জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি ও ভর্তুকির বাজারি দর্শন

কল্লোল মোস্তফা
Published : 20 Sept 2011, 04:33 PM
Updated : 20 Sept 2011, 04:33 PM

জ্বালানি তেলের মূল্য লিটার প্রতি ৫ থেকে ৮ টাকা এবং সিএনজি'র মূল্য ইউনিট প্রতি ৫ টাকা বাড়ানোর ফলাফল এখনই ভোগ করতে শুরু করেছে জনগণ । পরিবহন ভাড়া বেড়ে গেছে, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আসছে এবং এসবের সাথে তাল রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য ও সেবার দামও বাড়ছে। যদিও ব্যালেন্স অব পেমেন্ট(বিওপি)-এর ঘাটতি মিটানোর নামে আইএমএফ-এর এক্সটেনডেড ক্রেডিট ফেসিলিটি(ইসিএফ) ফান্ড থেকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ নেয়ার শর্ত হিসেবে এই মূল্য স্ফীতির আয়োজন করার সময় অর্থমন্ত্রী জনগণকে বলেছেন:ভর্তুকি কমানোর জন্য জ্বালানি তেল, বিদ্যূৎ এবং অন্যান্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করতে হবে কিন্তু এর ফলে নাকি মূল্যস্ফীতি হবে না, জনগণের নাকি ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে এবং তিনি নাকি জানেন কেমন করে জ্বালানির মূল্য বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতি, এমনকি, কমানোও যায়!
(সূত্র: ১৪ সেপ্টম্বর, বিডিনিউজ২ ৪ডটকম।)

এমনকি আইএমএফ তার ইসিএফ ফান্ড থেকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে যে বিভিন্ন শর্ত দিয়েছে তাও অস্বীকার করেছেন অর্থমন্ত্রী:"আইএমএফ একটা শর্তও দেয় নি, তারা কেবল সময় বেধে দিয়েছে।"(সূত্র: ১৫ সেপ্টম্বর,দ্যা ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেস)

অথচ খোদ আইএমএফ ওয়েবসাইটে ECF ফান্ড দেয়ার ক্ষেত্রে শর্ত মানার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে:
Under the ECF, member countries agree to implement a set of policies that will help them support significant progress toward a stable and sustainable macroeconomic position over the medium term. These commitments, including specific conditions, are described in the country's letter of intent.
(সূত্র: আইএমএফ ইসিএফ ফ্যাক্টশিট)
http://www.imf.org/external/np/exr/facts/ecf.htm

এখন প্রশ্ন হলো, আইএমএফ এর ইসিএফ ফান্ড থেকে এই ঋণ নেয়ার জরুরত কতটুকু এবং কীভাবেই বা তা তৈরি হলো? আইএমএফ এই ঋণ নেয়ার "যোগ্যতা" সম্পর্কে বলছে: "The ECF is available to all PRGT-eligible member countries that face a protracted balance of payments problem, i.e. when the resolution of the underlying macroeconomic imbalances would be expected to extend over the medium- or longer term.".

এ হিসেবে কোন দেশকে ইসিএফ ফান্ড থেকে অর্থ পেতে হলে দীর্ঘদিন ধরে বিওপি'র সমস্যায় ভুগতে হবে। বাংলাদেশ তো দীর্ঘ মেয়াদে বিওপি'র ঘাটতিতে ভুগতে থাকা কোন দেশ না। গত এক যুগ ধরে বাংলাদেশের কোন ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের ঘাটতি ছিল না, গত অর্থবছরে উদ্বৃত্ত ছিল ২৮৬.৫ কোটি ডলার। কিন্তু এ বছর দেখা যাচ্ছে ঘাটতিতে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী এই ঘাটতির পরিমাণ ৬৩.৫ কোটি ডলার। কী এমন ঘটলো যে বাংলাদেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের ঘাটতি হয়ে গেল?

ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ঘাটতি হওয়ার মানে হলো যে পরিমাণ ডলার দেশে প্রবেশ করছে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ দেশ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। রপ্তানির চেয়ে আমদানী বেশি হওয়া, বিদেশি বিনিয়োগের তুলনায় বিনিয়োগকারী কর্তৃক বেশি অর্থ মুনাফা আকারে দেশ থেকে বেরিয়ে য়াওয়া, রেমিটেন্সের পরিমাণ হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি নানান কারণেই এ বিষয়টি ঘটতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া হিসেব অনুসারে গত বছরের সাথে এ বছরের একটা তুলনা করা যাক:

উপরের টেবিল থেকে দেখা যাচ্ছে, বাণিজ্য খাতে ঘাটতি বেড়েছে সবচেয়ে বেশি-২১৭৩ মিলিয়ন ডলার, এরপর সেবা খাতে ১১৬৫ মিলিয়ন ডলার এবং ফাইনান্সিয়াল খাতে ৯৩৩ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া হিসেব থেকে দেখা যায়, ফাইনান্সিয়াল খাতে ঘাটতি বাড়ার কারণ হলো যে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ কিংবা ঋণ আকারে দেশে ঢুকেছে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থ ঋণের সুদ, বিনিয়োগের মুনাফা ইত্যাদি আকারে দেশের বাইরে চলে গেছে। সেবা খাতের ঘাটতি বাড়ার মূল উপাদান দেখা যায় ট্রান্সপোর্ট বা যোগাযোগ খাতে বিভিন্ন পণ্য ও সেবা আমদানি বেড়ে যাওয়ার কারণে। আর বাণিজ্য খাতের ঘাটতির জন্য খাদ্য শস্য ও গার্মেন্টস পণ্যের কাচামাল আমদানী বাবদ বাড়তি ব্যায় ইত্যাদির ভূমিকা থাকলেও এই ঘাটতি সবচেয়ে বেশি পরিমাণে হয়েছে জ্বালানি তেল আমাদানী খাতে। জ্বালানি তেল আমদানী ব্যায় ২৫৫৫.৫ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৪১০৯.১ মিলিয়ন ডলার হয়েছে অর্থাৎ এক বছরে জ্বালানি খাতে ব্যায় বেড়েছে ১৫৫৩.৬ মিলিয়ন ডলার।

আর এই বাড়তি জ্বালানি তেল আমদানির প্রধান কারণ হলো ডিজেল ও ফার্নেস ওয়েল ভিত্তিক রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ভর্তুকি মূল্যে জ্বালানি সরবরাহ করা। জরুরী ভিত্তিতে দ্রুত বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের কথা বলে গত বছর মোট ২২টি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। কথা ছিল ডিজেল ভিত্তিক কেন্দ্রগুলো চার মাসের মধ্যে এবং ফার্নেস ওয়েল ভিত্তিক কেন্দ্রগুলো ৯ মাসের মধ্যে চালু হবে। ২২টির মধ্যে মোট ১৮টি প্রকল্পের চুক্তি সম্পন্ন হয় যেখানে ডিজেল চালিত কেন্দ্র হতে গড়ে প্রতি ইউনিট ১৪ টাকা এবং ফার্নেস ওয়েল চালিত কেন্দ্র হতে প্রতি ইউনিট ৮ টাকা দর ঠিক হয়। সরকারী বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গড় উৎপাদন ব্যায় তিন/চার টাকা হলেও এবং সরকার গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৩.৬৬ টাকা করে বিক্রি করলেও জরুরী অবস্থা সামাল দেয়ার অজুহাতে এই উচ্চদামে বেসরকারী বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করে। কিন্তু কোন বিদ্যুৎ কেন্দ্রই সময় মতো চালু হয় নি, এ বছরের আগষ্ট মাস পর্যন্ত মোট ১২টি প্রকল্প চালু হয়েছে যার মধ্যে ৪টি তে নানা রকম যান্ত্রিক সমস্যা দেখা দিয়েছে এবং বেশির ভাগ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকেই নির্ধারিত পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে না। অথচ এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য সরকারকে দুই বার বিপুল ভর্তুকি দিতে হচ্ছে- একবার ভর্তুকি মূল্যে ডিজেল বা ফার্নেস ওয়েল সরবরাহ করার সময় আরেকবার ২/৩ টাকার বিদ্যুৎ ৮ টাকা বা ১৪ টাকায় কিনে গড়ে ৩.৬৬ টাকা করে বিক্রি করার সময়। এভাবে যে হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে আসলে কোটিপতি উৎপাদন-পুনরুৎপাদন করা হচ্ছে, সেই টাকায় জরুরী উদ্যোগ নিলে রাষ্ট্রীয় খাতে বেশ কয়েকটি ডুয়েল পাওয়ার বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব হতো যা ভর্তুকি ছাড়াই দেশের বিদ্যুৎ সংকটের স্থায়ী সমাধানে ভূমিকা পালন করতো।

কাজেই দেখা যাচ্ছে, যে বাড়তি ভর্তুকির হাত থেকে বিপিসি'কে রক্ষা করা ও ব্যালেন্স অব পেমেন্টের উপর থেকে চাপ কমানোর অজুহাতে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে সেটা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো হুট করে ঘটা কোন ঘটনা নয়। দেশের শিল্প ও বিনিয়োগ নীতিতে শতভাগ মুনাফা বিদেশে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ রাখা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় খাতে ছোট-বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন না করে বেসরকারি খাতে ডিজেল ও ফার্নেস ওয়েল ভিত্তিক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে একবার বাড়তি জ্বালানি তেলের উপর বাড়তি ভর্তুকি, আরেকবার উৎপাদিত বিদ্যুৎ বেশি দামে কিনে কম দামে বিক্রি -এই দুইধারি লস দেয়া, দেশি কোম্পানির বদলে বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির কাছে গ্যাস ক্ষেত্র ইজারা দিয়ে উচ্চমূল্যে গ্যাস ক্রয় ইত্যাদি কারণে ব্যালেন্স অব পেমেন্টের এই বেহাল অবস্থা। এই কারণগুলো জারি রেখে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার নামে আইএমএফ এর কথায় এবং শাসক শ্রেণীর বাজারি "উন্নয়ণ দর্শন" অনুযায়ী জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ইত্যাদির দাম বাড়ানোর ফলে বিপিসি কিংবা পিডিবি'র মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে লোকসানের হাত থেকে তো বাঁচানো যাবেই না উল্টো এসব প্রতিষ্ঠানের ক্রমবর্ধমান দূরবস্থার খেসারত বারবার জ্বালানি-তেল, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে জনগণকে দিতে হবে।

এভাবে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির মানে হলো পাবলিকের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নিয়ে ব্যাক্তি মালিক-কর্পোরেটের মুনাফার যোগান নিশ্চিত করা অর্থাৎ পাবলিকের টাকায় প্রাইভেটকে ভর্তুকি প্রদান। যে বাজারি উন্নয়ণ দর্শনের কাছে রাষ্ট্রীয় খাতে ভর্তুকি একটি নিষিদ্ধ ব্যাপার, সেই উন্নয়ণ দর্শনকেই দেখা যায় এভাবে প্রাইভেট কিংবা কর্পোরেট খাতকে ভর্তুকির প্রেসক্রিপশান দিতে। অথচ সরকারি কোন প্রতিষ্ঠান যখন অন্য কোন সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ভর্তুকি দেয় তখন টাকাটা এক পাবলিক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য পাবলিক প্রতিষ্ঠানে যায়, ফলে জনগণের অর্থ জনগণের কাছে থাকার ও জনগণের কাজে লাগার সুযোগ থাকে। কাজেই এখন প্রয়োজন দেশি-বিদেশি গোষ্ঠী স্বার্থে বেসরকারি-বহুজাতিক খাতে প্রদত্ত ভর্তুকির ম্যাকানিজম বন্ধ করে রাষ্ট্রীয় খাতগুলোকে শক্তিশালী করার দাবী তোলা যেন এমনিতেই নিম্ন আয় ও জীবন যাপন ব্যায়ের উচ্চহারে নাভিশ্বাস উঠা জনগণের জন্য বিদ্যুৎ-জ্বালানি-পরিবহন-স্বাস্থ্য-কৃষি ইত্যাদি জনকল্যাণমূলক খাতে ভর্তুকি বাড়নো যায়।

কল্লোল মোস্তফা: রাজনৈতিক কর্মী ও গবেষক।