খোঁজেরও খোঁজ করুন!

Published : 26 July 2016, 03:53 AM
Updated : 26 July 2016, 03:53 AM

গুলশানে জঙ্গি হামলার পর 'নিখোঁজ' শব্দটি খুব শোনা যাচ্ছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেশ কিছু নিখোঁজ তরুণের তালিকাও প্রকাশ করেছে। গুলশান হামলার ঘটনায় জড়িতদের অনেকেই নিখোঁজ ছিলেন; তাই এ নিয়ে সতর্ক হওয়া যেতেই পারে। কিন্তু ওই ঘটনার পর দেখেশুনে মনে হচ্ছে কেবল 'নিখোঁজদের' ওপরই জোর দেওয়া হচ্ছে।

যারা নিখোঁজ হয়েছে তাদের হদিস যদি জানা যায় এবং তারা যদি সত্যি সত্যি জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে; তাহলে হয়তো সাময়িক একটা সমাধানে আসা এই ভেবে যে, অন্তত এদের দ্বারা নতুন কোনো হামলা হবে না। কিন্তু ভবিষ্যতের লম্বা সময়ের জন্য এটি কোনো সমাধান নয়।

মনে রাখতে হবে, বর্তমানে যারা পৃথিবীব্যাপী জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত, বিশেষ করে আইএস কিংবা এই ধরনের সংগঠনের আদর্শে যারা বিশ্বাস করে, তাদের নিজস্ব একটা দর্শন আছে। সেই দর্শন তারা সমাজের অন্যান্য মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। আর ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদেরকেই বেছে নিচ্ছে, যারা খুব সহজে তাদের এই দর্শন মেনে নেবে।

কারা সাধারণত খুব সহজে এই ধরনের ভয়াবহ দর্শনের ফাঁদে পড়ে, যে দর্শন মানুষহত্যা সমর্থন করে?

উঠতি বয়সের কোনো ছেলে কিংবা মেয়ে যারা হয়তো পৃথিবীর বাস্তবতা পুরোপুরি অনুভব করেনি– যাদের কাছে পৃথিবী এখনও রঙিন– সেই তারা যখন যে কোনো কারণে সমাজ, সংস্কৃতি, পরিবারের বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, যখন তাদের মনে হয় জীবনের আর মানে কী, বেঁচে থেকে আর কী লাভ– ঠিক তখন যদি জঙ্গি-আদর্শের কেউ তাদের নিজেদের পথে আসার আহ্বান জানায়, অনেক সময় তারা সেই ফাঁদে পা দেয়। আর একবার ফাঁদে পড়ে গেলে ফিরে আসা খুব কঠিন। তাই কেউ যাতে সেই ফাঁদে পা না বাড়ায় সে দিকে নজর দেওয়া বেশি প্রয়োজন।

ছেলেমেয়েরা বড় হওয়ার সময় যদি তাদের নিজস্ব পারিবারিক শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক (স্কুল) শিক্ষা এবং সমাজকাঠামোর মধ্যে বিশাল গ্যাপ দেখতে পায়, তখন তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। সেই দ্বন্দ্ব অনেক সময় তাদের বিষণ্ণ করে তোলে। আর এর সুযোগ নেয় এইসব জঙ্গি সংগঠনগুলো।

যে কোনো সমাজ পরিবর্তনশীল। এই যেমন আমাদের সমাজে আগে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল খুব একটা প্রচলিত ছিল না। এক দশক আগে শুরু হয় ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর জোয়ার। এর আগে যা ছিল, সেগুলো হয়তো হাতে গোনা যেত। কিন্তু এখন দেশের আনাচেকানাচে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল দেখা যায়। এটিকে আমাদের সমাজ পরিবর্তনের একটি দিক হিসেবে দেখা যেতে পারে। অর্থাৎ সমাজের মানুষজন এখন মনে করছে, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে পড়াশোনা ভালো হয় কিংবা তারা চাইছে ছেলেমেয়েরা ইংরেজি ভালো জানুক।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ইংরেজি মাধ্যম স্কুল-কলেজগুলোতে কি দেশের মূলধারার সংস্কৃতির চর্চা হয়? নাকি তারা নিজেদের মূলধারার চেয়ে আলাদা কিছু মনে করে? তারা কি আমাদের নববর্ষ, একুশে ফেব্রুয়ারি কিংবা অন্যান্য সাংস্কৃতিক উৎসব নিজেরা ধারণ করে? নাকি এ ধরনের চর্চা 'ব্যাকডেটেড' কিংবা পিছিয়ে পড়া মানুষদের চর্চা বলে মনে করে?

যদি তারা নিজেদের এসব থেকে আলাদা মনে করে, তখনই আসলে একটা দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

এই একই প্রশ্ন দেশের মাদ্রসাগুলোর ক্ষেত্রেও করা যেতে পারে। তারা কি আমাদের সংস্কৃতি ধারণ করছে? আমাদের নববর্ষ, একুশে ফেব্রুয়ারি কিংবা অন্যান্য সাংস্কৃতিক উৎসবও? নাকি এ ধরনের কর্মকাণ্ড খারপ বলে মনে করে তারা?

যদি খারাপ কিছু মনে করে, তাহলে একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ার কথা।

এমনকি মূলধারার স্কুলগুলোর ক্ষেত্রেও সেটি প্রযোজ্য। তারা কি আজকাল আকাশ-সংস্কৃতির যুগে অন্যান্য সংস্কৃতি নিজেদের সংস্কৃতির চেয়ে ভালো কিছু বলে মনে করছে? মূলধারার স্কুলগুলোর ক্ষেত্রে হয়তো এখনও এই প্রশ্ন সেই অর্থে প্রযোজ্য নয়। তবে সময় বোধকরি এসেছে এ নিয়ে ভাবার।

একটা সামাজিক কাঠামোতে মূলধারার সংস্কৃতি আবহমান কাল থেকে প্রচলিত। একজন কিশোর বা কিশোরী যখন তার স্কুল কিংবা কলেজে গিয়ে দেখছে এক ধরনের সংস্কৃতি আর স্কুল-কলেজ থেকে বের হয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে চাইতে গিয়ে বা বাধ্য হয়ে মিশতে গিয়ে ভিন্ন সংস্কৃতি দেখছে, তখন তার মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। কারণ তার মানসিকতার সঙ্গে হয়তো সমাজের প্রচলিত কাঠামো মিলছে না। আর এই না মেলার ফলে অনেক সময় ছেলেমেয়েরা নিজেদের পুরো সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করতে শুরু করে। এ থেকে তাদের মধ্যে হতাশার জন্ম নিতে পারে।

যে সমাজ থেকে আপনি নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করতে শুরু করবেন সেই সমাজের জন্য আপনার মায়া-মমতা না থাকাই স্বাভাবিক। তাই তাদের পক্ষে যে কোনো ধরনের সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকে যায়।

দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গবেষকদের উচিৎ হবে গুলশান হামলায় জড়িতদের প্রত্যেককে একেকটা 'কেস স্টাডি' হিসেবে নেওয়া। যাতে তারা কেন এবং কোন পরিস্থিতিতে এ রকম কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ল সেটা ভালোভাবে জানা যায়। আর এটা জানতে পারলে ভবিষ্যতে সে অনুযায়ী কর্মপন্থা নির্ধারণ করা যেতে পারে।

স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো– তা যে মাধ্যমেরই হোক না কেন– সেখানকার পরিবেশ হতে হবে মূলধারার বাংলাদেশের মানুষ এবং তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। নইলে এরা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে পারবে না। আর পুরো বাংলাদেশের মানুষকে তো অসাধারণ বানানোও সম্ভব নয়। তাই এমন একটা শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে যেখানে অন্তত স্কুল পর্যায়ে সবাই এক ধরনের শিক্ষা পাবে।

এ ক্ষেত্রে অবশ্যই পরিবারগুলোর ভুমিকা রয়েছে। শিশুর সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ হচ্ছে তার পরিবার। সে প্রথম শিক্ষা পায় পরিবার থেকে। এরপর সে শিক্ষা নেয় স্কুল থেকে। তাই পরিবারগুলোকেও সামনে এগিয়ে আসতে হবে।

যারা মগজধোলাই হওয়ার কারণে এরই মধ্যে নিখোঁজ হয়ে গেছে তাদের মানসিকতা পরিবর্তন করা খুব কঠিন কাজ হবে। কারণ তারা সন্ত্রাসীদের ফাঁদে পা বাড়িয়েছে। কিন্তু যাদের এখনও 'খোঁজ' আছে– যাদের হয়তো যে কোনো পর্যায়ে এই ধরনের ফাঁদে পা দেওয়ার সম্ভাবনা আছে– তাদের দিকে নজর দেওয়াই বেশি প্রয়োজন।

তাই স্কুলিং থেকে শুরু করে বিদ্যমান সমাজকাঠামোর দিকে লক্ষ্য রাখা সময়ের দাবি।