বাজেটের জেন্ডার সংবেদনশীলতা

সায়মা হক বিদিশা
Published : 14 June 2016, 04:03 AM
Updated : 14 June 2016, 04:03 AM

জাতীয় বাজেট একটি দেশের প্রস্তাবিত বাৎসরিক আয়-ব্যয়ের দলিল। বাজেটে অর্থের বণ্টন, করারোপ বা রাজস্ব নীতি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবনযাত্রা যেমন বিভিন্ন মাত্রায় প্রভাবিত করে, তেমনি নারী ও পুরুষের উপরও এর প্রভাব ভিন্ন ভিন্নভাবে পড়ে। একটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে নারীর অবদান উপেক্ষা করে একটি টেকসই অর্থনৈতিক অবকাঠামো কখনও চিন্তা করা যায় না।

নারীর ক্ষমতায়ন কিংবা নারীর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার জন্য অপরিহার্য নিয়ামক হচ্ছে, নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক বরাদ্দ। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নারীরা যেহেতু সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিবিধ সুবিধাবঞ্চিত, সেহেতু সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তাদের একীভূত করার জন্য প্রয়োজন আলাদা আর্থিক বরাদ্দ। আর জেন্ডার-সংবেদনশীল বাজেটের মাধ্যমে সরকার পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও করারোপণ নীতির মাধ্যমে এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে।

বাজেটের জেন্ডার-সংবেদনশীলতা বিশ্লেষণ করতে গেলে সব থেকে আগে বলা দরকার জেন্ডার বাজেট সম্পর্কে। ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ৪টি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শুরু করে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ৪০টি মন্ত্রণালয়কে জেন্ডার বাজেটের আওতায় আনা হয়েছে যা নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।

এখানে মনে রাখতে হবে যে, জেন্ডার বাজেট কিন্তু নারীর জন্য আলাদা কোনো বাজেট নয়, বরং এটি একটি বিশেষ পদ্ধতি যার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় হিসাব-নিকাশের সাহায্যে জাতীয় বাজেটের জেন্ডার-সংবেদনশীলতা বিশ্লেষণ করা যায়। জেন্ডার বাজেটের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের জেন্ডার-সংবেদনশীলতা চিহ্নিত করা যাতে বাজেটে সম্পদের বণ্টনের মাধ্যমে নারী-পুরুষের সমতা বৃদ্ধি বা অসমতা হ্রাস করা যায়। সুতরাং জেন্ডার বাজেট বলতে নারীর উন্নয়ন এবং ক্ষমতায়নের সহায়ক একটি বাজেট-প্রক্রিয়া বুঝায় যা কিনা নারী ইস্যুগুলোর প্রতি সংবেদনশীল।

২০১৬-১৭এর প্রস্তাবিত জেন্ডার বাজেটে ৪০টি মন্ত্রণালয়ে মোট বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৯২,৭৬৫ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ২৭.২৫ শতাংশ এবং জাতীয় আয়ের (জিডিপির) ৪.৭৩ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জেন্ডার বাজেটে এই ৪০টি মন্ত্রণালয়কে ৩টি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে:

(১) নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি (৭টি মন্ত্রণালয়: প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ, কৃষি, মৎস ও প্রাণিসম্পদ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় ও মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়);

(২) উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং শ্রমবাজার ও আয়বর্ধক কাজে নারীর অধিকতর অংশগ্রহণ (৯টি মন্ত্রণালয়: সমাজ কল্যাণ, শ্রম ও কর্মসংস্থান, যুব ও ক্রীড়া, স্থানীয় সরকার, বস্ত্র ও পাট, পানি সম্পদ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়);

(৩) সরকারি সেবাপ্রাপ্তিতে নারীর সুযোগ বৃদ্ধি (২৪ টি মন্ত্রণালয়: জনপ্রশাসন, বাণিজ্য, স্বরাষ্ট্র, বিদ্যুৎ, ভূমি, খাদ্য, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ, রেলপথ, নৌ পরিবহন ইত্যাদি) (জেন্ডার বাজেট ২০১৬-১৭)।

এখানে উল্লেখ্য যে, চলতি অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৫-১৬ অর্থবছরের তুলনায় প্রস্তাবিত জেন্ডার বাজেটের বরাদ্দ ২৯ শতাংশ বেশি। ২০০৯-১০ অর্থবছরে অর্থাৎ জেন্ডার বাজেটিংএর প্রথম বছরে এই বরাদ্দ ছিল ২৭,২৪৮ কোটি টাকা যা তৎকালীন জাতীয় বাজেটের ২৪.৬৫ শতাংশ বা তৎকালীন জিডিপির ৩.৯৫ শতাংশ। সুতরাং পরিসংখ্যানের বিচারে বাজেটের জেন্ডার-সংবেদনশীলতা বেড়েছে এবং টাকার অংকে ৪০টি মন্ত্রণালয়ের জেন্ডার বাজেটের প্রেক্ষিতে প্রস্তাবিত বাজেটটি নারী উন্নয়ন-বান্ধব বলা যেতে পারে।

তবে শুধুমাত্র সংখ্যার বিচারে জেন্ডার বাজেটের বিশ্লেষণ যুক্তিযুক্ত নয়। প্রথমত, অনেক সময় এডহক ভিত্তিতে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্তের ব্যবহার ছাড়াই সরকারি প্রকল্পগুলোর জেন্ডার-সংবেদনশীলতা হিসাব করা হয় যা বেশিরভাগ সময় সঠিক চিত্র দেখায় না। এসব ক্ষেত্রে প্রকল্পের জেন্ডার-সংবেদনশীলতা বাস্তবের চেয়ে বেশি হবার সম্ভাবনা থাকে।

দ্বিতীয়ত, জাতীয় বাজেটের মতো জেন্ডার বাজেটের প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকে এবং বরাদ্দকৃত অর্থ অনেক সময় খরচ হয় না বা হলেও নির্দিষ্ট সময়ে হয় না।

তৃতীয়ত, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও দুর্নীতির কারণে প্রকল্পগুলোর সুবিধা থেকে অনেক ক্ষেত্রেই নারীরা বঞ্চিত হন।

সর্বোপরি, জেন্ডার বাজেটে অন্তর্ভুক্ত প্রকল্পগুলোর পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন (monitoring and evaluation) ছাড়া বাজেটের জেন্ডার-সংবেদনশীলতা সঠিকভাবে বোঝা সম্ভব নয়। এর জন্য আর্থিক মূল্যায়ন অর্থাৎ অর্থের বরাদ্দ ও খরচের হিসাব শুধু নয়, বরং দরকার ফলাফলভিত্তিক মূল্যায়ন। কারণ একটি নীতি, দলিল বা প্রকল্প তখনই সফল বলা যাবে যখন তা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছাতে সাহায্য করবে।

একটি দেশের বাজেট নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর অধিকার রক্ষায় কতটা ভূমিকা পালন করছে তা সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা না গেলে জেন্ডার বাজেটিংএর প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধিত হয় না। তবে জ়েন্ডার-বিভাজিত উপাত্তের অভাবে ও প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে বাজেট কতটা জ়েন্ডার-সংবেদনশীলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, তা নিরূপণ করা অনেক সময় অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কাগজে-কলমে নীতিমালা বা অর্থ-বণ্টনের ব্যবস্থা থাকলেও তা যদি নারীর আর্থ-সামাজিক অবস্থা (condition) ও অবস্থানের (position) উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম না হয় তবে সেই অর্থ-বণ্টন বা নীতিমালা প্রণয়নের যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

জেন্ডার বাজেট প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে ও নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের প্রকৃত সুফল পেতে হলে দরকার সুনির্দিষ্ট পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন এবং এর ভিত্তিতে বাজেটের পরিমার্জন। এসব সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও বলা চলে যে, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর জেন্ডার-বিভাজিত বিশ্লেষণের এই উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে এবং জেন্ডার বাজেটিং কিছুটা হলেও লিঙ্গভিত্তিক সমতা আনয়নের পথ সুগম করবে।

বাজেটের জেন্ডার-সংবেদনশীলতা বোঝার জন্য জেন্ডার বাজেটের পাশাপাশি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ পর্যালোচনা করা যেতে পারে। এ প্রেক্ষিতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, প্রস্তাবিত বাজেটে উপরোক্ত মন্ত্রণালয়ের জন্য মোট বরাদ্দ হচ্ছে ২,১৫০ কোটি টাকা যার মধ্যে অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ১,৯৮২ কোটি টাকা। সুতরাং উন্নয়ন ব্যয় মাত্র ১৬৮ কোটি টাকা। তিন কোটি চল্লিশ হাজার ছয়শ কোটি টাকার বাজেটের তুলনায় এই বরাদ্দ তাই অপ্রতুল। নারীর জন্য উন্নয়ন বাজেটে সরাসরি বরাদ্দের পরিমাণ বাংলাদেশের নারী-পুরুষের মধ্যকার বিদ্যমান অসমতার প্রেক্ষিতে নগণ্য।

বিগত বছরগুলোর বাজেট বরাদ্দ দেখলেও আমরা মোটামুটি একই ধরনের চিত্র দেখতে পাই। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ সব সময় প্রস্তাবিত বাজেটের ১ শতাংশেরও কম যার সিংহভাগ হচ্ছে অনুন্নয়ন খাতে ব্যয়। আরও মনে রাখতে হবে যে, এই বরাদ্দ কিন্তু নারী ও শিশু উভয়ের জন্য লক্ষীভূত। সুতরাং আলাদা করে শুধুমাত্র নারীর জন্য বরাদ্দ এর চেয়েও কম।

তবে নারীর ক্ষমতায়ন ও অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনের ক্ষেত্রে বাজেটের ভূমিকা শুধুমাত্র মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা একেবারেই ঠিক হবে না। কারণ নারীকে অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্রদানের জন্য বাজেটে অন্যান্য মন্ত্রণালয়েও বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পর্যালোচনা করলে এ ধরনের বেশ কিছু বরাদ্দের প্রস্তাবনা বা নীতিমালা দেখা যায়। সামাজিক সুরক্ষা ক্ষেত্রে বেশ কিছু কর্মসূচীর আওতা ও বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে যার অনেকগুলো প্রান্তিক নারীকে আর্থিক সুবিধা দেবে। এ প্রেক্ষিতে–

(১) বিধবা, স্বামী-নিগৃহীতা, দুস্থ মহিলা ভাতাভোগীর সংখ্যা ১১ লক্ষ ৫০ হাজারে উন্নীত করা হয়েছে এবং ভাতার হার মাসিক ৪০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০০ টাকা করার প্রস্তাবনা করা হয়েছে;

(২) মাতৃত্বকালীন ভাতার আওতা ৫ লক্ষ করার প্রস্তাব করা হয়েছে;

(৩) ভিজিডির আওতাধীন দুস্থ মহিলার সংখ্যা ১০ লক্ষে বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে যা পূর্বের চেয়ে ২ লক্ষ ৫০ হাজার বেশি;

(৪) সকল পৌরসভায় স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্য কর্মসূচী ১ লক্ষ ৮০ হাজার ৩০০ জনে আনার প্রস্তাবনা রয়েছে;

(৫) বয়স্ক ভাতা যার একটি বড় অংশের প্রাপকই মহিলা, তার হার ৪০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকায় বাড়ানো ও আওতা ৩১ লক্ষ ৫০ হাজারে বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে।

এগুলো ছাড়াও সামাজিক সুরক্ষার অন্তর্ভুক্ত প্রকল্পগুলোর বেশ কটি প্রান্তিক নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য সহায়ক। আশার কথা হল যে, ২০১৬-১৭এর প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ আগের বছরগুলোর চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেড়েছে। এ বছরের বরাদ্দ ৪৩,৫০০ কোটি টাকা যা জিডিপির ২.২ শতাংশ (বাজেটের ৫.৮ শতাংশ) যা গতবারের চেয়ে ১৩ শতাংশ বেশি।

তবে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের প্রকল্পগুলো অনেক ক্ষেত্রে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে সমালোচিত হয়ে থাকে যার ফলে প্রকল্পের সুফল থেকে অনেক মহিলা বঞ্চিত হন। এছাড়া প্রকল্পগুলোর আওতা ও মাথাপিছু বরাদ্দ বাড়লেও প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল।

২০১৬-১৭ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ উৎসাহিত করার জন্য বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে যা প্রশংসার দাবি রাখে। এই প্রণোদনার বেশ কিছু পূর্ববতী কর্মসূচীগুলোর ধারাবাহিকতায় প্রস্তাবিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:

(১) বিভিন্ন শহরে নারীর জন্য কর্মজীবী হোস্টেল নির্মাণ;

(২) ক্ষুদ্র ও কৃষিঋণ বিতরণে অগ্রাধিকার প্রদান;

(৩) নারী উদ্দোক্তাদের জন্য 'জয়িতা'র কার্যক্রম সম্প্রসারিত করা ইত্যাদি।

প্রস্তাবিত বাজেটে নারী উদ্যো ক্তাদের প্রণোদনা দেবার জন্য চলমান বিভিন্ন কর্মসূচীর পাশাপাশি নতুন কিছু কর্মসূচীও নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রতিটি ব্যাংক ও নন-ব্যাংকে বিশেষ নারী উদ্দোক্তা উন্নয়ন ইউনিট খোলার পদক্ষেপ ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের পরিকল্পনা অন্যতম।

তবে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে, সুবিধাবঞ্চিত ও গ্রামের নারীদের জন্য গঠিত ১০০ কোটি টাকার চ্যালেঞ্জ ফান্ড। উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় গঠিত এই ফান্ড ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে নারী উদ্যোক্তাদের প্রণোদনার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় বলা জরুরি যে, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, প্রশাসনিক জটিলতা ও তথ্যের অভাবে অনেক সময়ই আগ্রহী উদ্যোক্তার কাছে ঋণ পৌঁছায় না। অপরপক্ষে, আমাদের দেশের রক্ষণশীল সামাজিক কাঠামোয় অনেক ক্ষেত্রে মহিলাদের ঘরের বাইরের কাজ বা ব্যবসায় সক্রিয় অংশগ্রহণ ভালোভাবে দেখা হয় না। তাই আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও মহিলারা ঋণের আবেদন করতে পারছেন না।

এছাড়া ব্যবসায়-সংক্রান্ত জ্ঞান ও তথ্য না থাকায়, প্রয়োজনীয় কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব ইত্যাদি কারণেও এ ধরনের প্রণোদনাকারী কর্মসূচীর সুবিধা নারী উদ্যোক্তারা নিতে পারছেন না। যেমন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন পরিকল্পনার (refinancing scheme) আওতায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের জন্য স্বল্প সুদের ঋণের ১৫ শতাংশ নারীদের জন্য বরাদ্দের পদক্ষেপ থাকলেও বাস্তবে দেখা গেছে যে, এই ঋণের একটি অংশ অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। একই সমস্যা চ্যালেঞ্জ ফান্ডের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

এছাড়া ২০১৬-১৭ বাজেটের আরও কিছু প্রস্তাবনা বা কর্মসূচী, যেমন, মাল্টি-সেক্টরাল কর্মসূচীর মাধ্যমে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বিভিন্ন কর্মসূচী, নারী নির্যাতন প্রতিরোধের অংশ হিসেবে সাত বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডিএনএ স্ক্রিনিং ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি নারীর আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও অবস্থান উভয় ক্ষেত্রেই ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা যেতে পারে।

এছাড়া খাতওয়ারি বিবেচনায় দেখা যায় যে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বাজেটের ১৫.৬ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছে যা গত বছরের তুলনায় ৩৪.৫৫ শতাংশ বেশি। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে বাজেটের ৫.১ শতাংশ ও ২০১৫-১৬এর প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় যা ১৮.০৩ শতাংশ বেশি। মানবসম্পদ উন্নয়নে এই বরাদ্দ নারীর ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে মনে করা যায়।

তবে সার্বিক প্রয়োজনের তুলনায় এই বরাদ্দ অত্যন্ত অপ্রতুল এবং দক্ষিণ এশিয়াসহ বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় অনেক কম। তাই নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নসহ মানবসম্পদের সার্বিক উৎকর্ষের জন্য এ দুই খাতে বরাদ্দ বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি।

বাজেটের জেন্ডার-সংবেদনশীলতার ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, করের আওতা ও হার। প্রত্যক্ষ করের ক্ষেত্রে বলা চলে যে, প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত সীমিত এবং অংশগ্রহণ স্বল্প বেতনের কাজে সীমাবদ্ধ হবার কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মহিলাদের আয় করযোগ্য হয় না। প্রত্যক্ষ করের ক্ষেত্রে মহিলাদের ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়ের সীমা পুরুষদের চেয়ে বেশি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মহিলাদের (এবং ৬৫ বছরের তদ্দুর্ধ্ব) জন্য এই আয় ৩ লক্ষ টাকা যা পুরুষদের জন্য ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। বিদ্যমান প্রত্যক্ষ কর ব্যবস্থা তাই জেন্ডার-সংবেদনশীল বলা যেতে পারে।

খাতভিত্তিক করের ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত বাজেটের কিছু কিছু প্রস্তাবনা শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াবে বলে মনে করা যায়:

(১) ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের কর অব্যাহতির সীমা বার্ষিক ৩৬ লক্ষ টাকা টার্নওভার করা হয়েছে আগে যা ছিল ৩০ লক্ষ টাকা;

(২) হাঁস-মুরগীর আমদানি করা খাদ্যের উপর পূর্ববর্তী বছরের মতো ২০১৬-১৭ অর্থবছরেও শুল্ক ও কর রেয়াত দেওয়া হয়েছে;

(৩) নিট পরিসম্পদের প্রদর্শিত মূল্যের ওপর আরোপিত সারচার্জের হার পুনর্বিন্যাস করার প্রস্তাবনা যা আয়বৈষম্য কমানোর মাধ্যমে নারীদের জন্য সহায়ক হবে;

(৪) এলপিজি সিলিন্ডারের ওপর শুল্ক হ্রাস ইত্যাদি।

অপরপক্ষে মোবাইল ফোনের সিমের মাধ্যমে প্রদানকৃত সেবার উপর সম্পূরক শুল্ক ৩ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশতে বৃদ্ধির প্রস্তাব নারীর তথ্য-আহরণের প্রক্রিয়া ব্যাহত করতে পারে। এছাড়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠ্যবইয়ের ওপর আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাবনা বা আমদানি করা চালের ওপর শুল্ক ২৫ শতাংশ করার পদক্ষেপ দরিদ্র পরিবারের শিশু ও প্রান্তিক নারীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

জাতীয় বাজেটে নারীর জন্য পর্যাপ্ত অর্থ-বরাদ্দ, নারীবান্ধব কর ও রাজস্ব নীতির মাধ্যমে নারীর অবস্থার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সম্ভব। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, নারীর ক্ষমতায়ন কেবল বাজেটের বরাদ্দ, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর প্রকৃতি এবং ধরনের উপরই নির্ভর করে না, বরং বাজেট বরাদ্দ কতটা দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলো কত সঠিকভাবে কার্যকর হয়েছে তার উপরও এটা নির্ভরশীল।

তাই শুধুমাত্র আর্থিক বণ্টন নয়, বরং নারী উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে বাজ়েট কতটা সফল হয়েছে তার বিশ্লেষণের মাধ্যমেই বাজ়েটের জ়েন্ডার-সংবেদনশীলতা বোঝা সম্ভব যার জন্য প্রয়োজন নিয়মিত প্রকল্পভিত্তিক খাতওয়ারি পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন।