হিমশৈলের লুকোনো অংশ

ওমর শেহাব
Published : 31 July 2016, 10:34 AM
Updated : 31 July 2016, 10:34 AM

গত কিছুদিন ধরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় এত কাণ্ড ঘটে গেছে যে আমাদের সবার মন খুব খারাপ। আমার প্রজন্মের মানুষেরা মনে হয় এখনই সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে।

এমনও হয়েছে যে আমার একাধিক বিয়ে করে ফেলা বন্ধু পর্যন্ত আমাকে বলেছে, এরকম পরিস্থিতিতে, এরকম ধূসর সময়ে কি একটি নতুন শিশুকে পৃথিবীতে আনা ঠিক হবে? তাদের মধ্যে সবাই যে বাংলাদেশি, তা-ও নয়। আমি কি উত্তর দেব বুঝতে পারিনি। হয়তো তারা আসলে আশাও করেনি– আমি কোনো উত্তর দিতে পারব কি না।

তবে যেটি সবচেয়ে আশার কথা তা হলো গুলশান আর কল্যাণপুরের ঘটনার পর সরকার ও গণমাধ্যম ভীষণ ধাক্কা খেয়েছে। কেন এত দেরি হলো সেটি অবশ্য আমার মাথায় এখনও ঢোকে না। এই ধাক্কা তো জিয়াউর রহমান যখন নিষিদ্ধ জামায়াতে ইসলামীকে আবার রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেছিল তখনই খাওয়ার কথা ছিল।

জঙ্গিবাদ কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটি অনেকদিন ধরে গোড়ায় পানি ঢেলে যাওয়া একটি গাছের ফল। সেই গাছের নাম কী? এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বভিত্তিক রাজনীতি। কারা করে এই রাজনীতি? আওয়ামী ওলামা লীগ, হেফাজতে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ইত্যাদি।

অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, সিনিয়রিটির বিচারে জামায়াতে ইসলামী আর বিএনপির নাম আওয়ামী ওলামা লীগের আগে আসা উচিৎ। কিন্তু মানুষকে বয়স দিয়ে বিচার না করে তার গুণগত মান আর সম্ভাবনা দিয়ে বিচার করা উচিৎ। শাহবাগ আন্দোলনের পরে সবাই জেনে গেছে, জামায়াতে ইসলামী আর বিএনপি আসলে আমাদের ইতিহাসের ভুল বাঁকে সৃষ্টি হওয়া কৃত্রিম বুদবুদ।

তাহলে যারা এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বভিত্তিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে তারা যাবে কোথায়? যদি তাদের মাথায় একটুও ঘিলু থাকে তাহলে তারা বুঝতে পারবে, তাদের উচিৎ আওয়ামী লীগের দখল ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা। এখন দেখা যাচ্ছে, তাদের মাথায় আসলেই কিছু ঘিলু আছে।

আমরা যখন স্কুলে যেতাম তখন যেসব রাজনৈতিক অবস্থান বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামীকে নিতে দেখা যেত এখন সেগুলো নিতে দেখা যায় আওয়ামী ওলামা লীগকে।

আমরা স্কুলে থাকতে পড়েছি সমুদ্রে ভেসে থাকা হিমশৈলের মাত্র দশ শতাংশ পানির উপরে দেখা যায়। একই কারণে কোকাকোলায় বরফের টুকরো দিলে খুব অল্প একটু ভেসে থাকে বাকিটা ডুবে থাকে।

এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বভিত্তিক রাজনীতি হলো পুরো হিমশৈলটি। আর এর ভেসে থাকা, দেখা যাওয়া ছোট্ট অংশটি হলো জঙ্গিবাদ। তাহলে পানির নিচে বিশাল লুকোনো অংশটিতে কি আছে? সেটি হলো, সেইসব মানুষ যারা এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বভিত্তিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে, কিন্তু নিরপরাধ মানুষের রক্তে হাত ভেজায় না। তাদের নৃশংসতা, নিষ্ঠুরতা আর ধর্মান্ধতার প্রকাশ ঘটে ভিন্নভাবে।

কেউ হয়তো সংবিধানে সব ধর্ম, বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের সমঅবস্থান না চেয়ে কোনো একটি বিশ্বাসকে প্রাধান্য দিতে চায়; কেউ হয় চাকরিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বৈষম্য করে, কেউ হয়তো বুদ্ধি করে বেছে বেছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু পরিবারের কন্যাদের রাস্তাঘাটে হেনস্থা করে, যাতে করে তাদের পরিবার ভারতে নির্বাসিত হতে বাধ্য হয়; কেউ হয়তো নিজেদের শিশু সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর সময় 'মালাউন', 'ডান্ডি' (চট্টগ্রামের কথ্য ভাষায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আড়ালে এভাবে ডাকা হয়) এবং লাল ও কালো পিঁপড়ার গল্প শিখিয়ে পাঠায়।

এই রক্তে হাত না ভেজানো এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বভিত্তিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করা মানুষেরা আমাদের সমাজেরই অংশ। এরা সমাজের সেই অংশটি গঠন করে যেটি ইনিয়েবিনিয়ে জঙ্গিবাদের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশটি তৈরি করে। এরাই একেকটি হত্যাকাণ্ডের পর 'যদি', 'কিন্তু'– এসব অব্যয় পদের বন্যা বইয়ে দেয়। এরা যদি না থাকত তাহলে হিমশৈলটি থাকত না, আর তার চূড়া– জঙ্গিবাদও থাকত না।

১৯৭১ সালে সবাই মুক্তিযুদ্ধে যায়নি, কিন্তু সবাই মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করেছিল। তারাই মুক্তিযুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল, প্রাণ দিয়েছে কিন্তু লুকিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধান জানায়নি, রাতের অন্ধকারে রান্না করে খাইয়েছে, যুদ্ধ শেষে ফিরে আসলে ভালবাসা দিয়ে বরণ করেছে।

সেই তুলনায় সংখ্যায় খুব নগণ্য হলেও এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বভিত্তিক রাজনীতিতে বিশ্বাসকারীদের মধ্যেও সেরকম স্তর আছে। তার মধ্যে খুব অল্পই গর্ভস্থ সন্তানসহ নিরপরাধ মাকে হত্যা করে। (গুলশানের সেই ইতালীয় নারীর কথা মনে আছে?) বেশিরভাগ সমাজের নিরাপদ অংশে থাকে আর জঙ্গিদের কাজকর্মে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে।

সবাই একটু মনে করে দেখতে পারেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে কতজনের বিচার হচ্ছে আর তাদের জন্য বড় বড় পত্রিকায় বিচার স্বচ্ছ আর নিরপেক্ষ না হওয়ার বানোয়াট ধুয়া তুলেছিল কতজন? দ্বিতীয় দলের লোক সবসময়ই বেশি থাকে। ভবিষ্যৎ জঙ্গিরাও এই দ্বিতীয় দল থেকে 'প্রমোশন' নিয়ে প্রথম দলে আসবে। দেখাই তো যাচ্ছে কত জঙ্গি জামায়াত শিবিরের গ্র্যাজুয়েট!

তাহলে এখন কি করতে হবে? গোড়ায় হাত দিতে হবে। যাদের হাতে অস্ত্র আছে, তাদের না হয় পুলিশ সামলাল কিন্তু স্কুলে যারা বাচ্চাদের 'মালাউন' আর 'ডান্ডি'– এসব শব্দ শিখিয়ে স্কুলে পাঠায় তাদের কারা সামলাবে?

আমাদেরই সেটি করতে হবে। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তো এসব শিশুর পরিবারের উপর গোয়েন্দাগিরি করা বাস্তবসম্মত নয়। কিন্তু সবার বাড়িতেই সরকার ঢুকে যেতে পারে পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে। আমাদের শুরু করতে হবে শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে।

এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বভিত্তিক রাজনীতির ভ্রান্ত আদর্শের মোকাবেলা করতে পারে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর একটি– ধর্মনিরপেক্ষতা!

এটিই হোক আমাদের পাঠ্যবইগুলো রচনার মূলমন্ত্র! এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বভিত্তিক রাজনীতির হিমশৈলটি গলে যাক, ফেটে যাক, তার চূড়া– জঙ্গিবাদ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক!