আমার হুমায়ূন

লুৎফর রহমান রিটন
Published : 20 Sept 2011, 01:45 PM
Updated : 20 Sept 2011, 01:45 PM

২০০১ এর জুন থেকে আমি দেশান্তরী। ২০০৭ এর নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ফিরতে পারিনি। প্রথমে বাংলাদেশ থেকে জাপান। জাপান থেকে আমেরিকা। আমেরিকা থেকে কানাডা। এক দেশ থেকে আরেক দেশ। লম্বা জার্নি। জীবনটা কাটছিলো মোটামুটি দৌঁড়ের ওপর। কতো কতো প্রিয় জিনিস যে ফেলতে ফেলতে গেলাম! কতোজন যে আমার হাতছাড়া হয়ে গেলো! কতোজন যে আমার হাতটি ছেড়ে দিলো! কিন্তু একজনের সঙ্গে সম্পর্কটা আমার ছিন্ন হলো না। তিনি হুমায়ূন আহমেদ।

আমি যেদিন সন্ধ্যায় দেশ ছাড়ি সেদিন বিমানে আমার সঙ্গে ছিলো হুমায়ূনের বই। টোকিওর একটি হাসপাতালে আমার স্ত্রী শার্লির অপারেশন হলো। প্রতিদিন সকালে হাসপাতালে যাই ফিরে আসি রাত বারোটায়। বারোটার পর আর ওখানে থাকার নিয়ম নেই। কড়া ডোজের পেইন কিলার ইনজেকশন নিয়ে শার্লি হাসপাতালের বেডে ঘুমিয়ে থাকে। আমি ওর পাশে সারাদিন বসে থাকি। আমার সঙ্গে থাকে হুমায়ূনের বই।

কানাডার ইউনিভার্সিটিতে আমার কন্যা নদীর ক্লাশ কিংবা পরীক্ষার কারণে ওকে পৌঁছে দিয়ে ওখানেই গাড়ি পার্ক করে তিন চার ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। আমার একটুও বিরক্তি লাগে না কারণ আমার সঙ্গে থাকেন হুমায়ূন আহমেদ। এখন প্রতি বছর কানাডা থেকে বাংলাদেশে যেতে অটোয়া-হিথ্রো-দুবাই-ঢাকার দীর্ঘ ক্লান্তিকর বিমান যাত্রায় আমার সমস্ত ক্লান্তি মোচনে সঙ্গী হিশেবে উপস্থিত থাকেন হুমায়ূন আহমেদ। ফিরতি পথেও ধ্রুব এষের অসাধারণ প্রচ্ছদের ভেতর থেকে হুমায়ূন আহমেদ যেনো পরম মমতায় তাঁর হাতটি বাড়িয়ে দেন—এনিমেশন মুভিটা দেখার পরে একটা ব্রেক নাও, তারপর নো চিন্তা, আমি তো আছিই…।

হুমায়ূন আহমেদকে ছাড়া আমাদের ঈদ হয় না। ঈদের রাতে টিভিতে হুমায়ুনের নাটক না দেখলে বাঙালির কি ঈদ পরিপূর্ণ হয়? আমার এক নিত্যশুভার্থীর কল্যাণে ঢাকার ঈদ সংখ্যাগুলো দ্রুতই চলে আসে কানাডায়, আমার হাতে। এই তো মাত্র কদিন আগেই পেলাম বিশাল একটা ওজনদার প্যাকেট। প্যাকেটের ভেতর প্রথম আলো, আনন্দ আলো, অন্যদিন, সাপ্তাহিক, আর ইত্তেফাক। অন্যদিনের হিমু, ইত্তেফাকের মিসির আলী, প্রথম আলোর মেঘের ওপর বাড়ি আর আনন্দ আলোর কবি সাহেব পড়া শেষ। এখন পড়বো বাকিদের বাকি লেখাগুলো।

কানাডায় একান্ত পারিবারিক পরিবেশে আমাদের বাড়িতে পালিত হয় প্রিয়জনদের জন্মদিন। সেটাও আবার সপ্তাহ ব্যাপী। যেমন সত্যজিৎ সপ্তাহ। অমিতাভ সপ্তাহ। বিশেষ সেই সপ্তাহে সাতদিন ধরে আমাদের বাড়িতে চলে সত্যজিতের বই পুনঃপাঠ এবং সত্যজিতের ফিল্মগুলোর প্রদর্শনী। প্রতিরাতে একটা করে। হীরক রাজার দেশে দিয়ে শুরু আর শেষ হয় পথের পাঁচালি দিয়ে। অমিতাভের ক্ষেত্রে তাঁর অভিনীত ছবিগুলো দেখি। প্রতিরাতে একটা করে। শোলে দিয়ে যার শুরু হয়। একই পদ্ধতিতে চলে চার্লি চ্যাপলিন আর মিঃ বিন সপ্তাহ। তবে সবচে আনন্দের সঙ্গে উদযাপিত হয় হুমায়ূন সপ্তাহটি। এই সময় আমার সঙ্গে আমার স্ত্রীও থাকেন দর্শকের আসনে। বাকিদের বেলায় দর্শক আমি একাই।

১৯৯৪ সালে অবসর থেকে প্রকাশিত আমার বই 'ভূতের জাদু' আমি উৎসর্গ করেছিলাম হুমায়ূন আহমেদকে। ১৯৯৫ সালে আমার সম্পাদিত ছোটদের কাগজ পত্রিকাটিতে 'কালো জাদুকর' নামে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখেছিলেন হুমায়ূন। আসলে আমাদের সাহিত্যে হুমায়ূন নিজেই একজন জাদুকর। অসামান্য জাদুকর। এমন সম্মোহনী শক্তি নিয়ে আর কেউ আসেননি। আমরা আমাদের সময়ে একজন হুমায়ূন আহমেদকে পেয়েছি। এটা অনেক বড় প্রাপ্তি।

নিকট অতীতে হার্টের সঙ্গে লড়ে বিজয় ছিনিয়ে আনা প্রিয় কথক হুমায়ূন আহমেদকে এবার লড়তে হবে কোলন ক্যান্সারের বিরুদ্ধে। প্রার্থনা করি, এবারও বিজয়ী হবেন অসম্ভব ক্ষমতাবান এই সৃজনশীল মানুষটি। হুমায়ূন আহমেদ, গড ব্লেস ইউ……।