দুটি ময়না তদন্ত ও একটি ন্যায়বিচারের আশা

নাদিম মাহমুদনাদিম মাহমুদ
Published : 17 June 2016, 05:46 PM
Updated : 17 June 2016, 05:46 PM

মাস দুয়েক আগে বগুড়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক মেয়ে ধর্ষিত হয়েছেন দাবি করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আসেন। মেয়েটির অভিযোগ ছিল, তার স্বামী তাকে ধর্ষণ করেছেন। কথাগুলো যখন একজন ডাক্তার বন্ধুর মুখে শুনছিলাম, তখন অজ্ঞতাবশত হেসেছিলাম, স্বামী স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছে এটি কীভাবে প্রমাণ করা সম্ভব সে কথা ভেবে। প্রশ্ন করেছিলাম, তাহলে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের কোনটিকে 'ধর্ষণ' বলা যাবে আর কোনটিকে স্বাভাবিক মিলন বলতে হবে?

ডাক্তার বন্ধুর উত্তর ছিল সোজা-সাপটা। যখন কোনো মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সম্পর্ক হবে, তখন আক্রান্ত মেয়েটি আক্রমণকারীকে বিভিন্নভাবে বাধা দেবে। তার দেহে নখ বসিয়ে দিবে, তার দিকে থুতু ছিটাবে, এমনকি সিমেন বা বীর্য শরীরের বিভিন্ন অংশে লেগে থাকবে। আর স্বাভাবিক সংসর্গে এ ধরনের অস্বাভাবিকতা পাওয়া যাবে না। মূলত কেউ অভিযোগ করলে, তিনি যৌননিগ্রহের শিকার হয়েছেন কি না তা নিরূপণ করা যায় এসব ব্যহিক অবস্থা দেখে। চিকিৎসকরা প্রাথমিকভাবে ভুক্তভোগীর ধর্ষণ-বিষয়ক 'আলামত' পাওয়ার কথা জানান।

সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণের ঘটনা যেন প্রায় মহামারী হয়ে উঠেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার নারীকে কয়েক গুণ বেশি অবমাননার শিকার হতে হয় যখন তিনি কিংবা তার পরিবার রাষ্ট্রের কাছে সুবিচার চাইতে যান তখন। একই ঘটনা ঘটেছে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে সোহাগী জাহান তনু নামের যে তরুণীকে ধর্ষণ ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে তার বেলায়। আলোচিত এই খুন ও ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে যে 'ধোঁয়াশা' তৈরি করা হয়েছে তা থেকে কিছু সমাধান পেতেই এই লেখার অবতারণা। ময়না তদন্ত প্রতিবেদনের কিছু 'শব্দচয়ন' নিয়ে জনমনে যে ক্ষোভ তৈরি হযেছে, প্রাসঙ্গিকভাবে সেসবও আলোচনায উঠে আসবে।

পাঠক, সোহাগী জাহান তনুর বিষয়ে আলোচনার সুবিধার্থে আমরা এক নজরে দেখে নিই 'বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ধর্ষণ' বিষয়ে কী বলা হয়েছে সেটি। ১৮৬০ সালের আইনের ৩৭৫ দণ্ডবিধিতে সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে, নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে, কিংবা সম্মতি ছাড়া মৃত্যু কিংবা জখমের ভয় দেখিয়ে কিংবা নারীর সম্মতি আছে কিন্তু তার বয়স ষোল বছরের নিচে এমন অবস্থায় যৌন সম্পর্ক হলে তা 'ধর্ষণ' বলে ধরা হবে।

সাধারণত পৃথিবীর সব দেশেই 'জোরপূর্বক' যৌন সম্পর্ককে 'ধর্ষণ' মনে করা হলেও, ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি এই সংজ্ঞায় কিছুটা পরিবর্তন এনেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা এফবিআইএই। সে সংজ্ঞা মতে, কারও অমতে তার যৌনাঙ্গ, মুখ বা পায়ুতে যৌনইচ্ছা পূরণের চেষ্টা করা হলে সেটাই 'ধর্ষণ' বলে বিবেচিত হবে।

২০ মার্চ, ২০১৬ সন্ধ্যায় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী তনু কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থিত তাদের বাসা থেকে টিউশনির উদ্দেশে বেরিয়ে গিয়ে আর ফিরেনি। পরে তাকে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায় সেনানিবাসের ভেতরের একটি এলাকায়। হাসপাতালে নেবার পথে মারা যায় মেয়েটি। লাশ দেখে পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধর্ষণের কথা গণমাধ্যমে জানানোর পরের দিন, ২১ মার্চ তনুর দেহ থেকে বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করা হয়।

এর প্রায় চৌদ্দ দিন পর, ৪ এপ্রিল, ২০১৬ কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক শারমিন সুলতানা যে প্রতিবেদন তৈরি করেন তাতে 'ধর্ষণের কোনো আলামত পাননি' বলে জানিয়ে দেন। ইতোমধ্যে ময়না তদন্তের প্রতিবেদন পেতে দেরি হওয়ায় সারাদেশে বিক্ষোভ আর জনরোষ তৈরি হয়। সে প্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে ৩০ মার্চ, ২০১৬ কবর থেকে তনুর লাশ তুলে আবার ময়না তদন্ত করা হয়।

ওদিকে থানা পুলিশ ও ডিবির হাত ঘুরে তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া সিআইডি কয়েক দফায় ঘটনাস্থলে গিয়ে আলামত সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ঢাকায় নিয়ে আসে। ১৬ মে, ২০১৬ সিআইডি জানায় যে, মৃত্যুর আগে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল তনু, সংগৃহীত আলামতের ডিএনএ পরীক্ষায় কয়েক জন পুরুষের বীর্যের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

এর ২৬ দিন পর, ১২ জুন তনুর দ্বিতীয় ময়না তদন্তের প্রতিবেদন জমা দেন কুমিল্লা ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক কামদা প্রসাদ সাহা। সেই প্রতিবেদনে তনুর মৃত্যুর পূর্বে 'সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স' করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। সেখানে তিনি এই ইন্টারকোর্সকে 'রেপ' বলতে নারাজ। তার বক্তব্য ছিল এ রকম: ''মৃত্যুর পূর্বে তার সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স হয়েছে। যেহেতু দশ দিন পর ময়নাতদন্ত করা হয়েছে, মৃতদেহ পচা ছিল, দশ দিন পর পচা গলা মৃতদেহ থেকে নতুন করে কোনো ইনজুরি বোঝা সম্ভব হয়নি।"

তার মানে, তনুকে ধর্ষণ করা হয়েছে কি না এবং তনুর মৃত্যু কীভাবে হয়েছে, এ বিষয়ে এখনও কিছু বলতে পারলেন না তনুর ময়না তদন্তকারীরা!

আজকের এই প্রবন্ধের বিষয়বস্তু এখানে। রেপ আর সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স নিয়ে আলোচনা করার আগে প্রথমে আমরা জেনে নিব 'ধর্ষণের আলামত'এর ফরেনসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়ে। অনেক ক্ষেত্রে আমরা এই বিষয়গুলো জানি না বলে আমাদের রাষ্ট্রের সেবকরা যা গিলতে বলেন, আমাদের গণমাধ্যম সেগুলো উগড়ে দিয়ে আমাদেরকে হজম করায়। ডিএনএ টেস্ট শব্দটি নিয়ে মুখে মুখে সবাই ফেনা তুলে ফেলি, কিন্তু টেস্টটি আদৌ কী তা কি আমরা জানি?

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় আমার পড়ার বিষয় ছিল বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি। জাপানে এসে আমি এখন যে ল্যাবে গবেষণা করছি সেটা মূলত মলিকুলার ল্যাব অর্থাৎ ডিএনএ-প্রোটিন-ফ্লুরেসেন্স নিয়ে। প্রতিদিনই এখানে ডিএনএ নিয়ে কাঁটাছেড়া করি। কখনও সিকোয়েন্স, কখনও রিকমবেন্ট করে নতুন জিনের প্রোটিনীয় বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করতে হয়। এগুলো ধারাবাহিক কাজ হলেও এখানে ফরেনসিক মেডিকেল টেস্ট নিয়ে আমার একটু পড়াশুনা করার সৌভাগ্য হয়েছে। আর যেহেতু এই প্রবন্ধের বিষয়বস্তু 'ধর্ষণের ফরেনসিক পরীক্ষা', সেহেতু আমি সেই বিষয়গুলোতেই আলোকপাত করব।

সাধারণত ধর্ষণ বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য দুটি ধাপ রয়েছে:

(১) ফিজিক্যাল অ্যাপিয়ারেন্স বা বাহ্যিক অনুষঙ্গ দেখে ধর্ষণের আদর্শবিধি ও স্ট্যান্ডার্ড প্রটোকল অনুসরণ;

(২) সংগৃহীত প্রাণ-রসায়নিক (বায়োলজিক্যাল) নমুনা নিয়ে ফরেনসিক বা মলিকুলার টেস্ট।

বাহ্যিক অনুষঙ্গের বিষয়টি লেখার শুরুতে উল্লেখ করেছি। যখন কাউকে জোরপূর্বক যৌনক্রিয়ায় অংশ নিতে হয়, তখন বেশ কিছু অস্বাভাবিকতা পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে– ভিকটিম রাগান্বিত হবে, অবসাদগ্রস্ত থাকবে, বমি বমি ভাব হবে তার, ভীতি ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানসিক বিকারগ্রস্ততাও দেখা দিতে পারে। এগুলো দেখে প্রাথমিকভাবে ধারণা পাওয়ার পরই চিকিৎসকরা 'স্ট্যান্ডার্ড প্রটোকল' অনুযায়ী ধর্ষণের আলামত সংগ্রহ করতে পারেন।

চিকিৎসকরা ভুক্তভোগীর শরীর থেকে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে চুল, লালা, সিমেন বা বীর্য, পেলভিক রস, নখের ভিতর জমে থাকা 'উচ্ছিষ্ট' (যেখানে ধর্ষকের শরীরের কোষ বা সেল পাওয়ার সম্ভবনা থাকে, কারণ ভিকটিম বাধা দেওয়ার সময় নখে এই কোষ আটকে থাকে), ধর্ষিতার কাপড়, অন্তর্বাস, শরীরের জখম, মুখের ভিতরের 'প্রি-মোলার দাঁত' রস, রক্ত ও মূত্র সংগ্রহ করবেন। আক্রান্তের ভ্যাজাইনা, উরু ও শরীরের অংশ থেকে সিমেন বা বীর্য সংগ্রহ করে স্টেরালাইজ ও জীবাণুমুক্ত কটন বার্ড দিয়ে মাইক্রোস্কোপিক স্লাইডে রাখতে হয়। সজীব রাখার জন্য স্যালাইনে ডুবিয়ে রাখা হয় কোষগুলো।

প্রতিটি নমুনা সংগ্রহের সময় চিকিৎসকের হাতে গ্লাভস থাকা জরুরি। তাছাড়া পৃথক পৃথক খামে তা সংগ্রহ করার বিধি রয়েছে। কোনো কারণেই নমুনা সংগ্রহের সময় হাঁচি বা কাশি দেওয়া যাবে না। কারণ এতে সংগৃহীত নমুনায় সংগ্রাহকের 'কোষ' মিশে গিয়ে আলামত নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।

ফরেনসিক ল্যাবে নমুনা পাঠানোর আগে দেশের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার বা হাসপাতালগুলোতে সংগৃহীত 'সিমেন বা বীর্য' আলোক মাইক্রোস্কোপে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এ জন্য সাধারণত প্রচলিত রাসায়নিক উপাদান বা কিট, যেমন Sexual Assault Evidence Collection Kit (SAECK) বা ফ্লোর-ডাই ব্যবহার করা হয়। সিমেন হল এক ধরনের টেস্টোটেরন হরমোন। মূলত 'শুক্রাণু' কোষ হল সিমেন। শুক্রাণুর দুই অংশ (মাথা ও লেজ) কিটে থাকা ফসফাইটেজ নামক রাসায়নিক উপাদান যুক্ত হয়ে মাইক্রোস্কোপে দেখা যায়।

সে অনুযায়ী পরবর্তীতে চিকিৎসকরা মামলা রুজু করার নির্দেশ দেন। তবে হ্যাঁ, লক্ষ্য রাখার মতো বিষয় হল, সাধারণত সিমেন ৭২ ঘণ্টা, ভ্যাজাইনা-রস ১২ ঘন্টা থেকে ৭ দিন, নখ ২ দিন এবং চামড়া ৭ দিনের মধ্যে সংগ্রহ করতে হয়। এর মধ্যে কোনো অবস্থায় ধর্ষিতা গোসল করলে কিংবা শরীরের অংশ ধুয়ে ফেললে ধর্ষণের আলামত নষ্ট হয়ে যায়।

ধর্ষণ মামলা হওয়ার পর ধর্ষককে শনাক্ত করতে ফরেনসিক ল্যাবরেটরির সাহায্য নেওয়া হয়। বাংলাদেশের নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে ডেনমার্কের দাতা সংস্থার (ডেনিডার) অর্থায়নে দেশের একমাত্র জাতীয় ফরেনসিক ডিএনএ টেস্ট গবেষণাগার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপন করা হয়েছে।

ডি-অক্সি রাইবো নিউক্লিয়িক এসিড (ডিএনএ) হল কোনো ব্যক্তির একক বৈশিষ্ট্য নির্ণয়কারী শারীরবৃত্তীয় বা জেনেটিক একক। আমাদের প্রতিটি বৈশিষ্ট্য, যেমন চোখের রং, চুলের রং, গায়ের বর্ণ, ব্যবহারসহ প্রতিটি বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে 'জিন'। জিন তৈরি হয় ডিএনএ দ্বারা। জিন থেকে পাওয়া যায় প্রোটিন আর প্রোটিন হল দেহ গঠনের একক। এক কথায় বলতে গেলে, ডিএনএ হল একটি অট্টালিকার ইট আর জিন হল পুরো অট্টলিকা।

এবার আসি ডিএনএ টেস্ট বা ডিএনএ-প্রোফাইলিং বিষয়ে। উন্নত বিশ্বের বেশ কিছু দেশ তাদের নাগরিকদের পূর্ণাঙ্গ ডিএনএ তথ্য সংগ্রহ করে রেখেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Combined DNA Index System (CODIS) হল অপরাধ দমনের আলাদিনের যাদুর চেরাগ। যা সার্চ দিয়ে ডিএনএ-প্রোফাইল বের করে নিমিষে কোনো ব্যক্তিকে ধরে ফেলা যায়। যেহেতু ডিএনএ চারটি মৌলিক উপাদান (নিউক্লিওটাইড) দ্বারা তৈরি, সেহেতু একজন মানুষের ডিএনএর এই মৌলিক উপাদান একসঙ্গে সিকোয়েন্স বলা হয়। ডিএনএ-প্রোফাইলিং বলতে আমরা এই সিকোয়েন্স-বিশ্লেষণ বুঝি। এর জন্য কিন্তু অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয়। তাই, এখনকার বাস্তবতায় আমাদের দেশের নাগরিকদের ডিএনএ-প্রোফাইলিং করা সম্ভব নয় বলা যায়।

আমি সাধারণত এই প্রোফাইল করার জন্য 'জেনোম এনালাইজার' নামক একটি মেশিন ব্যবহার করি। যার মূল্য কয়েক লাখ টাকা। যে নমুনাটি প্রোফাইলিং বা সিকোয়েন্সের জন্য রাখা হয়, তা কিছু মৌলিক প্রোটোকলের আওয়তায় করতে হয়। সাধারণত মানুষের ডিএনএর দৈর্ঘ্য এমন যে, তার উপাদানগুলো একসঙ্গে যুক্ত করলে চাঁদে পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব।

ধর্ষণের ক্ষেত্রে ডিএনএ টেস্টের উদ্দেশ্য হল ধর্ষক শনাক্তকরণ। ধর্ষণ হয়েছে কি না তা দেখার জন্য প্রাথমিক সিমেন টেস্টই যথেষ্ট। ধর্ষককে চিহিৃত করতে হলে, সন্দেহভাজন ব্যক্তির শরীর থেকে দেহকোষ সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত শতকরা ৭৫ ভাগ ভুক্তভোগীই জানেন তাকে কে ধর্ষণ করেছে, ৮০ ভাগ ধর্ষণই হয় পরিচিত জায়গায়। তাই ধর্ষককে সন্দেহভাজন হিসেবে ট্রিট করা হয় ভুক্তিভোগীর জবানি থেকে। আদালতে আসল ব্যক্তিকে চিহিৃত করার জন্যই দরকার এই ডিএনএ টেস্ট।

সাধারণত ডিএনএ টেস্টের জন্য ধর্ষিত ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া নমুনা, যেমন বীর্য, দেহকোষ ইত্যাদি থেকে ডিএনএ এক্সট্রাক্ট বা ডিএনএ বিশ্লেষণ করা হয়। যেহেতু সব মানুষের ডিএনএ-প্রোফাইলিং করা কঠিন, তাই নির্দিষ্ট নমুনার ডিএনএর সঙ্গে সন্দেহভাজনের ডিএনএ হোমোলজি বা মিল পর্যবেক্ষণ করা হয়।

ডিএনএর এই হোমোলজি দেখার জন্য আমরা আগার জেল ব্যবহার করে থাকি। পরবর্তীতে ভিকটিমের ডিএনএ ও সন্দেহভাজনের ডিএনএ এই আগার জেলে বসিয়ে 'ইলেকট্রিক প্রবাহ' (ইলেকট্রোপরেসিস) তৈরি করা হয় যা কয়েক মিনিট (পনের কিংবা কুড়ি মিনিট) পর ডিএনএর নির্দিষ্ট ব্রান্ড খুঁজে বের করতে পারে।

ধরা যাক, কোনো নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। সন্দেহভাজনদের তালিকায় রয়েছে তিন ব্যক্তির নাম। এরা যখাক্রমে ক, খ ও গ। ধর্ষিতার দেহ থেকে পাওয়া ধর্ষকের নমুনার (যেমন, বীর্য) ডিএনএকে স্ট্যান্ডার্ড বা আদর্শ ধরে, সন্দেহভাজনের কাছ থেকে সংগ্রহ করা ডিএনএ ইলেকট্রোপোরেসিসে আগার জেলে তিন ব্যক্তির তিনটি পৃথক পৃথক ব্যান্ড পাওয়া যাবে। যার ব্যান্ডটি ধর্ষিতার কাছ থেকে সংগৃহীত নমুনার সঙ্গে মিলে যাবে অর্থাৎ সর্বোচ্চ হেমোলজি হবে, সেই ব্যক্তি নিঃসন্দেহে 'ধর্ষক'।

২০ মার্চ, ২০১৬ তনু খুন হবার পর ৪ এপ্রিল কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক শারমিন সুলতানা প্রদত্ত প্রতিবেদনে ধর্ষণের 'আলামত নেই' বলে উল্লেখ করা হয়। তাহলে পাঠক, আপনারা নিশ্চয়ই উপরের আলোচনার প্রেক্ষিতে ধারণা করেছেন যে, তনুকে ধর্ষণ করা হয়নি। আসলে তা-ই সত্য কি না আমরা এখনও জানি না। তবে তনুর প্রথম ময়না তদন্তের সময় এমন কিছু ঘটনা ঘটে থাকতে পারে যাতে ধর্ষণের আলামত নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে। সেগুলো ব্যাখ্যা করছি:

১.

সাধারণত সিমেন বেঁচে থাকার সময়সীমা হচ্ছে ১২ ঘণ্টা থেকে ৭২ ঘণ্টা। এর চেয়ে বেশি সময় গেলে সিমেন 'ডিনেচারেটেড' হয় বা এর প্রোটিন-স্বভাবচ্যুতি ঘটে। যেহেতু তনুর মৃত্যুর পরের দিন ফরেনসিক নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে, সেহেতু ধরে নিচ্ছি যে, শুক্রাণু তখনও বেঁচে ছিল। সাধারণত ভ্যাজাইনা ব্যাকটেরিয়াপ্রবণ এলাকা। সিমেন সংগ্রহের সময় যদি স্যালাইন পানি না দেওয়া হয় তাহলে মাইক্রোস্কোপিক স্টেনিংএ শুক্রাণুর পরিবর্তে ব্যাকটেরিয়া দেখা যাবে যা ধর্ষণের আলামত নয়।

২.

নমুনা সংগ্রহের সময় অতিরিক্ত কথা বললে কিংবা চিকিৎসকের থুতু নমুনায় লেগে গেলে সেটা অবিশুদ্ধ বা কন্টামিনেটেড হয়ে যায়।

৩.

সংগৃহীত নমুনা পর্যবেক্ষণের আগে যদি 'রেফ্রিজারেটরে' না রেখে খোলা জায়গায় রাখা হয়, তাহলেও তা নষ্ট হয়ে যায়।

৪.

যেহেতু ডাক্তার ৪ এপ্রিল ময়না তদন্তের প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন সেহেতু ডিএনএ টেস্টিং ল্যাবরেটরির আলামত নষ্ট হওয়ার সময়সীমার মধ্যে অর্থাৎ ছয় কিংবা সাতদিন পরে করেছিলেন। আর এ জন্য নমুনা পর্যবেক্ষণ অসার হয়ে পড়েছিল।

এবার আসি দ্বিতীয় ময়না তদন্তের প্রতিবেদন প্রসঙ্গে। ১২ জুন প্রদত্ত এই রিপোর্ট আসলে চিকিৎসাবিদ্যার ভাষায় 'ধোঁকাবাজি' ও 'লোকদেখানো' ছাড়া অন্য কিছু নয়। কারণ:

ক.

তনুর ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকরা কীভাবে তাদের প্রতিবেদনে 'সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স' করার কথা জানালেন? চিকিৎসাবিদ্যা, জেনেটিক বিদ্যা ও মলিকুলার বায়োলজির কোন টেকনোলজি ব্যবহার করে মৃত্যুর ১০ দিন পর পচা-গলা লাশে এমন আলামত পেলেন?

ধর্ষণ বা ইচ্ছাকৃত শারীরিক মিলন, যা-ই হোক না কেন, ব্যক্তিকে গোসল করানো হলে কিংবা যৌনাঙ্গ ধুয়ে ফেলা হলে কোনো নমুনাই শরীরে লেগে থাকবে না। যেহেতু তনুকে কবর দেওয়ার আগে গোসল করানো হয়েছিল, সেহেতু এটা শতভাগ নিশ্চিত যে, ধর্ষণ বা সঙ্গমের কোনো আলামতই আর থাকবে না।

এই ময়না তদন্তের উদ্দেশ্য যদি মৃত্যুর কারণ নির্ণয় হয় তাহলে ভিসেরা টেস্টসহ অন্যন্য টেস্ট করা যেতে পারত। ভিসেরা টেস্টের মাধ্যমে পাকস্থলিতে গরলের অস্তিত্ব বের করা সম্ভব। কিন্তু যেহেতু দ্বিতীয় ময়না তদন্তের উদ্দেশ্যেই ছিল ধর্ষণ ঘটেছে কি না তা শনাক্তকরণ, তাই পচা-গলা লাশ থেকে ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যাবে না, এটাই স্বাভাবিক।

খ.

তদন্তকারী ডাক্তাররা জানাননি তারা কীভাবে সেক্সুয়াল সিম্বল (সঙ্গমের প্রমাণ) ডিটেক্ট করেছেন। ডিএনএ মূলত জিনের একক। আর জিন প্রোটিন তৈরি করে। তাহলে কোন প্রোটিন সেক্সুয়াল কোর্সের জন্য দায়ী? আর তা নির্ণয় কীভাবে করা যায়?

গ.

ধরা যাক, তারা ইন্টারকোর্স হয়েছে তা নির্ণয় করেছেন। কিন্তু এই ইন্টারকোর্স যে ধর্ষণ নয় তার প্রমাণ কী? আমাদের ডাক্তারদের এই 'ইনোভেটিভ কাজ'টি (ফরেনসিক টেস্ট) বিজ্ঞান সাময়িকী 'ন্যাচার' কিংবা 'সায়েন্স'এ প্রকাশিত হবার যোগ্য। এমনকি নোবেল পুরস্কার পাবার মতোও বটে!

বিজ্ঞানের বিষয় বাদ দিয়ে যদি সাধারণ আইনি আলোচনায় আসি তাহলে দেখা যায়, সাধারণত ইন্টারকোর্স দ্বারা সংসর্গ বা সঙ্গম বুঝানো হয়। 'সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স' কোনো আইনি শব্দ নয়। প্রচলিত আইনে 'সেক্সুয়াল অ্যাসল্ট' হল রেপ। কামদা প্রসাদ সাহার রিপোর্টে মূলত এই শব্দ ব্যবহার করে বিতর্কিত, অপমানিত করা হয়েছে মৃত তনুকে। একই সঙ্গে নিদিষ্ট গোষ্ঠীকে বাঁচানোর অভিপ্রায়ও এর মধ্যে নিহিত।

ডিএনএ টেস্ট যে ল্যাবরেটরি করে সেই ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ-প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরি গত দশ বছরে এক হাজার ৮৬৬টি ধর্ষণের ঘটনায় ডিএনএ-প্রোফাইলিং করেছে। তাদের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যে দেখা যায় যে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৯০ জন ধর্ষিতার ডিএনএ টেস্ট করা হয়েছে। যা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রদত্ত তথ্যের সঙ্গে মিলে যায়। সংস্থার গত ৮ মে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ২৪৩ জন ধর্ষিত হয়েছে যার মধ্যে শিশু রয়েছে ৫৫ জন। ধর্ষণের ঘটনার মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের।

তনুর নৃশংস হত্যার ঘটনার পর যে প্রতিবেদন পাচ্ছি আমরা তা মূলত একপেশে ও নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে বাঁচানোর জন্য। রাষ্ট্রের যদি সদিচ্ছা না থাকে তাহলে কোনো দিনই কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হলে সঠিক প্রতিবেদন আসবে না। অধ্যাপক কামদা প্রসাদ সাহা মাসখানেক আগে নিজে হুমকি পাওয়ার কথা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন। আমরা সেটি ভুলে যাইনি। সে হুমকি যে কতটা মারাত্মক ছিল তা তার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। যদিও সায়েন্টিফিক্যালি তার 'ফরেনসিক' প্রতিবেদনের কোনো মূল্য খুঁজি পাওয়া যায় না। দ্বিতীয়বার ধর্ষণের আলামত সংগ্রহ করা ছিল মূলত জনগণকে শান্তনা দেওয়ার জন্য ঔষধ প্রদান মাত্র।

এ ধরনের প্রতিবেদন আসলে মৃত তনুকে আরেক দফা ধর্ষণের সমতুল্য। সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, মৃত্যুর পরও ময়না তদন্তের নামে বারবার ওর লাশ কাঁটাছেঁড়া করা হচ্ছে কেবল তা নয়, তার পরিবারের মনোবেদনা, সমাজের সচেতন মানুষের মর্মপীড়াও বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে এতে।

তবু তনুর জন্য ন্যায়বিচার পাবার আশাটি জিইয়ে রেখেই লেখা শেষ করতে চাই।