জঙ্গি দমন: ঐকমত্যে না জনসম্পৃক্ততায়?

আবুল হাসনাৎ মিল্টন
Published : 3 July 2016, 07:01 AM
Updated : 3 July 2016, 07:01 AM

ভোরে সেহেরির জন্য ঘুম ভাঙতেই ফেসবুকে নীলাভির নক, 'ঢাকার খবর পেয়েছেন?'

শুনেই বুকটা ধড়াস করে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে একাধিক অনলাইন নিউজ পোর্টালে গিয়ে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। গুলশানের 'হলি আর্টিজান' রেস্তোরাঁয় সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের হাতে ত্রিশ জনের বেশি জিম্মি। নীলাভি জানাল, ঢাকায় নাকি শুরুতে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল, রেস্তোরাঁ দখলের পর জঙ্গিরা আস্তে আস্তে পুরো ঢাকা দখলের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হচ্ছে। গুজবটি অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

সেই থেকে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশিদের মধ্যে প্রবল উৎকণ্ঠা। বারবার নিজেকে রেস্তোরাঁয় জিম্মিদের জায়গায় কল্পনা করছিলাম আর অসহায়ত্ব আরও প্রকট হয়ে উঠছিল। এর মধ্যে খবর আসে অভিযানের সময় বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সালাউদ্দিন ও ডিবি পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম রেস্তোরাঁর ভেতর থেকে সন্ত্রাসীদের ছোঁড়া গুলিতে মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ঝিনাইদহ এক্স-ক্যাডেট এসোসিয়েশনের সভাপতি, পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা মারুফ হাসানসহ আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্য। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ ঘিরে তখন শ্বাসরূদ্ধকর পরিস্থিতি।

এরকম অবস্থায় চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে দুয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল। ঘটনা কাছ থেকে সরাসরি সম্প্রচারের মাধ্যমে তারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রস্তুতি সম্পর্কে অগ্রিম এমনসব খবর সম্প্রচার করছিল, যা আসলে রেস্তোরাঁর ভেতরের সন্ত্রাসী এবং আশেপাশে ভীড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা তাদের সম্ভাব্য সহযোগীদের আগেভাগেই সতর্ক হবার সুযোগ করে দিচ্ছিল। রেস্তোরাঁয় জিম্মি থাকা একজন প্রকৌশলী ভেতর থেকে তার পরিবারের সদস্যদের কাছে এসএমএস পাঠাচ্ছিল। একটি টেলিভিশন চ্যানেল বেকুবের মতো তার নাম-ধামও প্রচার করছিল।

এসব দেখে ২০১৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর সিডনির প্রাণকেন্দ্র মার্টিন প্লেসের লিন্ড ক্যাফেতে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী ঘটনার কথা মনে পড়ল। সেখানে এক অস্ত্রধারী ক্যাফেতে উপস্থিত সবাইকে জিম্মি করলে পুলিশের পক্ষ থেকে সমস্ত মিডিয়াকে ঘটনাস্থল থেকে সরাসরি সম্প্রচার না করার জন্য নির্দেশনা জারি করা হয়।

সেদিন অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়া পেশাদারিত্বের পাশাপাশি দারুণ দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছিল। তারা দর্শকদের নিয়মিত আপডেট জানালেও জিম্মি-কাণ্ডের হোতা সন্ত্রাসীর কোনো দাবি-দাওয়া বা ইচ্ছের কথা প্রচার করেনি। অথচ ঘটনাস্থলের খুব কাছেই ছিল অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম বৃহৎ টেলিভিশন চ্যানেলের অফিস।

রেস্তোরাঁর সন্ত্রাসী ঘটনা অনেকগুলো প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে এসেছে। প্রথমেই প্রশ্ন জাগে সারাদেশে জঙ্গিবিরোধী অভিযান চলাকালীন, বিশেষ করে ঢাকা শহরের রাস্তায় মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট থাকা অবস্থায় গুলশানের মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকার জঙ্গিরা এত অস্ত্রশস্ত্রসহ কীভাবে রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করল? বিশাল নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ছিদ্র কোথায় যা দিয়ে বারবার জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা হামলা চালাচ্ছে?

এত বড় একটা হামলার সঙ্গে নিশ্চয়ই অনেক দিনের পরিকল্পনা জড়িত ছিল অথচ আমাদের গোয়েন্দা বাহিনী তা সময়মতো জানতে পারেনি! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও আগে সরকারকে এ ধরনের হামলার ব্যাপারে সতর্ক করেছিল। তারপরও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।

দ্বিতীয়ত, বর্তমানের এই ভিন্নধারার সন্ত্রাস মোকাবেলায় আমাদের পুলিশ বাহিনীর দক্ষতা অনেক বাড়াতে হবে। এর আগে কলাবাগানে জুলহাজ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়ও আমরা দেখেছি, জঙ্গিদের হাতের কাছে পেয়েও তাদের ধরে রাখতে পারেনি রাস্তায় টহলরত পুলিশ।

তৃতীয়ত, বর্তমানের এইসব 'পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড' কিংবা জিম্মি-সন্ত্রাসের রাজনৈতিক প্রকৃতি অনুধাবন করতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান সন্ত্রাসী হামলাগুলো মামুলি ধরনের ঘটনা নয়। এর পেছনে একটি রাজনৈতিক শক্তি রয়েছে। শতকরা নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে ইসলাম নতুন করে প্রতিষ্ঠার কিছু নেই। তার মানে, এসব সন্ত্রাসের পেছনে যে রাজনৈতিক শক্তি তাদের উদ্দেশ্য ইসলাম নয়, বরং ইসলামের নামে অন্য কিছু।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জামায়াত-শিবিরই এই সমস্ত জঙ্গি-সন্ত্রাসী হামলার মদদদাতা। ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি, জঙ্গি-সন্ত্রাসের অভিযোগে এ পর্যন্ত যতজন গ্রেফতার হয়েছে, তাদের অধিকাংশই সাবেক শিবির নতুবা জামায়াতের প্রাক্তন কর্মী। সাম্প্রতিক এই সন্ত্রাসী হত্যাকাণ্ডগুলোর সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের একটা যোগসুত্র দৃশ্যমান। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভণ্ডুল করার জন্য জামায়াতের তরফ থেকে দেশে-বিদেশে প্রচুর অর্থ ঢালা হয়েছে। বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছে। যদিও তাতে খুব একটা লাভ হয়নি। বিচারও চলছে, ঠেকানো যায়নি।

জামায়াত-শিবিরও তাই মরণ-কামড় দিচ্ছে। পেট্রোল-সন্ত্রাস, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড থেকে এখন শুরু হল জিম্মি-সন্ত্রাস। একের পর এক হামলা চলছে। অথচ জঙ্গিবাদের নামে, ধর্মের নামে সন্ত্রাস মোকাবেলার যে রাজনৈতিক তৎপরতা রাজপথে থাকা উচিত, তার ঘাটতি রয়েছে।

এবারের জিম্মি-সন্ত্রাসের ঘটনা বাংলাদেশের জন্য অভিনব, যদিও বিশ্বে এরকম ঘটনা অনেক ঘটেছে। এ ধরনের ঘটনা মোকাবেলায় সাধারণত সেনাবাহিনী বা পুলিশের বিশেষ প্রশিক্ষিত দক্ষ বাহিনী দরকার। আমাদেরও তা আছে। আমাদের সেনা-নৌ-পুলিশ বাহিনী ও র‌্যাব অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। সে জন্য তারা ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। দেশবাসী পুনর্বার তাদের নিয়ে গর্বিত বোধ করল।

কুড়িজন দেশি-বিদেশি জিম্মি আর ছয় জঙ্গিসহ আঠাশ জনের মৃত্যুর বিনিময়ে রেস্তোরাঁর জিম্মি-সন্ত্রাসের অবসান ঘটলেও এটাই কি বাংলাদেশে শেষ জঙ্গি হামলা? এর পরের টার্গেট কে বা কারা? ঢাকায় যখন জিম্মি-সন্ত্রাস চলছে, তখন ঝিনাইদহে আবার এক পুরোহিতকে হত্যা করা হয়েছে, সাতক্ষীরায় একজন পুরোহিতকে হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করা হয়েছে। অর্থাৎ, জঙ্গিরা থেমে নেই। তাদের সন্ত্রাসী আক্রমণ চলবে বলেই প্রতিভাত হয়।

দেশের এই সংকটকালে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং তাদের সমর্থিত বুদ্ধিজীবীরা সন্ত্রাসের বিরূদ্ধে জাতীয় ঐকমত্যের পরামর্শ দিচ্ছেন। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সেটা কি সম্ভব বা কার্যকরী কোনো পরামর্শ? বর্তমানের জঙ্গি-সন্ত্রাসের প্রেক্ষিতে যেখানে জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে, সেখানে তাদের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ও রাজনৈতিক সখা বিএনপির এই ঐকমত্যের আহবান কি স্রেফ রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি নয়?

সন্ত্রাস দমনে যদি বিএনপি আসলেই আন্তরিক হত, তাহলে তারা জামায়াতের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক ত্যাগ করে সন্ত্রাসবিরোধী ঐকমত্যের পরামর্শ দিত।

জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সরকারকেই তাই জঙ্গি-সন্ত্রাস দমনে এগিয়ে যেতে হবে। দমন-প্রক্রিয়ায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা নৌ-সেনাবাহিনী সহায়ক শক্তি হিসেবে থাকবে। তবে দীর্ঘমেয়াদে জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া সমস্যার সমাধান প্রায় অসম্ভব।