উল্টে দেখি জীবনের অপেক্ষমান অসম্ভব সুন্দর অন্য পাশটিও

ইসরাত বিজু
Published : 23 July 2016, 01:29 PM
Updated : 23 July 2016, 01:29 PM

এক সপ্তাহের ব্যবধানে গুলশান ও শোলাকিয়ার সংঘটিত জঙ্গি হামলা নিয়ে অনেক কিছু লেখা হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। অনেকেই রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের করণীয় নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন; খেদ-ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন অনেকে। অনেকের লেখাতেই উঠে এসেছে হামলাকারীদের পরিবারের ভূমিকার কথা। অনেক চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন বাস্তবতার নানা দিক।

কিন্তু তাই বলে প্রশ্নটি হারিয়ে যায় না, মাদ্রাসা-শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণদের পাশপাশি উচ্চবিত্ত পরিবারের, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, দেশের বাইরে পড়াশোনা করে আসা, প্রাচুর্যের মধ্যে বেড়ে ওঠা তরুণরা কেন 'এ ধরনের ধর্মের পথে' এসে 'ধর্মকে ঠিক রাখতে' এভাবে নির্মম মানবহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।

অনেকেই বলছেন, পরিবার ঠিকমতো খেয়াল করে, দেখেশুনে রাখতে পারেনি। অনেক ক্ষেত্রেই অন্য অনেক জুভেনাইল এবং তরুণদের মাধ্যমে সংঘটিত কেসগুলোতে দেখেছি, ভবিষ্যতে সন্তানদের অস্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপের প্রধান 'নিয়ামক' বা 'কারণ' হিসেবে পরিবার যথেষ্ট দায়ী থাকে। ব্যক্তিগত আগ্রহ, কিছুটা পড়াশোনা, কাজের অভিজ্ঞতা, আর বৈশ্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে শিশু ও কিশোর-তরুণের মনোজগৎ নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করি। তার আলোকে বলতে পারি, সন্তানদের এ রকম মনোবিকৃতির পেছনের অন্যতম কারণগুলো হলো–

১. চরম দারিদ্র্য– মৌলিক অধিকারগুলো পূরণ না হওয়া;

২. বেশি ভাইবোন হওয়াতে মনোযোগ এবং যথেষ্ট ভালোবাসা, যত্ম থেকে বঞ্চিত হওয়া;

৩. স্বার্থপরতার শিক্ষালাভ, পারিবারিক মূল্যবোধের শিক্ষার অভাব;

৪. বঞ্চিত হওয়ার কারণে হীনমন্য বোধ হওয়া, নিজেকে অবাঞ্ঝিত বা মূল্যহীন ভাবা;

৫. পরিবারের সদস্যদের মধ্যে, বিশেষ করে, মা-বাবার মধ্যে ভালোবাসার বন্ধন না থাকা। স্বামী/স্ত্রীর প্রতি সম্মানজনক আচরণ না করা, প্রচণ্ড বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান থাকা। মা বা বাবা কারোর দায়িত্ব পালনে চূড়ান্ত অবহেলা থাকা, অনৈতিক সম্পর্ক থাকা;

৬. মা-বাবার স্বার্থপর আচরণ করা এবং সন্তানের সামনে বারংবার মিথ্যে বলা, অন্য কারো কঠোর সমালোচনা করা, ভেদাভেদ সৃষ্টিমূলক আলোচনা করা;

৭. মা-বাবার নির্দয় শাসন, অন্যায় শাসন বা সন্তান পালনে অতি কঠোর বা নির্মমতা;

৮. অতি আদর, চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি প্রাপ্তি, না চেয়ে অনেক পাওয়ার অভ্যাস, সঠিক মাত্রার শাসনের অভাব, অন্যায় আবদারের প্রশ্রয়, সমর্থন;

৯. অনায়াসলভ্য সেবা বা প্রাপ্তি, অধিক প্রাপ্তি বা প্রাপ্য অধিকার পূরণ না হওয়া;

১০. নিজের চেয়ে দুর্বল কোনো কিছুর প্রতি চরম নির্যাতনমূলক আচরণ করে বিকৃত আত্মতৃপ্তি বোধ করা;

১১. শৈশব থেকেই সমাজের প্রতি, রাষ্ট্রের প্রতি, দেশের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ না শেখানো। ভালো মানুষ হওয়ার জন্য বারংবার উদ্বুদ্ধ না করা;

১২. শৈশবে পরিবারের কারোর নির্মম আচরণের শিকার হওয়া এবং সেটার যথেষ্ট প্রতিকার না পাওয়া;

১৩. শৈশবে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া;

১৪. সমবয়সীদের কাছ থেকে অন্যায় আচরণ বা বুলিজ-এর শিকার হওয়া;

১৫. শারীরিক কোনো খুঁতের কারণে ঠাট্টা-বিদ্রুপের শিকার হওয়া;

১৬. বয়ঃসন্ধিকালীন খুব জটিল এবং সংবেদনশীল সময়টিতে পরিবারের কারও যথেষ্ট গাইডেন্স বা পথপ্রদর্শন, মনোযোগ না পাওয়া;

১৭. সেটা সমবয়সী বা বাইরের কারো কাছ থেকে ম্যানিপুলেশন বা ভুল শিক্ষার মাধ্যমে পেয়ে যাওয়া;

১৮. কার সঙ্গে সন্তান মিশছে, ঘুরছে, ফিরছে তার কোনো ধারণা বা খোঁজ না রাখা;

১৯. হঠাৎ করে আচার আচরণে বিশাল পরিবর্তন আসা– যেটা পারিবারের সদস্যদের নজরে না আসা, বা চোখে না পড়া বা তা এড়িয়ে চলা;

২০. ধর্ম নিয়ে অতি আগ্রাসী ও কট্টরপন্থা অবলম্বন এবং নিজের ধর্মই সঠিক– অন্য সব 'অধর্ম' এবং সেগুলোর অস্তিত্ব নিয়ে আগ্রাসী, অসহিষ্ণু, সাম্প্রদায়িক মনোভাব পোষন করা এবং তাতে পরিবারের প্রশ্রয় বা সমর্থন পাওয়া, সে ব্যাপারে সঠিক শিক্ষার অভাব;

২১. ধর্মের ভুল অনুবাদ বা আংশিক ব্যাখ্যার অপব্যাখ্যা;

২২. ধর্মীয় কোনো আচারের বিরূপ প্রভাব, জিঘাংসা, রক্ত, হত্যাযজ্ঞ সমর্থন বা চোখের সামনে সংঘটিত হতে দেখা।

উপরোক্ত সবকটি আচরণ বা মনোভাব পর্যালোচনা করে দেখলে পরিবারে সন্তান পালনের ব্যর্থতাটাই কিন্তু দেখা যাবে সবার আগে। সমাজে সে আচরণটিই অগ্রহণযোগ্য যেটি অস্বাভাবিক, যেটি অপরের ক্ষতি করে, যেটি প্রচলিত মূল্যবোধের বাইরের। উপরের কার্যকারণ এবং পরবর্তীতে সে প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে করা আচরণগুলোর ব্যাখ্যা অবশ্যই আছে।

গুলশানে চালানো হত্যাযজ্ঞে অংশ নেওয়া হামলাকারীদের প্রায় সবার পরিবারের বিস্ময় প্রকাশ বা আমাদের অনেকেই বুঝে উঠতে পারছেন না– এত প্রাচুর্যের মধ্যে থেকে, এত 'নজরদারি'র মধ্যে থেকেও এসব সন্তান কী করে এমন বিপথে চলে যেতে পারল!

বলতেই হয়, চলে গেছে! এত কিছুর মধ্যেও 'গুড প্যারেন্টিং'এর অভাব অবশ্যই ছিল। উপরের কার্যকারণগুলোয় একটু চোখ বুলিয়ে আসুন। সন্তানের কোনো একটি 'জায়গায়' আপনি অবশ্যই সচেতন বা অসচেতনভাবে অনুপস্থিত ছিলেন। প্রচুর প্রাপ্তি, প্রাচুর্যের মধ্যে বড় করে তুলেছিলেন? কোনো অভাববোধ না রেখেই? সেটাই হয়তো তার বিপথগামী হওয়ার অন্যতম কারণ।

অনায়াসলব্ধ প্রাপ্তিতে আদর থাকে না, থাকে না মায়া। বরং হঠাৎ পেয়ে যাওয়া অসীম প্রাপ্তি অবহেলার জন্ম দেয়, ক্ষমতার অপব্যবহার শেখায়, অকারণ ক্ষমতাশালী ভাবতে সাহায্য করে। যথেষ্ট অবহেলা করেছিলেন? অতি কঠোর শাসনে রেখে 'ভালো' মা-বাবা হওয়ার সুনাম কিনতে চেয়েছিলেন? পকেট থেকে দু-চার টাকা চুরি করে না হয় আচার, আইসক্রিমই খেয়েছিল আপনার সন্তান। যদিও মাসে মাসে বেতন পেয়ে অন্য সব খরচ থেকে বাঁচিয়ে ঠিকই সেদিন আপনি আইসক্রিম বক্স নিয়েই ঘরে ফেরেন। তাই বলে, সন্তানের অতটুকু 'অন্যায়'-এর শাস্তি বেত দিয়ে মেরে পিঠ রক্তাক্ত করে দেওয়া? কাজটি যদি 'ঘোরতর অন্যায়' আপনার চোখে, তা হলেও একটু মায়া দিয়ে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে বলা যেত না?

আপনাদের দুজনকেই পরিবারের স্বচ্ছলতার জন্য, সন্তানদের আরও একটু নিরাপত্তার জন্য চাকরি করতে হয়– এটা প্রয়োজন, সময়ের দাবি। আপনি সব সময় ঘরে বসে সন্তান পাহারা দিতে পারছেন না। কিন্তু, সন্তানটিকে কতটুকু মানসিকভাবে প্রস্তুত করিয়ে বাইরে যান? সন্তান কি তার মা-বাবার কষ্ট প্রাণ দিয়ে বুঝতে পারবে? বাড়ি ফিরেই বা কতটুকু সময় তাকে দিয়ে তার অপ্রাপ্তি ভরিয়ে দেন আপনি? অর্থ আয়ের জন্য আপনাকে কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, তার একটু ধারণাও কি সন্তানকে দেওয়া উচিত নয়? তবেই তো সে মা-বাবার প্রতি, তাদের ত্যাগের প্রতি, সৎ পথে রক্তজল করা উপার্জনের প্রতি সম্মান দেখাতে শিখবে।

বয়ঃসন্ধির চরম বিপদসংকুল সময় সন্তানকে তার নিজের সঙ্গে অজানার সমুদ্রে একা যুদ্ধে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন? শিখিয়েছিলেন মেয়েকে, কীভাবে প্রথম ঋতুমতী হওয়ার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা নির্বিঘ্নে পার করতে হয়? প্রথম যৌন পরিস্ফুটনের অভিজ্ঞতার ব্যাপারে বলেছিলেন কি ছেলে সন্তানটিকে? সুস্থ-স্বাভাবিক যৌনতার শিক্ষা সে অবশ্যই আপনার কাছ থেকে লাভ করেনি। 'টিন' বয়সে একের পর এক ভালোলাগার সম্পর্কগুলোয় জড়ায় যখন, কোনটি উচিৎ কোনটি অনুচিৎ বুঝতে পারছিল না; এক একটি সম্পর্ক ভেঙে যাওয়াকে সে যে জীবন ভেঙে যাওয়া ভেবে আত্মহত্যার প্রস্তুুতি নিয়ে ফেলছিল, ছিলেন কি তখন বন্ধু হয়ে পাশে? নাকি 'নির্মম শাসক' হয়ে মা-বাবার 'দায়িত্ব' পালন করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে ব্যস্ত ছিলেন?

সন্তানের প্রতি আপনার যথাযথ দায়িত্ব পালনে আপনি অপারগ ছিলেন, বোধ করি, সে ভুলটি বোঝার বোধটুকু আপনার নেই-ই। তার ছোটবেলায় করা আপনারই কোনো অবহেলা বা নির্মম আচরণের কারণে, পুষে রাখা সে ভয়, বিতৃষ্ণা, প্রতিশোধপরায়ণতার কারণে আজ সে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় 'সোশিওপ্যাথ' বা মানুষ খুন করার আরো ভয়ঙ্কর পথে থাকা 'সাইকোপ্যাথ'। যে এখন ভালোবাসতে ভয় পায়, সম্পর্কে জড়াতে ভয় পায়, যে এখন সম্পূর্ণ অবচেতন মনে চূড়ান্ত স্বার্থপর, যে কারো সঙ্গেই কোনো ধরনের মানসিক নৈকট্য গড়ে তোলে না। তার প্রতি করা স্বাভাবিক কারো অনুভূতির প্রকাশে পর্যন্ত সে নির্বিকার, কারো আবেগের বহিঃপ্রকাশের প্রতি তার থাকে সীমাহীন উদাসিনতা। যে অন্য সবার মতো একটি স্বাভাবিক জীবন পায় না। যে অবলীলায় অপরাধ করতে দ্বিধা করে না।

যেখানে তথাকথিত এক ধর্মীয় বিদেশি টিভি চ্যানেল হয়ে উঠে 'ধর্ম শেখার' সবচেয়ে বড় উৎস, যেখানে চারটি কেন, আরো বেশি বিয়ে কেন আবশ্যক– তার শিক্ষা লাভ করা যায়, সে টিভি চ্যানেলের অনুসারী বড় বড় নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা মধ্যবয়সীদের মধ্যেও চর্চা চলে। এক ধর্মের উৎসবে অন্য ধর্মাবলম্বীর উপস্থিতি বা তাদের দাওয়াত দেওয়া হারাম। নিজের ধর্মের ছাড়া আর কোনো ধর্মের অস্তিত্ব নেই, সব বাজে, মৌলিকত্বহীন। বাসায় সন্তানদের তোতা পাখির মতো শিক্ষা দেওয়া হয়, বিধর্মীর বাড়িতে যাওয়া হারাম, তাদের পরিবেশন করা খাবার হারাম– সে ধরনের 'শিক্ষিত' মা-বাবার পরিবারের সন্তানরা দ্বিধাবিভক্ত থাকে ছোটবেলা থেকেই। পরবর্তীতে যাদের ইসলাম সম্পর্কে তথাকথিত ফেসবুক পেজ থেকে নৈতিক-অনৈতিকতার 'শিক্ষা' নিতে হয়, স্ত্রী পেটানোর উপায় জানতে হয়, শরিয়া আইন অনুযায়ী শিক্ষাব্যবস্থা, স্কুলিং কীভাবে চালাতে হয়, না চললে রাষ্ট্রকে কীভাবে বাধ্য করা যায়, জিহাদ কী, ধর্ম রক্ষায় কেন এটি জরুরি, নারী-পুরুষের বন্ধুত্ব হারাম কি না– যে বা যারা সেখানে গাইড করে, পহেলা বৈশাখ হারাম, এটি 'সম্পূর্ণ হিন্দুয়ানী' অনুষ্ঠান, যাদের এতটুকু জানা থাকে না– এটির প্রবক্তা বাদশাহ আকবর নামের একজন 'মুসলিম'। তাদের হাতে ধর্ম কি খুব নিরাপদ?

সব কিছুকে ধর্মের ছায়ায় এনে পরিমাপ করা কি সমাজে শুধু সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পই ছড়িয়ে দিচ্ছে না? কচি-কোমলমতি শিশুদের বোধোদয়ের আগেই, অ আ ক খ-এর শিক্ষা দেওয়ার আগেই সেই ধরনের 'ধর্মীয়' শিক্ষা দিয়ে তার প্রাকৃতিক বেড়ে ওঠা কেন রোধ করে দেওয়া হবে? সন্তানকে তার নিজের মতো করেই বড় হয়ে উঠতে দিন না! শুধু মনিটর করুন সে 'মানুষ' হয়েই বেড়ে উঠছে আপনার থেকে সঠিক শিক্ষাটা পেয়ে। তাহলে আর তাকে ধরে-বেঁধে জোর করে 'মানুষ' বানাতে হবে না।

সন্তানের মনোজগতে ছোটবেলায় অবলোকন করা ধর্মীয় কিছু আচারের ক্ষতিকর প্রভাব পরবর্তী সময়ে নেতিবাচকভাবে পড়তে দেখা যায়। তবে, সেটা সবার উপরেই সমানভাবে প্রতিফলিত হয় না। তবে কারো করো ওপরে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায়। বিশেষ করে পশুহত্যা, রক্তের দৃশ্য, মাংস কাটাকুটি ইত্যাদি শিশুমনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। অনেক শিশুকে মা-বাবা বা আত্মীয়-পরিজন সে সমস্ত আচার পালনকালে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে দেখানোর জন্য উপস্থিত করায়– যার রেশ সুদূরপ্রসারী। ব্যক্তিগতভাবে আমি এভাবে সবার গোচরে, উন্মুক্তভাবে এ ধরনের আচার পালনের বিরোধী। বাংলাদেশে যত নির্মমভাবে উন্মুক্তস্থানে পশু-উৎসর্গের মচ্ছব চলে তার নজির বিশ্বে অপ্রতুল।

উন্নত বিশ্বে খাবারের জন্য পশুহত্যার বিশেষ স্থান এবং পদ্ধতি নির্ধারিত থাকে। যা বাইরের কারোর পক্ষেই দেখা সম্ভব নয়। এমনকি যেসব মুসলিমপ্রধান দেশে পশু কোরবানি উৎসব করা হয়, তাদের পর্যন্ত এ জন্য আলাদা নির্ধারিত স্থান বরাদ্দ থাকে, যা জনসাধারণের দৃষ্টির বাইরে থাকে। গণমাধ্যমে হত্যা, রক্তাক্ত ছবি, গ্রাফিকস কখনোই সরাসরি দেখানো হয় না। কোনো সিনেমাতে যদি এ ধরনের দৃশ্য থাকেও সেটা আগে থেকে 'ভিউয়্যারস ডিরেকশন' এবং 'প্যারেন্টিং এ্যাডভাইস'-এর মাধ্যমে আগে থেকেই সতর্ক করা থাকে। আবার অনেক সংবাদ রিপোর্ট বা ভিডিও ফুটেজে দেখার আগেই সতর্কবার্তা থাকে, এখানে রক্ত এবং ভায়োলেন্সের কিছু ম্যাটেরিয়াল থাকতে পারে, সে ক্ষেত্রে দর্শকের নিজের দায়িত্বে দেখার বিষয়টি সতর্ক করা হয় বা সেগুলো দেখালেও ঝাঁপসা করে দেওয়া থাকে।

এর বিপরীতে এমনও দেখা গেছে, একটি হাউজিং সোসাইটির ভেতরে ফুটবল মাঠের অর্ধেক পরিমান খালি জায়গায় সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ৩৫টি পশু কোরবানির কাজ সারা হয়েছে। সবুজ নরম ঘাস দিনশেষে আর সবুজ থাকেনি; রক্ত-বর্জ্য-পুুঁতি-দুর্গন্ধময় অবস্থার পাশাপাশি শিশুদের মনে এর প্রচণ্ড বিরূপ প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। পশুটিকে সরাসরি গলা কেটে হত্যা হতে দেখা, ফিনকি ছোটানো রক্ত, মর্মন্তুদ যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মৃত্যু হওয়া দেখানো– এ বীভৎস দৃশ্য আঙুল দিয়ে শিশুকে সহাস্যে দেখিয়ে এমনও বলতে শোনা যায়, 'দেখ! দেখ!'। অর্থাৎ, একটি শিশুর বোধোদয় হওয়ার আগেই রক্তকে নেতিবাচকভাবে না দেখিয়ে, তার সঙ্গে আন্তরিকভাবে, মজা করিয়ে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

নিত্য চোখের সামনে এ রক্তাক্ত ব্যাপার দেখতে দেখতে শিশুটির হয়তো বা ভয় কেটে যায় এবং ভবিষ্যতে এটি তার কাছে তেমন কোনো বিশেষ ব্যাপার থাকে না। সেটিই হয়তো বা ভবিষ্যতে কোনো না কোনোভাবে অন্য সব হত্যা বা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হতে প্ররোচনা দিতেই পারে; যা মনোবিদগণের কাছে সবসময়ই উদ্বেগের এবং নিরুৎসাহের। ধর্মীয় ব্যাপার বলে হয়তো বা অনেকেই আমার সঙ্গে তীব্রভাবে বিরোধিতা করবেন।

তাহলে বলুন, যে আপনি ধর্মীয় কারণে উন্মুক্তভাবে এ ধরনের পশুহত্যা করে এবং দেখে অভ্যস্ত- সেই আপনি কী করে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি বা অ্যানিমেল প্ল্যানেট-এ দেখানো এক পশুর আরেক পশুকে শিকার দেখে শিউরে ওঠেন? এবং খেদোক্তি করেন, "এ ধরনের ভায়োলেন্স টেলিভিশনে দেখানো উচিৎ নয়, বাচ্চারা দেখে ভয় পায়!" স্ববিরোধী হয়ে গেল না?

আর ব্যাপারটা তো পশুর বেঁচে থাকারই একটা অংশমাত্র, আপনার 'বিনোদন'-এর বিষয় কিন্তু নয়। আর সে চ্যানেলগুলো কিন্তু গণদায়িত্বও পালন করে থাকে। রক্তারক্তি বা ভায়োলেন্সের বিষয়গুলো তারাও এড়িয়ে দেখায়।

সামনেই আসছে কোরবানির ঈদ। আপনাদের প্রতি আমার ব্যক্তিগত অনুরোধ, পাড়া-মহল্লায় দয়া করে উন্মুক্তভাবে পশুহত্যা করবেন না। সবাই মিলে শামিয়ানা টাঙিয়ে ঘেরাটোপের মধ্যে কোমলমতি শিশুদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে, তাদের দৃষ্টির আড়ালে এ ধর্মীয় কাজ সম্পন্ন করুন, যা বিশ্বের প্রায় সব দেশেই করা হচ্ছে। শিশুদের নরম মন নির্মল রাখুন। অবশ্যই এটি আপনার দায়িত্ব।

গুলশানে জঙ্গি হামলাকারীদের মা-বাবারা, সেসব মা-বাবার সন্তানরা আজ নিখোঁজ এবং অন্য সব মা-বাবাকেও বলছি, একটু মনে করে দেখুন তো, সন্তানকে সঠিকভাবে 'দেখেশুনে' রেখেছিলেন তো বা রাখছেন তো? উপরে শুরুর দিকে যেসব বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে সেগুলো করছেন বা করছেন না তো সন্তানের সঙ্গে? তার বন্ধু হওয়ার চেয়ে অজান্তে তার 'শত্রু' হয়ে যাননি বা যাচ্ছেন না তো?

আপনারা মা-বাবা যতই বলুন, কিছুরই তো অভাব রাখেননি। কেন এমন হলো বুঝতে পারছেন না! হ্যাঁ, তবু আপনাদেরই দায় নিতে হবে। ভালো করে, চিন্তা করে দেখুন কতটা সতর্ক ছিলেন বা আছেন আপনি?

আপনার সন্তান ভালো আছে তো? যান না, আজই সব জড়তা ফেলে, 'ইগো' ঝেড়ে ফেলে তার কক্ষে যান। যা কখনও করেননি, ইতস্তত না করে আজই তার পিঠে আপনার সস্নেহ হাত বোলান। ধীরে-সুস্থে খোঁজ-খবর নিন। পড়াশোনা কেমন চলছে। খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করে কি না। পরামর্শ দিন। প্রকৃতি, পরিবেশ, শিশু-দুস্থদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবীর কাজগুলোতে সে যদি আত্মনিয়োগ করে, আপনি তার পাশে উৎসাহ নিয়ে উপস্থিত আছেন।

কে জানে, সব সময় নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকা, আপনাকে অপছন্দ করা, পরিবারের সবার সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে ফেলা বা উগ্র আচরণ করা, বা আগামীকাল ভোরে সবার অগোচরে কোনো এক 'বিশেষ আহ্বানে' ঘর ছাড়বে বলে যে সন্তান লুকিয়ে ব্যাগটি গুছিয়ে ফেলেছে– আপনার কাছ থেকে প্রথম পাওয়া স্নেহের ছোঁয়াই হয়তো এক মুহূর্তে তাকে অনেক দিনের চেপে রাখা আনন্দে চিৎকার করে বলতে বাধ্য করাবে, "কই মা! বাজারের ব্যাগটা দাও। আমিই আজ ইলিশ কিনে আনব। ভুনা খিচুড়ি করবে কিন্তু!"

জীবন সব সময় সুন্দর।