পুলিশকর্তার অভিমান ও পেশাদারিত্বের প্রশ্ন

খাদেমুল হক
Published : 30 July 2016, 03:33 PM
Updated : 30 July 2016, 03:33 PM

রাজধানীর কল্যাণপুরের জঙ্গিবিরোধী অভিযান নিয়ে কথা হচ্ছে অনেক রকম। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো তো রীতিমতো সরগরম, তাদের অনুসরণ করে মূলধারার মিডিয়াতেও আসছে অনেক খবর। আর সেসবের অনেকগুলোতে অনেকের মন্তব্যে এই অভিযানের সাফল্য নিয়ে সংশয়ের বহিঃপ্রকাশ দেখে একজন পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা ফেসবুকে পোস্ট করেছেন এক অভিমানী স্ট্যাটাস। পুলিশের মুখপাত্র হিসেবে টেলিভিশনে কথা বলতে বলতে এই ভদ্রলোক আগে থেকেই সারা দেশে এক চেনা মুখ; সংবাদকর্মীরাও তাঁকে চেনেন বলে খবরের বিষয় হিসেবে বেশ আলোচিত হয়ে উঠেছে তাঁর স্ট্যাটাস।

তাঁর স্ট্যাটাসটা পড়ে এবং এর আগে-পরের ঘটনাপ্রবাহ দেখে কিছু প্রশ্ন উঠেছে আমার মনে।

কেন এমন হচ্ছে? কল্যাণপুরে ঘটনাস্থলের আশপাশের বাসিন্দা, প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ যতখানি প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করলে অন্তত এই ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ খুবই কম। আগে থেকে খবর পেয়ে (বা না পেয়ে, ঢাকায় চলমান ব্লক রেইডের অংশ হিসেবে) ওই বাড়িতে তল্লাশি করতে গিয়েছিল পুলিশ। তখন বাড়ির ভেতর থেকে তাদের বাধা দিতে শুরু করেছে এক দল লোক। পুলিশ পুরো বাড়িটা ঘিরে রেখেছে সারা রাত, থেমে থেমে চলেছে গুলিবিনিময়, আর সারা রাতই মেগাফোনের সাহায্যে 'জঙ্গি স্লোগান' দিয়েছে ঘেরাও হয়ে থাকা সন্দেহভাজন দলটি; আক্রান্ত অবস্থায় নিজেরাই জানিয়েছে তাদের জিহাদের প্রত্যয়ের কথা।

এরপরও কি না ফেসবুকের পাতাজুড়ে অবিশ্বাসের ছড়াছড়ি! মাত্র চারটা পিস্তল নিয়ে সারারাত গুলিবিনিময় করা সম্ভব কি না– এ রকম কত প্রশ্ন যে উঠছে! আর শুধু ফেসবুকেই কেন, দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি রাজনৈতিক দলের একজন দায়িত্বশীল নেতা পর্যন্ত প্রকাশ্যে সংশয় প্রকাশ করেছেন এই ঘটনায় পুলিশের গুলিতে নিহতরা নিরপরাধ ব্যক্তি হতে পারেন বলে।

এসব দেখেশুনে পুলিশের কর্মকর্তারা অভিমান করতেই পারেন! এমনিতেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় তাদের, আর মিডিয়া তো সারাক্ষণ 'নজরদারি' করেই চলেছে। যে কোনো ব্যর্থতাতেই খলনায়ক বানিয়ে দেওয়া হয় তাদের! তাহলে, সাফল্যে নায়ক হওয়ার সুযোগটা কেন পাবেন না তাঁরা? অন্তত এই অভিযানটা নিয়ে সমালোচনা নয়, প্রশংসাই প্রাপ্য তাদের।

কারণ, এই অভিযানটায় সম্ভাব্য সব রকমের পেশাদারিত্ব রক্ষা করে চলছিলেন তাঁরা। অভিযানে তাদের কেউ হতাহত হয়েছেন বলে শুনিনি। নয়জন সন্দেহভাজন জঙ্গি নিহত হয়েছে, বন্দি হয়েছে একজন আর পালিয়ে যেতে পেরেছে মাত্র একজন। নিহতদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করার বিষয়েও গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার ঘটনার মতো কোনো হঠকারিতা দেখাননি তাঁরা। আগে প্রকাশ করা হয়েছে ছবি। এরপর অনেকখানি নিশ্চিত হয়েই প্রকাশ করা হয়েছে তাদের নামধাম, পরিচয়।

তাহলে কেন এত অবিশ্বাস, এত সংশয়? এর জন্য কিন্তু দায়ী পুলিশ এবং তাদের সহযোগী আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোই। তাদের অতীত রেকর্ড যে মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়! বেশি দিন আগের কথা নয়, এই তো এ মাসেই তাদের টনক নড়িয়ে দেওয়া হলি আর্টিজানের ঘটনার পরও তাঁরা অবিশ্বাস্য রকমের অবিমৃষ্যকারিতার পরিচয় দিয়েছেন। ঘটনার দিন পুলিশের অনেক আগেই আক্রমণকারীদের ছবি প্রকাশ করে দিয়েছিল তাদেরই সহযোগীরা। কিন্তু তাদের দেওয়া আবু হোরাইরা-আবু সালমান জাতীয় আরবি ছদ্মনামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তড়িঘড়ি করে পুলিশ প্রকাশ করেছে আকাশ-বিকাশ-ডন-বাঁধন-রিপন জাতীয় 'অবিশ্বাস্য' নাম। ইন্টারনেটে ছবি দেখে হামলাকারীদের আসল পরিচয় প্রকাশ করতে কিন্তু ফেসবুক-গোয়েন্দাদের লেগেছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা! এই কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করলেই তাদের আসল পরিচয় প্রকাশ করা যেত।

যে ঘটনা সারা দেশ নাড়িয়ে দিয়েছে, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে দরকার সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব। কিন্তু পুলিশ-র‌্যাব কি সেটা পেরেছে? নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকার কথাই ধরা যাক। ওই তালিকা প্রকাশ করার পরের মাত্র দুই দিনে দেশের সংবাদকর্মীরাই খুঁজে বের করলেন কথিত নিখোঁজদের প্রায় সবাইকে; তাহলে পুলিশ-র‌্যাবের গোয়েন্দারা কেন পারলেন না? চার দিনের মাথায় তো সেই তালিকাটা বদলাতেই হলো, তাহলে কেন এত তড়িঘড়ি?

কল্যাণপুরের ঘটনা সেদিক থেকে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও আবেগের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মেনেছে পেশাদারিত্ব। ফেসবুকে আবেগী স্ট্যাটাস দেওয়ার পাশাপাশি নিজেদের বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য করতে তাঁরা ফাঁস করে দিয়েছেন তদন্তের সূত্র। বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়ায় নিহত তরুণদের মধ্যে ছয়জনের আইএসের পোশাক পরা যে ছবি প্রকাশিত হয়েছে, সেটা কিন্তু আইএসের ওয়েবসাইট প্রকাশ করেনি, পুলিশের হাত থেকেই বেরিয়ে পড়েছে কোনো কোনো সংবাদকর্মীর হাতে।

বাংলাদেশে পুলিশের প্রকাশ করতে চাওয়া তথ্য মিডিয়াকর্মীদের কাছে সরবরাহ করা এবং সেই সূত্রে সংবাদ প্রকাশের ঘটনা নতুন নয় মোটেই। আর পুলিশ-র‌্যাবের কথিত বন্দুকযুদ্ধের গল্পগুলোতেও সৃজনশীলতার কোনো ছাপ থাকে না– একই গল্পের পুনরাবৃত্তি শুনতে শুনতে সাধারণ মানুষেরও সেটা মুখস্থ হয়ে গেছে। তাই এগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে মানুষকে বিভ্রান্ত করার যথেষ্ট সুযোগ আছে। অনলাইনে এই কাজগুলো বেশ সাফল্যের সঙ্গেই করে যাচ্ছেন কেউ কেউ। হলি আর্টিজানের ঘটনার পর পরই যেমন অনলাইন গরম হয়ে উঠেছিল, 'জঙ্গিদের কেউ মাদ্রাসা-ছাত্র নয়', 'আওয়ামী লীগ নেতার ছেলেই জঙ্গি' এমন প্রচারণায়।

কল্যাণপুরের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে। নিহত সন্দেহভাজনদের একজন নিজের নিখোঁজ সন্তান হতে পারেন– এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন ইউনিয়ন পর্যায়ের একজন আওয়ামী লীগ নেতা। কিন্তু তা প্রমাণিত হয়নি এখনও। কারণ, ওই একই ছেলেকে নিজের সন্তান দাবি করেছেন অন্য আরেকজন। কিন্তু অনলাইন মিডিয়া সরগরম এবারও 'আওয়ামী লীগ নেতার ছেলেই জঙ্গি' এমন প্রচারণায়। অন্যদিকে আরেক পক্ষ প্রচারণা চালাচ্ছে, 'মোনায়েম খানের নাতি জঙ্গি'।

এটা আসলে অত্যন্ত দায়িত্বহীন এক সরলীকরণ। কোনো রকম গবেষণা, উপাত্ত বিশ্লেষণ না করে দিনের পর দিন বলা হয়েছে মাদ্রাসাগুলোই জঙ্গি তৈরির কারখানা। জঙ্গিদের একটা 'মিথিক্যাল' চরিত্র দাঁড় করিয়ে ফেলা হয়েছে। এখন তারা সেই মিথটাই ভাঙার চেষ্টা করছে; সাফল্যের সঙ্গে করছেও। অথচ মিথটা সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ, কিন্তু সেটা নিয়ে তো যথাযথ গবেষণা হতে হবে, খুঁজে বের করতে হবে এর প্রতিকার।

তা না করে কেবলই পরস্পরের প্রতি দোষারোপ, কাদা ছোঁড়াছুড়ি করে গেলে লাভ হবে না। তাতে কেবল সুযোগসন্ধানীরাই শক্তিশালী হবে।