বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের গতিমুখ

হায়দার আকবর খান রনো
Published : 22 Nov 2007, 05:40 PM
Updated : 8 May 2010, 08:19 AM

বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলন আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। শ্রমিক বলতে প্রধানত গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিক। পাকিস্তান আমল থেকে এই দেশে যে ট্র্যাডিশনাল শিল্প ছিল, যেমন পাটকল, বস্ত্রকল ও চিনিকল তা প্রায় বিলুপ্ত হবার পথে। আদমজিসহ বড় বড় জুট মিল এখন একেবারে বিলুপ্ত অথবা বন্ধ রয়েছে। টঙ্গি অথবা শীতলক্ষ্যা পারে যে সুতা ও কাপড়ের কারখানা ছিল, সেগুলি এখন জনশূন্য, নিষ্প্রাণ। বিশ্বায়নের প্রভাবে এক ধরনের বি-শিল্পায়ন ঘটেছে নব্বই-এর দশকে, তবে শ্রমিক সংখ্যা হ্রাস পায়নি, বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষিশ্রমিক বাদ দিলেও প্রাতিষ্ঠানিক ও ইনফরমাল প্রতিষ্ঠানের মোট শ্রমিকের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও তা যে এক কোটির উপর হবে এটা বলা চলে।

বাংলাদেশের শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে এক ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তনও সাধিত হয়েছে গত দেড়-দুই দশকে। বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়লেও, ছোট ও মাঝারি শিল্প তৈরি হয়েছে অনেক। এই সকল শিল্পের মালিকরা নতুন; শ্রমিকও নতুন প্রজন্মের। তার মধ্যে নারীশ্রমিকের প্রাধান্য বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।

সবচেয়ে বড় শিল্প খাত হল গার্মেন্টস। প্রধানত ঢাকা ও চট্টগ্রাম দুটি বড় শহরে ও তার আশেপাশে রেডিমেড গার্মেন্টসের কারখানাগুলো অবস্থিত। গার্মেন্টস শিল্পে নিয়োজিত আছে প্রায় তিরিশ লাখ শ্রমিক, যার ৮০ শতাংশ নারী, যাদের গড় বয়স ১৭ বছর মাত্র। আগের জুট মিল বা টেক্সটাইল মিল ঘিরে থাকত শ্রমিক কলোনি। ঢাকার আদমজি, ডেমরা, শীতলক্ষ্যার পার অথবা টঙ্গিতে ছিল শ্রমিক কলোনি। হাজার হাজার শ্রমিক একসঙ্গে বাস করত, যা ছিল শ্রমিক আন্দোলনের জন্য বড় শক্তি। এখন আর সে রকম শ্রমিক কলোনি নেই। তবে ঢাকার আশেপাশে কয়েকটি অঞ্চলে গড়ে উঠেছে গার্মেন্টস পল্লী বা শ্রমিক-বস্তি, যেখানে নানা কারখানার শ্রমিক একত্রে গাদাগাদি করে বাস করে। এই শ্রমিকদের পাঁচ শতাংশও সংগঠিত নয়।

অন্যদিকে মালিকরাও আধুনিক বুর্জোয়া হয়ে উঠতে পারেনি। তাদের মধ্যে সামন্ত মানসিকতা কাজ করে। তারা কোনোভাবেই ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন মেনে নিতে রাজি নয়। তারা প্রধানত আদিম কায়দায় শোষণ করতে অভ্যস্ত ও স্বভাবগতভাবে লুটেরা চরিত্রের। ফলে গার্মেন্টস শিল্পে শোষণের হারও বেশি, কারখানার পরিবেশও অমানবিক ও অস্বাস্থ্যকর। ফলে স্বাভাবিক ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন বিকশিত না হয়ে বার বার স্বতঃস্ফুর্ত অভ্যুত্থান ঘটছে। সাম্প্রতিক সময়ে শ্রমিক অঙ্গন যে আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, তা কোনো অস্বাভাবিক ও নতুন ঘটনা নয়।

গার্মেন্টস শিল্পে নূন্যতম মাসিক পাঁচ হাজার টাকা মজুরির দাবি উঠেছে। এ ব্যাপারে শ্রমিকদের মধ্যে সাধারণ ঐকমত্য লক্ষ্য করা গেছে। জাতীয় পর্যায়ে যে সকল শ্রমিক সংগঠন আছে, তারা সকলেই এই দাবির প্রশ্নেও একমত হয়েছেন। আজকের বাজারদর হিসাব করলে এই দাবি খুবই ন্যায়সঙ্গত। আইএলও কনভেশনে উল্লেখ আছে, একজন শ্রমিকের নূন্যতম কতটা পুষ্টি দরকার। এমনকি সাবান ইত্যাদিও কতটা দরকার। তা-ও উল্লিখিত আছে। সেই সব হিসাব করলে শ্রমিকের মজুরি আরও বেশি হওয়া উচিত।

এখানে আরও উল্লেখ্য যে, ট্রাডিশনাল পাট ও বস্ত্র শিল্পে শ্রমিকদের জন্য থাকার কলোনি, চিকিৎসা ভাতা ইত্যাদি ফ্রিজ বেনিফিটের ব্যবস্থা ছিল যা পাকিস্তান আমলে শ্রমিকরা অনেক সংগ্রাম করে আদায় করেছিল তা আজকের গার্মেন্টস শিল্পে অথবা নতুন গজিয়ে ওঠা কারখানাসমূহে অনুপস্থিত রয়েছে। তাই সব মিলিয়ে, শ্রমিকের ঘর ভাড়া, ওষুধ ও চিকিৎসা খরচ, নূন্যপক্ষে চারজনের এক পরিবারের জন্য মাসিক পাঁচ হাজার টাকা মোটেই বেশি নয়।

মালিকরা পাল্টা হুমকি দিচ্ছে যে, নূন্যতম মজুরি এত বেশি হলে তারা নাকি কারখানা বন্ধ করে দেবে। এটা আসলে ফাঁকা হুমকি। কারণ হিসাব করে দেখা গেছে যে, পাঁচ হাজার টাকা নূন্যতম মজুরি এবং সেই অনুপাতে অন্যান্য স্কেলের মজুরি ও পিস রেটের দাম নির্ধারণ করলেও মালিকের মোটা মুনাফা থাকবে। ২০০৬ সালের জুন মাসে এক বিরাট শ্রমিক অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সেদিন প্রথমবারের মতো সরকারের টনক নড়েছিল। তারা গার্মেন্টস শিল্পে নূন্যতম মজুরি নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি নিয়োগ করেছিল যেখানে সকলেই ছিল মালিকের প্রতিনিধি অথবা মালিকপক্ষের প্রতি সহানুভূতিশীল। নাজমা নামে একজন শ্রমিক নেত্রী ছিলেন, কিন্তু তিনি সরকার কর্তৃক মনোনীত।

সেই কমিটি নূন্যতম মজুরি নির্ধারণ করেছিল মাসিক মাত্র ১৬৬২ টাকা ৫০ পয়সা। সেদিন কোনো শ্রমিক সংগঠন এটা মানেনি। তথন দাববি ছিল তিন হাজার টাকার নূন্যতম মজুরির। পাঁচ বছর পর মুদ্রাস্ফীতি হিসাব করলে এখন পাঁচ হাজার টাকা খুবই যুক্তিসঙ্গত।

এরপর আসা যাক শ্রম দিবস প্রসঙ্গে। বাংলাদেশে শ্রম আইনে এ সম্পর্কে সুসঙ্গত বিধান আছে। তা হল–

১. সপ্তাহে ছয়দিন শ্রমিকরা কাজ করবেন, প্রতিদিন আট ঘণ্টার বেশি নয়;

২. দুই ঘণ্টা ওভারটাইম কাজ করানো যেতে পারে, কিন্তু কোনোক্রমেই তার বেশি নয়, অর্থাৎ কোনো অবস্থাতেই ১০ ঘণ্টার অতিরিক্ত হতে পারবে না;

৩. এই অতিরিক্ত দুই ঘণ্টার জন্য শ্রমিককে দ্বিগুণ মজুরি দিতে হবে;

৪. কোনো অবস্থাতেই মিল কর্তৃপক্ষ জোর করে অর্থাৎ শ্রমিকের সম্মতি ব্যতিরেকে ওভারটাইম কাজ করাতে পারবে না।

এটা জোরের সঙ্গে বলা যায় যে, ব্যতিক্রমহীনভাবে কোনো গার্মেন্টস কারখানায় এই আইন মানা হয় না। শ্রমিককে জোর করে ১৬/১৮ ঘণ্টা, এমনকি তার চেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে বাধ্য করা হয়। আর দ্বিগুণ মজুরিও দেওয়া হয় না। বস্তুত কারখানায় এক ধরনের শ্রম-দাসত্ব চলছে।

কারখানার পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর। ব্যবস্থাপনাও অমানবিক। অধিকাংশ কারখানায় মহিলা শ্রমিকদের পর্যন্ত বাথরুমে যাবার জন্য পাঁচ মিনিট ছুটি দিতেও চায় না কর্তৃপক্ষ। এছাড়া দৈহিক নির্যাতন, গালিগালাজ ও এমনকি যৌন নিপীড়নের ঘটনাও আছে। বস্তুত নব্য ধনীক যারা কারখানার মালিক হয়েছে, তাদের সাংস্কৃতিক মানও সাধারণভাবে বেশ নিচু।

গার্মেন্টস কারখানায় আগুন লাগার ঘটনাও অনেক। গত এক দশকে প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক আগুনের কারণে মারা গেছেন। কারখানায় বৈদ্যুতিক সর্ট সার্কিটের কারণে আগুন লাগে। এটি দুর্ঘটনা। অবশ্য এ ক্ষেত্রেও মালিকের অসাবধানতা দায়ী। কিন্তু তার চেয়ে বড় অপরাধ তারা যেটা করে তা হল, তারা বের হবার প্রধান গেট বন্ধ রাখে। তার উপর অপ্রসস্ত সিঁড়ি ও করিডোর হওয়ার ফলে পায়ের তলায় পিষ্ট হয়েও মারা গেছেন অনেক শ্রমিক। এই সকল অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য।

তাছাড়া শ্রম আইন লঙ্ঘন করার জন্য যে শাস্তির বিধান আছে, সেই শাস্তি এখনও পর্যন্ত কোনো মালিক পায়নি। দুয়েকজন মালিক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পেলে তারা হয়তো কিছুটা সচেতন হত।

আগেই বলেছি, এই মালিকরা নব্য ধনীক এবং মূলত লুটেরা চরিত্রের (তাই তারা কিছুতেই ট্রেড ইউনিয়ন মেনে নিতে রাজি নয়)। ফলে গার্মেন্টস কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করা খুবই কঠিন। শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন করার উদ্যোগ নিলে উদ্যোক্তাদের ছাঁটাই করা হবে, মিথ্যা মামলা দেবে এবং রাস্তায় ভাড়াটিয়া গুণ্ডাদের দিয়ে আক্রমণ করবে।

সম্প্রতি সরকার শ্রম আইন সংশোধন করে ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশনের জন্য যে বিধান করেছে তাতে আরও কঠিন হয়েছে ট্রেড ইউনিয়ন করা। এখনকার বিধান অনুযায়ী ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন পেতে হলে সরকারের শ্রম দফতর প্রথমে ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকর্তা ও সদস্যদের নাম মালিকের কাছে পাঠাবে এবং মালিকের সম্মতি নিতে হবে। অর্থাৎ ট্রেড ইউনিয়নকে মালিকের অধীনস্থ করার প্রয়াস। এতেই প্রমাণিত হয় সরকার কার স্বার্থে কাজ করছে!

বস্তুত এ যাবৎকালের সকল সরকার এবং প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলি যে ধনীক শ্রেণীর প্রতিনিধি ও শ্রমিক-বিদ্বেষী তার ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে।

শোষণ-নিপীড়ন যেখানে আছে সেখানে প্রতিরোধ গড়ে উঠবে, এটাই প্রকৃতির নিয়ম। তাই শ্রমিক আন্দোলন স্বাভাবিক ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের পথ না পেয়ে রাজপথ অবরোধ ও অভ্যুত্থানের পথ বেছে নিচ্ছে। মালিক ও সরকার বলার চেষ্টা করে যে এখানে নাকি কোনো তৃতীয় পক্ষের উস্কানিতে ভাঙচুর ইত্যাদি হচ্ছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীও এমন অভিযোগ করেছেন। বিদেশি এজেন্টের কারসাজি– এই অভিযোগে গত কেয়ারটেকার সরকারের আমলে একজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের হস্তক্ষেপের ফলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল সরকার।

কয়েক মাস আগে হামিম গ্রুপের একটি কারখানায় আগুন লাগিয়েছিল কতিপয় দুষ্কৃতকারী । জানা গেছে, তারা ঝুট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এবং তা নিয়ে কারখানার মালিকের সঙ্গে বিরোধ ছিল। তার মানে ওই অগ্নিসংযোগের ঘটনায় কোনো শ্রমিক নয়, বরং ঝুট ব্যবসায়ীই (যিনি আবার সরকারি দলের স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি) জড়িত। মোট কথা, শ্রমিক অসন্তোষের সুযোগ যে কেউ নিতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সাবোটাজ করছে মালিকরা নিজেরাই।

অন্যদিকে, শ্রমিকরা স্বতঃস্ফুর্ত জাগরণের মধ্য দিয়ে যে ধরণের ঐক্য ও সংহতির পরিচয় দিয়েছে তাতে প্রলেতারীয় বৈপ্লবিক  চরিত্রের প্রকাশ ঘটেছে। বিশেষ করে নারীশ্রমিকরা যেভাবে দলবদ্ধভাবে বাস করতে শিখেছেন, বদমায়েসদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে শিখেছেন এবং সর্বোপরি মালিকের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ও সংগ্রাম করতে অভ্যস্ত হয়েছেন, তাতে তারা যে প্রগতি ও নারীমুক্তির পথ দেখাবেন, সে আস্থা আমাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে।

তাই আমার বিশ্বাস, আগামীতে শ্রমিক আন্দোলনে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।


হায়দার আকবর খান রনো:
কমিউনিস্ট নেতা ও প্রাবন্ধিক।