জঙ্গি মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্য চাই

আমানুল্লাহ কবীর
Published : 13 July 2016, 05:37 PM
Updated : 13 July 2016, 05:37 PM

১ জুলাই গুলশানে কূটনৈতিক পাড়ার রেস্তোরাঁয় যে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা হয়েছে, তা আমাদের বিস্মিত করলেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। ঘটনাটা ছিল কেবল সময়ের ব্যবধানের ব্যাপার। এটা ছিল অব্যাহত জঙ্গি তৎপরতার সর্বশেষ ও সবচেয়ে ভয়াবহ বহি:প্রকাশ। বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন।

গত কয়েক বছর যাবত জঙ্গিদের হাতে একের পর এক খুন হয়েছে ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, বিদেশি ব্যবসায়ী ও এনজিও কর্মকর্তা, ধর্মীয় নেতা এবং সমকামী অধিকারের প্রবক্তা। এসব অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস ও আল-কায়দা। তারা ঘোষণা দিয়েই বাংলাদেশে তাদের তৎপরতা চালাচ্ছে এবং ঘটনা ঘটার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আইএস গুলশানের রেস্তোরাঁয় হামলা ও হত্যার দায় স্বীকার করে ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশে তাদের নেটওয়ার্ক যে যথেষ্ট শক্তিশালী এটা তা-ই প্রমাণ করে। বিভিন্ন জঙ্গি কৌশলের দিক থেকেও যে তারা পরিপক্ক, গুলশানের ঘটনা যারা টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছেন তাদের কাছে তা আর অস্পষ্ট নয়।

সফট টার্গেট (soft target) হিসেবে যে রেস্তোরাঁটি বেছে নেওয়া হয়েছিল, তার খাবারের আকর্ষণ দেশি-বিদেশি উভয় ভোজনবিলাসীদের কাছেই ছিল বেশ। যাদের জিম্মি করা হয়েছিল তাদের অধিকাংশই বিদেশি। ফলে, সারা বিশ্বের মিডিয়াতেই এই খবর প্রচার হয়, যা বাংলাদেশে জঙ্গিদের অস্তিত্বের জানান দেয় ব্যাপকভাবে। যে বিশজনকে হত্যা করা হয়েছে, তাদের তিনজন ছাড়া বাদবাকি সবাই বিদেশি। যে কারণে বিদেশি দেশগুলোর মধ্যে আরও প্রবল প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এখন সরকার যতই বলুক দেশে আইএস বা আল-কায়দার সাংগঠনিক অস্তিত্ব নেই, বাইরের দুনিয়ার কেউ সহজে তা বিশ্বাস করতে চাইবে না। ফলে বাংলাদেশের উপর নতুন করে চাপ সৃষ্টি হবে।

গুলশানের মর্মান্তিক ঘটনায় নিহত হয়েছে সর্বমোট ২৮ জন, তাদের দুজন পুলিশ কর্মকর্তা ও পাঁচজন জঙ্গি। নিহতদের মধ্যে কয়েকজন নারীও রয়েছে। সরকারিভাবে দুদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয়। এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম ও শেষ, আর রাষ্ট্রীয় শোক পালন করতে হবে না, এটা নিশ্চিত করাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ।

আইএস ও আল-কায়েদা যদি বাংলাদেশকে তাদের নিয়মিত হামলার তালিকাভুক্ত করে থাকে– এখন অবশ্য সে রকমই মনে হচ্ছে– তাহলে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি যথেষ্ট কিনা, তা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখতে হবে। কেননা, একবার বাংলাদেশ vulnerable প্রমাণিত হলে এ ধরনের বা এর চেয়েও বড় ধরনের জঙ্গি হামলা ঘন ঘন ঘটতে থাকবে।

আজ যেসব বিদেশি রাষ্ট্র সন্ত্রাস দমনে সাহায্য করতে চাচ্ছে, যা আমরা গ্রহণ করছি না, তখন তাদেরই ডেকে আনার জন্য পরিস্থিতি বাধ্য করবে। যে রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতি এখন পাকিস্তান পর্যন্ত বিস্তারিত, তা তখন ঢুকে পড়বে আমাদের দেশেও। তখন কেবল বাংলাদেশেরই নয়, গোটা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক দৃশ্যই পাল্টে যাবে, যা হবে এ অঞ্চলের দেশগুলোর স্বার্থের প্রতি মারাত্মক হুমকি।

গুলশানের ঘটনা থেকে এটা স্পষ্ট যে জঙ্গিরা তাদের কৌশল পাল্টে এখন বড় ধরনের টার্গেটের দিকে দৃষ্টি দিয়েছে। এতদিন তাদের টার্গেট ছিল ব্যক্তিবিশেষ, এখন তাদের টার্গেট হচ্ছে ব্যক্তিসমষ্টি ও প্রতিষ্ঠান। জঙ্গিরা তাদের কৌশল পাল্টালেও আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী শত্রুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের প্রতিহত বা মোকাবিলার জন্য পাল্টা কৌশল রচনা করতে পারেনি; অন্য কথায় ব্যর্থ হয়েছে।

এই ব্যর্থতার দুটি প্রধান কারণ হচ্ছে: এক, প্রয়োজনীয় গোয়েন্দা তথ্যের (intelligence) অভাব; দুই, গোয়েন্দা তথ্যের অভাবে সন্ত্রাসের মাত্রা কী হতে পারে তার ধারণা থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের পাল্টা রণকৌশল নির্ধারণে তৎপরতাহীনতা। এছাড়া রয়েছে রাজনৈতিক কারণে আমাদের নীতিনির্ধারকদের স্বচ্ছ ও সুস্থ চিন্তার সীমাবদ্ধতা, আত্মতুষ্টি ও অহংবোধ, যা গোটা জঙ্গি পরিস্থতিকেই ধোঁয়াশে করে রেখেছে।

অল্প কয়েকদিন আগেই জঙ্গিবিরোধী সপ্তাহব্যাপী অভিযান পরিচালনা করা হয়, যে অভিযানে প্রায় ১৪,০০০ লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মাত্র দুই শতাধিক সন্দেহভাজন বা তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। কোনো দাগী সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার হয়েছে বলে জানা যায়নি। গ্রেফতারকৃতদের প্রায় আড়াই হাজার বিরোধী দল বিএনপির নেতাকর্মী। অভিযান চলাকালে অভিযানের মূল উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন উঠেছিল। অভিযান শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ-র‌্যাবের কর্মকর্তারা তা সত্বেও এ অভিযান সফল বলে দাবি করেন। তাদের এই 'সফল অভিযান' শেষ হওয়ার সপ্তাহখানেক পরেই ঘটে গুলশানের ভয়াবহ ট্রাজেডি। তাহলে জনগণ মন্ত্রী ও র‌্যাব-পুলিশের কর্মকর্তাদের কথায় কীভাবে আস্থা রাখবে?

গুলশান ঘটনার পর পুলিশ প্রধান অবশেষে স্বীকার করেছেন, একজন ছাড়া ওই ঘটনায় জঙ্গি হামলাকারীদের আর কারও সম্পর্কে তাদের কাছে কোনো তথ্য ছিল না। প্রকারান্তরে তিনি ইন্টেলিজেন্সের ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়েছেন। সত্য স্বীকারে দোষ নেই, তাহলে বাস্তববাদী হওয়া যায়। নিরস্ত্র মানুষকে ক্রসফায়ারে দিয়ে অভ্যস্ত র‌্যাব-পুলিশ তেমনি সহজভাবে নিয়েছিল গুলশানের ঘটনাটি। প্রথমদিকে ঘটনার গুরুত্বই উপলব্ধি করতে পারেনি তারা, যে কারণে দুজন পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে।

এমন বাস্তবতাবিবর্জিত বাহিনী দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের মোকাবিলা করবে কী করে? অহংবাদী রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীদের মতো র‌্যাব-পুলিশের কর্মকর্তারাও এখন রাজনীতির ভাষায় কথা বলে এবং রাজনৈতিক কর্মীর মতো কাজ করে। ধারাবাহিকভাবে জঙ্গিরা একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটালেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও র‌্যাব-পুলিশের কর্মকর্তারা সেসব ঘটনা 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা' বলে আখ্যায়িত করেছেন বারংবার।

প্রশ্ন করা হলেই বলা হত, জঙ্গিদের আমরা জাল দিয়ে ঘিরে ফেলেছি, এখন কেবল পাকড়াও করা বাকি। গুলশান ট্র্যাজেডির পর এখন তারা কী বলবেন?

রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলা আমাদের প্রচলিত বিশ্বাসে প্রচণ্ড আঘাত হেনেছে, যে আঘাত আমাদের ও আমাদের নীতিনির্ধারকদের চোখ-কান নতুনভাবে খুলে দিয়েছে। ওই হামলার আগ পর্যন্ত আমাদের বিশ্বাস ছিল যে, দেশের মাদ্রাসাগুলো হচ্ছে জঙ্গি উৎপাদন কারখানা, মাদ্রাসার ছাত্ররা আর্থিকভাবে দুর্বল হওয়ায় সহজেই প্রলুব্ধ হচ্ছে আইএস ও আল-কায়দার মতো আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর প্ররোচনায়।

কিন্তু রেস্তোরাঁয় হামলাকারীদের একজন ছাড়া বাকিদের পারিবারিক ও শিক্ষাগত পরিচয় ভিমরি খাওয়ার মতো। যে পাঁচজনের ছবি ও পরিচয় পাওয়া গেছে তাদের তিনজনই উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান এবং লেখাপড়া করেছে ঢাকার খানদানি স্কুলে, ইংরেজি মাধ্যমে। এ দুটি স্কুল হচ্ছে স্কলাসটিকা ও টার্কিশ হোপ স্কুল। তাদের দুজন হচ্ছে মালয়েশিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এদের কেবল একজন মাদ্রাসার ছাত্র বলে জানা গেছে। বাকি একজনের পরিচয় পাওয়া গেছে একটি কিন্তারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক হিসেবে।

বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, হামলাকারী জঙ্গিদের অন্যতম রোহান ইমতিয়াজ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন নেতার ছেলে। এটা যে কেবল বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই ঘটেছে, তা নয়। বিভিন্ন দেশে জঙ্গি হামলা থেকে দেখা যায়, ওইসব দেশের জঙ্গিরাও, যারা বাংলাদেশের তরুণদের মতো আইএস-এর ধর্মীয় প্ররোচনায় আকৃষ্ট হয়েছে তারা মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মাধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত।

কেন মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণরা জঙ্গি আইএস ও আল-কায়েদার প্রচারণায় আকৃষ্ট হচ্ছে, তা বিরাট গবেষণার বিষয়। তবে আইএস ও আল-কায়েদার প্রচারণা ও যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি, যা কেবল আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতরাই ব্যবহার করতে পারে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মুসলমানদের একটা অংশ কেন খিলাফত যুগে ফিরে যেতে চায় তা অবশ্য ভাববার বিষয়।

যাহোক, সোশ্যাল মিডিয়া এমনই শক্তিশালী মাধ্যম যে হাজার হাজার মাইল দূরে বসে একজন আরেকজনের সঙ্গে বার্তা বিনিময় ও আলাপ-আলোচনা করতে পারে। সশরীরে উপস্থিত না থেকেও কার্যকরভাবে বার্তা ও মতবিনিময় করা যায়, যা পরস্পরের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং সশরীরে বা সাংগঠনিকভাবে উপস্থিত না থেকেও আইএস বা আল-কায়েদা তার অনুসারীদের মাধ্যমে কর্মকাণ্ড চালাতে সক্ষম। সরকার যাদের home-grown বা দেশজ জঙ্গি বলছে, এরা তারাই।

তবে গুলশান ট্রাজেডির পর একটু আগ বাড়িয়ে ভাবতে হবে। কেননা, হামলাকারী জঙ্গিরা ছিল সুশিক্ষিত ও সুসংগঠিত, যা সম্ভব কেবল প্রাতিষ্ঠানিক ও সমন্বিত নেতৃত্বের মাধ্যমে, যে নেতৃত্ব বাংলাদেশের ভেতর থেকেও হতে পারে, বাইরে থেকেও হতে পারে।

আইএস-এর দাবি অনুসারে তার একটা বাংলাদেশ শাখা রয়েছে, যার নেতৃত্বে রয়েছে এদেশেরই এক নাগরিক। আইএস-এর দাবির পক্ষে প্রমাণ হল যে, হামলা চলাকালেই আইএস-এর বার্তা সংস্থা 'আমাক' জিম্মি পরিস্থিতির বিষয়ে খবর ও ছবি প্রকাশ করে। এই সূত্র নিহতদের যে সংখ্যা উল্লেখ করেছিল অভিযান শেষে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ওই সংখ্যাই বলা হয়েছে। এটা এখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর দায়িত্ব খুঁজে বের করা কারা হামলার পরিকল্পনা ও পরিচালনা করেছিল, তাদের অবস্থান কোথায়– দেশের অভ্যন্তরে, না বাইরে। তাহলে স্পষ্ট হবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আইএস-এর কোনো সাংগঠনিক অস্তিত্ব আছে কি না।

অনুসন্ধানে আরও যেসব বিষয় পরিস্কার হওয়া দরকার সেগুলো হচ্ছে, হামলাকারীরা home-grown হলেও তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় কারা দিচ্ছে, কারা তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, কোথা থেকে তারা অর্থ ও অস্ত্র পাচ্ছে ইত্যাদি। home-grown জঙ্গি বলে তাদের হালকাভাবে দেখার কোনো উপায় নেই। কেননা আইএস বা আল-কায়েদার মূল নেতৃত্বে ভিনদেশি কারও উপস্থিতি ছাড়াও home-grown জঙ্গিদের সমন্বয়েই এদেশে তাদের শাখা-প্রশাখা গড়ে উঠতে পারে। সেটা বরং এসব আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের জন্য সুখবর।

সরকারকে কীভাবে জঙ্গি মোকাবিলা করতে হবে– বিদেশি সহযোগিতার সমন্বয়ে, না তাদের সহযোগিতা ছাড়া, তা নির্ভর করবে অনুসন্ধানে আইএস বা আল-কায়েদার অস্তিত্ব কোথায় রয়েছে– দেশের ভেতরে, না বাইরে। যেখানেই থাক, গুলশানের রেস্তোরাঁয় হামলার পর এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, দৌড়ে আমাদের র‌্যাব-পুলিশ জঙ্গিদের থেকে পিছিয়ে আছে, যে কারণে সেনাবাহিনীর সহায়তায় জিম্মিদের মুক্ত করতে কমান্ডো হামলা চালাতে বিলম্ব হয়েছে দশ ঘণ্টারও বেশি সময়। এই দীর্ঘ বিলম্বের কারণে প্রাণহানিও ঘটেছে বেশি।

পুলিশ প্রধান বিলম্বের জন্য দায় স্বীকার না করে বরং বলেছেন, জঙ্গিরা হামলার বিশ মিনিটের মধ্যেই অধিকাংশ জিম্মিকে হত্যা করে। তবে প্রশংসনীয় যে, কমান্ডো অপারেশন শেষ হয়েছে পনেরো মিনিটেরও কম সময়ে এবং জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে তেরো জিম্মিকে।

গুলশানের ঘটনার পর শোলাকিয়ার ঘটনা। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে মনে হয় জঙ্গিদের প্রস্তুতি রয়েছে, তারা যে কোনো সময় দেশের যে কোনো স্থানে এ ধরনের ও এর চেয়ে বড় ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে। এ কথা স্মরণে রেখেই সরকার ও আইন-শৃ্খলা রক্ষাবাহিনীকে প্রয়োজনীয় পাল্টা প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।

এটা ঠিক, আন্তর্জাতিক জঙ্গি তৎপরতা আন্তর্জাতিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে যে জঙ্গি হামলা হচ্ছে তা আন্তর্জাতিক জঙ্গি কর্মকাণ্ডেরই অংশ। বিশ্বটা 'Global village'-এ পরিণত হওয়ায় প্রায় সব দেশের নাগরিকই কোনো-না-কোনো কারণে প্রায় সব দেশেই রয়েছে এবং হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থিত থাকলেও এক দেশ যেন আরেক দেশের প্রতিবেশি। যে কারণে কোনো দেশে জঙ্গি হামলা হলে তৎক্ষণাৎ অন্যান্য দেশেও তার প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি খুবই গরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক জঙ্গি তৎপরতার পেছনে আন্তর্জাতিক রাজনীতি রয়েছে। এই আন্তর্জাতিক রাজনীতি পরিচালিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় বন্ধু দেশগুলো দ্বারা। আর তাদের সঙ্গে মিত্র হিসেবে কাজ করছে আরবের রাজতন্ত্রগুলো ও ইজরায়েল।

এটা আজ আর কারও অজানা নয় যে, মিথ্যা অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়ায় যে পশ্চিমা আগ্রাসী অভিযান চলে তা-ই জন্ম দিয়েছে আজকের আন্তর্জাতিক জঙ্গি তৎপরতা। ভৌগলিক ও মুসলমানপ্রধান দেশ হওয়ার কারণে আমাদের দেশ টার্গেট হয়েছে আন্তর্জাতিক জঙ্গি কর্মকাণ্ডের। জঙ্গিরা বাংলাদেশকে ঘাঁটি করে তাদের তৎপরতা চালাতে চায় প্রতিবেশী হিন্দুপ্রধান ভারতে ও বৌদ্ধপ্রধান মিয়ানমারে।

গুলশানে হামলা চলাকালেই কয়েকটি পশ্চিমা দেশ জঙ্গি দমনে বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার জন্য আবার তাদের আগ্রহের কথা জানিয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকাস্থ কূটনীতিকদের পরিস্থিতির উপর ব্রিফিং করার সময় তাদের সহযোগিতাও চেয়েছেন। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল ঢাকা সফর করেছেন। এখন আমাদের সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে জঙ্গি সামাল দিতে কোন দেশের কী ধরনের ও কতটুকু সহযোগিতা গ্রহণ করবে।

বিদেশি সাহায্য-সহযোগিতা গ্রহণের বেলায় অবশ্যই বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। ভৌগলিক কারণেই বাংলাদেশ ও ভারতের নিরাপত্তা পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের প্রায় তিন দিকেই ঘিরে আছে ভারত। বাংলাদেশের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি দেখা দিলে তা ভারতের জন্যও উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দেয়। অভ্যন্তরীণভাবে বাংলাদেশ নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই এবং এতে সবচেয়ে উদ্বিগ্ন ভারত। কারণ ভারত নিজের নিরাপত্তার স্বার্থেই প্রতিবেশী দেশে জঙ্গি উত্থান নীরবে মেনে নিতে পারে না। আবার, ভারতকে উপেক্ষা করেও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কোনো দেশের সাহায্য-সহযোগিতা নিতে পারে না।

যে বিষয়টা আমাদের বড় ধরনের ভরসা দিতে পারে তা হল, প্রতিবেশি ভারত ও মিয়ানমার তাদের স্বার্থেই জঙ্গি তৎপরতার জন্য তাদের ভূমি ব্যবহার করতে দেবে না এবং অন্য কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেবে না। এই নিশ্চয়তা পেলে বাংলাদশ কেন নিজের শক্তিতে জঙ্গিদের দমন করতে পারবে না?

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র ইউরোপীয় দেশগুলো জঙ্গি মোকাবিলায় সাহায্য-সহযোগিতা করতে চায় তাদের আন্তর্জাতিক রাজনীতির অংশ হিসেবে, যা একপর্যায়ে জাতীয় নিরাপত্তাকেই হুমকির মধ্যে ঠেলে দিতে পারে।

জঙ্গি কর্মকাণ্ড আমাদের জন্য জাতীয় সংকট সৃষ্টি করেছে। জাতীয় সংকট জাতীয়ভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। আর এ জন্য দরকার জাতীয় ঐক্য। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে জনগণ আজ দ্বিধাবিভক্ত। এই বিভক্তির ফলেই জঙ্গিরা সমাজের কোনো-না-কোনো অংশের আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে বেড়ে উঠছে। এ জন্য দায়ী রাজনীতিকরা যারা প্রকৃত অবস্থা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য blame game বা পরস্পরকে দোষারোপের রজনীতির আশ্রয় নিয়ে সমাজকে বিভক্ত করে রেখেছে।

বিভক্তির জন্য ক্ষমতাসীন দল সাময়িকভাবে লাভবান হলেও সব সময়ের জন্য লাভবান হতে পারে না, যার প্রমাণ এখন স্বচক্ষেই দেখতে পাচ্ছি। জঙ্গি দমন কেন্দ্র করে সরকার টার্গেট করেছে বিরোধী দল, বিশেষত বিএনপিকে। কেননা এখনও ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী একমাত্র বিএনপিই। জেল-জুলুম করে সরকার সফলভাবেই বিএনপি নেতৃত্বের মাজা ভেঙ্গে দিয়েছে। রাজনীতি রাস্তায় নেই, চার দেয়ালে বন্দি। তারপরও কি সরকার জঙ্গি দমন করতে পেরেছে?

সরকার নিজেই বলছে জঙ্গিরা home-grown, তার অর্থ জঙ্গিদের শিকড় এদেশের মাটিতেই। তাদের জন্ম যে কেবল বিএনপি-জামায়াতের পরিবারেই নয়, আওয়ামী লীগের পরিবারেও, তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি গুলশান ঘটনার পর।

বাস্তবতা হচ্ছে, জঙ্গিদের সঙ্গে জড়িত রাজনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজ। সমাজ থেকে জঙ্গিবাদের নির্মূল করতে এই চারের সমন্বিত প্রয়াস দরকার। অর্থাৎ রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে যারা জড়িত তাদের সমন্বয়ে সর্বস্তরে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

এ উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে একমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোই, বিশেষত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি-প্রধান বেগম খালেদা জিয়া উভয়েই জঙ্গি মোকাবিলার জন্য ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বিএনপিসহ কয়েকটি দল যে জাতীয় কনভেনশন ডাকার দাবি করেছে, তা পাশ কাটিয়ে সকল স্তরে জঙ্গিবিরোধী কমিটি গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। অর্থাৎ জাতির এই ভয়াবহ সংকট মুহূর্তেও জাতীয় ঐক্যের বিষয়টি অমীমাংসিতই থেকে যাচ্ছে।

জাতি বিভক্ত হলে পরিণতি কী হয়, তা আমরা স্বচক্ষেই দেখতে পাচ্ছি ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়াসহ বিভিন্ন দেশে। জাতীয় ঐক্য সংহত না করে বহির্বিশ্বের সাহায্য-সহযোগিতা নেওয়াও হবে আত্মঘাতী।