সেভেন-ওয়ান: একটি সামষ্টিক দায়

বিজন সরকার
Published : 19 July 2016, 08:39 PM
Updated : 19 July 2016, 08:39 PM

জুলাইয়ের এক তারিখ। দিনটি ছিল শুক্রবার। সারা দিনের ব্যস্ততা ছেড়ে ফেসবুক খুলেছি মাত্র। বাংলাদেশ সময় প্রায় রাত নয়টার কাছাকাছি। বিবিসি বাংলা বিভাগের ফেসবুক পাতায় বিবিসির একটি অনুরোধ দেখলাম। গুলশান এলাকায় গোলাগুলি হচ্ছে। দুটি মোবাইল নম্বর দিয়ে বিবিসি বাংলা অনুরোধ জানিয়েছে, কেউ যদি সেই এলাকায় উপস্থিত থাকেন তবে তারা তাদের সঙ্গে কথা বলতে চায়।

রাত নয়টার দিকে দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলো গুলশান হামলা নিয়ে অবিরাম সংবাদ পরিবেশন করতে থাকে। দেশে বিদেশে সকলেই জানল যে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গিরা হামলা চালিয়েছে এবং জঙ্গিদের হামলায় দুই পুলিশ অফিসার মারা গিয়েছেন। এই পর্যন্ত সংবাদ আমাদের গণমাধ্যমগুলো দিতে সমর্থ হয়েছে। তারপরের সকল সংবাদের জন্য আমাদের গণমাধ্যমগুলো সেকেন্ডারি উৎসের উপর, অর্থাৎ সাইট ইন্টিলিজেন্স, বিবিসি ও সিএনএনের মতো সংবাদ মাধ্যমের উপর নির্ভর করতে হয়েছে।

হামলা করেছে আইএস এবং মোট বিশজনকে যে হত্যা করা হয়েছে, সেই সংবাদও আমরা প্রথম পাই রাত দেড়টা থেকে দুইটা নাগাদ সাইট ইন্টেলিজেন্স এবং বিবিসি থেকে। পরের দিন আইএসপিআরএর সংবাদ সম্মেলনের আগ পর্যন্ত দেশীয় গণমাধ্যমগুলো নিশ্চিত করতে পারেনি জঙ্গিরা কতজনকে হত্যা করেছে কিংবা হামলায় কতজন জঙ্গি অংশগ্রহণ করেছে সে তথ্য।

বেসরকারি টিভিগুলোর সংবাদ সংগ্রহ এবং পরিবেশনের ক্ষেত্রেও ছিল অপরিপক্বতা। টিভি চ্যানেলগুলো লাইভ সম্প্রচারের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। র‍্যাব প্রধানের সরাসরি সম্প্রচার না করার অনুরোধও অনেক টিভি কর্তৃপক্ষ উপেক্ষা করেছে। হলি আর্টিজানের ভিতরেও যে জঙ্গিরা টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান সম্পর্কে জানতে পারছে, তা আমাদের বিবেচনাতে আসেনি। টিভিগুলোর উদ্দেশ্যই ছিল ব্যবসা তথা টিআরপি বাড়ানো। অথচ বেসরকারি টিভির বয়স প্রায় দেড় যুগ। এখনও তাদের পেশাদারিত্বে পুষ্টিহীনতার ছাপ স্পষ্ট।

জঙ্গিবাদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতোই দেশের গণমাধ্যমগুলোও তেমন সচেতন নয়। বাংলাদেশের প্রধান দুটি সমস্যার একটি হল জঙ্গিবাদ, আরেকটি হল দুর্নীতি। তৃতীয় বিশ্বের মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর মধ্যে যে সব দেশে দুর্নীতির প্রসার ঘটেছে, ধর্মীয় জঙ্গিবাদ সেখানে সমান্তরালভাবে বেড়েছে। অথচ দেশের গণমাধ্যমগুলোর এ দুই ইস্যুতে যে মাত্রায় ভূমিকা রাখার কথা, সেই মাত্রার ভূমিকাটি দেখা যায় না।

আমরা যদি বিগত সময়ের গণমাধ্যমের ভূমিকা পর্যালোচনা করি, দেখা যাবে জঙ্গিদের কর্মকাণ্ড নিয়ে গভীর অনুসন্ধানী রিপোর্ট তেমন একটা নেই। জঙ্গিরা তাদের অপারেশন ঘটনোর পর আমরা গণমাধ্যমের দৌড়ঝাঁপ দেখতে পাই। সোজাভাবে বললে বলা যায়, যা ঘটে তাই মিডিয়াতে আসে। প্রায়ই ঘটনাগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আগে আসে। অনেকে ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিচার-বিশ্লেষণ হওয়ার পরে আমাদের গণমাধ্যমে স্থান পায়। কী ঘটতে পারে সেই ধাঁচের অনুসন্ধানী রিপোর্ট তেমন দেখা যায় না।

অথচ নিরাপত্তা বাহিনীর দুটি চোখ থাকলে মিডিয়ার চারটি চোখ থাকার কথা। কেন যে গণমাধ্যমগুলো দীর্ঘ চার দশক ধরে প্রত্যাশিত জায়গায় আসতে পারেনি, সেটির উত্তর খোঁজাও জরুরি হয়ে পড়ছে।

দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর চিন্তা চেতনা ও পেশাদারিত্বের গভীরতার একটি উদাহরণ দিই। অনলাইনের ওপেন সোর্স থেকে একটি স্যাটায়ার সত্যি ধরে দেশের সর্বাধিক প্রচারিত গণমাধ্যম থেকে শুরু করে প্রথম সারির গণমাধ্যমগুলো একে সংবাদ আইটেম হিসেবে প্রকাশ করেছে। সংবাদটির সত্যতা যাচাই-বাছাই করার জন্য সামান্যতম পেশাদারিত্বের অবস্থান থেকে ইউনেসকোর অফিসিয়াল ওয়েব পেইজটি দেখার প্রয়োজন অনুভব করেনি কেউ।

১.৬২ বিলিয়ন মানুষের বিশ্বাসকে এভাবে ইউনেসকোর সনদ দেওয়া যে ধৃষ্টতার পর্যায়ে পড়ে– এটি বোঝার মতো সামান্যতম জ্ঞান কি আমাদের গণমাধ্যমের নেই? ইউনেসকো কোনো বিশ্বাসকে সনদ দেয়নি। কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসকে সনদ দেওয়া ইউনেসকোর এজেন্ডার মধ্যে পড়ে না–- এমন একটি ঘোষণা সংস্থাটির অফিসিয়াল ওয়েব পেইজে দেওয়ার পর গণমাধ্যমগুলোর অনলাইন সংস্করণ থেকে সংবাদ আইটেমটি সরিয়ে নেওয়া হয়।

ঠিক একইভাবে, যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দণ্ড নিয়ে সর্বাধিক প্রচারিত একটি বাংলা পত্রিকা পশ্চিমা গণমাধ্যমের বিভিন্ন ব্লগের লেখাকে সেই সকল পত্রিকার প্রতিবেদন হিসেবে দেশের জনগণকে খাইয়েছে।

দেশের জঙ্গিবাদ নিয়ে যদি মূল ধারার গণমাধ্যমগুলো সোচ্চার থাকত, তবে জঙ্গিবাদের প্রসার সমাজের এত গভীরে যেত না। গণমাধ্যমের ভালো করেই জানার কথা দেশের কোন কোন প্রতিষ্ঠান জঙ্গি প্রজনন কেন্দ্র। কেবল নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বহু বেসরকারি ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র শিবির ও হিজবুত তাহরিরের শিকড় অনেক গভীরে চলে গিয়েছে। বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এখন জঙ্গিদের 'মেন্টর' হিসেবে কাজ করছেন।

জঙ্গি নির্মাতাদের টার্গেট তরতাজা যুবকেরা। বিশেষ করে, সদ্য মাধ্যমিক স্কুল পেরিয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীর মস্তিস্কের নিউরনগুলো সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গিবান্ধব করে তোলা হচ্ছে। ইসলামী ছাত্র শিবির, হিজবুত তাহরিরসহ অনেক জঙ্গি সংগঠন আমাদের সবার নাকের ডগায় বিপদজ্জনক কাজটি করছে। মানুষ তার শৈশবে যে আদর্শের আলোকে মনন গঠন করে, বাকি জীবনের যে কোনো প্রতিকূলতায় সেই আদর্শ জিইয়ে রাখার চেষ্টা করে সে। দেশের স্কুল পাস করা শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশের সবচেয়ে উর্বর সময়টিতে ইসলামিক ছাত্র শিবির ও হিজবুত তাহিরিরের মতো জঙ্গি সংগঠনগুলো ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বিষক্রিয়ায় নীল করে তুলছে।

যারা গুলশানে সেভেন-ওয়ান ঘটিয়েছে, প্রতিটি জঙ্গির বয়স আঠারো থেকে বাইশের কোঠায়। মাদারীপুর সরকারি নাজিমউদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের গণিত বিভাগের শিক্ষক রিপন চক্রবর্তী হত্যাচেষ্টা মামলার কোনো আসামির বয়সই ২৫ হয়নি।

জঙ্গিদের সম্ভাব্য প্রজনন কেন্দ্র, জঙ্গি-মেন্টর হিসেবে কারা জড়িত, কোন কোন প্রতিষ্ঠান পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষভাবে জঙ্গিবাদী হিসেবে ভূমিকা রাখছে, আমাদের রাজনীতির কোন অংশ কৌশলে জঙ্গিবাদে উসকানি দিচ্ছে– সেসব বিষয় সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ ও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন গণমাধ্যমগুলোর প্রকাশ করা উচিত।

দেশের কথিত সুশীল ও বুদ্ধিজীবী সমাজ আজো বনসাই হয়ে আছে। এখনো এই সমাজ ডানে-বায়ে তাকিয়ে কথা বলে। বাংলাদেশে উগ্রবাদের চাষাবাদ এই প্রথম নয়। ধর্মীয় উগ্রবাদের প্রথম স্তর হলো আন্তঃধর্মীয় বিদ্বেষ। দেশের ভিতর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর ধারাবাহিক নির্যাতন সুশীল ও বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশটির মননে ও আলাপ-আলোচনায় স্থান পায়নি। নির্যাতনকারীরা দশকের পর দশক ধরে সুশীলের এড়িয়ে যাওয়া থেকে একটি নীরব সমর্থন পেয়ে আসছে। দেশের কবি-সাহিত্যিকের কর্মেও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের স্থান নেই।

জুনের মাঝামাঝি সময়ে প্রথম সারির একজন বুদ্ধিজীবী সংখ্যালঘু নির্যাতনের একটি চমৎকার (!) মূল্যায়ন করেছেন। উনার মতে, দেশে সেই অর্থে সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে না। উনার বক্তব্যের সারমর্ম দাঁড়ায়, 'যা-ই হচ্ছে সেটি মেনে নেওয়াই ভালো'। অথচ উনি আওয়ামী লীগের প্রথম সারির বুদ্ধিজীবী। আরেক বামপন্থী বুদ্ধিজীবীর মূল্যায়ন হচ্ছে: দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাই সংখ্যাগুরুদের নির্যাতন করছে।

জঙ্গি হামলার ধরন দেখে সুশীল ও বুদ্ধিজীবীদের চেতনা ও সংবেদনশীলতা প্রকাশ পায়। বিগত কয়েক মাস ধরে বুদ্ধিজীবীদের এই ধরনের প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সেভেন-ওয়ান না ঘটলে হয়তো উনাদের বক্তব্যের প্রবণতা একটি নির্দিষ্ট লিনিয়ার রেখা অনুসরণ করত। সমাজ বিভক্তকারী ও ঘৃণা-প্রচারক জাকির নায়েকের একার দোষ নয়। দেশের সুশীল ও বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ নানা রূপে জ্ঞাত ও অজ্ঞাতসারে জাকির নায়েকের ভূমিকা পালন করছে।

আইএস সৃষ্টিতে পশ্চিমাদের মূল ভূমিকা রয়েছে। ইরাকে আইএস যখন গঠিত হয়, তখন মার্কিন সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা শাখার প্রধান ছিলেন মাইকেল টি ফ্লেন। বহু সাক্ষাৎকারেই ফ্লেন স্বীকার করেছেন যে, আইএস যখন সৃষ্টি হয় তারা বুঝতে পারছিলেন। ইরাক থেকে মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্টও পাঠানো হয়েছিল হোয়াইট হাউসে। অজ্ঞাত কারণে মার্কিন প্রশাসন নীরব ছিল।

আইএস সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে সরানো। মার্কিন প্রশাসন আসাদকে রেখে সিরিয়ায় একটি রাজনৈতিক সংস্কারের পক্ষে ছিল। কেবল মধ্যপ্রাচ্যে দেশটির বিশ্বস্ত মিত্র সৌদি আরবের চাপে ওবামা প্রশাসন সেদিকে আগাতে পারেনি। সিরিয়ায় রাশিয়ার হামলার পরও সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে যে সকল বহুজাতিক সভা হয়েছে, সেখানেও আসাদকে রেখে একটি সমাধানের চেষ্টা করা হয়। তাতেও সৌদি আরব আপত্তি জানায়।

এখানেই সুশীল ও বুদ্ধিজীবী সমাজের কাছে একটি প্রশ্ন রাখতে চাই। পশ্চিমরা তাদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থে আইএস সৃষ্টির জন্য নীতিগত সমর্থন দিয়ে গেছে। কিন্তু সেসব দেশ থেকে মানুষ আইএসে যোদ্ধা হিসেবে যোগ দিয়েছে তাদের কি কোনো দোষ নেই? যারা আইএসকে অর্থায়ন করল, তারা নিষ্পাপ? অতি সম্প্রতি আইএসের যোদ্ধাদের যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে আইএসের মোট যোদ্ধার মধ্যে চার ভাগের এক ভাগ সৌদি আরবের নাগরিক। এটি ওপেন সিক্রেট যে আইএসের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় সৌদি আরব, কাতার আর কুয়েতের টাকায়; তুরস্কে আইএসের তেল বিক্রির টাকাও রয়েছে।

ফলে আমরা যখন জঙ্গিবাদ নিয়ে কথা বলি, সে ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের ভূমিকাটি এড়িয়ে গিয়ে কেবল পশ্চিমাদের দোষ দেওয়ার প্রবণতা শেষে জঙ্গিদের পক্ষে যায়। যার যতটুকু অবদান সে ডিগ্রি অনুযায়ী বিশ্লেষণ হওয়া উচিত। তা না হলে একটি নির্দিষ্ট জাতি-গোষ্ঠীর প্রতি উগ্রবাদ সমাজে বিনির্মিত হয়।

দেশে জঙ্গি উত্থানের কারণ হিসেবে আরেকটি ন্যারেটিভ সামনে আনা হয়। বলা হয়ে থাকে, দেশে বিরোধী দল নেই; ফলে জঙ্গিরা সেই শূন্যতা পূরণ করছে। কোনো সন্দেহ নেই যে, একটি শক্তিশালী বিরোধী দল আমাদের দেশের শিশু গণতন্ত্রের জন্য খুবই অপরিহার্য। তবে জঙ্গিবাদ যে গণতন্ত্র দিয়ে মোকাবিলা করা যাবে না সেটি আমাদের সুশীলরা বুঝেও না বোঝার ভান করেন।

পশ্চিমা দেশগুলিতে গণতন্ত্র থাকা সত্ত্বেও কি জঙ্গি হামলা হচ্ছে না? পাশের দেশ ভারতে কি গণতন্ত্র নেই? সেখানে কি জঙ্গিরা হামলা করেনি? ফলে কেবল গণতন্ত্রের দুর্বলতার জন্য জঙ্গি হামলা হচ্ছে– এটি একটি দুর্বল মতামত। আবার অনেক রাষ্ট্রে শরিয়া ও শরিয়া-সদৃশ রাষ্ট্রব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও জঙ্গি হামলা হচ্ছে। বরং সেই সকল দেশ থেকেই জঙ্গিবাদ কচুরিপানার মতো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। উদাহরণ: তুরস্ক, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও সৌদি আরব।

দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এটি সত্য যে, সরকারের বিশেষ কিছু বাহিনী দীর্ঘ কয়েক বছর জঙ্গিদের অপারেশনাল কর্মকাণ্ড বেশ দক্ষতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ রাখার সক্ষমতা দেখিয়েছে। তবে বর্তমানে যে নতুন মাত্রার জঙ্গিপনা দেখা দিয়েছে, তা মোকাবেলা করার সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহও দেখা দিয়েছে। সেভেন-ওয়ান যে আমাদের গোয়েন্দা ব্যর্থতার ফল, এটি স্পষ্ট। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো একই সময়ে জঙ্গি হামলার খবর জানতে পারে!

সমাজের উচ্চ স্তরের শত শত যুবক আত্নঘাতী হয়ে উঠছে, অথচ আমাদের গোয়েন্দারা টেরই পায়নি। আমাদের কাছে এখনও এমন কোনো পরিসংখ্যান নেই যে, কতজন বাংলাদেশি নাগরিক আইএসে যোগদান করেছে। খোদ ঢাকার ভিতরেই বহু মূলধারার প্রতিষ্ঠান থেকে শত শত শিক্ষার্থী নিখোঁজ, আমাদের গোয়েন্দারা জানতেই পারেনি। সেভেন-ওয়ানের পরে গোয়েন্দারা মাত্র দুদিন চারটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে শতাধিক ছাত্র নিখোঁজের সন্ধান পেয়েছে।

নিখোঁজ থাকাদের প্রায় শতভাগই উচ্চবিত্ত, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত একশ্রেণির কর্মকর্তার সন্তান।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে জঙ্গি নেটওয়ার্ক, এটি কি এক দিনে গড়ে উঠেছে? এ ধরনের নেটওয়ার্ক গঠনের জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। অথচ আমাদের গোয়েন্দারা আঁচ পায়নি, এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। এটি কি কেবল গোয়েন্দা ব্যর্থতা, নাকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে থাকা কেউ কেউ সেই সুযোগ করে দিচ্ছে?

আওয়ামী লীগের ভিতরের 'লোভী লীগ' অংশটির প্রতিনিধিবৃন্দ এই প্রশ্নটির উত্তর ভালো করেই দিতে পারবে। সরকারের উচিত কালবিলম্ব না করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যদের ভেটিংএর আওতায় আনা। এমনকি যে সকল 'লোভী লীগ'এর সদস্য অর্থের জন্য জামায়াত–শিবিরপন্থী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের পক্ষে কাজ করছে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

রাজনৈতিক দলগুলোর সুবিধাবাদিতা জঙ্গিবাদ উত্থানের পিছনে ভূমিকা রাখছে। একজন দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ কী করে আশা করেন যে, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বার্থে রাজনীতি করে? সমাজে তাদের রাজনীতি করতে দিয়ে জঙ্গিবাদ নির্মূল সম্ভব নয়। জামায়াতে ইসলামী কৌশল করে দেশের সমাজব্যবস্থা পরিবর্তন করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। তারা খুব দ্রুতই এগুচ্ছে, দুর্বল হচ্ছে বিএনপি।

জামায়াতে ইসলামী বহু ক্ষেত্রেই সফল। আজ যে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের নীল বিষে সমাজ আক্রান্ত, বাংলাদেশে এটির প্রাইমারি উৎস হচ্ছে ওই দল। বাংলাদেশে কল্পিত আইএস, হিজবুত তাহরির, জেএমবি কিংবা আনসারউল্লাহ বাংলা টিম হল জামায়াত ইসলামের রাজনীতির বাই-প্রডাক্ট।

কিছু দিন আগে ডা: জাফরউল্লাহ বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে আহ্বান জানিয়েছিলেন বিএনপি যেন জামায়াতকে ছেড়ে দেয়। মঞ্চে বেগম জিয়াও উপস্থিত ছিলেন। জাফরউল্লাহর আহ্বান বেগম জিয়া সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন। বিএনপি এবং জামায়াত একে অন্যের পরিপূরক। বর্তমান বাস্তবতায় বিএনপি জামায়াতকে ছাড়া অনেকটা রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো অন্ধ মানুষের মতো। জামায়াত জঙ্গিবাদের ম্যানুফ্যাকচারার– এটি কেবল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নয়, পশ্চিমা বিশ্বের প্রায় সকল রাষ্ট্রই বিশ্বাস করে। অথচ এই জামায়াত থেকে বিএনপিকে আলাদা করা সম্ভব নয়।

জামায়াত নামক বিষাক্ত সাপটি বেশ চতুরতার সঙ্গে এখন আওয়ামী লীগকে ছোবল দিচ্ছে। 'লোভী লীগ' জামায়াতকে বিষাক্ত ছোবল দেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীর জঙ্গি-অর্থনীতির প্রতি এই 'লোভী লীগ'এর দৃষ্টি রয়েছে। রাজশাহী, বগুড়া, সাতক্ষীরা বা চট্টগ্রামে এমন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী খুঁজে পাওয়া যাবে না যারা জামায়াতের সঙ্গে বোঝাপড়া না করে চলাফেরা করে। প্রায়ই গণমাধ্যমে দেখি, আওয়ামী লীগের নেতাদের টাকাপয়সা দিয়ে জামায়াতের সন্ত্রাসী নেতাকর্মীরা আইনের বাইরে থাকে।

দেশের জঙ্গিবাদের মূল কারণসমূহ নির্ণয় করা হয়তো একাডেমিক গবেষণার বিষয়। তবে আমরা যারা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সচেতন মানুষ, তারাও জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতসারে জঙ্গিবাদে ভূমিকা রাখছি। এই ভূমিকাগুলো নিয়ে এখন ভাবার সময় হয়েছে।