মুহম্মদ মোফাজ্জল-এর গল্প: এক মুঠো আবীর

মুহম্মদ মোফাজ্জলমুহম্মদ মোফাজ্জল
Published : 15 June 2016, 04:54 AM
Updated : 9 April 2022, 08:38 AM


চিত্রকর্ম: হুয়ান মিরো

উর্মীর মুখ ট্রেনের জানালায়, আর দৃষ্টি বাইরে। কমলাপুর স্টেশন থেকে ট্রেনটা ছাড়ার পর হালকা বৃষ্টি নামে। জানালার বাইরে হাত পেতে সে কয়েক ফোটা বৃষ্টির পানির স্পর্শ নেয়। ভেতরটা তার বহির্মুখী হয়ে ওঠে। কতো দিন ঝুম বৃষ্টিতে তার ভেজা হয় না। তার ইচ্ছে করে দূর দিগন্ত রেখায় একাকী তাকিয়ে থাকতে। আজকাল মাঝে মাঝে তার এমনটা হয়। প্রায় রেল লাইন সংলগ্ন রাজধানীর সড়ক পথের যানবাহন আর চলমান জনারণ্যে তার আটকে যাওয়া দৃষ্টি বেশি দূর প্রসারিত হয় না। তবুও বাহির থেকে তার দৃষ্টি ফেরাতে ইচ্ছে করছে না। বৃষ্টি থেমে গেছে। বিমান বন্দর স্টেশনে ট্রেন থামার পর স্টেশনটা যাত্রীদের উঠানামার কলরোলে জেগে ওঠে। উর্মী আনমনা হয়ে প্লাটফর্মের দিকে তাকিয়ে আছে।
'এক্সকিউজ মি, জানালার পাশের সিটটা আমার।'
আবীর ট্রলিব্যাগটা পাায়ের কাছে রেখে বললো। উর্মি জানালা থেকে মুখ সরিয়ে নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।
'আবীর তুমি!'
'হ্যাঁ, আমিই তো। আর তুমি তো দেখছি উর্মী।'
'অবাক হওনি?'
'পৃথিবী গোলাকার বলে দেখা হয়ে যায়। তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই।'
আবীর খুব স্বাভাবিকভাবেই কথা বললো। অনেক বছর পর উর্মীকে দেখার পরও তার চাহনিতে কোনো রকম উচ্ছ¡াস নেই। উর্মী জানে তার জন্য আবীরের কোনো উচ্ছ্বাস থাকার কথা ছিলো না। বিরক্তি থাকার তো কথা ছিলো। কিন্তু সেটাও নেই। তাই তাকে দেখে 'আবীর তুমি' বলতে গিয়ে সুপ্ত আবেগের এতোটা প্রকাশ পাওয়ায় ভেতরে ভেতরে নিজের কাছে নিজেকে ছোট লাগলো। আবীরের কাছে তার আবেগের মূল্যায়ন হওয়ার কথা নয়। সেটা নিজের কাছেও প্রত্যাশিত নয়। আর আবীর তো বিশ্বাসই করে না যে উর্মীর ভেতর তার জন্য কোনো আবেগের স্থান আছে।
'তোমার মনে হতে পারে যে বহু বছর পর দেখা হওয়া সহপাঠিনীকে করুণা করে জানালার ধারে নিজের সিটটা ছেড়ে দিচ্ছি। তাই আত্ম-সম্মান বোধ বিবেচনায় নিয়ে তুমি আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে পারো।' আবীর বললো। আবার হাসলোও। উর্মী নির্বাক তাকিয়ে আছে।

'আর যদি মনে করো যে এই সিটে বসছি তো বসছিই তবে আমিও দখলদারিনীকে উচ্ছেদ করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর স্মরণাপন্ন হবো না।' আবীর আবার হেসে স্বাভাবিকভাবেই কথাগুলো বলে গেলো।
উর্মী স্থানু হয়ে আবীরের সিটে বসে আছে। সে খেয়াল করেনি যে জানালার বাইরে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে তাদের দু'জনের কথাবার্তা শুনছিলো আবীরের স্ত্রী আর মেয়ে স্নাতা। উত্তরার বাসা থেকে তারা আবীরকে ট্রেনে তুলে দিতে এসেছে। আবীরের খুনসুটিতে তারা জেনে গেছে যে উর্মী আবীরের বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠিনী।
'বাবা, জাস্ট লাভলি! তোমার সময়টা ভালো কাটবে'। স্নাতা বললো। উর্মী তাদের দিকে তাকালো।
'আমার স্ত্রী ও মেয়ে।' আবীর বললো।
আবীরকে জানালার ধারে বসতে দিয়ে স্ত্রী ও মেয়ের সাথে কথা বলার সুযোগ দিতে উর্মী উঠতে যাচ্ছিলো। তখনই আবীরের স্ত্রী তার হাতটা খপ করে ধরে থামিয়ে দিলো।
'আরে উঠছেন কেন? আপনি জানালার ধারে বসুন তো।' আবীরের স্ত্রী স্মিত হাসিতে বললো।
ট্রেনটা নড়ে উঠলো। উর্মী তাকিয়ে আছে আবীরের স্ত্রী আর মেয়ের দিকে। আবীরের হাসি-খুশি স্ত্রীর পেটানো শরীর আর চেহারায় মিশুক ভাব। মেয়েটির চাহনীও উচ্ছলতায় ভরপুর। বয়স কতো হবে? চৌদ্দ কি পনের। সময় কতো দ্রæত বয়ে যায়! স্নাতার দিকে তাকিয়ে উর্মী তার ও আবীরের বয়সের ধারণা বা হিসেব করতে চায় না।
'এক দিন বাসায় আসুন না।' আবীরের স্ত্রী বললো। তার আতিথেওতায় উর্মী মুগ্ধ হয়।
ট্রেন ধীর গতিতে প্লাটফর্ম অতিক্রম করছিলো। স্নাতা ট্রেনের জানালা ধরে হালকাভাবে দৌড়াতে দৌড়াতে আবীরকে উপদেশ দিচ্ছিলো।
'বাবা, খেতে ভুলে যেও না। খেয়াল রেখো যাতে মোবাইল ফোনের চার্জ ফুরিয়ে না যায়। তোমার যা ভুলু মন!'
আবীর দাঁড়িয়ে জানালার দিকে ঝুঁকে মাথা নেড়ে সায় দিলো। ট্রেনের গতি আরো বেড়ে যাওয়ায় স্নাতা জানালা ছেড়ে দিলো। আবীর ট্রেনের যে বগিতে উঠেছে সেটি প্লাটফর্মের শেষ প্রান্ত অতিক্রম করছিলো। উর্মী তাকিয়ে দেখলো আবীরের মেয়ে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা পেছনে দাঁড়িয়ে আছে আবীরের স্ত্রী। স্ত্রী-সন্তান চোখের আড়াল হওয়ায় আবীরের মনোকষ্ট উর্মী টের পায়। আবীর ট্রলিব্যাগটা উপরে রেখে উর্মীর সিটে বসে পড়লো। সে স্ত্রী-সন্তানের কাছে উর্মীকে নিজের সহপাঠী বলেছে। এর চেয়ে ভালো কোনো সম্বোধন আবীরের কাছে নেই। সেটা উর্মীই সবচেয়ে ভালো জানে। এক সময় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভালো লাগা এবং দ্বিধাদ্বন্ধের সম্পর্কের ব্যর্থ পরিণতির বিবেচনায় সহপাঠিনী সম্ভোধনটাই যথোপযুক্ত।

অনেক বছর পর এক সঙ্গে এতোগুলো কথা আবীরের মুখ থেকে শোনে এবং তাকে হাসতে দেখে উর্মীর ভালো লেগেছে। ক্যাম্পাসে সে জহিরের বাহুলগ্না হওয়ার পর আবীরকে কখনোই হাসতে দেখেনি। আবীর হাসতে ভুলে গিয়েছিলো। ভুলে যেতে হয়েছিলো। নিজেকে লুকিয়ে রাখতো। উর্মী আর জহির আরো ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রদর্শনী করে আবীরের মনোকষ্টটা উপভোগ করতো। উপভোগকারীর দলে কয়েকজন সহপাঠীও ছিলো। আবীরের মনে হতো সে জনারণ্যে থেকেও বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপের নিঃসঙ্গ মানব। উর্মী যখন অনুধাবন করলো যে ব্যাপারটা অমানবিক বা অনেকটা পৈশাচিক ততোদিনে আবীর দৃষ্টিসীমার বাইরে ভিন্ন গ্রহের একজন।
'কেমন আছো?' আবীর জানতে চাইলো।
'ভালো।'
'আর তুমি?' উর্মী জানতে চাইলো।
'কেটে যায়, রক্ত বের হয় না।' এ কথা বলে আবীর হাসলো। উর্মীও হাসি চেপে রাখতে পারলো না। আর ভাবলো যে এক সময় কথা বলতে ভুলে যাওয়া আবীরের কতোই না পরিবর্তন।
অনেক বছর পর পূর্ব পরিচিত কারো সাথে একটু দীর্ঘ সময় কথা বলার সুযোগ হলে অবধারিতভাবেই নিজের সাংসারিক ও পার্থিব অবস্থা ওঠে আসে। আর কোনো প্রাক্তনের সাথে আলাপচারিতায় খুব কমন কৌতুহলী প্রশ্ন হচ্ছে, বিয়ে করেছো তো? তোমার কয় সন্তান? তারপর আলোচনাটা কে কতটা ভালো আছে সে দিকেই মোড় নেয়। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগই প্রাক্তনই নিজেরা যতোটা ভালো আছে তার চেয়ে যেনো বাড়িয়েই বলে। কেউ কেউ বর্তমান সম্পর্কে স্থিতি, বার্ধক্য বা অনীহার কথা চেপে গিয়ে প্রাক্তনের সাথে নিজের বৈষয়িক অর্জনের কথা বলে নিজেকে এগিয়ে রাখতে চায়। উদ্দেশ্য হচ্ছে, দেখো তোমাকে ছাড়া আমি কতোটা ভালো আছি। আবীর সেই ফুটানিটা করেনি। সে কেমন আছে তার অনেকটা উর্মী নিজ চোখে আঁচ করতে পারলো। তার বাইরে আবীর যতোটা আছে কেবল ততোই বলেছে। স্ত্রীর সাথে তার উষ্ণমধুর সম্পর্ক, কখনো ঝগড়াঝাটি এবং পরক্ষণেই মেয়ের হস্তক্ষেপে শান্তির আবহের বর্ণনা দেওয়ার সময় আবীর হাসছিলো। উর্মী এমন করে নিজের কথা বলতে পারেনি। আবীরও জানতে চায়নি।

'তোমার মেয়েটি খুব সুন্দর। মনে হয় ভীষণ কেয়ারিং ও লাভলী।' উর্মী আবীরের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো।
'আমি চাইনি আমার মেয়ে হোক।' আবীর বললো।
আবীরের এমন কথায় উর্মী ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড রকম ধাক্কা খেলো। তার বিস্ময়ের সীমা নেই। আবীরের মুখের দিকে তাকিয়ে সে ভাবছিলো আবীর কি তবে সেইসব স্বামীদের মতোই যারা কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ায় স্ত্রীকে দোষারোপ বা অপবাদ দিয়ে মানসিক নির্যাতন করে? আবার আবীরের কথাতেই তার ভুল ভাঙলো।
'মেয়েটি যখন স্বামীর কাছে চলে যাবে তখন আমার কষ্টের সীমা থাকবে না।' আবীর বললো।
মেয়ে দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকলে বাবার আনন্দের পৃথিবী সংকুচিত হয়ে যায় বলেই আবীর চায়নি তার মেয়ে হোক। এমনটা শোনার পর উর্মী ভেতরে ভেতরে লজ্জা পেলো। সে চোখ সরিয়ে বাইরে তাকালো। সামনে খোলা মাঠ পেরিয়ে তার দৃষ্টি এবার দূরে মোহাচ্ছন্ন হয়ে আছে। তখন এক পশলা বৃষ্টির ছাঁটে উর্মীর কোল আর মুখমন্ডল হালকা ভিজে গেলো। আবীর তাকে জানালা বন্ধ করতে বললেও সে আমলে নেয়নি।

মেয়ে স্নাতা আর স্ত্রীর সাথে ফোনে কথা বললো আবীর। তারপর সিটে ঘাড় এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুমিয়ে থাকা আবীরের মুখের দিকে উর্মী আড় চোখে তাকালো। সে ঘুমের ভান করে তাকে দেখছে না তো! দেখলে দেখুক। উর্মী তাকিয়েই আছে। সত্যি সত্যি আবীর ঘুমাচ্ছে। যাকে বলে একোরে সাউন্ড স্লিপ। উর্মী ভেবে পেলো না তা কী করে সম্ভব। তার ভালো লাগছে এটা ভেবে যে আবীর ভালো আছে। উর্মী ভাবে যে আবীর কি কখনো নিজের স্ত্রী বা সন্তানের কাছে তার সম্পর্কে কিছু বলেছে! স্টেশনে অল্প সময়ে তাদের যতোটুকু দেখেছে তাতে উর্মীর ধারণা আবীর হয়তো তার সম্পর্কে বলেছে। এমন পারিবারিক বন্ধুর কাছে অতিতের বিয়োগান্তক গল্প করাই যায়। পরক্ষণেই উর্মী নিজের ভাবনাকে শাসন করে এই বলে যে, সে আবীরের কী এমন কাছের মানুষ ছিলো যে তার সম্পর্কে নিজের স্ত্রী-সন্তানের কাছে বলতে যাবে!

প্রথম চাকুরি ছেড়ে দেয়ার পর আবীর আর কোনো চাকরি-বাকরি কিছু করেনি। কয়েকটা ফার্মে কনসালটেন্সি করে। স্থায়ী কোনো কিছু নয়। প্রয়োজনে তার ডাক পড়ে। কাজ শেষ হয়ে গেলে ঘুরে বেড়ায়। এতেও তার ভালই চলে যায়। চাকুরি কেন করে না তার জবাবে আবীর বলেছে, ধরাবাধা তার ভালো লাগে না। দশটা-পাঁচটা অফিস, কখনো কাজ না থাকলেও ডেস্কে বসে থাকার নিয়ম, বসকে তেলবাজি করা- এসব তার ধাতে সয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আবীরের রেজাল্ট ভালো হতে পারতো। টিচাররা তোমাকে বেশ পছন্দ করতেন। উর্মীর সাথে বিচ্ছেদের পর সে নিজেকে গুটিয়ে নিলো। একটা সময় সামনের ডেস্ক ছেড়ে একেবারে পেছনের ডেস্কে আশ্রয় নিয়েছিলো। পারলে ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে উর্মীর চোখের আড়াল হতে পারলেই যেন বেঁচে যেতো। উর্মী বুঝতে পারলো রেজাল্ট ভালো না হলেও আবীর অনেক ভালো রেজাল্টধারীর চেয়ে ভালো করছে। উর্মী যেন অস্ফুট স্বরে নিজেকে ধিক্কার দিলো এই বলে যে, হায়রে রেজাল্ট। অতিত পটভূমির বিবেচনায় এ কথার অর্থ তার চেয়ে বেশি কেউ জানে না।

ট্রেনের জানালায় হাতের তালুতে মুখ রেখে ভাবালুতায় ডুবে আছে উর্মী। কিছুক্ষণ আগে জহিরের সাথে তার ফোনে কথা হলো। জহিরকে তার বলা হয়নি যে কাকতালীয়ভাবে আজ তার সহযাত্রী যাত্রী হচ্ছে আবীর। বললে জহির কী আকাশ থেকে পড়তো? কিংবা ব্যাপারটাকে স্বাভাবিকভাবে নিতো? বলা মুস্কিল। ক্যান্টিনের বেয়াড়া চা-কফি বা নাস্তা লাগবে কিনা জানতে চেয়ে ঘ্যানর ঘ্যানর করে গেলো। তারপরও আবীরের ঘুমে কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি দেখে উর্মী যারপরনাই অবাক হলো।

একটা ফোন কলে আবীর চোখ খুললো। প্রায় চল্লিশ মিনিটের একটা ফ্রেশ ঘুম হয়ে গেলো তার। ট্রেনটা অজপাড়া গাঁয়ের একটা ছোট্ট স্টেশনে থামলো। ক্রসিং না থাকলে এখানে আন্তনগর ট্রেনটা থামার কথা নয়। ক্রসিং ছাড়াই ট্রেনটা এখানে থেমেছে। আবীর নামবে বলে উঠে দাঁড়ালো। তারপর উর্মীকে 'আসি' বলে সে ট্রলিব্যাগ নিয়ে নেমে গেল। সে উর্মীকে এমন একটা জায়গার নাম বলেছিলো যেখানে সে একটা কাজে যাচ্ছে। আবীর প্লাটফর্মে নেমে কাকে যেনো হাতের ইশারায় নিশ্চিত করলো যে সে ট্রেন থেকে নেমেছে। অনেক বছর পর দেখা পেয়ে কেবল 'আসি' বলে বিদায় নেয়াটা আবীরের কাছে যতোটা সহজ ও স্বাভাবিক, উর্মীর কাছে ততোটা নয়। সেটা আবীরের বোঝার সাধ্য নেই। আবীর প্লাটফর্ম থেকে উর্মীর উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে হাঁটা দিলো।
'আবীর।' উর্মী ডাকলো।
আবীর ঘুরে ট্রলিব্যাটা প্লাটফর্মে দাঁড় করিয়ে উর্মীর জানালার ধারে দাঁড়ালো।
'বলো'। খুব স্বাভাবিকভাবেই আবীর বললো। উর্মী নির্বাক তাকিয়ে আছে।
'আমাদের গেছে যে দিন/একেবারেই কি গেছে/কিছুই কি নেই বাকি- এমন কিছু বলবে নাতো?' আবীর হেসে জিজ্ঞেস করলো। উর্মী কোনো কথা বলছে না।
'রাতের সব তারাই আছে/দিনের আলোর গভীরে- এ জাতীয় কিছু আমি বুড়ো বয়সে বলতে পারবো না।' আবীর আবার স্বাভাবিক হাসিতে কথাগুলো বললো।
'কেন? ভয় পাও?'
'তা তো বটোই।'
'তোমার অনেক পরিবর্তন হয়েছে।'
'তাই নাকি! তা কোন দিকে পরিবর্তন? শারীরিক, বৈষয়িক নাকি মানসিক?' আবীর বললো। আবার সেই একই হাসি।
'যতোই হাসো না কেন, তোমার এই পরিবর্তনের পেছনে কিছুটা কৃতিত্বের দাবিদার কিন্তু আমি।'
আবীর এবার বিস্ময়ভরা চোখে তাকালো উর্মীর দিকে। তার জোরে হাসতে ইচ্ছে করলেও নিজেকে অবদমন করলো।
'কী হয়েছে তোমার? জহিরের সাথে ঝগড়া হয়েছে? সব ঠিক আছে তো?' আবীর জানতে চাইলো।
'সব ঠিক আছে।'
'গুড। জহির খুব ভালো মানুষ। ভালো থেকো।' আবীর মন থেকেই বললো। উর্মীরও তাই মনে হলো।
'অনেক সময় ভালোবাসার চেয়ে আঘাত বেশি শক্তিশালী ও নির্মাণে ফলপ্রসু ভূমিকা রাখে।' উর্মী বললো।
আবীরের মনে হলো উর্মীকে আজ কথা বলার রোগে ধরেছে। তাই সে আর কথা বাড়াতে চাইলো না। ট্রেন ছেড়ে দিলো। উর্মীর চোখ দুটি সরে যাচ্ছে। আবীর দাঁড়িয়ে আছে। দু'জনের ব্যবধান বাড়তে লাগলো। পেছনের তিনটা বগি আবীরকে অতিক্রম করার পর উর্মী যেনো একেবারেই তার চোখের আড়াল হয়ে গেলো। উর্মী তখনো আবীরকে দেখতে পাচ্ছিলো। প্রায় জনশূন্য প্লাটফর্মে আবীর দাঁড়িয়ে আছে। ঘাড় কাঁত করে সেই দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে উর্মীর মনে হলো, এক মুঠো আবীর তার নিষ্ফলা ভেতরটাকে আজ রাঙিয়ে দিয়ে গেলো। আবীর দেখলো সমান্তরাল রেললাইনের ওপর দিয়ে ট্রেনের সর্বশেষ বগিটাও দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। সেই বগি তার দৃষ্টিসীমা অতিক্রম করার পর সে দেখলো রেললাইনটা ক্রমশ সংকুচিত হতে হতে দূর দিগন্তে একটি রেখার মতো হারিয়ে গেছে। পেছনে সে আপাতত একা, নির্জন প্লাটফর্ম, তার ওপর একটা ট্রলিব্যাগ। সে ব্যাগের দিকে এগিয়ে গেলো। তার হাতে অনেক কাজ। পকেট থেকে মোবাইল বের দেখে স্নাতার অনেকগুলো মিসড্ কল।
'সরি মা। খেয়াল করিনি। আর এমন হবে না।' আবীর ফোনে স্নাতাকে বললো।