলের শিক্ষাগত যোগ্যতা, সম্পদ এবং সামাজিক অবস্থা গুরুত্ব পায়; সে তুলনায় মূল্যবোধ-আদর্শ, সংবেদনশীলতা এবং সামাজিক যোগ্যতা অনেকটাই উপেক্ষিত। এর ফলে, অনেক নারী বিয়ে-সংশ্লিষ্ট প্রতারণা, নিপীড়ন ও লাঞ্ছনার শিকার হন।

সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিক সঙ্গী নির্বাচনে বিয়ের পূর্বে একে অপরকে জানাশোনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কীভাবে?

আয়োজন করা বিয়েতে আমাদের সমাজের প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে, প্রাথমিক পছন্দের পর কয়েকদিন দুজনের একসঙ্গে বাইরে বেড়ানো, সিনেমা দেখা বা রেস্তোরাঁয় খাওয়া। প্রেমের বিয়েতেও তা-ই হয়; তফাত শুধু সময়ের পরিমাণ।

প্রেমের বিয়েতে বিয়েপূর্ব অধিক সময় ঘোরাঘুরি চলে। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই ওই নির্দিষ্ট সময়ে দুজনেই পরস্পরের সামনে সবচেয়ে ভালোভাবে নিজেকে উপস্থাপন করে এবং সর্বোচ্চ 'পারফরমেন্স' দিয়ে একে অপরকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করে।

এই নির্দিষ্ট সময়ে দেখাসাক্ষাতে পরস্পরকে উপলদ্ধি করা, একজন মানুষের পারিবারিক মূল্যবোধ অনুধাবন করা কঠিন; অনেক সময় অসম্ভব। বিশেষ করে, যেসব বিয়ে পারিবারিকভাবে আয়োজন করা হয়।

উদার সমাজব্যবস্থায় প্রেমিক-প্রেমিকার বিয়েপূর্ব 'একত্র-বসবাসের' (Living Together) সুযোগ আছে। অনেক যুগল এই ব্যবস্থায় দীর্ঘদিন একসঙ্গে বসবাস করে। অনেকে বিয়ের আগেই বাচ্চা নেয় এবং সুবিধামতো সময়ে বিয়ে করে। এই ব্যবস্থার পক্ষে দর্শন হচ্ছে, একসঙ্গে বসবাসে একে অপরের মূল্যবোধ, আদর্শ, পছন্দ-অপছন্দ এবং ভালোবাসার গভীরতা ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায় এবং তাতে দম্পতিদের মধ্যে কম ঝামেলা হয়।

বিতর্ক হতে পারে তাদের সম্পর্ক/বিয়ের স্থায়িত্ব নিয়ে। এটা ঠিক যে, এই ব্যবস্থায়ও অনেকের বিচ্ছেদ হয়। তবে তারা যতদিন একসঙ্গে থাকে ততদিন অধিকাংশই আনন্দময় সময় কাটায়। অন্যদিকে আমাদের সংস্কৃতিতে দীর্ঘ বিবাহিত জীবনের সুনাম আছে, কিন্তু এই জীবনের অন্তরালে অনেক নারীর বেদনা, বঞ্চনা এবং নির্যাতনের করুণ কাহিনিও কম নয়; যা অব্যক্ত থেকে যায়।

একত্র-বসবাসের সুফল থাকলেও আমাদের সমাজ-সংস্কৃতিতে তা স্বীকৃত নয়। তাছাড়া, পুরুষতান্ত্রিক সমাজকাঠামোর কারণে আমাদের দেশে নারী-পুরুষের অবস্থান এখনও ভারসাম্যহীন। সেজন্য একত্র-বসবাস ব্যবস্থায় নারী নির্যাতন ও শোষণ বৃদ্ধির সম্ভাবনা প্রবল।

কিন্তু বিয়ে-পূর্ব সঙ্গীর মূল্যবোধ-আদর্শ-শিষ্টাচার এবং সম্পর্ক যাচাইয়ের বর্তমান পদ্ধতির আমূল সংস্কারও আবশ্যক মনে করি। আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির আলোকেই সে সংস্কার হতে হবে। এ বিষয়ে আমার প্রস্তাব:

আয়োজিত বা প্রেমের বিয়ে যা-ই হোক, প্রাথমিক সিদ্ধান্তের পর ছেলে এবং মেয়ে দুজনেই পরস্পরের বাবা-মায়ের বাড়িতে তিন থেকে পাঁচ দিনের জন্য অতিথি হবে। চাইলে সঙ্গে একজন বন্ধু/আত্মীয় নিতে পারে। তবে মেয়েদের অতিথি হওয়াটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, অধিকাংশ সময় মেয়েরাই নিপীড়নের শিকার হয়।

মেয়ে যখন ছেলের বাড়িতে অতিথি হবে সে সময় হবু বর তার পরিবার ব্যবস্থাপনা করবে। বরটি অন্তত একদিন বাড়ির জন্য বাজার করবে এবং রান্না করতে পারলে আরও ভালো। অতিথিসহ সবার জন্য সঠিক সময়ে খাবার এবং সংসারের দৈনন্দিন কাজকর্মের দেখভাল নিশ্চিত করবে।

মেয়ের পর্যবেক্ষণের বিষয় হবে, হবু বর পারিবারিক পরিবেশে কতটা দায়িত্বশীল। যেমন: বাজার করা, রান্না করার দক্ষতা, বাড়িঘর সামলানো এবং কাজের লোকসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের প্রতি কতটা সহানুভূতিশীল, সে কতটা আত্মনির্ভরশীল, উদার এবং নির্ভরযোগ্য।

ঘরোয়া-বিষয়ক কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এবং ছোটখাটো সমস্যা সমাধানে সে কতটা দক্ষ, আত্মবিশ্বাসী বা অন্যের দ্বারা কতটা প্রভাবিত ইত্যাদি। সে কি কর্তৃত্ববাদী নাকি অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

উল্লেখ্য, যে কর্তৃত্ববাদী এবং যে অন্যের কর্তৃত্ব হজম করে– এ দুদলই বিপদজ্জনক। যেমন: যে ছেলে তার স্বজন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, ওই ছেলের স্ত্রীর ওপর সেই স্বজনরা কর্তৃত্ব করা জায়েজ মনে করে।

এ প্রক্রিয়ায় অতিথি মেয়ে হবু শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে অবহিত হবে; সেই পরিবারের মূল্যবোধ-আদর্শ-সংস্কৃতি এবং জীবনাচার সম্পর্কে ধারণা নেবে। একইভাবে সে বাড়ির লোকজনও অতিথির আচার-আচরণ, ব্যক্তিত্ব, সংবেদনশীলতা এবং দায়িত্বশীলতা সম্পর্কে একটা ধারণা পাবে।

একইভাবে ছেলে হবু কনের বাড়িতে অতিথি হবে। এই আতিথ্য-পর্বে ছেলে ও মেয়ে একই বাড়িতে সহ-অবস্থান (Staying Together) করবে। এতে বিয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে, অথবা মত পরিবর্তন হতে পারে; দুপক্ষকেই তা সহজভাবে মেনে নিতে হবে।

এই পদ্ধতির সুফল অনুধাবনে একটা তুলনামূলক ক্লাসিক উদাহরণ হতে পারে হুমায়ূন আহমেদ, গুলতেকিন খান ও মেহের আফরোজ শাওন।

বিয়ের পূর্বে গুলতেকিন খুব সীমিত সময়ের জন্য হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছিলেন, যা হয়তো পরস্পরকে বোঝার জন্য যথেষ্ট ছিল না। অন্যদিকে পরিচয়ের পর হুমায়ূন আহমেদ ও শাওন দীর্ঘদিন একসঙ্গে কাজ করেছেন। কাজের জন্য শাওন নুহাশপল্লীতে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে অবস্থান করেছেন। এতে তাদের পরস্পরের মূল্যবোধ, পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে ভালো বোঝাপড়া হয়েছে। এঁদের সম্পর্কের পরিণতি আমরা সবাই জানি।

আমাদের নানি-মা-খালারা বিয়েপূর্ব পরস্পরকে জানাশোনার কথা চিন্তাই করতে পারতেন না। সময়-পরিক্রমায় সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে।

অনেক মেয়ে এখন শিক্ষা, আর্থিক এবং সামাজিকভাবে স্বাবলম্বী। এর ফলে তারা আত্মবিশ্বাসী এবং ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে সচেতন। নিপীড়নমূলক সম্পর্ক, স্বামীর অন্যায় কর্তৃত্ব এবং অবমাননাকর আচরণ মুখ বুজে সহ্য করার কুসংস্কৃতি তারা চ্যালেঞ্জ জানাতে সক্ষম।

অধিকাংশ মেয়ে নিজেই পছন্দ করে সঙ্গী বাছাই করে। অনেকে দীর্ঘ সময় নিয়ে হবু বরকে বোঝার চেষ্টা করে। কিন্তু তাতে সব সময় স্বপ্ন পূরণ হয় না। পরস্পরের প্রতি সম্মান, ভালোবাসার গভীরতা, একে অপরের মূল্যবোধ-আদর্শ-নীতি, যতটা সম্ভব সঠিকভাবে উপলদ্ধির জন্য আরও এক ধাপ অগ্রসর হওয়াটা জরুরি। যেমন: একসঙ্গে অবস্থান করা (Staying Together)।

আশা করি, সঠিক সঙ্গী বাছাইয়ে আমাদের মেয়েরা আরও সাহসী হবে। কারণ, আত্মবিশ্বাসীরাই সমাজ সংস্কারে ভূমিকা রাখে।

কোনো পদ্ধতিই নিখুঁত নয়। তাই এ পদ্ধতিতে সব সময় সফলতা আসবে– এমনটা মনে করা ঠিক হবে না। তবে এতে হয়তো সঠিক সঙ্গী নির্বাচনে সুবিধা হবে এবং বৈবাহিক প্রতারণা ও নিপীড়ন প্রতিরোধ করা যাবে। বিশেষ করে, দাম্পত্য জীবনে ছেলেদের সমর্থন এবং সহযোগিতামূলক মানসিকতার উন্নতি হবে।