পরিবেশের মরণবেশ: আইনে সংকট প্রয়োগও তথৈবচ

Published : 5 June 2016, 04:05 AM
Updated : 5 June 2016, 04:05 AM

''আমরা লোভবশত প্রকৃতির প্রতি ব্যভিচার যেন না করি। আমাদের ধর্মে-কর্মে, ভাব-ভঙ্গিতে প্রত্যহই তাহা করিতেছি, এই জন্য আমাদের সমস্যা উত্তরোত্তর জটিল হইয়া উঠিয়াছে– আমরা কেবলই অকৃতকার্য এবং ভারাক্রান্ত হইয়া পড়িতেছি। উপকরণের বিরলতা, জীবনযাত্রার সরলতা আমাদের দেশের নিজস্ব– এখানেই আমাদের বল, আমাদের প্রাণ, আমাদের প্রতিজ্ঞা।''

— আত্মশক্তি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পরিবেশ দিবস আসে আর যায়। পরিবর্তন হয় না নগরের বাতাসের সীসা আর কার্বনের প্রাবল্যের– নদী-খাল-বিলের দূষণের। যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশে বিদায়ী অর্থবছরের মতো নতুন অর্থবছরেও জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব রেখেছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু আসলে কী হবে এই তহবিল দিয়ে? আমাদের মানসিকতা আগের মতো রেখে, অর্থাৎ শেকড়ের পোকা পরিস্কার না করে গাছের শাখায় জলসিঞ্চনে কী লাভ?

পরিবেশ বিষয়ক আইন দেখে মনে হয় এটি তৈরি করা হয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরের জন্য, জনগণ বা ভুক্তভোগীদের জন্য নয়।

পরিবেশ আইন যুগোপযোগী করা হবে বলছেন বর্তমান আইনমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা। আইন-লঙ্ঘনকারী, দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের জরিমানার টাকা আদায়ের মাধ্যমে পরিবেশ অধিদপ্তর কোটি কোটি টাকা সরকারের আর্থিক খাতে জমা করছেন বলে ঢোল পেটাচ্ছন বটে, কিন্তু অবস্থা তথৈবচ।

ষোল বছর আগে, ২০০০ সালে 'পরিবেশ আদালত আইন' প্রণয়নের মাধ্যমে বিচারিক আদালতে বিশেষায়িত পরিবেশ বিচার ব্যবস্থা চালু করা হয়। আইনে প্রতিটি বিভাগে এক বা একাধিক 'পরিবেশ আদালত' এবং সারা দেশের জন্য এক বা একাধিক 'পরিবেশ আপিল আদালত' প্রতিষ্ঠার বিধান রাখা হয়। পরে, ৬ মার্চ ২০০২ আইন মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে (২০০৫ সাল থেকে) একটি করে পরিবেশ আদালত এবং সমগ্র বাংলাদেশের জন্য ঢাকায় একটি পরিবেশ আপিল আদালত প্রতিষ্ঠা করে।

২০০২ সালে এ আইনে সংশোধনী এনে পরিবেশ আদালতের পাশাপাশি পরিবেশ-সংক্রান্ত লঘু দণ্ডের অপরাধ বিচারের জন্য একজন মহানগর হাকিম (মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট) বা প্রথম শ্রেণির বিচারিক হাকিম (জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট) দিয়ে স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত গঠনের বিধান করা হয়।

২০১০ সালের আগের আইনটি রহিত করে 'পরিবেশ আদালত আইন' নামে সম্পূর্ণ নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়। বর্তমান আইনে প্রত্যেক জেলায় একজন যুগ্ম-জেলা জজকে দিয়ে এক বা একাধিক পরিবেশ আদালত স্থাপনের কথা বলা থাকলেও সেগুলো কোনো স্বতন্ত্র আদালত হবে না, বরং জেলা ও দায়রা জজ আদালতের একজন যুগ্ম-জেলা জজকে তাঁর সাধারণ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে পরিবেশ আদালত পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হবে।

কার্যত নতুন কোনো আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়নি বলে শুধু আগের তিনটি আদালত ও একটি আপিল আদালতই এখন কাজ করছে এবং আগের মতোই বিশেষ হাকিম বা স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলো কাজ করছে। পাশাপাশি নির্বাহী হাকিমগণ (এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট) ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন (মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯)এর অধীনে গঠিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে পরিবেশ-সংক্রান্ত বিভিন্ন আইনের অধীনে কিছু অপরাধ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলেই আমলে নিয়ে দণ্ডারোপ করেন।

পরিবেশ আদালত আইনের তত্ত্ব, তথ্য, খুঁটিনাটি সুলুক সন্ধান করে গত পনের-ষোল বছর ধরে এ আইন ও আদালত বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন তৈরি করেছি। কথা বলেছি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে, সাক্ষাৎকার নিয়েছি অনেকের। দেখেছি, পরিবেশ আদালতে পরিবেশের মামলা নেই। সেখানে অস্ত্র ও বিস্ফোরক মামলারও শুনানি নেওয়া হচ্ছে। দেখেছি, অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমাণ আদালতে শুধুমাত্র জরিমানা দিয়ে রেহাই নিয়ে আবারও পুরনো অপরাধে জড়িয়ে পড়ার দৃষ্টান্ত।

কিন্তু যেহেতু মামলা হিসেবে এ আদালতের নথিগুলি সাময়িক সংরক্ষণ করা হচ্ছে, সে কারণে দ্বিতীয়বার অপরাধের বিচারের সময় প্রথমবারের অপরাধ উঠে আসছে না। অথচ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন এবং পরিবেশ আদালত আইন লঙ্ঘনে দ্বিতীয় বা তৃতীয়বারের অপরাধে প্রথমবারের চাইতে বেশি জরিমানার বিধান রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে মোবাইল কোর্ট অন্যান্য ক্ষেত্রে যত সফলই হোক না কেন, পরিবেশ বিষয়ক আইন ভাঙার বিচারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না।

প্রতিদিন গণমাধ্যমে সারাদেশের প্রায় সবখানেই পরিবেশের অবক্ষয়, বিপর্যয় ও দূষণের খবর প্রকাশিত হলেও মানুষ কেন পরিবেশ আদালতে এসে প্রতিকার চান না? পরিবেশ আইনের এত লঙ্ঘন সত্ত্বেও পরিবেশ আদালতসমূহে ক্ষতিগ্রস্তের আশ্রয় নেওয়ার পেছনের কারণ কি শুধুই পরিবেশ আইন সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতা বা অসচেতনতা?

যদি প্রাসঙ্গিক আইনি বিধান পরিকাঠামো পর্যালোচনা করি তবে দেখি বিপরীত রূপ। পরিবেশ আদালত আইনে জনগণকে সরাসরি মামলা দায়েরের অধিকার দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫এ ক্ষতিগ্রস্ত যে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, জনগণ কর্তৃক সরাসরি পরিবেশ আদালতে ক্ষতিপূরণের মামলা দায়ের করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পরিবেশ আদালত আইন, ২০১০এ বলা হয়েছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শকের লিখিত রিপোর্ট ব্যতীত কোনো পরিবেশ আদালত বা স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত কোনো ক্ষতিপূরণের দাবি বা কোনো অপরাধ বিচারার্থ গ্রহণ করবে না।

অবশ্য এ বিধানের একটি ব্যতিক্রম আছে; তা হল, যখন কেউ পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শকের কাছে আবেদন করার পর পরিদর্শক ৬০ দিনের মধ্যে ব্যবস্থা না নেন, তবে আবেদনকারী এ বিষয়ে পরিবেশ আদালতে আবেদন করবে। আদালত সন্তুষ্ট হলে সেই পরিদর্শক বা মহাপরিচালককে শুনানির সুযোগ দিয়ে লিখিত রিপোর্ট ছাড়াই মামলা নিতে পারবেন।

আইন যেহেতু সমাজ-সঞ্জাত অধিকাংশ মানুষের মতামত, সে জন্য পরিবেশগত ন্যায়বিচার নিশ্চিতকল্পেও আইনি বিষয়ের সঙ্গে কিছু আর্থ-সামাজিক বিষয় বিবেচ্য। এ সমাজে পরিবেশ দূষণকারীরা সাধারণত উচ্চশ্রেণির, বিত্তশালী, ক্ষমতাধর, অভদ্র, সন্ত্রাসী, পরধন ও অধিকার হরণকারী কায়েমী স্বার্থবাদী হয়ে থাকে।

অন্যদিকে, ভুক্তভোগী বিচারপ্রার্থী জনসাধারণের বেশিরভাগই দরিদ্র ও প্রান্তিক বর্গের কিংবা মধ্যবিত্ত, সজ্জন শ্রেণিজাত হওয়ায় তারা মামলা দায়েরে সাহসী হয় না। অতি জটিল, অস্পষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদী আইনি প্রক্রিয়া তাদেরকে আরও বেশি নিরুৎসাহিত করে তোলে। নারী, শিশু, বয়স্কদের ভরণ-পোষণ, প্রতিপাল্য, শোষণ-নির্যাতনবিরোধী সরকারি, বেসরকারি, স্বেছাসেবী সংগঠন থেকে লিগ্যাল এইড দেওয়া হলেও, নিখরচায় এ ধরনের মামলা পরিচালনা করার বিধান নেই। রাষ্ট্রের অন্যান্য সংস্থাগুলোও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রভাবশালী দখল-দূষণকারীদের অনুকূলে কাজ করে। সব মিলিয়ে ভুক্তভোগী বিচারপ্রার্থী নিরীহ জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতা ও প্রতিকারহীনতায় ভোগে।

পরিবেশ আদালত আইনের ধারা, উপ-ধারা থেকে এটা স্পষ্ট যে, পরিবেশ আদালত স্থাপিত হয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরের জন্যই, জনসাধারণের জন্য নয়। পরিবেশ আদালতে মামলা দায়ের করার প্রাথমিক দায়িত্ব এবং মামলা তদন্তের ভার পরিবেশ অধিদপ্তরের ওপর। আইনে প্রত্যেক জেলায় পরিবেশ আদালত স্থাপনের বিধান থাকলেও কার্যত পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যালয় বা অফিস রয়েছে কেবল ২২টির মতো জেলায়। তাই দপ্তর ও লোকবলের অনুপস্থিতি এবং অপ্রতুলতা সকল জেলায় পরিবেশ আদালত স্থাপন বিঘ্নিত করছে।

পরিবেশ আদালত বিশেষায়িত বিচারিক আদালত, আইনানুযায়ী পরিবেশ-সংক্রান্ত অপরাধের বিচার ত্বরান্বিত করাই যার একমাত্র উদ্দেশ্য। কিন্তু পরিবেশ আদালত বিদ্যমান ফৌজদারি ও দেওয়ানি কার্যবিধি এবং সাক্ষ্য আইন অনুসারে বিচারকাজ পরিচালনা করে, এর জন্য পৃথক কোনো কার্যপ্রণালী বিধিও তৈরি করা হয়নি। বিদ্যমান এসব আইনের ফল হল, বিচারকাজে দীর্ঘসূত্রতা আর মামলার জট।

আবার এসব আইনানুযায়ী অভিযোগকারীকেই অভিযোগ প্রমাণ করতে হয়; তাকেই নিজ দাবির সপক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করতে হয়। কারিগরি বিষয়ে সাক্ষ্য সংগ্রহে দরকার হয় প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা যা অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে পড়ে দুষ্প্রাপ্য; তাই অভিযোগ প্রমাণ হয়ে যায় দুঃসাধ্য।

পরিবেশ আদালতের এখতিয়ারও স্পষ্ট ও সরলরৈখিক নয় বরং অহেতুক জটিল। বাংলাদেশে বিদ্যমান আইনসমূহের মধ্যে পরিবেশের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত আইনের সংখ্যা প্রায় ২০০। পরিবেশ আদালত শুধু 'বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫' এবং 'ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩'এর অধীন অপরাধসমূহের বিচার এবং ক্ষতিপূরণের দাবি বিচারার্থে গ্রহণ করতে পারে।

কিন্তু দেশের বন ও বনজ সম্পদ সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র্য ও বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ, মৎস্য-সম্পদ, পানিসম্পদ বা অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে পরিবেশ আদালতে মামলা করা যাবে না; অর্থাৎ পরিবেশের সার্বিক বিষয়ে মামলা গ্রহণ করার এখতিয়ার পরিবেশ আদালতের নেই। যদিও দেশের সর্বোচ্চ আদালতে রিট আবেদনের সুযোগ রয়েছে।

বেলা (বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল লইয়ার্স এসোসিয়েশন), বাপা (বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন), পবা (পরিবেশ আন্দোলন বাংলাদেশ) পরিবেশ বিষয়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আলোচনা, গোলটেবিল বৈঠক, প্রচার-প্রোপাগাণ্ডা করে থাকলেও এ আইন ও আদালত নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ও আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কতটুকু আলোচনা করেছে ও করছে তা নিয়ে আমি পরিস্কার নই।

তবে বেলার কয়েকটি রিট আবেদন নিয়ে হাইকোর্টের ল্যান্ডমার্ক কয়েকটি জাজমেন্ট সম্পর্কে জানি। জানি খুব সদর্থক উদ্যোগ রাজধানী থেকে সাভারে চামড়া কারখানা বা ট্যানারির স্থানান্তর সম্পর্কে। বুড়িগঙ্গা দূষণ নিয়েও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর উদ্যোগ চোখে পড়ার মতো।

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় পরিবেশ সংরক্ষণ সকল বর্গের জনসাধারণের জীবন-জীবিকা সংরক্ষণের সমার্থক। এদেশে একটি জনমুখী পরিবেশ বিচার ব্যবস্থার নিশ্চিন্ত প্রজ্ঞায় নাগরিকের সরাসরি অংশগ্রহণই গণতন্ত্রকে একটি শক্তিশালী ভূমিতে দাঁড় করাতে পারে। সে জন্য প্রচলিত সকল প্রকারের ও ধরনের আইন-আদালতগুলোর চৌকাঠে আমজনতার স্পর্শ থাকতে হবে। লাল সালুর আমলাতান্ত্রিকতা ভেঙ্গে তাদের ব্যাপক ও নিরন্তর অভিগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে।

তবেই এ দেশের শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত জনসাধারণ এবং অনাগত প্রজন্মের পরিবেশগত অধিকার সমুন্নত রাখা সম্ভব। এখনই অচলায়তন পার হয়ে উদারনৈতিক সংশোধনী নীতি গ্রহণ করা জরুরি। আইনটিতে প্রয়োজনীয় সংশোধনীও আনতে হবে। দেশের পরিবেশ আদালতসমূহে পরিবেশগত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা বা অধিকারের সুরক্ষায় গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিবিম্ব তখনই দেখা যাবে।