সন্ত্রাসের বিস্তার এবং সামাজিক প্রতিরোধ

ডা. এম এ হাসান
Published : 11 July 2016, 01:19 PM
Updated : 11 July 2016, 01:19 PM

Conflict, violence, strife and unrest not only shatters peace, it terribly shrinks the economic stability causing social turmoil, further strife, poverty and displacement.

Poverty it invokes not only in terms of wealth, it relates food, basic needs, shelters etc.

সন্ত্রাস কী:

সন্ত্রাসের শুরুটাই হল অসহিষ্ণুতা, হীনমন্যতা, ভারসাম্যহীন প্রেরণা তথা Disorganized thinking process এবং নষ্ট ইল্যুশনের মধ্য দিয়ে। এই নষ্ট মাইন্ডসেট উদ্ভুত চিন্তা-চেতনা সন্ত্রাসীর মনোজগতে এমন ক্রোধ ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ ইচ্ছা সৃষ্টি করে যা তাকে টেনে নেয় হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে। এই নষ্ট কর্মের মধ্য দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা বিস্তার করার পরিবেশ তৈরি হয় বলে মনে করে সন্ত্রাসীচক্র এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকগণ। সন্ত্রাসীকর্ম প্রতিটি সন্ত্রাসীকে উচ্চমাপে নিয়ে যায় বলে তারা বিশ্বাস করে। একে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর চিন্তা ও পরিচয় অধিকতর পরিচিত করবার পথ বলে মনে করে সন্ত্রাসের পথে পা-দেওয়া মানুষগুলো।

আপাতদৃষ্টিতে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বিচ্ছিন্নভাবে সংগঠিত (Organized) বা অসংগঠিত (Disorganized)– দুধরনেরই হতে পারে। জটিল, দীর্ঘস্থায়ী ও বড় সন্ত্রাসগুলো অপেক্ষাকৃত সংগঠিত অপরাধ চিন্তার ফসল। ব্যক্তি ও গোষ্ঠী নিজেদের ইচ্ছা ও কল্পনাপ্রসূত চিন্তা সত্য জেনে পরিকল্পিতভাবে এমন ধ্বংসাত্মক কাজ করে যা রাষ্ট্র বা সমাজে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে।

সন্ত্রাসের সর্বোচ্চ রূপই হল জাতিগত যুদ্ধ এবং পররাজ্যে আগ্রাসন– যা কিনা একটি সম্পূর্ণ সংগঠিত অপরাধ (Organized Crime)। সকল যুদ্ধই আরও যুদ্ধ, সংঘাত ও সন্ত্রাস টেনে আনে।

সন্ত্রাসের কারণ:

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সন্ত্রাসের নানা জটিল কারণ ব্যাখ্যা করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। তবে সমস্যার গভীরে পৌঁছাবার জন্য এ বিষয় ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন। এ সমস্যার কারণ–

১. সমাজের অভ্যন্তরে গভীর ভারসাম্যহীনতা ও বিত্তের বৈষম্য;

২. মানুষের সাধ্যের সঙ্গে স্বপ্নের এবং চাওয়ার সঙ্গে পাওয়ার অসীম দূরত্ব, ইচ্ছার সঙ্গে নিজ শক্তির সীমাহীন ভারসাম্যহীনতা এবং শরীর ও মনের অক্ষমতা;

৩. আপন সত্তার সঙ্গে নিজের এবং নিজের সঙ্গে পরিবারের ও সমাজের অমোচনীয় দ্বন্দ্ব;

৪. অশিক্ষা, দারিদ্র এবং কর্মসংস্থানের অভাব;

৫. ভুল পথে পরিচালিত ধর্মশিক্ষা;

৬. সামাজিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ন্যায় ও সাম্যের অভাব;

৭. সমাজে বৈষম্যভিত্তিক নিপীড়ন ও পরসম্পদ লুণ্ঠন;

৮. দেশের অভ্যন্তরে পরাজিত শক্তির সহিংস উত্থান; বিপথে বিত্ত ও শক্তির উত্থান;

৯. লুটপাটের মাধ্যমে লুম্পেন, লুটেরা ও জোতদার-মজুতদার দখলদার শ্রেণির উদ্ভব এবং ক্ষমতা অর্জন;

১০. রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতান্ত্রিক চেতনা বা Collective নেতৃত্বের অভাব;

১১. ভোগবাদী বাজার সংস্কৃতি ও গ্লোবালাইজেশনের একচ্ছত্র অভিযান। জীবন পদ্ধতি এবং জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে ভুল সংকেত প্রেরণ;

১২. সমাজে নষ্ট ব্যক্তিদের চালিকা শক্তিতে অবস্থান এবং পরিকল্পিতভাবে এদের দ্বারা জনগণের শক্তি, মনোবল ও নৈতিক অধিকার অপহরণ;

১৩. ন্যায়ভিত্তিক সমাজ সৃষ্টিতে ব্যর্থতা। বিচারহীনতার কারণে অপরাধের বিস্তার ও সন্ত্রাসের সংক্রমণ ঘটে। এ প্রক্রিয়ায় অত্যাচারিত অপরাধীর নষ্ট চরিত্র নিজের মধ্যেই শুষে নেয়;

১৪. প্রত্যক্ষ সামাজিক যোগাযোগের অভাব এবং পারিবারিক তথা সামাজিক Integrationএ ব্যর্থতা;

১৫. নষ্ট পথে পরিচালিত আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং দেশে দেশে চাপিয়ে দেওয়া সংঘাত;

১৬. ন্যায় ও সত্যের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতা;

১৭. আত্মপরিচয়ের সংকট।

শক্তি প্রয়োগ ও সংঘাতের মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমষ্টির উপর আঘাত এনে ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি করে বা ভীতির আবহ তৈরি করে সাধারণ জনগণের মনে ভীতি সৃষ্টি করা সন্ত্রাসের প্রাথমিক লক্ষ্য। ভিন্নমত, সংস্কৃতি ও দর্শনে বিশ্বাসী তথা ভিন্ন জাতি ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর উপর উগ্র আঘাত হেনে সরকার ও জনগণের উপরে চাপ সৃষ্টি করে ফায়দা লাভের প্রচেষ্টা এবং এর বাস্তবায়নকে সন্ত্রাসবাদ হিসেবে অভিহিত করা হয়।

বর্তমান সময়ে এই সন্ত্রাস সংজ্ঞায়িত করতে যেয়ে বলা হচ্ছে:

It is defined as the use of violence, or threatened use of violence, in order to achieve a political, religious, or ideological aim.

একে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এবং জাতিসংঘ। তবে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থ এবং আগ্রাসী চক্রের নষ্ট পরিকল্পনার কারণে সন্ত্রাসের উৎপত্তি, লালন ও বিস্তৃতি এমনকি এর সংজ্ঞা একটি ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছে। সন্ত্রাসবাদ নতুন কিছু নয়। প্রাচীন যুগে শক্তিধর গোষ্ঠীসহ নানা দেশের নিষ্ঠুর উপজাতি তথা নিপৃতিগণ ভয়াবহ নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে অরগানাইজড সন্ত্রাস সৃষ্টি করে বিশেষ জাতি ও গোষ্ঠীর মর্যাদা ও মনোবল ছিন্নভিন্ন করার চেষ্টা করেছে।

কিছু বিশেষজ্ঞ Terrorism শব্দের শাব্দিক উৎপত্তি ব্যাখ্যা করেছেন ১৭৯৩-১৭৯৪ সালে ফরাসি সরকার কর্তৃক ব্যবহৃত Terrorisme শব্দ থেকে। তবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বা সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসের উৎপত্তি আরও পুরানো। খ্রিস্টপূর্ব ১০৫ সনে Cimbri গোত্রভুক্ত যোদ্ধারা যখন রোম আক্রমণ করে তখন রোম সরকার Terror Cimbricus নামক একটি কৌশল প্রয়োগ করে। সেই থেকে ক্ষমতাসীনদের উপর বৈধ ও অবৈধ আঘাতকেই সন্ত্রাস বলে ব্যাখ্যা করা হয়। তারপর স্পষ্ট করা প্রয়োজন যে, ব্যক্তি-স্বার্থ, গোষ্ঠী-স্বার্থ এবং সামষ্টিক-স্বার্থে পরিকল্পিতভাবে যুদ্ধের বাইরে সাধারণের উপর যে আঘাত হানা হয় সেটাই সন্ত্রাস।

সন্ত্রাসের কারণ এবং লক্ষ্য তথা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের পদ্ধতিগুলো অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন সন্ত্রাসের বৈশ্বিক বিস্তার অনুভবের জন্য। সন্ত্রাসের পেছনে থাকে ভয়াবহ আবেগ, ঘৃণা, ক্রোধ, অসহিষ্ণুতা এবং অনেক ক্ষেত্রে সীমাহীন লোভ। ২০০৪ সালে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল Terrorism কে এমনভাবে ব্যাখ্যা করেন:

It is intended to cause death or serious bodily harm to civilians or non-combatants with the purpose of intimidating a population or compelling a government or an international organization to do or abstain from doing any act.

বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে প্রত্যেক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থসহ ধর্মীয় ও গোষ্ঠীগত অসহিষ্ণুতার প্রভাব থাকে সুগভীরভাবে। ব্যক্তি ও সমষ্টির নিজস্ব ঘৃণা ও ঘৃণ্য কৌশলকে সমষ্টির আবেগে মুড়িয়ে সন্ত্রাসী উন্মাদনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার বহু উদাহরণ রয়েছে। দেশে দেশে সংঘটিত বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডগুলো মালা গেঁথে নানা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্রের সঙ্গে সেতুবন্ধন স্থাপনের চেষ্টা এমন কৌশলের উদাহরণ– যেটা এখন বাংলাদেশে ঘটছে।

সন্ত্রাসের মূলধারার উপর আঘাত হানলে তা আবার ক্ষুদ্রাকার নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। যেমনটি হয়েছে বিন লাদেনের উপর আঘাতের পর। একে কাণ্ড থেকে পত্র (Tree trunk to leaves) জাতীয় সন্ত্রাস বিস্তার বলা যেতে পারে।

সস্ত্রাস ও আত্মপরিচয়

মানুষের চলন, বলন, কথনসহ তাদের ভাবনা ও গুরুত্বপূর্ণ নানা কর্ম যেমন মানুষের বুদ্ধিভিত্তিক প্রণোদনা প্রকাশ করে তেমনি এগুলো ব্যাপকভাবে প্রকাশ করে এক এক জন মানুষের আত্মপরিচয়।

যেভাবে ইসলামি সন্ত্রাসের শুরু

আফগানিস্তানের মাটিতে যে ইসলামি মুজাহিদ গোষ্ঠীকে যুক্তরাষ্ট্র এক সময় সাহায্য করেছিল তারাই আমেরিকাসহ পাশ্চাত্য গোষ্ঠীকে দেশ থেকে বিতাড়িত করতে যুদ্ধ ও সংঘাতে জড়ায়। তাতে ইসলামি জনগোষ্ঠীর দুধারার মানুষ সম্পৃক্ত হয়। এর মধ্যে একটি ইরান ও শিয়া-প্রভাবিত মুজাহিদিন গোষ্ঠী; অন্যটি পাকিস্তান ও সৌদি সুন্নি গোষ্ঠী প্রভাবিত তালেবান। আইএসআই ও পাকিস্তানে প্রশিক্ষিত তালেবান গোষ্ঠী আল-কায়দা নাম গ্রহণ করে। এর অর্থ The way বা পথ।

আল-কায়দার সঙ্গে সিআইএএর সখ্যতার বিষয় বা ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে বুশ পরিবারের নৈকট্যের বিষয় অনেকেই জানেন। মুজাহিদ খালক নেতা ছিলেন মোল্লা মাসুদ বা আহমেদ শাহ মাসুদ নামক এমন এক গেরিলা কমান্ডার ছিলেন যে কিনা সমর-কৌশলে সেরা সমরবিদদের মতো মেধাবী ছিলেন। দেশপ্রেমিক এই নেতা আফগানিস্তানের প্রকৃত সমস্যা ও সমাধান দুটোই ভালো বুঝেছিলেন।

তালেবানদের নেতা ছিল মোল্লা ওমর। তালেবানদের উপর সওয়ার হয়ে লাদেন ও ইসলামি ব্রাদারহুড গোষ্ঠী সৃষ্টি করে আল-কায়দা। আল-কায়দার নেতা লাদেন ও তাদের অন্য শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত কিছু আরব ও পাকিস্তানি সামরিক সদস্যের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। আইএসআই ও সিআইএ প্রভাবিত আল-কায়দার নেতা হয়েছিল বিন লাদেন। সিআইএ ও আইএসআইএর সহযোগিতায় তারা মোল্লা মাসুদকে সুকৌশলে হত্যা করে এবং নিজেদের নেতৃত্ব কণ্টকবিহীন করে। এরাই টুইন ইন টাওয়ার ধ্বংসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

ওই পরিকল্পনায় এমন কিছু বুদ্ধিমান ও শক্তিধর গোষ্ঠী পর্দার পেছন থেকে কলকাঠি নাড়াচ্ছিল যারা চাচ্ছিল মুসলমান ও খ্রিস্টানদের মধ্যে এমন বিরোধ সৃষ্টি করতে যা সহজে শেষ না হয়। এ ক্ষেত্রে অনেকে মোসাদ এবং কিছু ইউরোপীয় গোয়েন্দা বাহিনীকে সন্দেহের চোখে দেখেছে। এই সংঘাতের ফায়দা গ্রহণের চেষ্টা করে নানা দেশের অস্ত্র-বিক্রেতারা। এতে যে সন্ত্রাস ও সংঘাত শুরু হয় তা সোমালিয়া থেকে ইয়েমেন, ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।

বিবেক-বিবেচনাহীন ইরাক যুদ্ধ এবং লিবিয়ার নেতা গাদ্দাফির হত্যা এই সন্ত্রাস বিস্তারে অপরিমেয় ঘৃতাগ্নি সংযুক্ত করেছে।

আল-কায়দার মতো একই প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়েছে আইএস। মূলত সাদ্দামের পতনের পর পর ইরাকের শক্তিধর সুন্নি গোষ্ঠীগুলো ক্ষমতার বলয় থেকে ছিটকে পড়ার সঙ্গে আইএসএর উদ্ভবের সম্পর্ক রয়েছে। সাদ্দাম হোসেনের সমর্থক সেনাবাহিনী, সুন্নি সেনা কর্মকর্তারাই আইএস সৃষ্টিতে মূখ্য ভূমিকা পালন করে। ইরানবিরোধী আরব দেশগুলো শুরুতে এদেরকে অস্ত্র ও অর্থ যোগান দেয়। এদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল শিয়া শাসকদের উৎখাত। পরবর্তীতে এরা সুন্নিশাসিত একটি মুক্ত অঞ্চল সৃষ্টির চেষ্টা করে।

এদের প্রাথমিক বিজয়ে উৎসাহিত হয়ে এদের মদদ দিতে এগিয়ে আসে পাকিস্তানের আইএসআই এবং সিআইএ। এরাই শিয়া ধর্মাবলম্বী সিরিয়ার শাসক আসাদকে উৎখাতের চেষ্টা চালায়। এদেরকে নিয়ে জটিল খেলায় মাতে ইউরোপ ও ইসরাইলের বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা এবং তুর্কি সরকার।

আরব ও ফিলিস্তানির প্রতি সহনুভূতিসম্পন্ন ইউরোপীয় দেশগুলোকে ইসলামবিদ্বেষী তথা মুসলিমদের প্রতি বৈরি করবার জন্যই আইএসকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে। ইউরোপ ও আমেরিকায় ইসলামের বিস্তার তথা ইসলামের প্রভাব কমিয়ে আনার জন্য নানা কায়দা ও কৌশল ব্যবহৃত হচ্ছে। জার্মান-নেতৃত্বাধীন ইউরোপ শক্তিশীল হোক এটা অনেকেই চায় না। এটা অধিকাংশ জার্মান নাগরিক ও ইউরোপীয় প্রগতিশীল মানুষের অন্তরের কথা। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এই ভ্রান্ত রাজনীতি থেকে ফিরে আসুক সেটা সকল বিবেকবান মানুষের আকাঙ্ক্ষা।

আরব বিশ্বে নানা যুদ্ধ-সংঘাতের মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ যেমন নিহত হয়েছে, তেমনি অনেকে গৃহহীন হয়ে অভিবাসী হয়েছে ইউরোপে। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে আলজেরিয়া, মরোক্কো, তিউনিসিয়াসহ আরব ও আফ্রিকার যে দেশগুলো ফ্রান্স ও বেলজিয়াম-শাসিত ছিল, সেখানকার মানুষেরা অভিবাসী হয়ে আছে ফ্রান্স বেলজিয়ামসহ ইউরোপের নানা দেশে। শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে থাকা, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এই গোষ্ঠী আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগছে। ফ্রান্সসহ এই সব দেশে অভিবাসীদের সাংস্কৃতিক ইন্টিগ্রেশন (একীভবন) নিম্ন পর্যায়ে হওয়ায় তারা জঙ্গিদেরকে আপন করে নিচ্ছে। আবার ঐ রাষ্ট্রগুলোর চিন্তা-চেতনা ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় ঐ সব স্থানে আইএসএর হামলা সহজ হয়ে উঠছে।

তবে এর সঙ্গে সিআইএ ও মোসাদের কোনো ভূমিকা রয়েছে কিনা সেটা ভেবে দেখা প্রয়োজন। ইরান-সমর্থিত হেজবুল্লাহ গোষ্ঠী ইসরাইলের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেও আইএস ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়িয়েছে এমন উদাহরণ নেই।

পক্ষান্তরে ইউরোপের জনগোষ্ঠী ছাড়া আইএসএর লক্ষ্য শিয়া, ইয়াজিদি ও কুর্দি জনগোষ্ঠী। প্রাচীন কুর্দি জনগোষ্ঠী যারা মানব সভ্যতা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছিল তাদেরকে যুগের পর যুগ অবদমন করে রেখেছে ইরান, ইরাক এবং সাম্রাজ্যবাদী তুর্কি শাসকগণ।

আরমেনিয়া গণহত্যার খলনায়ক তুর্কিদের নিষ্ঠুরতা তথা কর্তৃত্ববাদী চিন্তা অনেকটা ঐতিহাসিক। সার্বিক প্রেক্ষাপটে ইউরোপের মাটিতে যে অভিবাসী গোষ্ঠী ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর মূলধারায় সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারেনি এবং সেখানকার ঘেটোগুলোতে মানবেতর জীবন যাপন করছে, তাদের কেউ কেউ আইএসএর সমর্থক হয়ে উঠেছে প্রতিহিংসা ও হীনমন্যতার কারণেই। মুক্তচিন্তার নামে নানা ধর্মের স্পর্শকাতর বিষয়ে তীর্যক মন্তব্য তথা সমালোচনা সুকৌশলে ব্যবহৃত হয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দ্বারা। তারা সব সময় বৈষম্য ও জনঅসন্তোষ কাজে লাগিয়ে ফায়দা লাভের চেষ্টা করে। এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নতুন কর্মী ও সমর্থক সংগ্রহ করে তারা।

সাম্প্রতিক সময়ে লিবিয়ার শাসক গাদ্দাফিকে যেভাবে অপসারণ করা হয়েছে এবং সাদ্দাম ও গাদ্দাফির সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে তা যেমন সন্ত্রাসী সৃষ্টিতে প্রণোদনা হিসেবে কাজ করেছে, তেমনি তাদের অবর্তমানে রাষ্ট্র ও সমাজে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা সন্ত্রাসী সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি করেছে। সিরিয়াতে যে লক্ষ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়েছে তার যৎকিঞ্চিত মূল্য পরিশোধ করছে আরব ও ইউরোপীয় নানা দেশ।

প্রতিটি যুদ্ধ ও সংঘাত নতুন সংঘাত ও মৃত্যু টেনে আনে। বৈশ্বিক জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় করতে হলে সমগ্র বিশ্বের শাসন ব্যবস্থা তথা অর্থনৈতিক কাঠামো নতুন করে সাজাতে হবে। যতদিন পর্যন্ত পাশ্চাত্য শক্তি আরব বা আফ্রিকার মাটিতে শাসন ও শোষণের ইতি না টানছে, ততদিন কোনো না কোনোভাবে সন্ত্রাস টিকে থাকবে। সাম্যভিত্তিক তথা মানবমর্যাদাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বা রাষ্ট্র-ব্যবস্থা প্রবর্তিত না হলে বিচ্ছিন্নভাবে বৈশ্বিক জঙ্গিবাদ ঠেকানো সম্ভব নয়।

একই সঙ্গে নানা দেশের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী বা অভিবাসীদের ইন্টিগ্রেশনের পথ খুলে দিয়ে নব আত্মপরিচয় নির্মাণের ব্যবস্থা না নিলে সন্ত্রাসবাদ দমন অধরা থেকে যাবে। সন্ত্রাসের পেছনে মানুষের নষ্ট পরিচয়ের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

আল-কায়দা, আইএস ও সালাফিস্ট

আইএস মূলত সালাফি অনুসারী। এটা সৌদিভিত্তিক একটি নষ্ট দর্শন। সালাফিস্টদের অভিযাত্রা শুরু হয় ১৯৮৮-১৯৯৯ সালে। ভারতের মওদুদীবাদী ও ব্রাদারহুড গোষ্ঠীর সঙ্গে সালাফিস্ট চিন্তাধারার অনেক মিল রয়েছে। ৭ম শতকের খারিজিদের (খারিজাইট) অনুসরণ করে এরা উঠে এসেছে।

খারিজিদের চিন্তাধারা এবং সালাফিস্টদের চিন্তাধারায় যথেষ্ট মিল ছিল। ১৮ শতকের শেষে এবং ১৯ শতকের শুরুতে কোনো কোনো ইসলামিস্ট ধর্মকে জাতীয়তার অংশ করতে চেয়েছে এবং রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার চেয়েছে। এরা ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে ইসলামি রাষ্ট্রের ঐক্য চেয়েছে।

তবে ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ভারতের জামিয়াত-এ-উলুমে হিন্দ শুরু থেকে নিজেদেরকে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে দূরে রেখেছে। মাওলানা মেহমুদ, আহমেদ মাদানী, সৈয়দ হোসেন, আহমেদ দেহেলবী ইত্যাদি ইসলামি চিন্তাবিদরা ১৯১৯ সালে এমন একটি বিশাল সংঘ তৈরি করেন। ঐ সংঘ জাতীয়তাবাদী চিন্তা ও দর্শনে প্রধান্য দিয়ে ভারতের সংবিধানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। সেই সঙ্গে অমুসলিমদের সঙ্গে সদাচরণ ও হিন্দুদেরকে কাফের হিসেবে আখ্যায়িত না করে ধর্মভিত্তিক অনাচারে লিপ্ত না হওয়ার চুক্তি করে।

শুরুতে প্যান-ইসলামিস্টদের বিস্তার ঘটে মিশর, ইয়েমন, লিবিয়া, ইরাক, সিরিয়া, তুরস্ক ও ভারতে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাথ পার্টি ও নাসেরি চিন্তার বিকাশ ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে। ঐ সময় ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী ব্রাদারহুডসহ অন্যান্য মৌলবাদীদের পিছু হটিয়েছে। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর এরা পুনরায় ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী হয়।

সালাফি জিহাদি গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ কর্মকাণ্ড শুরু হয় ১৯৯০এ। এটা ব্রাদারহুডকে অনুসরণ করলেও সকল উগ্র মুসলিম দলগুলোর মধ্যে এরা অন্যতম উগ্র। ৭ম শতকের খারিজি মতবাদের তাত্ত্বিক দর্শন এবং ব্রাদারহুডের কাঠামো নিয়ে সৃষ্ট এক উগ্র জঙ্গি গোষ্ঠী সালাফিস্ট। এদের লক্ষ্য হল আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠা, মানুষের সৃষ্ট সকল সংবিধান অমান্যকরণ এবং কল্পিত খেলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠা। শরিয়া আইন প্রয়োগ করে ইসলামি রাষ্ট্রগুলোতে শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তন এবং তথাকথিত অবিশ্বাসীদের রাষ্ট্রে আঘাতসাধন এদের সুপ্ত লক্ষ্য।

আল-কায়দা এবং আইএস কোনো না কোনোভাবে খারিজাইট, তাকফির ও সালাফিস্টদের মিশ্র মতবাদ গ্রহণ করে কাজ করছে। ভিন্নধর্মের প্রতি অসহিষ্ণুতা সালাফিস্ট, তাকফির ও আইএসদের মধ্যেই বেশি। বিধর্মী এবং তথাকথিত ধর্মবিচ্যুত মুসলিমদেরকে নিধন করা আইএস ও তাকফিরগণ ধর্মীয় কাজ বলে মনে করে।

সালাফিস্ট, খারিজাইট, তাকফির এবং আইএসএর মতবাদগুলো অনেকটা কাছাকাছি। এদের মধ্যে কিছু তাকফির ও আইএস অস্ত্রধারী। আইএসএ আছে বাথ পার্টি ও ইরাকি বাহিনী থেকে ফিরে আসা সুন্নি সেনা সদস্য এবং উচ্চশিক্ষিত সামরিক কর্মকর্তা। সৌদি-মার্কিন আঁতাত ও নষ্ট ভূ-রাজনীতির কারণেই এরা শক্তিশালী হচ্ছে এবং টিকে আছে।

ভিন্নমতে এই সালাফিস্টগণ ১৯৪৮এর পরপর ক্ষুদ্র পরিসরে পাকিস্তানের রাজনীতিতে শেকড় স্থাপন করে জামায়াত এবং তাদের সমমনা দলগুলোর মধ্যে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ভারতের মাটিতে ইতোপূর্বে যারা ওয়াহাবি ও ফারাজি আন্দোলন করেছিলেন তাদের অনেকেও খারিজি চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। ইসলামিক রিচ্যুয়াল বা আনুষ্ঠানিকতাভিত্তিক ধর্মাচারে বিশ্বাসী গোষ্ঠীর মধ্যে যারা শরিয়া আইনে প্রাধান্য দিয়ে ধর্মের বিভাজন মুখ্য করে তোলে এবং সুফীবাদের সূক্ষ্ম তথা আধ্যাত্মিক মতবাদ ইসলাম ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে করে তারাই সালাফিস্ট তথা তাকফির ও খারিজাইট।

সৌদি প্রভাবান্বিত ওয়াহাবিরাও এমন মতবাদ ধারণ করে। এরা শিয়া, হাম্বালি, মালেকি, কাদিয়ানিসহ নানা ভিন্নমতালম্বীর সঙ্গে অসহিষ্ণু আচরণে প্রাধান্য দেয়। এরা জিহাদকে আত্মার মুক্তি অর্থে গ্রহণ করে না। ভিন্নমতালম্বীদের হত্যাকাণ্ডে এরা ধর্মীয়ভাবে বৈধতা দেয়। এরা শরিয়া আইন ও খেলাফতের পুনরুত্থান চায়।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে নষ্ট দর্শন হৃদয়ে পোষণ করেছিল, সেই দর্শন ও ঘৃণা উসকে দিয়েছিল সালাফিস্টরাই। এরাই পাকিস্তানের বালুচদের ওপর নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। লিবিয়া, মালে, সোমালিয়া, সুদান, নাইজেরিয়ায় সালাফিস্ট, তাকফির ও ওয়াহাবিরাই অপকর্ম করে যাচ্ছে। তবে ঐ সমস্ত দেশে ফরাসিদের উপনিবেশবাদ এবং নব-উপনিবেশবাদ তথা নানা সংঘাত ও মানবতাবিরোধী অপরাধ এই সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে।

২০০১ সালের পূর্বে আল-কায়দারা যেমন প্রচার ও জনসমর্থন পায়নি তেমনি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি। সোভিয়েতকে দুর্বল করবার জন্য উজবেকিস্তান ও চেচনিয়ায় সোভিয়েতবিরোধী গ্রপগুলোকে পাশ্চাত্যের সমর্থন ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। ইসলামি বিশ্বে নানা যুদ্ধ ও সংঘাতের ঘটনা অনুসরণ করলে এই ভ্রান্ত মতবাদের উত্থানে পাশ্চাত্যের নেতিবাচক ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আল-কায়দা বিশ্বময় একক চেইন অব কমান্ডে চলে না। এটি একটি ভ্রান্ত দর্শন বাস্তবায়নের নষ্ট পদ্ধতি।

সন্ত্রাসের পেছনে নষ্ট পরিচয়

মানুষের জন্মগত প্রকৃতি, প্রবণতা, মানসিক অবস্থানের সঙ্গে পরিবার ও সমাজের শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বপ্ন, ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা এবং অর্জনের বিক্রিয়াগুলো নির্মাণ করে আত্মপরিচয়। নানা ঘাত, প্রতিঘাত, সফলতা, বিফলতা, সামগ্রিক প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির প্রেক্ষাপটে ঐ পরিচয় এমন নিবিড়ভাবে আপন সত্তার সঙ্গে মিশে যায় যেন মনে হয় এটি মূল দেহ এবং পরিচয়ের বৃক্ষ। কল্পিত শিকড় ভুলিয়ে দেয় সত্যিকার শিকড়ের কথা, ভুলিয়ে দেয় নৃতাত্বিক পরিচয় এবং Biological বাস্তবতার বিষয়টি।

কালচারাল Aggression ও Diffusion অথবা আরোপিত সংস্কৃতি ছেয়ে ফেলে মাটির গন্ধে ও প্রকৃতির সঙ্গে বেড়ে ওঠা অতি আপন সংস্কৃতি। এতে একজন মানুষ বা গোষ্ঠীর নিকট আপনজন বা কাছের মানুষগুলো দূরের মানুষ বলে প্রতীয়মান হয়। কখনও কখনও ধর্ম ও বিশ্বাসের ভিন্নতার কারণে কাছের মানুষটি শত্রু হিসেবে বিবেচিত হয়।

এতে উপেক্ষিত হয় শিকড়ের বন্ধন, ভৌগলিক বন্ধন, সামাজিক বন্ধন, মানবতার বন্ধন এমনকি আত্মীয়তার ঐক্য। এতে আরোপিত পরিচয়ধারী বা Reactive Identity বিশিষ্ট মানুষটি আপন করে নেয় দূরের মানুষ বা কল্পিত ছায়াকে। নষ্ট ভাবাদর্শনে দিক্ষীত হয়ে শত্রুজ্ঞান করে কল্পিত বিরোধী পক্ষকে অথবা সাধারণ মানুষকে। কখনও অনেকে মিলে সমষ্টিগতভাবে শত্রুজ্ঞান করে সাধারণ শত্রুকে।

এ ক্ষেত্রে–

Association of many images and interaction of those with self-image and portrayed image provokes making of new images constructing false identity.

Many including Prof. Amartya Sen and others termed it as reactive identity.

Association with various identities and owning them are essential instruments in making identity.

Here emergence of various identities and shaping of all – old and new are sequel of reactive phase. All images are filtered in our mind, in the net of neurons according to our mental state, pattern and structure. All have strong psychological and biological basis. They do comply natural reconstruction process and as well as artificial thrust imposed on it. In the process it defines new identity and belief, which are almost indivisibles from self-images.

প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংযোগের মাধ্যমে মানুষ যে সব সত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়, নানা অভিজ্ঞতায় সিক্ত হয় অথবা ভিন্নভাবে যে ঘটনা বা বিষয়গুলো তাদের মনের পাতায় ছাপ রেখে প্রচণ্ড আক্ষেপ বিক্ষেপ তৈরি করে, যে ঐচ্ছিক বা অনৈচ্ছিক প্রক্রিয়াগুলো নানাবিধ প্রণোদনা সৃষ্টি করে তাই আত্মপরিচয়ের ভূমি নির্মাণ করে।

এই অসংখ্য বিষয়ের মধ্যে নানাবিধ সংযোগের মধ্যে কোন কোনটি একজন ব্যক্তি বেছে নেবে বা কোন বিষয়গুলো মনে সুদৃঢ় ছাপ ফেলবে সেটা সহজভাবে নির্ণয় সম্ভব নয়। ব্যক্তির বোধ, বিবেক, সক্ষমতা, অক্ষমতা, বুদ্ধির স্তর ও চিন্তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের বাধন এবং শাসন কী প্রতিক্রিয়া বা প্রণোদনা সৃষ্টি করছে এবং মন্দ কাজে বাধার দেয়াল তৈরি করছে সেটা প্রকৃতপক্ষে গবেষণার বিষয়।

শিকড়ের সঙ্গে ব্যক্তি ও সমষ্টির সম্পর্ক, পরিবার ও রাষ্ট্রের প্রতি তাদের দায়, নিজস্ব সংস্কৃতি, বিশ্বাস এবং সামগ্রিক উপলব্ধি তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নানাভাবে। গোষ্ঠীর চিন্তা, দর্শন এবং রাজনৈতিক চিন্তাগুলো যখন কেউ ধারণ করে এবং তা বিশ্বাসের সঙ্গে ছড়িয়ে দেয় সেটা প্রবল শক্তি হয়ে উঠে। তবে এ ক্ষেত্রে নির্বাচনের সুযোগ রয়েছে। একজন কেবল চিকিৎসক হবেন নাকি বিপ্লবী হবেন সেটি নির্ধারিত হয় দুটো পথের সংযোগস্থলে।

যে আত্মপরিচয় ও অর্জনের মধ্যে ব্যক্তি নিজেকে নবভাবে আবিষ্কার করে, উপভোগ করে এবং নতুন পরিচয়টি আপন হিসেবে বেছে নেয়, সেটাই তার মূখ্য আত্মপরিচয় হয়ে উঠে। এতে কিছু কর্ম সে আপন ভুবনের কর্ম হিসেবে বেছে নেয়। একজন চিকিৎসক একাধারে কবি হলে কোন পরিচয় তিনি বেছে নেবেন সেটা তার ঐচ্ছিক নির্বাচনের বিষয়। ডা. চে গুয়েভারার জীবন বিশ্লেষণ করলে উপরোক্ত মন্তব্যের প্রয়োগিক উদাহরণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

একই বক্তব্য মহাত্মা গান্ধীর বেলায় প্রযোজ্য। দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর দুটি পরিচয় ছিল– একটি হল ডাকসাইটে ব্যারিস্টার হিসেবে, অপরটি বর্ণবাদবিরোধী নেতা হিসেবে। রাজনীতি-সচেতন গান্ধীর মনে বর্ণবাদ তথা শৃঙ্খলিত কালো মানুষের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের নিষ্ঠুর আচরণ, বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতা যেমন প্রভাব ফেলে, তেমনি ফিনিসদের অহিংস আন্দোলন তার ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।

পরিশেষে তিনি পেশাজীবী পরিচয় ছেড়ে ভারতের স্বাধীনতা ও মুক্তির আন্দোলন আপন করে নেন। বিদ্বেষ, ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা ও সন্ত্রাস-নির্ভর ভাবনাগুলো দুরে ঠেলে নিজের করেন অহিংসবাদ। অর্থাৎ কিছু বর্জন করেন এবং নতুন কিছু গ্রহণ করে নেন। গ্রহণের মাধ্যমে নতুন পরিচয়টি তাঁর আপন হল।

অশান্ত বিবেকানন্দ নানা চড়াই-উত্তরাই পেরিয়ে নিজের সন্ত চরিত্র আবিষ্কার করলেন। বহু দস্যু এমনি করে শুদ্ধ দেশপ্রেমিক হয়ে উঠেছিল ১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধে।

মানুষের আত্মপরিচয় অনেকটা মালার মতো– অনেকগুলো পরিচয় বা পরিচয়ের সমাহার যেমন একসঙ্গে গেঁথে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী আপন পরিচয় ধারণ করে, তেমনি কিছু বর্জন বা নতুন করে কিছু গ্রহণ করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যেমন সমধর্মী ও সমগোত্রীয় পরিচয়গুলো বৃহত্তর পরিচয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়, তেমনি কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যের সমাহার একটি একক পরিচয়ের মোড়কে ঠাঁই নেয়। জাতীয়তা বা লিঙ্গ এর উদাহরণ।

কারা কোন পরিচিতি বেছে নিচ্ছে বা সংঘবদ্ধভাবে কাজ করছে তার সঙ্গে Belongingএর প্রশ্নটি জড়িত। যারা ধর্মকে ব্যবহার করে নিজের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে অথবা সামাজিক ও রাজনৈতিক সুবিধা লাভের চেষ্টা করছে, তাদের যেমন একটি নিজস্ব পরিচয় ও জোট থাকতে পারে, তেমনি বৃহত্তর ইসলামি (ইউটোপিয়ান) রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর একটি জোট রয়েছে। আত্মপরিচয়ের নৈকট্যের জন্য তাদের কাছাকাছি চিন্তা-চেতনার মানুষগুলো অথবা তাদেরকে কিছুটা আপন ভাবছে এমন মানুষগুলো তাদের সমর্থন যোগাতে পারে।

সত্যিকার অর্থে ধর্মীয় আচার-আচরণ পালন না করলেও হেজাবীগণ তাদের সমর্থক হতে পারে এবং তারাও ঢালাওভাবে ঐ বহিরাবরণ সমর্থন করতে পারে। ঐ ছবির বাইরে অবস্থানকারী নারীদেরকে তারা শত্রু জ্ঞান করতে পারে। আবার এই সরলীকরণ কার্যকর না-ও হতে পারে। ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রুখবার জন্য এই জটিল সমীকরণ অনুধাবন করা প্রয়োজন। কার কাছে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ বা অগ্রগণ্য তা নির্ভর করছে হোমোজেনাস বা নন-হোমোজেনাস আত্মপরিচয়ের উপর।

একটি বিশেষ আত্মপরিচয়ধারী গোষ্ঠীর কার্যক্রমের সঙ্গে বাস্তবতার সংযোগ; প্রকৃত বাধা এবং নানা সীমাবদ্ধতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে কোন গোষ্ঠী কী চাচ্ছে, কেন চাচ্ছে, কীভাবে চাচ্ছে– এই বিষয়গুলো জেনে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে সহজ হয়ে উঠতে পারে। সহমর্মিতা, সহনশীলতা, শান্তির অন্বেষার মাঝে এবং নানামুখী সৃষ্টিশীল কর্মের মধ্যেই মানবজীবনের স্বার্থকতা।

নিজের অস্তিত্ব অনুভবের মধ্য দিয়ে জীবনের যে প্রকাশ ও বিকাশ তা ধীরে ধীরে পরিণত হয় নানামুখী মানবিক সংযোগ, অভিজ্ঞতা ও অনুভবের মধ্য দিয়ে। এই অনুভবের ভূমিটি তখনই ক্ষুদ্র এবং পরিচিত পরিমণ্ডল খণ্ডিত হয়ে আসে যখন আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করি বা অপরদের বিচ্ছিন্ন করতে চেষ্টা করি।

মানুষের জীবনধারা, সংস্কৃতি, ভিন্নতা, ঐ ভিন্নতার মাঝে গভীর ঐক্য এবং সার্বিকভাবে ভিন্নতার সৌন্দর্য্য মানবজীবনকে নানা বৈচিত্রে সমৃদ্ধ করে তুলে। এই ভিন্নতার প্রতি বৈরিতা এবং দ্বীপজীবন মানবজীবনকে কেবল খণ্ডিত নয় ব্যাধিগ্রস্ত করে তোলে। এ কারণে জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিশ্বাসের জায়গাটুকু অটুট রেখে মানবপরিচয় এবং বৈশ্বিক স্বার্থটি সমুন্নত করে সামষ্টিক স্বার্থের বিষয় সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য করতে পারলে সন্ত্রাসের উত্থান কঠিন করা যেতে পারে।

এ প্রেক্ষাপটে যেমন নানা বিশ্বাসের মধ্যে, নানা সংস্কৃতির মধ্যে ব্যাপক আলোচনা সচল করা প্রয়োজন, তেমনি ধর্মভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো সীমিত করে আনা প্রয়োজন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত উপাসনালয়ে সবার জন্য সুযোগটি সমান করে দেওয়া প্রয়োজন। মসজিদ, মন্দির ও গির্জাগুলো একটি প্রাঙ্গনে আনা প্রয়োজন। সকল ধর্মের ইতিহাস এবং ধর্মের সারবস্তু সবার জন্য অবশ্যপাঠ্য হওয়া প্রয়োজন। সকল ধর্মের ঐক্য, মানবজীবনের আকাঙ্ক্ষা এবং আত্মার চাওয়ার বিষয়টি সবার উপর স্থান দেওয়া উচিত।

বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আচার, আচরণ ও সংস্কৃতিতে মূল্য দিয়ে ভিন্নতার সৌন্দর্য্যটুকু উপভোগ্য ও সর্বজনীন করে নৃতাত্ত্বিক, ভৌগলিক বৈশিষ্টগুলো সমন্বিত করা প্রয়োজন। অর্থাৎ commonality বা সাধারণ ঐক্যে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।

ইউরোপের সাদা মানুষটিকে জানতে হবে যে, পৃথিবী ও সারা বিশ্বের প্রায় ৯৬ ভাগ মানুষ সরাসরিভাবে কালো আফ্রিকা থেকে আগত এবং তারা তাদেরই বংশধর। বিতর্কিতভাবে পৃথিবীর চার ভাগ মানুষ Homo heidelbergensis, নিয়েন্ডারথাল এবং ডেনিসোভা গ্রুপের মানুষ। Multiregional continuity এবং assimilation তত্ত্ব অনুযায়ী–

It is often incorrectly thought that we are the only human species and that we have always lived in a world empty of other human species. Yet when Homo sapiens started to expand out of Africa it was not the only species of human that inhabited the world.

এটিও জানতে হবে যে, প্রধান প্রধান ধর্মগুলো আসসিরিয়া, মেসোপটেমিয়াসহ এশিয়া মাইনরের প্রাচীন মানুষগুলোর 'কোড অব কন্ডাক্ট' অনুসরণ করে উঠে এসেছে। অনেক ধর্মের ভালো কথাগুলোর সূত্র একটি কমন ব্যাংক। যার শুরুটা Ur সভ্যতার সময় হয়েছিল (Code of King Dungi, Reigned Ur about 2400 B.C.)।

ধর্ম

উর্ধ্বমুখী চিন্তায় আচ্ছন্ন সাধারণ মানুষগুলো আত্মবীক্ষণ ও নিরন্তর অনুতাপ ও পরিতাপের মধ্য দিয়ে নিজেদেরকে শুদ্ধ করার চেষ্টার মাঝে খুঁজে পায় তাদের ধর্ম। আত্মার শূন্যতা, পূর্ণতার আকাঙ্ক্ষা ও শুদ্ধতার তৃষ্ণার মাঝে সেতুবন্ধন নির্মাণ করে ধর্ম। বিশ্বাসের বর্ম নিয়ে ভয়কে জয় করে প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকা এবং চিরজীবী হওয়ার জন্যই যুগে যুগে ধর্মকে আঁকড়িয়ে ধরেছে মানুষ। আর সেই সঙ্গে ক্ষমতাবানগণ ক্ষমতার চর্চা করবার জন্য সাধারণের বিশ্বাস ব্যবহার করেছে।

নিঃসন্দেহে ধর্ম এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা ব্যক্তি, সমষ্টি, গোষ্ঠী ও জাতির ভাবনা ও ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে। ধর্ম মানুষের জীবনে কতটুকু প্রয়োজনীয় কিংবা কতটুকু সত্য ও সঠিক এ বিষয়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ব্যাপকভাবে ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত। যদিও ভয়, হতাশা এবং ধ্বংস থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মানুষ সাধারণভাবে ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করে।

তারপরও এটি নির্মম সত্য যে, অনেক ক্ষেত্রে ধর্ম নতুন করে ভয়, ঘৃণা ও ধ্বংস ডেকে নিয়ে আসে। এটি কেবল নিজের ধর্মকে সত্য এবং নিজের ঈশ্বরকে পরম মনে করবার জন্য নয়, এটি অপরকে হীন ও দূরের মানুষ মনে করবার জন্য।

যে আশা, বিশ্বাস এবং সাহস একটি ধর্ম সৃষ্টি করার কথা তা অনেক ক্ষেত্রে ভুল পথে পরিচালিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ গোষ্ঠী বা রাজাধীরাজগণ নিজ স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করে এবং ধর্মের নানা অপব্যাখ্যা তৈরি করে। ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের অন্তর্গত দুর্বলতা ও বিশ্বাস। তারপরও পৃথিবীর অনেক মানুষ যেমন ধর্মে আস্থা স্থাপন করে, তেমনি অনেকেই ধর্মের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসবার জন্য নানামুখী ভাবনার আশ্রয় গ্রহণ করে। গান্ধী যখন বলেন, "By religion I mean– that which brings a man to face creative reality." তখন মার্কস অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে ব্যক্ত করেন, "Religion provides an illusory happiness– It is the opium of the poor— The idea of God is the key- stone of a perverred civilization."

গান্ধী যখন মনে করেন, ধর্ম নিতান্তই ব্যক্তির অভিজ্ঞতা তখন মার্কস একে সামাজিক সমস্যা বলে মনে করেন। গান্ধী যখন এর মাঝে একটি শুভ দিক খুঁজেন, মার্কস তখন এর মধ্যে অসুখ খুঁজে পান। মূলত ব্যক্তি ও সমাজের সমস্যার প্রেক্ষাপটেই ধর্মের সৃষ্টি। ন্যায়, অন্যায়বোধ, পাপ-পূণ্য চিন্তা, ঈশ্বর ও আত্মা নিয়ে ভাবনা, ভবিষ্যত ও পরিণতি নিয়ে দুঃশ্চিন্তা, ধর্ম সৃষ্টি ও ধর্ম বিবর্তনে মূখ্য ভূমিকা পালন করে।

ধর্মের অপব্যবহার ও মুক্তি

আজকের সন্ত্রাসীগণ খলিফা উত্তরযুগের সালাফিস্টদের উত্তরসূরী। এরাই মিশরের ব্রাদারহুড এবং জামায়াতের সমর্থক। দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি যে, পাশ্চাত্য বিশ্ব যেমন তার হীনস্বার্থ ও প্রবণতার কারণে একটি নষ্ট মূল্যবোধ ও পরিচয় নির্মাণ করছে, সভ্যতা ও মানবতার কপট বহিরাবরণ ধারণ করেছে, তেমনি ঐ সন্ত্রাসী চক্র বৃহত্তর বলয়ের মধ্যে ক্ষুদ্রতর বলয় সৃষ্টি করে কল্পিত এক আদিম ও নিষ্ঠুর সত্তাকে আপন মনে করে মানববিধ্বংসী খেলায় মত্ত হয়েছে।

এ অবস্থান থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে একদিকে যেমন ধর্মগুলোর সত্যিকার ইতিহাস, আচরণবিধি এবং মূল বক্তব্যগুলো পরিষ্কার করতে হবে, তেমনি যুগের ভাণ্ডারে সঞ্চিত সভ্য মানুষের 'কোড অব কন্ডাক্ট' ব্যাখ্যা করতে হবে। নতুন করে নির্মাণ করতে হবে মুল্যবোধ। এ দেশসহ সারাবিশ্বে বারবার এই মূল্যবোধ ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। যুদ্ধবিগ্রহ, প্রকৃতিক দুর্যোগ– খরা, প্লাবন, দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এবং সাম্প্রতিক গ্লোবালাইজেশনের আগ্রাসন এই মূল্যবোধকে চূর্ণবিচূর্ণ করেছে।

খাড়ির প্রান্তে দাঁড়িয়ে আজ দেশ ও সমাজ। আপন অন্তিত্ব ও পরিচয় বাঁচাতে হলে সর্বশক্তি দিয়ে নির্মাণ করতে হবে নব আত্মপরিচয়। সভ্যতার আকর গ্রন্থ থেকে শুরু করে সকল ধর্মগ্রন্থ ও দর্শন, ধর্মগুরু থেকে শুরু করে সাধুসন্ত, পণ্ডিত, দার্শনিক, বিজ্ঞানী এবং প্রধান নবীদের চরিতাবলী ও আচরণলিপির সারবস্তু নিয়ে বিন্দু বিন্দু করে নির্মাণ করতে হবে একটি অবয়ব। ঐ ভারচুয়াল অবয়ব কীভাবে চিন্তা করবে, কীভাবে কাজ করবে, কী করবে, কী করবে না, কী হবে তার আরাধনা– তা মোটা দাগে লিখতে হবে মনের দেয়ালে। এ সব প্রোথিত করতে হবে চেতনার আকাশে এবং অবচেতনে। এই ছবিটি পাঠ্য পুস্তকসহ সকল মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে।

নষ্ট চিন্তা ও প্রভাব যাতে দেহ ও মনে প্রবশে না করে সেই প্রতিরক্ষা বুহ্যটি নির্মাণ করতে হবে আমাদের। মধ্যপথ অনুসারী শান্তিকামী তথা সাহসী, সহিষ্ণু, বিজ্ঞানমনস্ক জাতি, গোষ্ঠী ও সমাজ নির্মাণে অবদান রাখতে হবে আমাদের সবাইকে।

স্থানীয় উপকথা, রূপক চিন্তা এবং ভালোমন্দ সম্পর্কিত Ethics বোধ যখন হৃদয়ের শূণ্যতা, ঈশ্বরচিন্তা এবং অন্তরাত্মার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে ঐক্যতান সৃষ্টি করে, তখনই ধর্মচিন্তা বিকশিত হবার ক্ষেত্র নির্মিত হয়। ধর্মচিন্তা আশ্রয় করে 'কোড অব কন্ডাক্ট' প্রণয়ন ও প্রয়োগচিন্তা ব্যক্তি ও সমষ্টিকে নানা আচার, অনুষ্ঠান, Rituals ও বিধিনিষেধে বেঁধে ফেলে।

এই সব পরিচয় বা অন্য কোনো পরিচয় যখন ব্যক্তি ও সমষ্টির অন্তরে ভিন্নতার প্রতি বিদ্বেষ, ক্রোধ ও অসহিষ্ণুতার বীজ বুনে দেয় তখনই শুরু হয় সংঘাত। ভিন্ন চিন্তা দোষণীয় নয়, তবে ভিন্নতার প্রতি বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতা নিতান্তই অপরাধ। বিশ্বসমাজের নানা স্তরে, নানাভাবে এই বিদ্বেষ ও ঘৃণার চর্চা চলছে। সম্পদের অসম বণ্টন থেকে শুরু করে মানুষের শান্তি, মর্যাদা, অধিকারের উপর আঘাত, ভারসাম্যহীন চিন্তা ও প্রণোদনা সৃষ্টি করে। সাধ্য ও স্বপ্নের সঙ্গে আকাঙ্ক্ষার সংঘাত বেপথু মানুষকে আত্মঘাতী করে তুলে। এই অবস্থান থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে নানামুখী নিবিড় শিক্ষা এবং সমঝোতাপূর্ণ আলাপচারিতা প্রয়োজন।

সমাজের প্রধান ক্ষতগুলো নিরাময়ে প্রত্যেক জাতি, গোষ্ঠী ও ব্যক্তিকে আপন ভিন্নতা ও মর্যাদা নিয়ে নিজের ভূমিতে দাঁড়াবার সুযোগ করে দেওয়া প্রয়োজন। ভিন্নতার প্রতি মর্যাদা যেমন শান্তি ও সাম্যে বিশ্বাসীদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে, তেমনি যারা ঈশ্বরে আস্থাবান না তাদের সঙ্গেও সেতুবন্ধন নির্মাণ করতে পারে। আমাদের জ্ঞান ও বোধের সীমা স্বীকার করে শান্তি ও সহনশীলতার সিংহদুয়ারটি উম্মোচন করা দুরুহ কোনো ব্যাপার নয়।

প্রত্যয় ও নিরবচ্ছিন্ন ইচ্ছা থাকলে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব যাবতীয় নষ্ট দর্শন ও নষ্ট কর্ম থেকে। এই জন্য প্রয়োজন পুরান আইডেনটিটি মুছে ফেলা এবং নতুন আইডেনটিটি গ্রহণ করা। এটি সমাজ বিজ্ঞানী ও সোশ্যাল সাইকোলজিস্টদের কাজ। তবে এতে রাজনৈতিক ও সামাজিক সমর্থনটি সবল হতে হবে। সচেতন সমাজের অংশগ্রহণ ছাড়া এ কাজ প্রায় অসম্ভব।

আত্মপরিচয় নির্মাণের ক্ষেত্রে সমাজ ও সংস্কৃতিকে সব কিছুর উপর গুরুত্ব দিলে, ধর্মকে ব্যক্তির একান্ত বিশ্বাস মনে করলে, রাষ্ট্র থেকে ধর্মাচার বিচ্ছিন্ন করতে পারলে, লোকদেখানো বাহ্যিক আচরণ থেকে মুক্ত হয়ে ধর্ম পালন করলে মানবধর্মবিরোধী অনেক কর্ম থেকে মুক্ত হওয়া যায়। এতে আস্তিক নিবিড়ভাবে খুঁজে পাবে ঈশ্বরকে, আর মুক্ত মনের যুক্তিবাদী মানুষ মুক্ত করতে পারবে আপন আত্মাকে।

মানুষের সংস্কৃতি নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। একে প্রভাবন্বিত করে অর্থধর্ম, ইন্দ্রিয়জাত ধর্ম, স্বার্থধর্ম এবং উৎপাদনের সঙ্গে সামাজিক শ্রমের সম্পর্ক তথা শরীর ও আত্মার নানা চাহিদা। এ ক্ষেত্রে বিচারমূলক ও বিশ্বাসমূলক ধর্ম সংস্কৃতির একটি সমন্বয় প্রয়োজন। এসব বিবেচনায় সুফিবাদ ও বৈষ্ণববাদ হতে পারে বাংলার বর্ণিল সংস্কৃতি এবং আত্মপরিচয়ের মেরুদণ্ড।

শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সহনশীলতা

ভিন্নতার প্রতি সহনশীলতা বা নানা সংস্কৃতির ঐক্য-চিন্তা এবং ঐতিহাসিক বাস্তবতার বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে। প্রশ্নহীন বা শর্তহীনভাবে কোনো বিষয় মেনে নিতে রাষ্ট্র বা সংঘ বাধ্য নয়। দেশ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা নৃতাত্ত্বিক বা সাংস্কৃতিক পরিচয়ভিত্তিক Identity প্রকাশ ও প্রচারে কোনো বাধা নেই। তবে এই পরিচয়ধারী মানুষগুলো কোথায় কতটুকু ইচ্ছা প্রকাশ করবে, কী শর্তে করবে তা নির্ধারণ করবে রাষ্ট্র বা সংঘ।

মাদ্রাসা শিক্ষায় কোনো বাধা নেই। তবে তা আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে সমন্বিত হতে হবে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি মেনে নিতে হবে। মানবতাবিরোধী তথা বিভেদমূলক দর্শনের প্রচার, প্রকাশ এবং তার দীক্ষা ও শিক্ষা নিষিদ্ধ হতে হবে সর্বতোভাবে। যারা এই ধরনের দর্শন ও মতাদর্শ ভিত্তি করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালায় বা চালাবে তাদেরকে রোধ করার জন্য আইন প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে উদার শিক্ষা বা বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা জোরদার করতে হবে। সেটা এমন শিক্ষা হবে যা মানবতার কল্যাণ তথা দেশ ও জাতির কল্যাণের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

সন্ত্রাস প্রতিরোধ করতে হলে একদিকে যেমন সন্ত্রাসী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন. তেমনি সন্ত্রাসের কারণ এবং সন্ত্রাসের মনন, ভাবনা, চিন্তা, পরিকল্পনা জানা প্রয়োজন। সরলীকরণ না করে ঐ ধ্বংসাত্মক কর্মের ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক ব্যাখ্যা পাঠ ও নির্ণয়ের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বিবেচনায় আনা উচিত।

একই সঙ্গে সামাজিক বিবর্তন, ধর্মের বিকাশ ও বিবর্তনগুলো বিবেচনায় আনতে হবে সামাজিক পরিবর্তন এবং ব্যক্তি মনন পাঠ করার জন্য। এ ক্ষেত্রে প্রচলিত শিক্ষা ও সামাজিক শিক্ষার ভূমিকাটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষানীতি, শিক্ষা পদ্ধতি, শিক্ষার অগ্রগতি, বিশেষ করে বিজ্ঞান, দর্শন এবং ইতিহাসের পাঠ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এই শিক্ষা গুরুভিত্তিক হলেও তার একটি আধুনিক কাঠামো থাকা প্রয়োজন। তথাকথিত সাধু, সন্ত তথা ধর্মনেতাদের শিক্ষা অনেক ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হতে পারে।

মৌলিক কাঠামোভিত্তিক শিক্ষা নিশ্চিত করে শিক্ষার বাস্তব মূল্যায়ন এবং শিক্ষিতজনের জীবনে উন্নয়ন তথা ঐক্য সন্ত্রাস প্রতিরোধ করতে পারে। শিক্ষিতজনের কর্মসংস্থান, কর্মযোগ জাতির ভাগ্য উন্নয়ন সাধন করে সন্ত্রাসবাদের জায়গা ছোট করে আনবে। এ ক্ষেত্রে জাপান ও কোরিয়ার মতো দুটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের উদাহরণ অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

গ্লোবালাইজেশনের নানা ফাঁদে আবদ্ধ না হয়ে সুচিন্তিতভাবে ব্যাপক যোগাযোগ ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় সাধন জাতির ভাগ্য উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সন্ত্রাসের জায়গাটুকু সংকুচিত করে আনা সম্ভব।

এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান সংস্কৃতি এবং Antecedent সংস্কৃতির মধ্যে সেতুবন্ধন স্থাপন করে সংস্কৃতির ভালো দিকটিকে নিতে পারলে সংঘাত এবং সংস্কৃতিজাত সন্ত্রাস ঠেকিয়ে দেওয়া সহজ হতে পারে। এতে সাংস্কৃতিক গোঁড়ামি তথা সংকীর্ণতা বা Cultural conservatism এবং Cultural diversity এই বিষয়গুলো মুখোমুখি দাঁড় করাবার সুযোগ থাকবে না। এই ইন্টিগ্রেশনের কাজটি সহজ করতে পারলে অনেক দেশে সন্ত্রাসের বৃক্ষটি জন্মাতে পারত না। পাশ্চাত্য বিশ্বে উঠতি Antifreedom অবস্থান অভিবাসীদের বিক্ষুব্ধ করবার সুযোগ পেত না। এতে সন্ত্রাস উস্কিয়ে দেবার পরিবেশও সৃষ্টি হত না।

সন্ত্রাস, উগ্র মতবাদ এবং অসহিষ্ণুতা প্রতিরোধে প্রথাগত শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক শিক্ষা সামনে আনতে হবে। এই শিক্ষা দেশের তৃণমূল পর্যায় নিতে হবে এবং এতে প্রচার মাধ্যম বা আইটি প্রযুক্তির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। সমাজে অন্তর্গত সহজাত জ্ঞান ও শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সমাজভিত্তিক নিবিড় আলোচনা, কাউন্সিলিং, নানা মত নানা পথের ইন্টিগ্রেশন যেমন জাতি ও রাষ্ট্রের শান্তি, সমঝোতা ও উন্নয়ন যেমন নিশ্চিত করতে পারে, তেমনি রুখতে পারে উগ্রবাদ এবং মতাদর্শগত সংঘাত।

প্রতিটি রাষ্ট্র নানা গোষ্ঠী ও সমাজের ফেডারেশন। এ কারণে বিভেদ অতিক্রম করতে হলে, উগ্রবাদ অতিক্রম করতে হলে, কেবল উগ্রবাদ, মৌলবাদ, ধর্মীয় জঙ্গিবাদের প্রতি মনোযোগী হলেই চলবে না, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতবাদসহ জঙ্গি ও শ্রেণিভিত্তিক সংঘাতগুলো মনোযোগে আনতে হবে।

এ প্রেক্ষাপটে ব্যাপক আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা-কার্যক্রম চালানের সঙ্গে সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ে উঠান বৈঠক আয়োজন করা প্রয়োজন। আইটিলব্ধ পদ্ধতি ব্যবহার করে মোবাইল, রেডিও ও টেলিভিশনের সাহায্যে উপদেশমূলক ও আলোচনামূলক শিক্ষা চালু করা প্রয়োজন। সকল পাঠ্যপুস্তকে সহনশীলতা, সহমর্মিতা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। সকল স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় ন্যায় ও মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষা চালুর সঙ্গে সঙ্গে প্রার্থিত 'কোড অব কন্ডাক্ট' এর পাঠ দেওয়া প্রয়োজন। এ কারণে Hammurabi বা মনুর 'কোড অব কন্ডাক্টের' মতো ভারী না হলেও সময়োপযোগী বাস্তব 'কোড অব কন্ডাক্ট' তৈরি করা প্রয়োজন। এতে জাতি অনেক ক্ষেত্রে নির্বুদ্ধিতা থেকে বেরিয়ে এসে একটি বাস্তব পথ চলার দিকনির্দেশনা খুঁজে পাবে।

শিক্ষা, আলোচনা, সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচিত গোষ্ঠীকে সুপরিকল্পিত 'ইনডকট্রিনেশন' করে আলোচনার ক্ষেত্রটি বিস্তৃত করা প্রয়োজন। যারা সমাজে সুবিধাবঞ্চিত তাদের জন্য নিম্নতম অধিকারটুকু প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে সামষ্টিক স্বপ্ন নির্মাণ প্রয়োজন। নির্মাণ প্রয়োজন একটি আকাশ। মৌলবাদ, জঙ্গি প্রতিরোধে বা উগ্র ধর্মীয় মতবাদ প্রতিরোধে মসজিদের ইমাম এবং নানাবিধ পুরোহিতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

তবে তা এক ব্যক্তি বা বিশেষ গোষ্ঠীভিত্তিক না হয়ে বা সামগ্রিকভাবে পুরোহিতনির্ভর না হয়ে নানা বিশেষজ্ঞনির্ভর হওয়া উচিত। এতে ইমাম ও পুরোহিতদের সঙ্গে সমাজের নানা চিন্তাবিদ তথা শিক্ষক ও সামাজিক নেতাগণ অংশগ্রহণ করলে সার্বিক সমঝোতা ও সহনশীলতা একটি দৃঢ় ভূমির উপর দাঁড়াবে। মওদুদীর মতো ধ্বংসাত্মক চিন্তাবিদের বিচরণ ক্ষেত্র সংকুচিত করে আনা প্রয়োজন নানাভাবে। সালাফিস্টদের ভূমিকা গৌণ করে আনা প্রয়োজন।

পাশ্চাত্যের আগ্রাসন এবং সন্ত্রাস

ক্ষুধার্ত মানুষ যখন দুর্বলতার কারণে যুদ্ধের শক্তি হারায় বা আন্দোলনের মনোবল হারায় তখন সমাজ বিষাক্ত নিরবতায় শীতল হয়ে ওঠে। তবে ঐ শীতলতার মধ্যে ঘুমিয়ে থাকে এক বিষ্ফোরণের বীজ। পাশ্চাত্য বিশ্ব আপন প্রয়োজন ঐ নিরবতায় অস্ত্র ও পণ্য বিক্রয়ের পরিবেশ চায়– জনগণ অর্থে না হলেও রক্ত ও সম্পদে তা পরিশোধ করুক– এটা তাদের চাওয়া।

এ কারণে ঐ পাশ্চাত্য সীমাহীন লোভ ও ক্রোধে ইরান থেকে শুরু করে মিশরের সুয়েজ পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়িয়েছে; উত্তর আফ্রিকা ও আরব দেশগুলোতে বহুমুখী স্বার্থের কারণে নিরন্তর রক্তপাত ঘটিয়েছে; পূর্ব এশিয়ায় গণহত্যার লীলাভূমি বানিয়েছে; আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ার সভ্যতা মুছে অগুনতি মানুষের বুক ও পাঁজর দাপিয়ে বিশ্বসভ্যতার সূতিকাগারগুলো একের পর এক শ্মশান বানিয়েছে– তারাই যে তালেবান, আল-কায়দা ও আইএসএর স্রষ্টা তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এদের পূর্বসূরী ব্রিটিশ ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো শিয়া ও সুন্নি বিভেদ সৃষ্টি করে সালাফিস্টদের মদদ দিয়েছিল এবং আজও দিচ্ছে। এভাবেই তারা নিজেদের প্রকৃত পরিচয় ও উদ্দেশ্য আড়াল করে প্রাচীন সভ্যতাগুলো মুছে নিজেদের ঝাণ্ডা উড়াবার চেষ্টা করছে।

সপ্তদশ শতক থেকে বিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য সভ্যতা নির্মিত হয়েছে এশিয়া ও আফ্রিকার মাটি থেকে শোষিত রক্ত ও সম্পদের উপর। সপ্তদশ থেকে উনবিংশ শতাব্দীতে বিশ্ববাজারে বিদ্যমান সম্পদ ও অর্থের সিংহভাগ ছিল ভারত ও বাংলার। উনবিংশ থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত ঐ সম্পদ ও অর্থের যোগান দেয় মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা। সাম্প্রতিক সময়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের বিস্তার ও অস্থিতিশীলতার উদ্ভব একই পথে। ইউরোপ এবং কোনো কোনো আরব দেশে এ কারণে শিকড়হীন মানুষ তথা disintegrated class ও জাতির উদ্ভব।

ইসরাইলের মতো artificial state এর সৃষ্টির পেছনে যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অস্থিতিশীলতা কাজ করছে তেমনি, কাজ করছে পশ্চিমা বিশ্বের রাজনৈতিক স্বার্থ। এতে জাতিগত বিদ্বেষ এবং ধর্মজাত ঘৃণা যেমন কাজ করেছে, তেমনি অতীতাশ্রয়ী আত্মপরিচয়ের প্রকাশ্য প্রভাবের বিষয়টি দৃশ্যমান হয়েছে। ঐ দৃষ্টান্ত আরব বিশ্বে কেবল ঘৃণা ও সংঘাতের বীজ বুনে দেয়নি, তা তাদেরকে অধিকতর অতীতাশ্রয়ী করে তুলেছে– তা তাদেরকে কেবল অর্থহীনভাবে others করে তুলেনি– ভিটে থেকে উচ্ছেদ, নিরন্তর নিষ্ঠুর নির্যাতন, অসহায় মৃত্যুর পর মানবতার বিমূর্ত চেহারা এবং পাশ্চাত্য রাজনীতির hypocrisy তাদেরকে এবং তাদের দুর্বল সমর্থকদেরকে আক্ষরিক অর্থে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় নিক্ষেপ করেছে।

এ প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসলাম ধর্মসহ নানা sectorial বিদ্বেষের উদ্ভব হয়েছে। এই ধর্মভিত্তিক বিদ্বেষ যেমন নতুন নয়, তেমনি ধর্মজাত Identity নতুন কিছু নয়। ইউরোপের চার্চভিত্তিক সংঘাত এবং ধর্মভিত্তিক বিদ্বেষগুলোর যেমন নানা যুদ্ধ ও সংঘাতের কারণ হয়েছে, তেমনি তা ইয়াহুদি নিধনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। ঐ বিদ্বেষ ও প্রবণতা এখনও ইউরোপ ও আমেরিকার শরীরের মধ্যে রয়েছে।

ইউরোপের খ্রিস্টানগণ ইয়াহুদি নিধনের মধ্য দিয়ে তাদের ঘৃণা প্রশমিত করে বাহ্যিকভাবে তা করুনা-রসে সিক্ত করে এবং আপতদৃষ্টিতে মানবতার আবরণ দেয়। এর পেছনে ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণটি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

মূল্যবোধ নির্মাণ ও সন্ত্রাস দমনে সামাজিক প্রতিরোধ

এই বাস্তবতার আলোকে তথাকথিত মানবতাকে সত্যিকার মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন। সকল স্তরে নতুন করে মূল্যবোধ নির্মাণ করা প্রয়োজন। জাতির শান্তি, মর্যাদা ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্যই এ কাজটি করতে হবে সমাজ ঐক্যবদ্ধ করে। এতে আস্তিক ও নাস্তিক, শিয়া-সুন্নিসহ সকল বিশ্বাস ঐক্যবদ্ধ করে মসজিদ ও মাদ্রাসাভিত্তিক সমাজকে দেয়ালের ওপারে না ঠেলে, ভেদজ্ঞানশূণ্যে এনে অভেদ করতে হবে জাতীয় ঐক্য ও স্বার্থ।

একটি দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধের সঙ্গে সেই দেশে চর্চিত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তথা সাম্যভিত্তিক মূল্যবোধের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। জনগণের অধিকারবোধ ও মর্যাদাবোধের সঙ্গে মূল্যবোধের সম্পর্ক নিবিড়। এটা বাইরে থেকে চাপিয়ে দেবার বিষয় নয়। অথচ তথাকথিত গণতন্ত্র বিস্তারের নামে পশ্চিমা বিশ্ব পরোক্ষভাবে আপন স্বার্থে দেশে দেশে যুদ্ধ ও সংঘাত ছড়িয়ে দিচ্ছে। অশান্ত করে তুলছে আফ্রিকা, এশিয়া ও মধ্য আফ্রিকার দেশগুলো। এই যুদ্ধের আঘাতে আফ্রিকা ও এশিয়ায় যে মানুষগুলো অবরুদ্ধ বা অভিবাসী তাদের মধ্যে তরুণ সম্প্রদায় কেবল প্রতিবাদী হয়ে সন্ত্রাসী হচ্ছে না, শিক্ষা থেকেও ছিটকে পড়ছে। এ কারণে দীর্ঘ সময় তারা শিক্ষার ছায়া থেকে দূরে রয়ে ভিন্নতর শিক্ষা তথা নতুন মতে দীক্ষিত হচ্ছে। নতুন আত্মপরিচয়সম্পন্ন ভিন্ন একটি তরুণ প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে।

এরা এদের মতো করে বদলে দিতে চাচ্ছে পৃথিবী। আমাদের দেশের মাটিতে যারা তাদের প্রতি সমব্যথী হয়ে উঠছে বা মৌলবাদী দর্শনে প্রভাবিত হচ্ছে তারা আমাদের দেশের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। তাদেরকে দেয়ালের ওপারে ঠেলে না দিয়ে, পারসিকিউশনের মুখোমুখি না করে শিক্ষা ও আলোচনার মাধ্যমে সমাজের মাঝে এদেরকে একীভবনের চেষ্টা করা উচিত। কঠোর নজরদারি অব্যাহত রেখে এবং শাস্তি বিধানের জায়গাটি নিশ্চিত করে এই গোষ্ঠী ও এদের সমর্থকদের আত্মপরিচয় পুননির্মাণের দিকে মনোযোগী হতে হবে। এ কাজটি সহজ নয়।

নজরদারি বিষয়টি প্রধানত পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর এখতিয়ারভূক্ত। ঐ কাজে নিরাপত্তাকর্মীদের প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি যেমন প্রয়োজন, তেমনি মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ সম্পর্কিত ধারণাটি তাদের মধ্যে পরিষ্কার করা প্রয়োজন। যে কোনো জঙ্গি ও সন্ত্রাসী দেশে অনুপ্রবেশকারী বহিরাগত চর বা আগ্রাসী সেনার চেয়ে কম ভয়ঙ্কর নয়। এদের রুখবার দায়িত্ব কেবল সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর নয়। আইনের পরিসীমার মধ্যে থেকেই নানা প্রক্রিয়ায় এদের নিস্তব্ধ ও নিষ্ক্রিয় করার দায়-দায়িত্ব দেশের সকল জনগণেরই।

কাজটি করতে হলে যেমন তাদের চলাচল ও আবাসস্থলগুলো নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন, তেমনি দেশের মাঝে তাদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রগুলো সীমিত করে আনা প্রয়োজন। আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে যেমন তাদের ইতিবাচক Engagement সম্ভব, তেমনি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ সৃষ্টি করে নানা ন্যায় কাজে তাদের সম্পৃক্ত করা সম্ভব।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি এনজিও উদ্যোগ, সামাজিক উদ্যোগে উৎসাহিত করার দায়-দায়িত্ব রাষ্ট্রের। বহু ধর্ম ও মতভিত্তিক স্কুল ও শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করে নানা মত ও ধর্মের মিলনক্ষেত্র নির্মাণ করা প্রয়োজন। এ কারণে প্রতিটি ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মধ্যে যে ঐক্য বা Commonality আছে সেটি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনায় আনা প্রয়োজন। সকল ধর্ম, বর্ণ সংস্কৃতি মধ্যে অমিলের চেয়ে মিলটি কোথায় তা দেখা প্রয়োজন।

সকল মানুষকে global perspectiveএ দেখা প্রয়োজন। জাতীয়তাবাদের উপর যেমন বিশ্বমানবতার স্থান দেওয়া প্রয়োজন, তেমনি আপন সংস্কৃতির সঙ্গে বিশ্বসংস্কৃতিকেও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। শিকড়ের সন্ধান করতে হবে সবাইকে। এ প্রেক্ষাপটে স্কুল কলেজের পাঠ্যবইয়ে Biological, Anthropology ও Social Anthropology এর পাঠ অত্যাবশ্যক হওয়া প্রয়োজন।

Historical & cultural evidence of migration, cultural diffusion এবং evolution of religion এর পাঠটি নিপুণ হাতে নির্মাণ করা প্রয়োজন। বিতর্ক ও সংঘাত সৃষ্টি না করে প্রচলিত এবং প্রোথিত বিশ্বাসগুলো অনাব্যশকভাবে আঘাত না করে, মোটা দাগে সকল মানুষের জন্ম, জীবন ও বিশ্বাসের ঐক্যের জায়গাটুকু সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। যে পাশ্চাত্য বিশ্ব দীর্ঘ সময় ধরে সুনির্দিষ্ট ন্যায় ও গণতন্ত্রের কথা বলে আসছে, তাদের ন্যায় ও মূল্যবোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে বিনিয়োগের কথা ভাবতে হবে।

দেশের পাড়ায় পাড়ায়, গ্রাম-গঞ্জে, মহল্লায় এমন স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে হবে যা সৎ ও ভালো মানুষ সৃষ্টি করতে পারবে, নতুন করে জাতির মূল্যবোধ নির্মাণ করতে পারবে। School for reconstruction of values and identity নির্মাণের কাজটি শুরু করতে হবে। এটা শুরু হতে পারে বাংলাদেশ থেকেই। একই সঙ্গে মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন ধর্মীয় চিন্তাবিদ এবং 'মাল্টি-ফেইথ মেডিয়েটর' তৈরির কাজটি এখনই করতে হবে। এ কাজের দায়-দায়িত্ব সরকার, সমাজ এবং নানা আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার।

খোলা চোখে নিবিড় পুলিসিংসহ আইটি নজরদারিতে যুব সমাজকে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। আইটি-বেইজড হাইটেক পুলিসিংগুলো নিরাপত্তা বাহিনীকে করতে হবে। নানা ধরনের যানবাহন এবং নতুন মানুষের চলাচলের দিকে চোখ রাখবার দায়িত্ব মহল্লার মানুষ ও স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর। মসজিদ ও মাদ্রাসায় শিক্ষিত সম্প্রদায়ের চলাচল বাড়াতে হবে।

ধর্মগ্রন্থ বুঝবার বা বোঝার দায়িত্ব কেবল ধর্মীয় নেতাদের উপর ছেড়ে দেওয়া যাবে না। সবার অংশগ্রহণে ধর্মীয় বিশ্বাসের জায়গাটি কেবল অবারিত হবে না তা মুক্ত ও স্বচ্ছ হবে নানা আঙ্গিকে। একই সঙ্গে প্রচলিত সংস্কৃতিকে সাধারণের প্রাণের কাছে নিয়ে আসতে হবে নানা ভঙ্গিতে ও প্রক্রিয়ায়।

অহিংসা চর্চার জন্য নালন্দার মতো প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা যেতে পারে। অহিংসা এবং শান্তির বাণী জনগণের কাছে পৌঁছে দেবার বিষয়টি আইটি ব্যবসায়ীদের জন্য বাধ্যতামূলক হওয়া প্রয়োজন। সন্ত্রাসের দায় বহন করতে হবে পরিবার, সমাজ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে। এ কারণে এদেরকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

If we want to stop war then we are to confront the powerful. We are to continue our mission through dialogue, discussion and non-violent movement. In order to be able to do this with safety, we can very much apply the principles of non-violence with Tolstoyan thoroughness.

Each individual grow in his own shell and identity, which in due course flourish with multiple association and alliances. The questions of loyalty come forward with the new affiliation and new alliances. With this background, if we want to reconstruct identity we are to train the person for "identity disregard". For that single organic pack of humanity is to be projected and the older identity has to be replaced by that. Definitely, this is a complex concept and a difficult work to pursue.

অনুসরণ করতে হবে তাও-এর সেই বাণী–

Act by not acting
do by not doing.
Enjoy the plain and simple
Find that greatness in the small.
Take care of difficult problems
While they are still easy;