মোহাম্মদ আলী: এক বিশাল মানুষের শ্রেষ্ঠ বিজয়

শারমিন আহমদ
Published : 10 June 2016, 05:30 AM
Updated : 10 June 2016, 05:30 AM

"যেন আমারই একটি অংশ বিচ্যুত হয়েছে", পবিত্র রমজানের মাত্র কদিন আগে, গত ৩ জুন, জগতবরেণ্য বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর তিরোধানে, এই মন্তব্য করলেন, তাঁরই এককালীন প্রতিপক্ষ আরেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জর্জ ফোরম্যান। ১৯৭৪ সালে আফ্রিকার যাইয়েরে অনুষ্ঠিত 'রাম্বল ইন দ্য জাঙ্গল' নামে খ্যাত ঐতিহাসিক মুষ্টিযুদ্ধে আলীর কাছে ফোরম্যান হারিয়েছিলেন তাঁর বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন খেতাবটি, কিন্তু পরবর্তীকালে আলীর সঙ্গে বন্ধুত্বে তিনি ফিরে পেয়েছিলেন অনেক বেশি।

এ কারণেই ফোরম্যান বলেছিলেন যে, মোহাম্মদ আলী তাঁর মুষ্টিযুদ্ধের চাইতেও অনেক বড়। তাঁর এই অনুভূতির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ ভেদে বিশ্বের অযুত-কোটি শোকার্ত মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা যুক্ত শোকবাণীতে বলেন:

"মোহাম্মদ আলী ছিলেন সবচাইতে বৃহৎ… তিনি বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিলেন।"

সিভিল রাইটস অ্যাকটিভিস্ট ধর্মযাজক রেভারেন্ড অ্যাল শার্পটন এই মত প্রকাশ করেন যে, সব বিখ্যাত লোক বৃহৎ নয়। মুষ্টিযুদ্ধে বহু বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের আবির্ভাব ঘটেছে, কিন্তু কজন তাদের নাম জানেন? কিন্তু এ ক্ষেত্রে মোহাম্মদ আলীর অবস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন। শার্পটন উদাহরণস্বরূপ বলেন:

"তিনি (আলী) মুষ্টিযুদ্ধের বেষ্টনীর ভেতরে এবং বাইরে উভয় জায়গাতেই চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে তিনি অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন… যে কারণে তিনি শুধু বিশাল ঝুঁকি নেননি, তিনি সবই হারিয়েছিলেন… তিনি মুষ্টিযুদ্ধে সে সময়ের হেভিওয়েট বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ছিলেন এবং সেই খ্যাতির সঙ্গে যুক্ত সব চাকচিক্য, সবই তিনি ত্যাগ করেছিলেন তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে… এমনকি সে সময় চরম দক্ষিণপন্থী যারা যুদ্ধের পক্ষে ছিলেন তারাও এই মানুষটিকে শ্রদ্ধা করেছিলেন। কারণ তিনি আন্তরিকভাবেই তাঁর বিশ্বাসের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন।"

ব্যক্তিগতভাবে এই বিশাল মাপের মানুষটিকে কাছে থেকে দেখা ও তাঁর বক্তব্য শোনার আমার পরম সৌভাগ্য হয়। ১৯৭৮ সালে ঢাকার বিশাল জনসভায় তাঁর সহজ-সরল প্রাণঢালা বক্তব্য বিমোহিত করেছিল আমার মতো অগুণতি মানুষকে।

তারপরে, যুক্তরাষ্ট্রে, নব্বই দশকের প্রথমার্ধে মোহাম্মদ আলীর সুযোগ্যা স্ত্রী লনি আলী এবং আলীর এক বন্ধুর মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে ফোনালাপের সৌভাগ্য হয়। ১৯৮৪ সালে পারকিনসন্স ব্যাধি নির্ণয় হবার পর তাঁর স্বাস্থ্যগত সমস্যা পরবর্তী বছরগুলিতে আরও জটিল আকার ধারণ করে। কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ বা কথা বলা তখন আরও সীমাবদ্ধ।

সে প্রেক্ষিতে আমার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত কথা বলার স্মৃতিটুকু ছিল এক বিশাল সৌভাগ্যেই বটে। রোগাক্রান্ত অবস্থার কারণে তাঁর কথা জড়িয়ে গেলেও উচ্চারণে আবেগের কমতি ছিল না। তিনি উচ্ছাসের সঙ্গে স্মরণ করলেন তাঁর প্রতি বাংলাদেশের মানুষের প্রাণঢালা অভ্যর্থনার স্মৃতি। আমি যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম যে, তরুণদের প্রতি তার কোনো বার্তা রয়েছে কিনা, তিনি একই আবেগের সঙ্গে বললেন:

"প্রার্থনা… প্রার্থনা তরুণদের বর্তমানের বহু সমস্যার উত্তর হতে পারে। বোন, আপনি তরুণদের বলুন তাঁরা যেন পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করে।"

মোহাম্মদ আলীর বিশালত্ব সেখানেই যে, তিনি যশ ও খ্যাতির শিখরে পৌঁছেও তাঁর আধ্যাত্মিক বিশ্বাস, যা জাতি ধর্ম-বর্ণভেদে অসহায়, আর্ত, নির্দোষ ও নিরপরাধের পক্ষে রুখে দাঁড়ায় তাকে সমুন্নত রাখার অঙ্গীকারে ব্যক্তিস্বার্থ বিসর্জন দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে আরোপিত বর্ণবাদবিরোধী এবং আফ্রিকান আমেরিকান জাতীয়তাবাদের সমর্থক ধর্মীয় সংগঠন 'নেশন অব ইসলামের' মধ্যে দিয়ে ষাটের দশকে তাঁর ঐতিহাসিক যাত্রা সত্তর দশকে বিবর্তিত হয় মূলধারার বিশ্বজনীন ইসলাম ধর্মে এবং পরবর্তীতে তাঁর বিরামহীন আত্মউন্নয়নের সংগ্রাম তাঁকে পৌঁছে দেয় সুফী দর্শনে।

রোগের সঙ্গে লড়তে লড়তেই তিনি বিশ্বমঞ্চে আবির্ভূত হন শান্তি ও সম্প্রীতির উদীপ্ত প্রতীকরূপে। জিম্মিদের উদ্ধারের জন্যে কখনও ছুটে যান ইরাকে, শান্তিরক্ষায় কাবুলে। রূপান্তরিত হন বিশ্বনাগরিকে। ধর্মের অপব্যাবহারকারী, নিরীহ, নির্দোষ মানুষ হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে তাঁর জীবন এখনও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের, কেনটাকি অঙ্গরাষ্ট্রের লুইভিল শহরে, এক নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণকারী (১৭ জানুয়ারি, ১৯৪২) ক্যাসিয়াস মারসেলাস ক্লে, ১৯৬০ সালের অলিম্পিকে, লাইট হেভিওয়েট বক্সিংএ জিতে নেন স্বর্ণপদক। ১৯৬৪ সালে, ক্লে, তৎকালীন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন 'অপরাজেয়' সনি লিসটনকে পরাজিত করে হেভিওয়েট বক্সিংএ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের প্রথম মুকুট ধারণ করেন। তার পরপরই 'নেশন অব ইসলামের' সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা ঘোষণা করে বিশ্বঅঙ্গনে আবির্ভূত হন মোহাম্মদ আলী রূপে।

প্রতিপক্ষর বিরুদ্ধে আলীর মনস্তাত্ত্বিক কলাকৌশল, কৌতুকময় ছড়া– ''প্রজাপতির মতো ভাস, মৌমাছির মতো দংশাও"– ক্ষিপ্র গতি এবং নৃত্যের ভঙ্গিমা মুষ্টিযুদ্ধে অভিনব মাত্রা এনে দেয় এবং অযুত কোটি মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে।

১৯৮১ সালে মুষ্টিযুদ্ধ হতে অবসরগ্রহণের এত বছর পরও মোহাম্মদ আলীর খ্যাতি এবং তাঁর প্রতি মানুষের ভালোবাসা যে হ্রাস পায়নি তা তাঁর মৃত্যুর মধ্যে আবারও প্রমাণিত হয়। তাঁর মহৎ উক্তি এবং কাজের মধ্যে ব্যতিক্রমধর্মী অভিন্নতার কারণে অগুণতি মানুষের দৃষ্টিতে তিনি একজন খাঁটি ও বিশাল মাপের মানুষ রূপে নন্দিত হন। যৌবন ও খ্যাতির স্বর্ণশিখরে থাকা অবস্থায় তিনি সত্য, ন্যায় ও মানবাধিকারের পক্ষে ত্যাগ করেছিলেন খেতাব, যশ ও বিত্ত।

তাঁর এই অনন্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, তাঁর তিনবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের অভূতপূর্ব রেকর্ড সৃষ্টির চাইতেও অনেক বড়। ১৯৬৭ সালে, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং বিবেকের কারণে ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন না এই ঘোষণা দিয়ে তিনি হারিয়েছিলেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের খেতাব, মুষ্টিযুদ্ধের লাইসেন্স, পাসপোর্ট এবং মিলিয়ন ডলারের উপার্জন। তাঁর নির্ভীক কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল:

"কেন তারা আমাকে ইউনিফর্ম পরে, বাড়ি থেকে দশ হাজার মাইল দূরে যেয়ে ভিয়েতনামের বাদামি বর্ণের মানুষের উপরে বোমা ও বুলেট ছুঁড়তে বলবে, যখন লুইভিলের তথাকথিত নিগ্রোদের সঙ্গে কুকুরের মতো আচরণ করা হয় এবং তাঁরা সাধারণ মানবাধিকার হতে বঞ্চিত! … না, আমি বাড়ি থেকে দশ হাজার মাইল দূরে যেয়ে আরেকটি দরিদ্র জাতিকে হত্যা ও পোড়ানোতে সহায়তা করব না… যারা তাদের ন্যায়, স্বাধীনতা ও সাম্যের জন্যে লড়াই করছে, তাদেরকে দাসত্বে বাঁধবার যন্ত্রে নিজেকে পরিণত করে আমি আমার ধর্ম, আমার মানুষ এবং আমাকে অবমানিত করব না…।"

ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করায় মোহাম্মদ আলীকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও দশ হাজার ডলার জরিমানা দেওয়া হয়। আলী আদালতে আপিল করেন। আইনি লড়াইয়ের চার বছর পর, ১৯৭১ সালে সুপ্রিম কোর্ট আলীর পক্ষে রায় দেয়।

মোহাম্মদ আলী বিজয় লাভ করেন। এই অন্যন্য বিজয়টি ছিল তাঁর অপার সৌন্দর্যমণ্ডিত মানবিক চেতনার নিষ্কলুষ বিজয়, যার আলো পথ প্রদর্শন করে প্রজন্ম হতে প্রজন্মে।

আদ্দিস আবাবা: ৯ জুন, ২০১৬